ফকির ইলিয়াস
===================
সৈনিক বললেন, ' আমি আর পারছি না '
আমি বললাম, এইতো সামনেই ভোলাগন্জ সীমান্ত ক্যাম্প
আর কিছুক্ষণ পরই আমরা পৌঁছে যাবো আমাদের তাঁবুতে।
সৈনিক কেঁদে ফেললেন। কেঁদে উঠলাম আমিও
আমার কাঁধে তখন তাঁর দুহাতের ভার। মনে হচ্ছিল আমি একটি
পতাকা, একটি রাষ্ট্রের ভার উত্তোলন করে ক্রমশঃ হাঁটছি।
সারারাত আমরা যুদ্ধ করেছি হায়েনাদের সাথে। সহযোদ্ধারা যারা
প্রাণ উৎসর্গ করেছেন, তাদের শবদেহ প্রতিবেশী সর্ষেক্ষেতের মাটিতে
পুঁতে আমরা আহত সতীর্থদের নিয়ে ফিরে যাচ্ছি। আমার রক্তাক্ত
শার্টে দুটি বয়স্ক মাছি আমাকে অনুসরণ করছে সেই সন্ধ্যা থেকেই।
ঘন রক্তের দাগ আর গুলিবিদ্ধ পেশীতে ডানা ঘঁষতে ঘঁষতে
মাছিগুলো মোটেও ক্লান্ত হচ্ছে না। ক্লান্ত নই আমিও। মাথার গামছাটা
কোমরে বেঁধে স্ট্যানগানটায় বাঁ হাত রাখছি বার বার। আর আষাঢ়ের
নরম মাটিতে পা রেখে হাঁটছি নদীর দিকে।
নৌকোটা তৈরিই ছিল। নদী পাড়ি দেবো বলে যখন কাছে এসে
দাঁড়ালাম তখন মাঝিভাই জানালেন, কিছুক্ষণ আগেই কয়েকটি
পশ্চিমা ট্রলার টহল দিয়ে গেছে। আমরা মোটেও শংকিত হলাম না।
বরং নৌকোতে চেপে বসে নদী পাড়ি দেবার জন্য প্রস্তুতি নিলাম।
বিপরীত দিক থেকে কমান্ডার সিদ্দিকের নেতৃত্বে একদল মুক্তিসেনা
আমাদেরকে হাত নেড়ে আরেকটি নৌকা বেয়ে চলে গেল।
আমরা খুব ধীর গতিতে পাহাড় থেকে ভেসে আসা কচুরিপানার সমান্তরালে, আমাদের নৌকোটি ভাসিয়ে দিলাম।
' আমি কী আর বাঁচবো না সুলতান'- শোনে আবারও আঁতকে উঠলাম
আমি। ' এইতো এসে গেছি' - বলে তাঁকে শান্তনা দেবার চেষ্টা করলাম।
এভাবে শান্তনা আমি দিয়ে এসেছিলাম আমার মা'কেও।
বলেছিলাম, এইতো ফিরে আসবো।তোমার জন্য নিয়ে আসবো একটি
দেশ। একটি স্বাধীনতা।
নৌকোর পাটাতনে দাঁড়িয়ে যখন ভোরের অপেক্ষা করছি
ঠিক তখনই মাঝিভাই হাঁক দিলেন- ' এই যে হার্মাদ ' !
স্ট্যানগানটা তাক করার সাথে সাথেই দেখি , ওরা আমাদের
ঘিরে ফেলেছে। আর কিছুই ভাবার সময় না পেয়ে
গুলি চালাতে চালাতে নদীতে ঝাঁপ দিলাম। ডুব দিয়ে, সাঁতার
কেটে বেশ দূরে গিয়ে যখন কিনারার দেখা পেলাম,
তখন সূর্যের লাল আভা স্পর্শ করেছে প্রিয় পৃথিবীর মুখ ।
তাকিয়ে দেখলাম, গুলিতে গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছে
আমাদের নৌকো। মাঝিভাই সাঁতার কেটে গিয়ে পৌঁছেছেন
পশ্চিম তীরে। আর সৈনিক , আমার প্রিয় সৈনিক ............
না, আমি তাঁকে সাথে করে আনতে পারিনি। তাঁর রক্তে
ভেসে গেছে নদীর বক্ষদেশ আর চরের সবুজ ঘাস সাম্রাজ্য।
এখানে, এই পিয়াইন নদীর মোহনায় আমি যেখানে দাঁড়িয়ে
আছি, ঠিক সেখানেই আমি হারিয়েছি আমার প্রিয় সৈনিককে।
প্রিয় সহযোদ্ধাকে।
এখনও ভোর হয়। সূর্য উঠে। আমি সবজি-আনাজের ভার
কাঁধে নিয়ে বাজারে বিক্রী করতে যাই। অনেকেই এখন আর
আমাকে চেনে না। চিনেই কী হবে ! ভাবি, হয়তো এই মাটির
আমাকে আর খুব বেশী প্রয়োজন নেই।
সৈনিক, শহীদ হয়ে বেঁচে গিয়েছেন। আর আমি বেঁচে থেকেও
মরে গেছি। পিয়াইন নদীর জলে হাত রেখে আমি প্রায়ই
অনুভব করি তাঁর রক্তের উষ্ণতা। মাঝে মাঝে মনীন্দ্রদের বাগান
থেকে কয়েকটি জবাফুল তোলে ভাসিয়ে দিই সেই জলে। মাঝে মাঝে,
'আমরা কেমন আছি' - সেই সংবাদ ভরা পুরনো খবরের কাগজের
কয়েকটি অক্ষর ভাসিয়ে দিতে থাকি নদীর স্রোতে,তাঁর উদ্দেশে।
কথা হয় তাঁর ছায়ার সাথে,
এভাবেই আমি, বাংলার নদীগুলোতে প্রতিদিন সাজাই
হরফের জলসৌধ। তাঁদের স্মৃতির বেদীতে ,
নদী নক্ষত্রে চিরদিন যাঁদের অম্লান সমাধি।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে মার্চ, ২০১১ সকাল ৭:৩৩