পানি, প্রতিফলন ও পত্রপল্লব....পানির উপরে প্রতিফলন, পত্রপল্লবের ফাঁক দিয়ে দেখা।
২১ অক্টোবর ২০২৩, দুপুর ০২টা ০২ মিনিট
আমাদের এলাকার মাসজিদে যখনই নামায পড়ি, প্রতিটি নামাযের পর মাসজিদের পূর্ব পার্শ্বে অবস্থিত পুকুরটার চারপাশে দু'তিনটা চক্কর দিয়ে বাড়ি ফেরাটা আমার এখন নিত্যদিনের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। দু'বার চক্কর দিলেই ১.১ কি.মি. পথ হাঁটা হয়ে যায়। পাঁচ ওয়াক্তের মধ্যে যোহর, মাগরিব আর এশার নামায প্রায় প্রতিদিনই মাসজিদে পড়ি। মাঝে মাঝে ফজর এবং আসরের নামাযও পড়া হয়। যোহর ছাড়া বাকী ওয়াক্তের পর আমি হাঁটার উদ্দেশ্যেই হাঁটি, ফিটনেস কনসার্ন থেকে। তখন brisk walk করি। কিন্তু যোহরের পরে যে হাঁটাটা হাঁটি, সেটা আপন খেয়ালে, ধীর লয়ে, কোন ফিটনেস কনসার্ন থেকে নয়। মধ্যাহ্ন হলেও, পুরো ওয়াকওয়ের ধারে প্রচুর গাছপালা থাকায় এখনকার ঋতুতে এ সময়টাতে গরম সহনীয় পর্যায়ে থাকে। আবার নামাযের পর পর সবাই যার যার বাড়ি ফিরে যায় বলে পথটা বেশ নিরিবিলি হয়ে যায়। হাঁটতে হাঁটতে একটা জায়গায় এসে প্রতিদিন একটা ঘুঘুর ডাক শুনতে পাই। এই অলস মধ্যাহ্নে একই জায়গা থেকে ডাকটা শোনা যায় বলে অনুমান করে নেই, সেখানকার কোন গাছের ডালে হয়তো কোন ঘুঘু দম্পতি বাসা বেঁধেছে। ফেব্রুয়ারী মাসের মাঝামাঝি থেকে, বসন্ত ঋতু শুরু হবার বেশ আগে থেকেই, কোকিলের ডাকও শোনা যায় এখানে প্রতিবছর।
আমি হাঁটি আর চারপাশের গাছ-গাছালি, মানুষ আর বাতাসে হিল্লোলিত পুকুরের জলে মৃদু তরঙ্গের খেলা দেখি। দেখতে ভালো লাগে। শিশুপার্কটা মধ্যাহ্নে শিশুবিহীন থাকে বলে সেখানে দেখার মত কিছু থাকেনা, তবে অন্য সময় শিশু ও তাদের মা/বাবা/পরিচর্যাকারীদের উপস্থি্তিতে পার্কটা বেশ সরগরম থাকে। পার্কের পাশ দিয়ে যাওয়া সদ্য উন্মুক্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের ওপর দিয়ে ছুটে চলা গাড়ি দেখি। সেটার নীচেই আমাদের এলাকার কম্পাউন্ড ওয়াল। একদিন দেখি কাচ্চা বাচ্চা নিয়ে সেটার উপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে শতাধিক বানর বানরীর দল। সংখ্যাটা আমি মোটেও বাড়িয়ে বলছিনা। এ পথে বানরের দলের আসা যাওয়া আমি এর আগেও দেখেছি, কিন্তু এত অধিক সংখ্যায় আর কখনো দেখিনি। একজন তরুণ সিকিউরিটি গার্ডকে দেখলাম লাঠি হাতে ওদেরকে তাড়া করতে। কিন্তু ওরা সেটা আমলে না নিয়ে একটু দৌড়ে সামনে এগিয়ে পেছন ভিড়ে ভেংচি কাটছিল। বুঝলাম, এসব দাবড়ানিতে ওরা অভ্যস্ত হয়ে গেছে, যেমন হয়েছে প্রতিদিনকার পেশাদার ভিক্ষুকের দল। ওরা ভেংচি কাটার সাহস পায় না বটে, তবে ওদেরকেও এক জায়গা থেকে তাড়িয়ে দিলে অন্য রাস্তার মোড়ে ঘাঁটি গেড়ে বসে।
এমন উদ্দেশ্যহীন পায়চারির সময় আমি আশেপাশের মানুষদেরকেও দেখি; বিশেষ করে সরোবরের আশেপাশে বসার বেঞ্চিগুলোতে বসে থাকা মানুষগুলোকে। কেউ কেউ হাতে মোবাইল নিয়ে উচ্চঃস্বরে কারও সাথে কথা বলছে, বডি ল্যাঙ্গুয়েজ পড়ে বুঝতে পারি তার ঘরে শান্তি নেই, মনেও নেই! কেউ বসে বসে আপন মনে পুকুরের, চারপাশের প্রকৃতির এবং মাঝে মাঝে মাথার উপর দিয়ে উড়ে যাওয়া ঢাউস ঢাউস প্লেনের ছবি তুলছে। আমাদের এলাকাটি বিমানবন্দর থেকে টেক-অফ করা বিমানগুলোর গতিপথের সরাসরি নীচে বলে সদ্য টেক-অফ করা বিমানগুলোকে অনেক বড় দেখা যায়। মধ্যাহ্নে এলাকাটি বেশ নিরিবিলি থাকে বলে আশেপাশের বাসাগুলো থেকে আসা বুয়ারা এ সময়টিকেই বেছে নেয় বেঞ্চিতে বসে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেয়ার জন্য। দিনের এরকম একটা গুরুত্বপূর্ণ সময়ে বুয়াদের পুকুর পাড়ে এসে বসে বিশ্রাম নেয়ার ফুরসৎ থাকার কথা নয়। তবে শিশু পরিচর্যায় নিয়োজিত কিছু কিছু বুয়া শিশুদেরকে একটু 'ঘুরিয়ে আনার ছলে' পার্কে আসার, বেঞ্চিতে বসার এবং দোলনায় বসে দোল খাওয়ার সুযোগ নিয়ে থাকে। কমবয়সীরা চাঞ্চল্যের সাথে একবার এ বেঞ্চে আরেকবার ও বেঞ্চে, একবার এ দোলনায় আরেকবার ও দোলনায় ঘোরাঘুরি করে শিশুকে নিয়ে। কয়েকজন বয়স্কা বুয়াও মাঝে মাঝে এসে বেঞ্চিতে বসে পুকুরের জলের দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকেন। বাসা থেকে মুখে পুরে আনা পান ধীরে ধীরে চিবোতে থাকেন। কেউ কেউ আঁচলেও পান-শুপারি-চুন বেঁধে নিয়ে আসেন। তারা দোলনায় বসেন না; বেঞ্চিতেই বসেন। তাদের আচরণে সাধারণতঃ কোন প্রাণচাঞ্চল্য থাকে না, চেহারায় থাকে একটা নিরালা জায়গায় বসে একান্তে একটু স্মৃতির জাবর কাটার তৃপ্তি। কমবয়সী, বেশি বয়সী সব বুয়ারাই অবশ্য সিকিউরিটি গার্ডদের ভয়ে সতর্ক থাকে, কারণ গার্ডরা মাঝে মাঝে এসে ওদেরকে উঠিয়ে দেয়।
গত কয়েকদিন ধরে দেখছি পুকুরের পশ্চিম পাড়ের একটা নির্দিষ্ট বেঞ্চে একজন মধ্যবয়স্ক ব্যক্তি একাকী বসে থাকেন। তিনি মোবাইলেও কথা বলেন না, ছবিও তুলেন না, প্লেনের দিকেও তাকান না। শুধুই জলের দিকে তাকিয়ে থাকেন। তিনি যে জায়গাটায় বসে থাকেন, সেটা পুকুরের জল, উন্মুক্ত আকাশ আর আশেপাশের গাছপালা দেখার জন্য একটি সুন্দর জায়গা। আমিও একদিন আমার নাতনিকে নিয়ে সেই জায়গাটার দোলনায় বসে দোল খাচ্ছিলাম। হাঁটতে আসা আমার এক বন্ধু আমাদের দোল খাওয়ার সে দৃশ্যের ছবি তুলে হোয়াটসএ্যাপে পাঠিয়েছিল। দু'দিন আগে আমি সেই ভদ্রলোকের আসনটির সামনে গিয়ে পুকুরের কয়েকটি ছবি তুললাম। তিনি শুধু একবার আমার দিকে তাকালেন। পা তুলে বসেছিলেন, আমাকে দেখে পা নামিয়ে সৌজন্য প্রদর্শন করলেন। মুখে কেউ কিছু বললাম না, আমি ছবি তুলে চলে এলাম। আজ আবার সেই ভদ্রলোককে একই জায়গায় দেখে এগিয়ে গেলাম। তাকে দেখে খুব ভারাক্রান্ত মনে হচ্ছিল। নিজেকে ইন্ট্রোডিউস করে তিনি কিছু আলাপচারিতায় রাজী আছেন কিনা জিজ্ঞেস করলাম। আমার ধারণা ছিল, তিনি যদি সত্যিই ভারাক্রান্ত হয়ে থাকেন, আলাপচারিতার পর তিনি কিছুটা ভারমুক্ত বোধ করতে পারেন। তিনি সানন্দে রাজী হলেন। আরেকদিন রাতে এশার নামাযের পর হাঁটার সময় দেখি, পুকুরের দক্ষিণ পাড়ের এক বেঞ্চিতে বসে ২২/২৩ বছরের এক যুবক উদাস চোখে জলের উপর কম্পমান আলোর প্রতিফলনের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সে একজন মেহনতি মানুষ, ঢাকার পূর্বাচলে তার বাড়ী। নিজস্ব তাঁত আছে, সেখান থেকে সে দুই একটা করে জামদানি সিল্ক শাড়ি বুনে ঢাকায় এনে বিক্রয়ের মাধ্যমে অন্ন সংস্থান করে। সেদিন এখানকার কোন এক ম্যাডাম তার কাছ থেকে শাড়ি কিনবেন বলে তাকে আসতে বলেছিলেন। সে বিকেল পাঁচটায় এসে ফোন দিলে ম্যাডাম বাইরে আছেন বলে তাকে পুকুর পাড়ে বসে থাকতে বলেন। রাত আটটায়ও তিনি ফিরে না আসাতে ছেলেটির মুখে চিন্তার রেখা দেখা দিয়েছিল। আমার সাথে কিছুক্ষণ আলাপচারিতার পর ছেলেটি আমাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলে, আলাপের পর তার ভালো লাগছিল। সেই কথাটি মনে করেই আমি এই ভদ্রলোকের সাথে আলাপ জুড়ে দিলাম।
৪৬ বছর বয়স্ক এই ভদ্রলোকের নাম শরীফ আহসান, বাড়ি সাতক্ষীরায়। তার বাবা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এ্যাকাউন্টস শাখার একজন কর্মচারী ছিলেন। বাবার চাকুরীর সুবাদে তিনি একটানা ২২/২৩ বছর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পাউন্ডের ভেতরে বাস করেছিলেন। সেখান থেকেই তিনি এসএসসি, এইচএসসি পাশ করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং এ অনার্স সম্পন্ন করেন। তারপর তিনি আহসানিয়া মিশনে চাকুরি জীবন শুরু করেন। অর্থাভাবের কারণে তখনোও তিনি মাস্টার্স সম্পন্ন করতে পারেন নাই, কিন্তু আহসানিয়া মিশনে চাকুরি শুরু করার পরে তিনি সেখানকার কর্তৃপক্ষের শুভদৃষ্টি লাভ করেন। একজন ম্যাডাম ছিলেন তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। তিনি নিজে তাকে নিয়ে আহসানহউল্লাহ বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে তাকে এমবিএ কোর্সে ভর্তি করে দিয়ে আসেন। তার প্রতিষ্ঠান তার এমবিএ কোর্সের অর্ধেক ব্যয়ভার বহন করে। এখন তিনি একটি এ্যাগ্রোবেজড ইন্ডাস্ট্রির এ্যাডমিন ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত আছেন। একই মালিকের এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট ব্যবসাও আছে। সেগুলোরও কিছু কিছু কাজ তাকে দেখতে হয়। তিনি জানালেন, এতদিন তিনি ভালোই ছিলেন। কিন্তু এখন বৈশ্বিক পরিস্থি্তির অস্থি্রতার কারণে তাদের ব্যবসায়ে মন্দা দেখা দিয়েছে। বহুলোক ইতোমধ্যেই ছাঁটাই হয়েছে, তিনিও যে কোন সময়ে চাকুরিচ্যুতির আশঙ্কা করছেন। তাদের সংসারে একটি মেয়ে রয়েছে, পড়ে মিরপুরে অবস্থিত মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে। মিরপুরেই তাদের বাসা, সেখান থেকে প্রতিদিন এখানে এসে অফিস করেন। অফিসের লাঞ্চ ব্রেকের সময় তিনি পুকুর পাড়ের এই জায়গাটাতে এসে বসেন। পুকুরের জলের দিকে তাকিয়ে নানা কিছু ভাবেন। সামনের অনিশ্চয়তার কথা ভেবে কোন কূল কিনারা পান না। এই মধ্যবয়সে এসে অন্য কোথাও উপযুক্ত চাকুরির সন্ধানের কথা তিনি ভাবতে পারছেন না।
আলাপ করতে করতেই আমরা উঠলাম। পুকুরের পাড় থেকে যেখানে ওনার অফিসের দিকে যাওয়ার রাস্তা, আমি সেখান থেকে বিদায় নিতে চাইলাম। উনি বললেন, ওনার কথা বলতে খুব ভালো লাগছে। ওনার সাথে আরেকটা চক্কর হাঁটতে আমি রাজী আছি কিনা তা জিজ্ঞেস করলেন। আমি রাজী হলাম। ওনার সম্বন্ধে আরও কিছু জানা হলো। আলাপচারিতায় দেশের অর্থনৈতিক দুরবস্থার একটা চিত্র পেলাম, ধাবমান 'অর্থনৈতিক সুনামি'র ভয়াবহ ইঙ্গিত পেয়ে এবারে আমি নিজে চিন্তিত মনে বাড়ি ফিরে এলাম।
ঢাকা
২১ অক্টোবর ২০২৩
শব্দ সংখ্যাঃ ১১৪১
পুকুরপাড়ের ওয়াকওয়ে
১৯ অক্টোবর ২০২৩, দুপুর ০১টা ৩৯ মিনিট
পশ্চিম ও উত্তর দিকের পুকুরপাড়
১৯ অক্টোবর ২০২৩, দুপুর ০১টা ৪২ মিনিট
পুকুরপাড়ে সিনিয়র সিটিজেনদের জন্য বসার কয়েকটি স্থানের মধ্যে একটি....
২২ অক্টোবর ২০২৩, দুপুর ০১টা ৩৮ মিনিট
সবুজ পাতারা...
১১ অক্টোবর ২০২৩, দুপুর ০১টা ৩৬ মিনিট
সবুজের বুকে জীর্ণ ঝরাপাতা....
১৯ অক্টোবর ২০২৩, দুপুর ০১টা ৩৯ মিনিট
এই আলোর প্রতিফলনের দিকেই ছেলেটি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল।
১৩ অক্টোবর ২০২৩, রাত ০৮টা ১৭ মিনিট
"পুকুরের পশ্চিম পাড়ের একটা নির্দিষ্ট বেঞ্চে একজন মধ্যবয়স্ক ব্যক্তি একাকী বসে থাকেন। তিনি মোবাইলেও কথা বলেন না, ছবিও তুলেন না, প্লেনের দিকেও তাকান না। শুধুই জলের দিকে তাকিয়ে থাকেন"।
২১ অক্টোবর ২০২৩, দুপুর ০২টা ০১ মিনিট
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে অক্টোবর, ২০২৩ সকাল ১১:০২