সেলফি, সোসাইটি, সিক্যুরিটি
ফকির ইলিয়াস
------------------------------------------------------------
প্রথমেই দুঃখ প্রকাশ করি প্রিয় পাঠক-পাঠিকা। লেখাটির নাম হতে পারতো- আত্মছবি, সমাজ ও নিরাপত্তা। কিন্তু ‘সেলফি’ শব্দটি হালে এতো বেশি বাজার পেয়েছে, ফলে সেই শব্দটি ব্যবহার করছি আমি। আজকের অগ্রসরমান পাঠক ইংরেজিতে অনেকটাই অভ্যস্ত। কথায় কথায় ইংরেজির প্রভাব। বলে রাখি, আমি কিন্তু এর পক্ষে। বিদেশে প্রায় তিন দশকেরও বেশি সময় কাটানোর অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, ইংরেজি ভাষা রপ্ত ছাড়া বিশ্বে চলা খুবই কঠিন তা দেশে হোক আর বিদেশেই হোক।
পবিত্র ঈদুল আজহা শেষ হলো। আমি আশা করছি, সকলের ঈদ আনন্দেই কেটেছে। একটা সংবাদ দিয়ে শুরু করি। না ঠিক সংবাদ নয়। একটা ফেসবুক স্ট্যাটাস। নিজের টাইমলাইনে লিখেছেন বাংলাদেশের এই সময়ের কৃতী ছড়াকার জুলফিকার শাহাদাৎ। তার লেখার শিরোনাম- ‘চামড়া সন্ত্রাসী’। তিনি লিখেছেন, ‘কুরবানির পর যথারীতি গরুটির চামড়া ছিলানো হলো। একটু পর দেখি, তাগড়া তিন জোয়ান এসে বললেন, চামড়াটি তাদেরকে দিতে হবে। বললাম, ইতোমধ্যে এটির মূল্য ২১০০ টাকা বলে গেছেন একজন। আপনারা তার বেশি পারলে বলেন। চামড়া সন্ত্রাসীরা তখন পরিচয় দিলেন, ওরা ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রনেতা। কাউকে এ চামড়া নিতে দেবেন না তারা। তারাই চামড়াটি নেবেন। সে মুহূর্তে চামড়া নিয়ে লড়াই করবো না মাংস নিয়ে বাসায় ফিরবো এ ভাবনায় দ্বিধান্বিত ছিলাম। পরে বললাম, ঠিক আছে; আগে যে দাম উঠেছে ঐ দামই দেন আপনারা। ওরা কোনো কথা না শুনে জোর করে আগের দামের চেয়ে অনেক কম টাকা গছিয়ে দিলেন। প্রতিবাদ করতে পারলাম না। তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষণ।
আহারে আমার সোনার বাংলাদেশ, স্বাধীন বাংলাদেশ। চামড়া সন্ত্রাসীদের তা-বে তোমার বুকে আজ আমরা কতো অসহায়। কতো অসহায়! একজন লেখক কী ভীতি নিয়ে ঈদ উদযাপন করেছেন- সে চিত্র আমরা পেলাম। এই কি সেই সোনার বাংলাদেশ! ‘আমি তোমায় ভালোবাসি’ বলে আমরা কিনা আহাজারি করি!
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এগিয়েছে। আমি দেখেছি, ফেসবুকে গরুর সঙ্গে অনেক মানুষের ছবি। কুরবানির গরু এখন প্রচারের অন্যতম হাতিয়ার। কে কতো বেশি টাকার গরু কুরবানি দিচ্ছেন তা এখন প্রচারের অন্যতম বিষয়। ধর্ম কি আত্মপ্রচারকে সমর্থন করে? দানের বিষয়টি হলো এরকমÑ দান করলে ডানহাত যে দান করেছে তা যেন বাম হাতও না জানে। আমরা কি তা তামিল করছি? আমাদের নৈতিক অবক্ষয় এতো নিচে নেমে গেলো কেন?
একটি বিষয়ে বিশ্বব্যাপী বিতর্ক শুরু হয়েছে। তাহলো ‘সেলফি’। অর্থাৎ সেলফ পোর্টেট বা আত্মছবি। খবর বেরিয়েছে এবার পবিত্র হজে গিয়েও অনেকে মুঠোফোন দিয়ে আত্মছবি প্রচার করেছেন বিভিন্ন সামাজিক গণমাধ্যমে।
মক্কায় মুসলিমদের অন্যতম পবিত্র একটি স্থানের সামনে বাবাকে জড়িয়ে ধরে সেলফির জন্য হাত বাড়িয়ে দেন একজন কুয়েতি যুবক ইউসুফ আলী। এবারের হজে এই প্রবণতা দেখা গেছে ব্যাপকভাবে। হাজার হাজার তরুণ পুণ্যার্থী ক্যামেরা ও স্মার্টফোনে নিজেদের ছবি তুলে ইন্টারনেটে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে পোস্ট করেছেন। বিষয়টিকে ইতিবাচকভাবে নিতে পারেননি অনেকে। রক্ষণশীল মুসলিমদের মধ্যে এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে বলে যুক্তরাজ্যভিত্তিক দৈনিক টেলিগ্রাফের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
মুসলিম সম্প্রদায়ে অন্যতম বড় ধর্মীয় উৎসব হজ। এ বছর ২০ লাখেরও বেশি মুসলিম হজ পালনের জন্য সৌদি আরবের মক্কায় সমবেত হন। এদেরই একজন ২৪ বছর বয়সী কুয়েতের ইউসুফ আলী বলেন, ‘এটি আমার প্রথম হজ। তাই আমার চারপাশে যা ঘটছে সেসব ধরে রাখা আমার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।’ মিনায় শয়তানকে পাথর ছোড়ার স্থানে একটা দেয়ালে সবুজ রংয়ে ‘বড় জামারাহ’ লেখার পাশে দাঁড়িয়ে নিজের ছবি তোলেন তিনি। তিনি বলেছেন-‘আমি যেখানে যাই সেখানেই ছবি তুলি। বিশেষ করে এখন আমাদের কাছে এই ক্ষুদ্র ক্যামেরাগুলো আছে। এটি দিয়ে এই এলাকার পুরো দৃশ্য তুলে নেয়া যায়’।
আমরা লক্ষ করছি ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠা এই বিষয়টি অবশ্য সবার কাছে সমান গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে না। রক্ষণশীল মুসলিমরা এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। কেউ কেউ টুইটারে নিজেদের ছবি তোলা (সেলফি) হাজিদের সমালোচনা করেছেন। একজন তার ব্যক্তিগত টুইটারের পাতায় লিখেছেন- ‘নব্বই দশকের মাঝামাঝি আমরা যখন ওমরা করতে গিয়েছিলাম, ‘হারাম!’ বলে চিৎকার করে বাবা তখন নিজের ক্যামেরা প্রায় বাজেয়াপ্ত করেছিলেন। এখন হজ সেলফি একটি বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এ কি এক বিশ্ব!’ কাহবা নামের অপর একজন লিখেছেন, ‘এটি আল্লাহর সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ার এবং নিজের আত্মাকে পরিশুদ্ধ করার সময়। এ সময় সেলফি নেয়া উচিত নয়।’
অন্যদিকে এই সেলফি বা আত্মছবির পক্ষেও বলছেন অনেকে। আব্দুল মুফেজ শহীদ একজন প্রশ্ন করেছেন, ‘হজ সেলফি নিয়ে লোকজন বিরাট একটি ইস্যু তৈরি করছে। হজের সময় যদি ছবি তোলার অনুমোদন দেয়া হয় তাহলে সেলফিতে সমস্যা কোথায়?’
এ বিষয়ে সৌদি আরবের ইসলামি শরিয়া আইনের এক অধ্যাপক বলেন, ‘ছবি যদি ব্যক্তিগত স্মৃতির জন্য তোলা হয় এবং আত্মপ্রচারের জন্য না হয়, তাহলে কোনো সমস্যা নেই।’ তিনি আরো বলেছেন, ‘কিন্তু এগুলো যদি লোক দেখানোর মানসিকতা থেকে হয়, তাহলে তা নিষিদ্ধ। হজের সময় যে সব ছবি তোলা হচ্ছে তা প্রায়ই এ ধরনের। তাই মুসলিমদের জন্য এটি এড়িয়ে যাওয়াই ভালো।’
যারা সেলফির পক্ষে তারা বলছেন, ‘ক্যামেরা মোবাইলের মতোই একটি যন্ত্র। ধর্মীয় বিশেষজ্ঞরাও মোবাইলে নিষেধাজ্ঞা না দিয়ে নিজেরাই ব্যবহার করেন, তাই আধুনিক সময়ে আরেকটি যন্ত্রকে নিষিদ্ধ করা কেন?’
হ্যাঁ- অতি সম্প্রতি বাংলাদেশের একজন সিনিয়র মন্ত্রী আব্দুল লতিফ সিদ্দিকীকে নিয়ে নিউইয়র্কে যে কা- ঘটে গেলো, তার মূল হাতিয়ার কিন্তু এই মোবাইল ডিভাইস। যতোটুকু জানি, কেউ একজন তার হাতের শক্তিশালী মোবাইলে রেকর্ড করেই ঐ মন্ত্রীর বক্তব্য ফেসবুক, ওয়েবে ছড়িয়ে দেন। এরপরই মিডিয়াগুলো তা লুফে নেয়। যা মন্ত্রীকে হিরো থেকে জিরো বানিয়ে ফেলে মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে। সামাজিক গণমাধ্যম এখন একটি বিরাট শক্তি। জাতীয় দৈনিক বের হয় ২৪ ঘণ্টা পর। টিভি আপডেট হয় ঘণ্টায় ঘণ্টায়। আর হ্যান্ড মোবাইল চলে মিনিটে মিনিটে। খবর ছড়িয়ে পড়ে মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যেই। এই প্রবণতা সমাজের জন্য ক্ষতির কারণও বটে। কারণ সামাজিক অবক্ষয়, অন্যকে ব্ল্যাকমেল করা, কারো বিনা অনুমতিতে ছবি আপলোড করা সমাজের, মানুষের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করছে। যা খুবই শঙ্কার কারণ।
গণমাধ্যমে সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়টি খুবই জরুরি হওয়া উচিত। এ বিষয়ে বাংলাদেশের মাননীয় তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর কিছু কথা তুলে ধরা দরকার। তিনি কিছুদিন আগে এক সেমিনারে বলেছেন- ‘যে দেশে জঙ্গিবাদকে ও তেঁতুল হুজুরদের রাখার কথা বলা হয় সে দেশে সামাজিক নিরাপত্তা এবং অবাধ তথ্য অধিকার দুর্বল হয়ে পড়ে। আর এটি তখনই সচল হয় যখন গণতন্ত্র নামে কিছু থাকে।’ তিনি বলেন, ‘আমি সকল মিডিয়ার কাছে অনুরোধ করবো, আপনারা সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে দেশের জনগণের স্বার্থে অন্তত কিছু সময়ে ‘তথ্য অধিকার আইন বা তথ্য সম্ভার’ নামে অনুষ্ঠান প্রচার করে জনগণকে জানান তাদের অধিকার সম্পর্কে।’
আবারো ফিরে আসি বৈষম্যহীন সমাজ বিষয়ে। শান্তির সমাজ চাইলে ক্ষমতাসীনদের ভোগবিলাস ত্যাগ করতে হয়। বাংলাদেশ মূলত ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে সেই চেতনায়ই স্বাধীন হয়েছিল। আজ সেই চেতনা ভূলুণ্ঠিত। কেন ভূলুণ্ঠিত, কেন এ দেশে ঈদেও চামড়া সন্ত্রাসী দাপট দেখাবে- তা খুঁজতে হবে। ক্ষমতা কারো চিরস্থায়ী নয়। ক্ষমতার পালাবদল এ দেশে আগেও হয়েছে। লুটেরা যে দলেরই হোক না কেন- সরকার তাকে দমন করবে সেটাই নিয়ম। তা না হলে আত্মপ্রচার করে সমাজের কলুষতা দূর করা যাবে না।
-----------------------------------------------------
দৈনিক ভোরের কাগজ ॥ ঢাকা ॥ : ১১/অক্টোবর/২০১৪ শনিবার প্রকাশিত
আলোচিত ব্লগ
তালগোল
তুমি যাও চলে
আমি যাই গলে
চলে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফুরালেই দিনের আলোয় ফর্সা
ঘুরেঘুরে ফিরেতো আসে, আসেতো ফিরে
তুমি চলে যাও, তুমি চলে যাও, আমাকে ঘিরে
জড়ায়ে মোহ বাতাসে মদির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন
মা
মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।
অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন
কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।
একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন
শাহ সাহেবের ডায়রি ।। গানডুদের গল্প
তীব্র দাবদাহের কারণে দুবছর আগে আকাশে ড্রোন পাঠিয়ে চীন কৃত্রিম বৃষ্টি নামিয়েছিলো। চীনের খরা কবলিত শিচুয়ান প্রদেশে এই বৃষ্টিপাত চলেছিলো টানা ৪ ঘন্টাব্যাপী। চীনে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর প্রক্রিয়া সেবারই প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন
ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে
ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন