বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বলেছেন, ‘পদ্মা সেতুর স্বপ্ন দেখাচ্ছে সরকার। কিন্তু পদ্মা সেতু আওয়ামী লীগের আমলে হবে না। এ সেতু জোড়াতালি দিয়ে বানানো হচ্ছে। এ সেতুতে কেউ উঠবেন না।’
২ জানুয়ারি ২০১৮, মঙ্গলবার সন্ধ্যায় রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটশন মিলনায়তনে ছাত্রদলের ৩৯তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন।
জোড়াতালি'র পদ্মাসেতুর শুরুর কথা:
পদ্মা সেতু বাংলাদেশের পদ্মা নদীর উপর নির্মাণাধীন একটি বহুমুখী সড়ক ও রেল সেতু। এর মাধ্যমে লৌহজং, মুন্সিগঞ্জের সাথে শরিয়তপুর ও মাদারীপুর যুক্ত হবে, ফলে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশের সাথে উত্তর-পূর্ব অংশের সংযোগ ঘটবে। বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশের জন্য পদ্মা সেতু হতে যাচ্ছে এর ইতিহাসের একটি সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জিং নির্মাণ প্রকল্প। দুই স্তর বিশিষ্ট ষ্টিল ও কংক্রিট নির্মিত ট্রাস ব্রিজটির (truss bridge) ওপরের স্তরে থাকবে চার লেনের সড়ক পথ এবং নিচের স্তরটিতে থাকবে একটি একক রেলপথ।
পদ্মা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা নদীর আববাহিকায় ১৫০টি স্পান, ৬,১৫০ মিটার দৈর্ঘ্য এবং ১৮.১০ মিটার প্রস্থ পরিকল্পনায় নির্মিত হচ্ছে দেশটির সবচে বড় সেতু।
বিশ্বব্যাংকের হিসাব মতে, (দি ডেইলি স্টার, ৩ জুলাই ২০১২) সেতুটির কারণে ২০১৫ সাল থেকে শুরু করে পরবর্তী ৩১ বছরে বাংলাদেশের জিডিপি বা দেশজ উৎপাদন বাড়বে ছয় বিলিয়ন ডলার (প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা)। একই সময়ে দক্ষিণাঞ্চলে কৃষি উৎপাদন বাড়বে ৫০ শতাংশ এবং কর্মসংস্থান ১০ দশমিক ২ শতাংশ। বাৎসরিক হারে জাতীয়ভাবে দারিদ্র্য কমবে ১ দশমিক ৯ শতাংশ এবং দক্ষিণাঞ্চলে ২ শতাংশ। এ ছাড়া নয় হাজার হেক্টর জমি নদীভাঙন থেকে রক্ষা পাবে। জমি রক্ষা, বিদ্যুৎ-গ্যাসলাইন ও ফাইবার অপটিক লাইন স্থাপন এবং ফেরি সার্ভিস বন্ধ থেকে সরকারের সাশ্রয় হবে প্রায় ৮৩০ কোটি টাকা।
পদ্মা সেতু কেলেঙ্কারি
জানা যায় যে সেতু নির্মাণ কোম্পানির এসএনসি-লাভালিনের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থের জন্য নির্মাণ চুক্তির বিনিময়ে অর্থের দাবি জানায় যাদের অনেকে বাংলাদেশের আওয়ামী লীগের সরকারের সাথে জড়িত ছিল ।
বিশ্বব্যাংক দাবি করেছে, দুর্নীতির সুস্পষ্ট অভিযোগ উত্থাপন করা সত্ত্বেও বাংলাদেশ সরকার এ ব্যাপারে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি। আমাদের সরকার অবশ্য বরাবরই দুর্নীতির অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন যে বিশ্বব্যাংক দুর্নীতি প্রমাণ করতে না পারলে সরকার তাদের কাছ থেকে ঋণ নেবে না।
পদ্মা সেতু প্রকল্প আদৌ আলোর মুখ দেখবে কিনা তা নিয়ে ২০১২ সালের জুলাই মাসে চট্টগ্রামের এক জনসভায় সংশয় প্রকাশ করেছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। তিনি বলেছিলেন, বর্তমান সরকারের দুর্নীতির কারণেই পদ্মা সেতু হলো না। খালেদা জিয়া বলেন, প্রধানমন্ত্রী ও তার পরিবার দুর্নীতিতে নিমজ্জিত। সরকারের দুর্নীতির কারণেই পদ্মা সেতু নির্মাণ চুক্তি হলো না। তারপরও আওয়ামী লীগ সরকারকে যারা ভোট দেবে, তারা জাতীয় বেঈমান হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।
যাইহোক, দুর্নীতির অভিযোগগুলি পরে মিথ্যা প্রমানিত হয় এবং কানাডীয় আদালত পরবর্তীতে মামলাটি খারিজ করে দেয়। বাংলাদেশ সরকার নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়। ভেঙ্গে যাওয়া পরিকল্পনায় প্রথম জোড়া লাগে এই সিদ্ধান্তে।
নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের মাধ্যমে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে আনীত তথাকথিত দুর্নীতির মিথ্যা অভিযোগের তার সরকার সমুচিত জবাব দিয়েছে উল্লেখ করে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আমরা নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করছি। যারা আমাদের এই পদ্মা সেতু নির্মাণ নিয়ে মিথ্যা অপবাদ এবং বাংলাদেশের সামর্থ্যকে হেয় করার চেষ্টা করেছিল আমরা তাদের সমুচিত জবাব দিয়েছি। নিজস্ব অর্থায়নে মেগা প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের মাধ্যমে আবারও বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে।
পরিকল্পনা বাস্তবায়নে জোড়াতালি:
দুর্নীতির ষড়যন্ত্র–সংক্রান্ত জটিলতার পর সরকার নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নিয়ে শুরুতে যে পরিকল্পনা নেওয়া হয়, তাতে চার বছরে অর্থাৎ ২০১৮ সালের মধ্যে সেতুটি যানবাহন চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) গত ২০ নভেম্বর ২০১৭ সেতু বিভাগে পাঠানো প্রতিবেদনে বলা আছে, পদ্মা সেতু নির্মাণের নির্ধারিত সময় শেষ হতে বাকি আর মাত্র ১৪ মাস। কিন্তু এই পর্যন্ত নির্মাণকাজে অগ্রগতি মাত্র ৪৮ শতাংশ। ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকার মধ্যে গত অক্টোবর পর্যন্ত খরচ হয়েছে মাত্র ১৪ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে নির্ধারিত সময়ের চেয়ে আট মাস পিছিয়ে আছে নির্মাণকাজ।
পদ্মাসেতু নির্মান ব্যয়ে জোড়াতালি:
পদ্মা বহুমুখী সেতু বাস্তবায়নে ২০০৭ সালে একনেকে ১০ হাজার ১৬১ কোটি ৭৫ লাখ টাকার প্রকল্প অনুমোদিত হয়। এরপর দুই দফা ব্যয় সংশোধন করা হয়। যেমন, ২০১১ সালে ব্যয় বাড়িয়ে করা হয় ২০ হাজার ৫০৭ কোটি ২০ লাখ টাকা এবং ২০১৬ সালে ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা। আর এখন জমি অধিগ্রহণের জন্য বাড়তি যুক্ত হচ্ছে আরও ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। ফলে মোট ব্যয় দাঁড়াচ্ছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে মূল প্রকল্প প্রস্তাব থেকে ব্যয় বেড়েছে ২০ হাজার ৩১ কোটি ২৫ লাখ টাকা।
সরকারের ক্রয়সংক্রান্ত আইনে বিশেষ কোনো অবস্থার সৃষ্টি না হলে দুবারের বেশি প্রকল্প প্রস্তাব সংশোধন করা যায় না। কিন্তু পরিকল্পনা কমিশন পদ্মা সেতু প্রকল্পের জন্য এই আইন শিথিল করার বিষয়ে একমত হয়েছে।
সর্বশেষ ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা ব্যয় বাড়ছে নদী শাসনের জন্য তোলা বালু ফেলার জায়গা কেনায়। প্রথমে নদীর ডুবোচরে এসব বালু ফেলার সিদ্ধান্ত হয়েছিল এবং এসব জমি খাস হিসেবে বিবেচনা করেছিল কর্তৃপক্ষ। কিন্তু বালু ফেলতে গেলে স্থানীয় লোকজন স্থাপনা নির্মাণ করে ও চাষাবাদ শুরু করে দিয়ে মালিকানা দাবি করেন। তখন সরকার প্রায় দেড় হাজার হেক্টর জমি ক্রয়ের সিদ্ধান্ত নেয়। এই কাজে আরও জমির প্রয়োজন হতে পারে বলে সূত্র জানিয়েছে।
প্রকল্পসংশ্লিষ্ট সূত্র আরও জানায়, আন্তর্জাতিক বাজারে রডের মূল্য কম। অর্থাৎ পণ্যের মূল্যের কারণে এখনো খেসারত দেওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। তবে মাঝনদী ও মাওয়া প্রান্তে পাইলিং নিয়ে যে ঝামেলা তৈরি হয়েছে, এর জন্যও পুনরায় ব্যয় বাড়তে পারে। আরও জমি অধিগ্রহণের প্রয়োজন হলে সে ক্ষেত্রেও ব্যয় বাড়বে। অর্থাৎ প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার আগে এর ব্যয় কত দাঁড়াবে, তা নির্দিষ্ট করে বলা যাবে না।
পিলারের পাইল বসানো নিয়ে জটিলতা:
মাঝনদী ও মাওয়া প্রান্তে ১৪টি পিলার নির্মাণ নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দেয় যা এখনো কাটেনি। এই ১৪টি পিলারের নিচে ৮৪টি পাইল বসানো নিয়ে করিগরি জটিলতা আছে।
সেতু বিভাগ সূত্র জানায়, পদ্মা সেতু প্রকল্পের পিলারের নিচে ৯৮ থেকে ১২৮ মিটার পর্যন্ত গভীর পাইল বসানো হচ্ছে। বিশ্বে এত গভীরে পাইল বসিয়ে সেতু নির্মাণের নজির নেই বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। ১৪টি পিলারের নিচে যে গভীরতায় পাইল বসানোর কথা, এর ৩ থেকে ৭ মিটার ওপরে কাদামাটি পাওয়া গেছে। সাধারণত কাদামাটির স্তরের ওপরে থাকা শক্ত মাটিতে পাইলের শেষাংশ থাকা বাঞ্ছনীয়। এ জন্যই এই ৮৪টি পাইল আরও গভীরে বসানো হবে, নাকি গভীরতা কমিয়ে সংখ্যা বাড়িয়ে দেওয়া হবে—এটা নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় আছে প্রকল্প কর্তৃপক্ষ। মাটি থেকে পানি পর্যন্ত একটা নির্দিষ্ট উচ্চতায় পিলারের চারপাশে বেড়া দিয়েও এর সমাধান হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য কাউই ইউকে লিমিটেড নামে একটি ব্রিটিশ পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
চলছে বিশাল কর্মযজ্ঞ
সেতু বিভাগ সূত্র জানায়, পদ্মা সেতু প্রকল্পে এখন প্রায় চার হাজার লোক কাজ করছেন। তবে কর্মীর সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ে-কমে। শুকনা মৌসুমে বেশি লোক কাজ করেন। আবার বর্ষায় কিছুটা কমে যায়। কর্মরত মানুষের মধ্যে এক হাজারের বেশি বিদেশি, যাঁদের বেশির ভাগই চীনের। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারত, জাপানসহ আরও অনেক দেশের নাগরিকও আছেন। তাঁদের বেশির ভাগ পরামর্শক।
পদ্মা সেতু প্রকল্প এলাকায় শতাধিক ক্রেন মজুত আছে। এর মধ্যে বড় একটি ক্রেনের ভার বহনের ক্ষমতা ৪ হাজার টন। এটি দিয়েই প্রায় ৩ হাজার ২০০ টন ওজনের স্টিলের কাঠামো তুলে খুঁটিতে বসানো হবে। আর ২ হাজার ৪০০ ও ১ হাজার ৯০০ কিলোজুল ক্ষমতাসম্পন্ন দুটি হাইড্রোলিক হাতুড়ি দিয়ে পাইল বসানোর কাজ চলছে। সম্প্রতি সাড়ে ৩ হাজার কিলোজুল ক্ষমতাসম্পন্ন আরেকটি হাতুড়ি এসেছে। এর বাইরে নদী শাসনে সক্রিয় আছে বেশ কিছু ড্রেজার।
জোড়াতালি উপসংহার:
যতটুকু বুঝা যাচ্ছে, পদ্মাসেতু ব্যাপক প্রভাব পড়বে আগামী নির্বাচনে। আওয়ামীপন্থীরা ঘুষ কেলেঙ্কারির বিষয়টি যে শুধু সফলতার সাথে মোকাবিলা করেছে তাই নয়, নিজস্ব অর্থায়নে এত বড় প্রজেক্টের কাজ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে নানা প্রতিকুলতা মোকাবেলা করে। এই সফলাতা জনগনের সম্মুখে প্রকাশ্যে আনার জন্য কাজটি সম্পন্ন করার জন্য তাড়াহুড়া করছে বলে জানা যায়। অন্যদিকে বিএনপি সহ বিরোধী পক্ষ চাইছে পদ্মাসেতুর কেলেঙ্কারীসহ নানা খুতগুলি জনগনের সামনে নিয়ে এসে সরকারের ব্যর্থতা তুলে ধরতে। যদি সকল দলের অংশগ্রহনমূক নির্বাচন হয়, মনে হচ্ছে পদ্মাসেতু হয়ে উঠতে পারে আগামী নির্বাচনের টার্মকার্ড।
তথ্যসূত্র:
https://bn.m.wikipedia.org/wiki/পদ্মা_সেতু.
http://www.dailyjanakantha.com/details/article/299099/নিজস্ব-অর্থায়নে-পদ্মা-সেতু-বাস্তবায়নের-পথে.
http://www.newspapers71.com/637274/জোড়াতালির পদ্মা সেতুতে কেউ উঠবেন না : খালেদা জিয়া.
http://www.newspapers71.com/627129/নির্বাচনের আগে হচ্ছে না পদ্মা সেতু.
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই জানুয়ারি, ২০১৮ বিকাল ৫:০৩