এক কালে আমি মস্ত লিখক ছিলাম ।আমার লিখার সুখ্যাতি নিজ বাড়ীতো বটেই ,পুরো গ্রামেই চাউর হইয়া গিয়াছিল ।
বাড়ি ,গ্রাম কি বলিতেছি ; আমার পাঠক ছিল ব্রহ্মাণ্ড বিস্তৃত । তাবৎ বিশ্বের তৃষ্ণার্ত পাঠকগন আমার লিখার জন্য তীর্থের কাকের মত হা করিয়া থাকিত । যাহার রেশ ধরিয়া আমার গুণমুগ্ধদল দলে দলে আমার দ্বারে হাজীর হইতেন ।
আগেই বলিয়াছি , আমি ছিলাম মস্ত লিখক । তাহাবৎ লিখনি প্রত্যাশীদের বসাইয়া রাখিয়াই তাৎক্ষনিক তাহাদের চাহিদা মাফিক লিখা লিখিয়া তাহাদের সম্প্রদান করিতাম । তাহারাও হাস্য বদনে ফিরিয়া যাইতো ।
পাশের বাড়ীতে এক নারী সমাবেশে আমার এক ভগিনী হাজির ছিল । (তার মুখ নিঃসৃত) হাজেরিনে মজলিশে একথা সেকথার পর এক মহিলা আক্ষেপ করিয়া আমার এক জেঠাইমাকে বলিতেছেন ,''অবা আঁর হোলা বিদেশতুন কোন টেঁআ হইসা হাঁড়ায় না ,কত কষ্ট করিয়ের ।''
কিরূপ পরামর্শ প্রদান করিবেন তাহা যেন জেঠাইমার জিহ্বার অগ্রভাগেই মৌজুদ ছিল ।
-'' আরে কি কস টেঁআ হাডায় না , অমুকের হোলার আতে চিড়ি লেয়া ,দেখবি কেমনে টেঁআ আইয়ে ।''
বলা বাহুল্য বোধ করিতেছি যে ''অমুকের হোলা''টাই এই অধম লিখক ।
এতক্ষনে পাঠককুলের গোচরে আসিয়াছে যে , আমি কি টাইফের লিখক ছিলাম ।
সেকালে গ্রামে পত্র লিখকের বড়ই আকাল ছিল । যাহারা চিঠি পত্র লিখিত বা পড়িতে পারিত তাহাদের রীতিমত ''মাস্টর'' বলা হইত ।
বয়সে পিচ্ছি ছিলাম বলিয়া আমি ''মাস্টর'' নামটা ফাটাইতে পারিলাম না , আফসোস !
প্রোষিতবর্তিকা এক ভ্রাতৃবধূ অনেকদিন ধরিয়া এক খানি পত্র লিখিয়া দিবার তরে আমার পিছু লইয়াছে ।
আমি আজ,কাল,পরশু বলিয়া ''দাম'' দেখাইতেছিলাম ।
একদা বিদ্যালয় গমন প্রাক্বালে ভ্রাতৃবধূটি আমার হস্তে এক খানা ''ইনকিলাব'' ধরাইয়া দিলো । সাথে মধ্যপ্রাচ্যের ডাক মাশুল আট টাকা ।
ভাবনায় পড়িলাম এই পত্র উনি কাহার হস্থে লিখাইলেন । পাশের বাড়ীতে এক নববধূর আগমন ঘটিয়াছে । দুই তিন কেলাশ পাশ দিয়াছে বলিয়াও শুনিয়াছিলাম । এই বধূটি আমার প্রতিধন্ধি হইয়া উঠিতেছে কিনা বুঝিতেচিলাম না ।
পোষ্টাপিসে গমনান্তে ''জেব'' হইতে পত্র খানা হস্তে নিয়া দেখি , এর জোড়া মুখ আলগা হইয়া আছে । ভাত দিয়া আঠা কর্ম সারানোয় এমনটি ঘটিয়া থাকিতে পারে ।
অনধিকার চর্চা বশতঃ ( ঠিক অনধিকার চর্চাও নহে ,প্রতিধন্ধি , প্রতিপক্ষ সম্পর্কে সম্যক ধারনা লাভার্থে টুকটাক গোয়েন্দাগিরির প্রয়োজনীয়তা রহিয়াছে) পত্রের মুখান্মেশ ঘটাইয়া দেখি , ভিতরে এক খানা সাদা কাগজ , কয়েক গাছি লম্বা চুল আর কিছু তিব্বত পাউডার ।
আহারে ! আহারে !!
ইশকে খত লিখিবার বেলায় আমার খ্যাতি সম্পর্কেও বিদগ্ধ প্রেমিকরা অবগত ছিল । ভ্রাতুষ্পুত্র মিন্টু ( আমরা সমবয়সী) ছিল আমার বান্ধা কাস্টমার । চা, বিস্কুট বা বিড়িতে দুই তিন টান জাতীয় কিঞ্চিৎ সন্মানির বিনিময়ে সে আমার কাছ হইতে অনেক লিখা হাতাইয়া নিয়াছে ।
তাহার হস্ত লিখা ছিল জীবন্ত ''হিব্রু লিপি'' , মহেঞ্জোদারোতে প্রাপ্ত প্রাচীন শিলালিপির সাথে যার কিঞ্চিৎ মিল ছিল ।
তাহার কিয়ৎ শিক্ষিত প্রণয়িনীরা হিব্রু পাঠে পারঙ্গম ছিল না বিধায় তাহারা এই লিপির মর্মোদ্ধার করিতে ব্যার্থ ছিল । তদ্দরুন মিন্টুও হালে পানি পাইতেছিল না ।
অগত্যা সে কোনরূপ কপি ব্যাতিরেকে আমার লিখা প্রেমপত্র খানা তাহার ১৩ নম্বর প্রেমিকার বইয়ের অভ্যন্তরে সমর্পণ করিয়াছিল ।
ইহা লইয়া বিদ্যালয়ে মহা হুলুস্থুল !
এই হস্তলিপি কাহার তাহা নির্ণয়ে প্রধান শিক্ষক উমেশবাবুকে শার্লখ হোমস হইবার প্রয়োজন ছিল না ।
অনেক দিবস পর একটা ''ছেঁচা'' কর্মের উপলক্ষ পাইয়া তিনি ঈষৎ পুলকিত । সাহাব উদ্দিনকে ''খাজুরের ডাণ্ডা'' আনিবার নির্দেশ দান করিয়া তিনি দুই খানা আবুল বিড়ি ছাইয়ে রূপান্তর ঘটাইলেন । ( সেকালে ধূমপান এখনকার মত এত আপত্তিকর বিষয় হইয়া উঠেনি , অফিস ,আদালত,শ্রেনিকক্ষে এর যথেচ্ছ ব্যাবহার ছিল ।)
সাহাব উদ্দিন অনেক দিন ধরিয়া এরূপ একখান পত্র লিখিয়া দিবার জন্য আমার শরন নিয়া আছে । এখন পর্যন্ত চা বিড়ির দর্শন ঘটেনাই দেখিয়া আমি নানাহ বাহানায় তাহাকে ৩ মাস ঘুরাইয়াছি ।
এইক্ষণে তাহার শোধ লইবার একটা মওকা আসিয়া তাহার হস্তে ধরা দিবে ,এইটা তাহার কল্পনারও অতীত ছিল ।
''মওকা''র সবর্চ্ছো ব্যাবহার নিশ্চিত কল্পে সে খর্জূর বৃক্ষের সবচাইতে মোটা ডাণ্ডাগুলিই ভাঙ্গিয়া আনিয়াছে । তাহার ভাব দেখিয়া মনে হইতেছিল , আস্ত খর্জূর বৃক্ষটি ভাঙ্গিয়া আনিতে পারিলেই সে অধিক তৃপ্ত হইতো ।
ফিসফাস করিয়া সেলিমের সাথে পরামর্শ করিলাম । সে ধন্বন্তরি এক উপায় বাতলাইয়া দিল । সেলিম একবার ধূম্র পান করিতে যাইয়া ধরা পরিয়াছিল । এই তরীকা প্রয়োগ করিয়া পূর্বে সে উমেশ বাবুর বিড়ির আদালত হইতে পিষ্ঠ অক্ষত রাখিতে সফল হইয়াছিল ।
শিক্ষক প্রবর ধুম্রএস্তেমাল করিয়া শরীরে পূর্ণ শক্তি সঞ্চয় করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইলেন ।
সেলিম ছিল ''চিকন'' কর্মে মহাজ্ঞ্যানী । সুতরাং ''মহাজ্ঞ্যানী মহাজন, যে পথে করেছে গমন --'' আমিও সেই পথে ক্লাসের পেছনের ভাঙ্গা বেড়া দিয়া ''খিচ্ছা'' দৌড়, একেবারে বীরের মত পলায়ন ।
সেই দিবস হইতে লিখক তাহার সাহিত্য কর্মের প্রেমপত্র শাখা হইতে অবসর লইয়াছিল ।
এক সময়ে প্রবাসীরা দেশের একখানা পত্রের জন্য অধীর অপেক্ষায় থাকিতো , দেশের স্বজনরাও অনুরূপ । সেই দিন বহু আগে গত হইয়াছে । প্রিয়জনের মনের আকুতি মিশানো সেই চিঠি সাহিত্য এখন বিলুপ্ত । সে স্থান দখলে লইয়াছে মোবাইল ফোন , ইন্টারনেট ।
অনেক সময় শেফালী ঘোষের একখান সঙ্গীত মনে পড়ে -
''ঘৃত,মধু,দুধের সর ,তুইলা রাখছি শিকার পর ,
আইসা বন্ধু খাইবা তুমি বসিয়া নিরলেরে ,
যারে যা চিঠি লেইখা দিলাম সোনাবন্ধুর নামেরে ----''
কিংবা মহাদেব সাহার সেই বিখ্যাত কবিতা - চিঠি দিও ।
করুণা করে হলেও চিঠি দিও,
খামে ভরে তুলে দিও আঙ্গুলের মিহিন সেলাই
ভুল বানানেও লিখো প্রিয়, বেশি হলে কেটে ফেলো তাও,
এটুকু সামান্য দাবি, চিঠি দিও,
আহ ! বড় নস্টালজিক হইয়া পড়ি ।
রবি বাবুর সাথে সুর মিলাই ,''পুরনো সেই দিনের কথা ভুলবো কিরে হায় -----।''
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই আগস্ট, ২০১৫ দুপুর ১:৩৬