দৈন্দদিন নগর জীবনে যানবাহনে যাতায়াতের পদ্ধতিতে আমার মতো লক্ষ লক্ষ যাত্রী এক নিদারুণ যন্ত্রণা ভোগ করতেছেন প্রতিনিয়তই। এই যন্ত্রণাদেয়া পদ্ধতির মধ্যে একটি হলো ০১। লোকাল বাস সার্ভিস, এবং অন্যটি হলো ০২। সিটিং বাস সার্ভিস। যদিও এর পুরো সিস্টেমটাই মালিক-শ্রমিক কর্তৃপক্ষের মনগড়া!
গত বছর (২০১৭ সালে) বিআরটিএ এবং বাস মালিক সমিতির যৌথ উদ্দেগ্যে সকল রুটের বাসকে লোকাল সার্ভিস হিসেবে ঘোষণা করা হলো। সেই ঘোষনার পরিপ্রেক্ষিতে বেশ কিছুদিন আমরা লোকাল যাত্রী হিসেবে সিটির সকল বাসেই ভ্রমণ করেছি এবং কিছুটা সস্তা ভাড়ায় নির্দিষ্ট গন্ত্যব্যে যাওয়া-আসা করতে পেরেছি। মূলত সিটির সকল বাস সার্ভিসকে লোকাল সার্ভিস ঘোষণা করার কারণ হচ্ছে সকল যায়গা থেকে সকল যাত্রী তার নিজস্ব গন্তব্যে নির্দিদ্বায় যাতে যাতায়াত করতে পারে তা নিশ্চিত করার জন্যই। তারপর হঠাৎ একদিন আবার তা ঘোষণা দিয়ে ১৫ দিনের জন্য বন্ধ করে পূর্বের ন্যায় সিটিং সার্ভিস চালু করা হলো। যদিও কর্তৃপক্ষের বেধে দেয়া ঘোষণা আজও সেই ১৫ দিন শেষ হয়নি!
তাতে করে কি লাভ হয়েছে কর্তৃপক্ষের জানেন কি?
মূলত সিটির সকল বাস সার্ভিসকে লোকাল ঘোষণা করে পরবর্তীতে আবার সেই লোকাল বাসগুলোকে সিটিং সার্ভিস দেখিয়ে সার্ভিস চালু রাখাতে বাস মালিক সমিতি এবং বিআরটিএ এর উভয়ের মুনাফা বেড়েছে। যেমনঃ মিরপুর ১২ থেকে বিহঙ্গ গাড়ীগুলো গুলশান পর্যন্ত সিটিং সার্ভিস চালু অবস্থায় ভাড়া আদায় করে জনপ্রতি ২০টাকা করে। আবার সেই বিহঙ্গ গাড়ী যখন লোকাল হিসেবে ঘোষনা করা হলো ভাড়া আদায় করতো ১৫টাকা করে। অথচ আবার যখন সেই লোকাল সার্ভিসকে সিটিং সার্ভিস বলে ঘোষণা করা হলো, দেখা গেলো পূর্বের ন্যায় গাড়ী লোকাল হচ্ছে কিন্তু ভাড়া আদায় করা হচ্ছে ২০টাকা করে। যা এখন পর্যন্ত বলবৎ আছে। আমার মনে হয় সিটির অন্যান্য রুটেও একই চিত্র দেখা যাবে।
যতদ্দুর বুঝতে পারি এর প্রতিবাদ করে কোনো লাভ কিংবা মুনাফা আশা করতে পারিনা। বরং কষ্ট করে গাড়ীতে আসা যাওয়া করবো কিন্তু ভাড়া দিবো আরামদায়ক গাড়ীর, সেটা সত্যি খুবই বিরক্তিকর বটে। আর এ নিয়ে প্রতিদিন বাদানুবাদের শেষ থাকেনা। আর এর একটি সুন্দর ও সঠিক বিহীত আশা করছি। বিশেষ করে যারা এর দায়িত্বে রয়েছেন তাদের কাছে।
এখন এই লোকাল গাড়ীকে সিটিং কিংবা সিটিং গাড়ী লোকাল বলে যাত্রীর নিকট থেকে বাড়তি ভাড়া আদায় করার যে রেওয়াজ শুরু হয়েছে তা বন্ধ করার জন্য আমি ব্যক্তিগত ভাবে ট্রাফিক ডিপার্টমেন্টের দৃষ্টি কামনা করছি। আমি জানি, এক্ষেত্রে যাত্রীর সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে বাসের মুনাফার সাথে জড়িত কোনো ব্যক্তি কিংবা সংগঠন এই সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসবে না। যদি ট্রাফিক ডিপার্টমেন্ট এই সমস্যা সমাধানে ভুমিকা রাখে তাহলেই কেবল এই সমস্যা সিটি সার্ভিস থেকে একেবারে স্বমূলে নিপাত হতে পারে।
বাংলাদেশ ট্রাফিক পুলিশের ডিআইজিকে (বিভিন্ন সিটির অধীনে) অনুরোধক্রমেঃ
০১। আপনারা সকল সিটির সকল গাড়ীর তালিকা বুঝে নিন। কোন গাড়ীটি লোকাল হিসেবে চলে আর কোনটি সিটিং।
০২। লোকাল গাড়ীর ব্যাপারে প্রতিটি ষ্টেশন নির্দিষ্ট করে দিন এবং ড্রাইভারকে লেন মেনে চলতে বাধ্য করুন। যাতে করে প্রতিটি নির্দিষ্ট ষ্টেশনে যাত্রী উঠানো নামানো সহজ করা যায়। আর যাত্রী গাড়ী থেকে নামার সময় অবশ্যই সেভ জোনে গাড়ী পার্কিং এর সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। যাতে করে যাত্রী সাধারণের রাস্তায় নেমে হেঁটে যাওয়া ঝুঁকিমুক্ত হয়। রাস্তার মাঝঁখানে যাত্রী উঠানো-নামানো যাবে না। এর মাধ্যমে কিছু হলেও যানযট কমে যাবে বলে মনে করি। সব সময় এসব তদারকি করুন।
০৩। যাত্রা শুরু হওয়ার পর প্রতিটি স্টপেজ থেকে ভাড়া নির্দিষ্ট করে দিন। লোকাল এবং সিটিং উভয় ভাড়ার তালিকা প্রকাশ করুন।
০৪। সিটিং সার্ভিস এর ক্ষেত্রে গাড়ীর যাত্রা (শুরুর) অবস্থান থেকে নির্দিষ্ট গন্তব্যে যাওয়া পর্যন্ত প্রতিটি গাড়ীতে নজর রাখুন, যেনো প্রতিটি সিটের বিনিময়ে একজন যাত্রীই শুধু বহন করা হয়। যাত্রী না পেলে গাড়ী খালি যাবে কিন্তু অতিরিক্তি যাত্রী কোনো ভাবেই বহন করা যাবে না। সেটা গাড়ীর যাত্রা শুরু হওয়ার পর থেকেই শেষ পর্যন্তই নজরদারীতে রাখতে হবে।
০৫। কোনো ভাবেই দাঁড়িয়ে যাত্রী বহন করা যাবে না। যদি সিটিং সার্ভিস গুলোতে দাঁড়িয়ে যাত্রী বহন করতে দেখা যায়, তাহলে অতি দ্রুত ট্রাফিক আইনে ব্যবস্থা গ্রহণ করুন। প্রয়োজন হলে নতুন করে সুনির্দিষ্ট আইন তৈরি করুন।
০৬। দাঁড়িয়ে থাকা প্রতি যাত্রীরই জরিমানা করিয়ে দিন। উদাহরণ স্বরুপ বলছি, যদি গাড়ীটি মিরপুর-বাড্ডা পর্যন্ত যায় তবে সেক্ষেত্রে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পুরো ভাড়ার বিপরীতে ৩গুন আদায় করুন। যাত্রী যেখানেই নামুক, সেই দিকে নজর না দিয়ে বরং শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ভাড়া আদায় করা হউক। যেমনঃ মিরপুর-বাড্ডা পর্যন্ত ভাড়া হলো-৩০টাকা। জরিমানা করুন ৯০টাকা। এভাবে প্রতিটি রুট অনুসরণ করে তদারকি করুন।
০৭। সাথে সাথে ড্রাইবার এবং হেল্পারের পুরো দিনের উপরি আয়সহ মুজুরীটাও জরিমানা করে দিন। যেমন, ড্রাইভারের প্রতিদিনের হাজিরা (শহর কেন্দ্রিক প্রতি ট্রিপে প্রকার ভেদে- ২৫০/৩০০/৩৫০ এবং হেল্পারের ১৫০/২০০/২৫০ টাকা এবং প্রত্যেকের উপরি আয় আরো গড়ে ২৫০/১৫০ টাকা করে) ন্যুনতম ৭৫০ + ২৫০ = ১০০০ টাকা। হেল্পারের ৪৫০ + ১৫০ = ৬০০ টাকা রুট ভেদে কার্যকর হবে (আসা-যাওয়া গড়ে ৩ ট্রিপ হিসেবে)।
০৮। গাড়ীর মালিকের ৩ দিনের জমার সমান টাকা জরিমানা করে দিন। যদি প্রতিদিন জমা ২৫০০ টাকা হয় সে হিসেবে ৭৫০০ টাকা জরিমানা করিয়ে দিতে হবে।
০৯। ৭ দিনের জন্য ড্রাইভারের লাইসেন্স বাতিল/স্থগিত করে দিন। এবং
১০। কোনো ভাবেই উল্টোপথে গাড়ী টার্ণ করা যাবে না কিংবা উল্টোপথে চালানো যাবে না। এ অবস্থায় গাড়ী জব্দসহ ড্রাইভার ও মালিকের উভয়ের জরিমানা নিশ্চিত করতে হবে এবং নির্দিষ্ট দিন পর্যন্ত ঐ গাড়ী রাস্তায় চলতে পারবে না মর্মে জব্দ থাকবে। যে কয়দিন জব্দ তালিকায় গাড়ীটি রাখা হবে ঠিক সেই কয়দিন নির্দিষ্ট হারে গাড়ীর জরিমানাও গুনতে হবে মালিককে।
এছাড়া আরো কয়েকটি বাড়তি সতর্কতা মেনে চলা সবার জন্য খুবই জরুরী। ট্রাফিক আইনে এই নির্দেশনাগুলো উপস্থিত থাকা দরকার বলে মনে করি।
নির্দেশনাগুলো নিম্নরুপঃ
০১। সাধারণ পথচারীদের যত্রতত্র দিয়ে রাস্তা পারাপার হওয়া যাবে না যদি ফুটওভার ব্রিজ না থাকে তবে জেব্রা ক্রসিং দিয়ে পারাপার হতে বাধ্য করুন। এবং পথচারী পারাপারে ট্রাফিক সিগন্যাল না পড়া পর্যন্ত পথচারীকে অপেক্ষা করতে কিংবা মেনে চলতে বাধ্য করুন। এর জন্য পুলিশ মাইকিং করে পথচারীদেরকে সহায়তা অভ্যাহত রাখা খুবই জরুরী।
০২। বাসের ছাদে অতিরিক্ত যাত্রী বহন করা যাবে না যদিও সেই বাস লোকাল হয়।
০৩। বাসের গতি সীমিত রাখার পরামর্শ দিন এবং ড্রাইভারের কাগজপত্র পরীক্ষাসহ গাড়ীর গতিসীমা নিয়ন্ত্রণে বাসের পিটনেস পরীক্ষা করুন প্রতিনিয়তই।
০৪। রাস্তায় চলমান অবস্থায় নিজ গাড়ীর সাথে অন্য গাড়ীর প্রতিযোগিতা কখনোই করা যাবে না। যিনি আগে আছেন, তাকে আগে যেতে দিন মর্মে নির্দেশ প্রদান করুন। এই রকম মানসিকতা ও অনাকাঙ্খিত দুর্ঘটনার জন্য অনেকাংশে দায়ী। এবং
০৫। প্রতিটি ড্রাইভার গাড়ীতে ধুমপান মুক্ত থাকবেন অন্যথায় যাত্রীর অভিযোগের ভিত্তিতে ট্রাফিক আইনে জরিমানার ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
এই শর্তগুলো ট্রাফিক বিভাগ থেকে নিয়মিত কিছুদিন প্রচার করুন (সকল টিভি চ্যানেল সহ মিড়িয়ার মাধ্যমে) এবং প্রয়োজনে নাগরিকদের বুঝার সুবির্ধাতে লিপলেট বিতরণ করুন। যাতে করে নগরে বসবাসকারী সবাই ট্রাফিক বিভাগ সম্পর্কে সুন্দর ধারণা পোষণ করতে পারেন। এবং যাত্রীসহ নগরের বসবাসকারীরা যাতে কোনো প্রকার অনাকাঙ্খিত সমস্যার মুখোমুখি পড়তে না হয়, সে ব্যাপারে সতর্ক করে দিন।
উপরে উল্লেখিত ১০ টি নিয়ম এবং ০৫ টি নির্দেশনা যদি পরিপূর্ণ ভাবে ট্রাফিক পালন করে তাহলে আমি আশা করছি, যাত্রী পথচারীসহ সকল গাড়ীর ড্রাইবার হেল্পার সবাই সচেতন হয়ে যাবে। কারণ, শেষের দিকে গাড়ীতে ওঠা যাত্রী নিজেই যখন বুঝতে পারবেন যে তিনি সিটিং গাড়ীতে অতিরিক্ত যাত্রী হিসেবে ভ্রমণ করছেন তখনই তিনি নিজ উদ্দেগ্যে বাস থেকে নেমে যাবেন। এমনকি আমরা মাঝে মাঝে পথে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিদেরকে গাড়ীতে ধাক্কা-ধাক্কি করে উঠতে দেখি। এটা রাস্তায় দুর্ঘটনার আরো একটি কারন হতে পারে। যদি ট্রাফিক বিভাগ উল্লেখিত এই ১০ টি নিয়ম এবং ০৫ টি নির্দেশনা পরিপূর্ণ ভাবে পালনে সবাইকে বাধ্য করেন তবেই হয়তো রাস্তায় চলাফেরা এবং গাড়ীতে ভ্রমণ সবার জন্য অনেকাংশে নিরাপদ হয়ে উঠবে। আর এরকম অনিয়ম দেখলেই অভিযানের মাধ্যমে আদায়কৃত অর্থে সরকারেরও রাজস্ব বেড়ে যাবে।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই মে, ২০১৮ দুপুর ১:০২