somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বিজয়-বিশোধন

১৮ ই মার্চ, ২০১৬ রাত ১২:৪৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

প্রিয় সুধী, আমাদের মাঝে এইমাত্র উপস্থিত হয়েছেন উপজেলা চেয়ারম্যান জনাব আব্দুল আহাদ সাহেব। মঞ্চে আসন গ্রহণ করার জন্য তাকে বিনীত অনুরোধ জানাচ্ছি।
সুকণ্ঠি শারমিন সুলতানার স্বাগত সম্ভাষণে প্রধান অতিথি মৃদুমধুর হাসেন। হাত নাড়েন অন্যান্য অভ্যাগত অতিথিদের উদ্দেশ্যে। মুক্তিযোদ্ধা মইনুল হাছানের ডান পাশের আসনে গিয়ে বসেন। টাইপিন ঠিক করতে করতে আড়চোখে তাকান পরের খালি আসনটির দিকে। এটি ইউএনও সাবের জন্য নির্ধারিত।
শরীরচর্চা শিক শারমিন সুলতানা মাইকে ঘোষণা করেন, এবার আপনাদের সামনে বক্তব্য পেশ করবে শৈবাল আদিত্য, দশম শ্রেণি, বিজ্ঞান শাখা, রোল নং এক।
দৃপ্তপায়ে এগিয়ে আসে শৈবাল। মাউথপিসে ফুঁ দিয়ে শানিত দৃষ্টিতে তাকায় শ্রোতাদের দিকে। যথাযথ সম্বোধনের পর নির্ভয়ে বক্তৃতা শুরু করে সাবলীল কণ্ঠস্বরে।
দীর্ঘ তেইশ বছরের আন্দোলন আর নয় মাসের সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে আমরা পেলাম স্বাধীনতা। এক কোটিরও অধিক লোকের গৃহত্যাগ, আড়াই লাখ নারীর সম্ভ্রম, তিরিশ লাখ মানুষের প্রাণের বিনিময়ে এ স্বাধীনতা অর্জিত। স্বাধীনতার জন্য এত অল্প সময়ে এত বেশি ত্যাগস্বীকার অন্য কোনো জাতির করতে হয়নি। টানা পঁচিশ বছর সংগ্রামের পর স্বাধীন হয়েছে ভিয়েতনাম। প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে দশ লাখ মানুষ। কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া, চীন, দণি আফ্রিকাসহ লাতিন আমেরিকার বেশ কিছু দেশ স্বাধীনতার সংগ্রাম করেছে।...
ুদে বক্তার ঝরঝরে বাচন শুনে মুগ্ধ হন প্রধান শিক। ডান কাতে মুখ ঘুরিয়ে মইনুল হাছানকে ফিসফিসিয়ে বলেন, আপনার নাতি বড় নেতা হবে একদিন। এই ইশকুলের মুখ উজ্জ্বল করবে।
দোয়া রাখবেন ফজর আলি সাব, বলে মইনুল হাছান কান পাতেন শৈবালের তেজি কথামালায়।
পাকিস্তানি নরপশুরা বুঝে গেল বাঙলার স্বাধীনতাকে আর দমিয়ে রাখা যাবে না। তখন এরা এই জাতিকে মেধাশূন্য করতে চাইল যাতে আমরা অর্জিত স্বাধীনতা না রা করতে পারি। এদের টার্গেট তখন এ দেশের খ্যাতনামা শিাবিদ, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, চিকিৎসক, আইনজীবী, বিজ্ঞানী প্রমুখ বুদ্ধিজীবীগণ। বিজয়ের মাত্র দু-দিন আগে তাদের হত্যা করল পাকসেনারা। এই নৃশংস কাজের নীল নকশা প্রণয়ন করে দিল আমাদের দেশের কিছু কুলাঙ্গার। এরা আল বদর...
এই ইঁচড়ে পাকা ছেলেটা কার? নড়েচড়ে বসে কাউকে উদ্দেশ্য না করে রাগত স্বরে জিগ্যেস করেন আব্দুল আহাদ।
আজকের এই অনুষ্ঠান উপস্থাপিকার, দৃঢ কণ্ঠে জবাব দেন মইনুল হাছান। মঞ্চে দাঁড়ানো মেয়েটির দিকে তাকিয়ে নস্টালজিক হয়ে পড়েন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা।
শারমিন তখন মাতৃগর্ভের অন্ধকারে। বঙ্গবন্ধুর ডাকে স্বাধীনতার সংগ্রাম শুরু হয়ে গেছে। দলে দলে লোকজন ঝাঁপিয়ে পড়ছে মুক্তিযুদ্ধে। যুবক মইনুলের রক্তের ভেতর খেলা করে মুক্তির উন্মাদনা। হৃদয়তন্ত্রীতে বাজে যুদ্ধের দামামা। কোনো কাজে মন বসে না তাঁর। বন্ধুদের সঙ্গে পরামর্শ করেন তিনি। ওদের কেউ একজন রেগেমেগে বলে ওঠে, ভোঁদাই কোথাকার! বউয়ের এই চূড়ান্ত অবস্থায় কেউ কি যুদ্ধে যায়? অনাগত সন্তানের অমঙ্গল আশংকায় পিছপা হন তিনি। কিন্তু যুদ্ধ যুদ্ধ খেলার নেশায় প্রতিমুহূর্ত বিভোর থাকেন। শারমিনের মাকে বাপের বাড়ি চলে যেতে রাজি করান বুঝিয়ে শুনিয়ে। একদিন লোক মারফত জরুরি ডেকে এনে শ্বশুরের সঙ্গে নৌকায় তুলে দেন নয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে। এদিকে পাকিস্তানি আর্মি নেমে পড়েছে চারদিকে। ঘরবাড়ি, দোকানপাট, শিাপ্রতিষ্ঠান জ্বালিয়ে দিচ্ছে। সামনে যাকে পায় তাকেই হত্যা করে নির্বিচারে। নৌকা দেখলেই থামিয়ে চেক করে ভেতরে কী আছে। না থামলে গুলি ছোড়ে দূর থেকে। মইনুল পরে জানতে পারেন তার স্ত্রী জলে ডুবে সসম্মানে মরতে চেয়েছিলেন, নরপশুদের হাতে লাঞ্চিত না হয়ে। কিন্তু পেটের সন্তানের কথা ভেবে বিরত থাকেন। ভাগ্যক্রমে পৌঁছুতে পারেন নিরাপদে গন্তব্যে। সপ্তাহখানেক পর শারমিনকে জন্ম দিয়ে অতিরিক্ত রক্তরণে মারা যান তিনি। স্ত্রীর সঙ্গে আর দেখা হয়নি মুক্তিযোদ্ধা মইনুল হাছানের।
কষ্টস্মৃতি সাময়িক ভুলে থাকতে মইনুল হাছান মনোনিবেশ করেন শৈবাল আদিত্যর উদ্দীপ্ত ভাষণে।
রাজাকারদের বাঁচাতে যুদ্ধাপরাধ আইন বাতিল হলো। স্বাধীনতাবিরোধীদের গাড়িতে স্বাধীন দেশের পতাকা উড়ল। স্বপ্নাহত হলো মুক্তিযোদ্ধারা। কিছুদিন আগে তাদের মনে দেখা দিল আশার ঝলকানি। স্বাধীনতার চার দশক পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকার্য শুরু হয়েছে। সর্বোচ্চ শাস্তিও ঘোষণা করেছে ট্রাইব্যুনাল। রায় কবে কার্যকর হবে কিংবা আদৌ হবে কিনা কে জানে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাঋদ্ধ তরুণসমাজ কোনো বাহানা মেনে নেবে না। ট্রাইব্যুনালের রায় মনঃপুত না হলে ওরা যেমন প্রতিবাদে ফুঁসে ওঠে তেমনি...
শাহবাগে স্লোগানরত শৈবালের ছবিটা পত্রিকায় দেখেছিলাম, মুক্তিযোদ্ধার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলেন প্রধান শিক ফজর আলি।
সেখানে কী কাণ্ডটাই না করেছিল সে! আলপিনে আঙুল ফুটো করে রক্ত দিয়ে গেঞ্জির ওপর লিখে ফেলল― রাজাকারমুক্ত বাঙলা চাই। চুপে চুপে কথাগুলো বলে মইনুল হাছান তির্যক দৃষ্টিতে তাকান আব্দুল আহাদের দিকে। চেয়ারম্যান সাব বসে আছেন বেজার মুখে। অসহ্য লাগছে নির্ভীক শৈবালের দুর্বিনীত বচন।
আলশামস, আলমুজাহিদ, আলবদর― সকল রাজাকারের তালিকা এলাকাভিত্তিক প্রকাশ করা উচিত। এরা সবাই যুদ্ধাপরাধী, দেশমাতৃকার চিরশত্র“। ঐতিহাসিকভাবেই এদের অপরাধ স্বীকৃত। শুধু তালিকা দেখে স্যাপ্রমাণ ছাড়াই এদের শাস্তি দেওয়া যেতে পারে। যেসব রাজাকারের নাম তালিকা থেকে বাদ পড়েছে বা কাটা গেছে এদের ব্যাপারেও নতুন করে ভাবা দরকার। প্রয়োজনে আঞ্চলিক ইতিহাস ঘেঁটে রাজাকারদের খুঁজে বের করতে হবে। মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় যদি সংযোজন চলে, রাজাকারদের েেত্র তা প্রযোজ্য হবে না কেন?
আক্রমণাত্মক প্রশ্নটি আহত করে আব্দুল আহাদকে। কারণ তিনি শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন। রাজাকারের তালিকায় নাম না থাকায় জিন্দেগি পার করছেন বহাল তবিয়তে। অর্থবল ও বাহুবল দুটোই আছে তার। ভোটযুদ্ধে এসব খুবই কাজে লাগে। তাই মুক্তিযোদ্ধা এক প্রার্থীকে পরাজিত করে তিনি উপজেলা চেয়ারম্যান হতে পেরেছিলেন। বেশ ক’টি সামাজিক সংগঠন ও শিাপ্রতিষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকও তিনি। তবে মুক্তিযোদ্ধা মইনুল হাছানের বিরোধিতার কারণে মুক্তিনগর উচ্চ বিদ্যালয়ের সভাপতি মনোনীত হতে তাকে বেশ বেগ পেতে হলো। ম্যানেজিং কমিটির সদস্যদের প্রলোভন দেখিয়ে, প্রধান শিকের ওপর প্রভাব খাটিয়ে তিনি শেষতক সফলকাম হতে পারেন। আসলে তিনি যা চান তা করেই ছাড়েন। মুক্তিযোদ্ধাকে তিনি পুরস্কার দিচ্ছেন এমন একটি ছবি দৈনিকের পাতায় দেখার সখ বহু দিনের। আজ তা পূরণ হতে চলছে বোধহয়। এজন্য তাকে যথেষ্ট কাঠখড় পুড়াতে হয়েছে। গাদ্দারি করে আজকের মুক্তিযোদ্ধা-সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে ইউএনও চলে না এলেই হয়। আশঙ্কিত আব্দুল আহাদ চকিত দৃষ্টি ফেলেন পাশের আসনে বসা মুক্তিযোদ্ধার ওপর। মইনুল হাছান তন্ময় হয়ে রয়েছেন নাতির নাতিদীর্ঘ বক্তৃতায়।
রাজনীতিতে যুদ্ধাপরাধীদের পুনর্বাসন, অপশক্তিকে নিয়ে সরকার গঠন, জোট গঠন সত্যিই বিস্ময়কর, লজ্জাকর তো বটেই। তবে সুখের ব্যাপার রাজাকারদের দলটির নিবন্ধন বাতিল করেছে নির্বাচন কমিশন। কিন্তু পরিতাপের বিষয় এরা বাঙলার মাটিতে আজো জ্বালাও-পোড়াও-ভাঙচুর-বিস্ফোরণ চালিয়ে যেতে পারছে। মাঝেমধ্যে ইচ্ছে করে একাই এসব সারমেয় শাবকদের শায়েস্তা করে ফেলি। সেই মতা যে নেই আমার। কিন্তু ধিক্কার তো জানাতে পারি। আজ এই মঞ্চে দাঁড়িয়ে থুতু ছিটাই সকল রাজাকারের মুখে।
আঁতকে ওঠেন আব্দুল আহাদ। থুতুটা যেন তার শরীরে এসে পড়েছে। বেয়াদব কোথাকার! অস্ফুট স্বরে উচ্চারণ করেন চেয়ারম্যান। কঠিন চোখে তাকিয়ে ফজর আলিকে প্রশ্ন করেন, এই বদমাশটাকে এলাউ করলেন যে? প্রধান শিক নিরুত্তর। আগের চাইতে অধিক মনোযোগী হন প্রিয় ছাত্রের বাগ্মিতায়।
একসময় আমরা তুর্কি, মোগল, ইংরেজ ও পাকিস্তানিদের দ্বারা শাসিত-শোষিত ও নিপীড়িত হয়েছি। স্বাধীনতালাভের পরও আমরা হয়তো স্বাধীনতার যোগ্য হয়ে উঠতে পারিনি। তাই মতার রদবদলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বদলে যায়। পাঠ্যপুস্তকে বিকৃতি ঘটে তথ্য-উপাত্তের। এই অপপ্রয়াস স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য সত্যিই অবমাননার। দলাদলির ঊর্ধ্বে থেকে স্বাধীনতার সঠিক স্বরূপ সত্যনিষ্ঠতায় তুলে ধরতে হবে নতুন প্রজন্মের কাছে। এ মহান ব্রতে সর্বাগ্রে এগিয়ে আসতে হবে...
রাজাকার চেয়ারম্যানের ছটফটানি আঁচ করতে পেরে শারমিন সুলতানা পেছন থেকে বলেন, তাড়াতাড়ি শেষ কর। শৈবাল অগ্রসর হতে থাকে উপসংহারের দিকে।
রাজাকার বাদে প্রায় সবাই স্বাধীনতার পইে ছিল। তারা মুক্তিযুদ্ধে কমবেশি অবদান রেখেছে প্রত্য বা পরোভাবে। যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে প্রাণিত-শানিত করলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের আহার-আশ্রয় দিলেন তারাও তো যোদ্ধা। আর একটা কথা, তালিকাভূক্ত মুক্তিযোদ্ধারা সরকারি ভাতা, চাকরিতে সন্তানসন্ততিদের কোটা প্রভৃতি সুযোগ সুবিধা পান কিন্তু যারা অকাতরে প্রাণ দিলেন, সম্ভ্রম হারালেন তারা বা তাদের পরিবার কী পেলেন? এই প্রশ্নটা আপনাদের সকলের কাছে রেখে গেলাম। পরিশেষে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা আর রাজাকারদের প্রতি বিশুদ্ধ ঘৃণা জানিয়ে আমার বক্তব্য এখানেই শেষ করছি। জয় বাংলা। জয় জনতা।
মুক্তিনগর উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠ শ্রোতাদের মুহুর্মুহু করতালিতে মুখরিত। মাউথপিস মুখের কাছে ধরে মিটিমিটি হাসছেন শারমিন সুলতানা। তার ড্রাফট করা কথাগুলো চমৎকারভাবে বলতে পেরেছে শৈবাল। গর্বিত ভঙ্গিতে ছেলেকে ধন্যবাদ জানিয়ে পরবর্তী বক্তার নাম ঘোষণা করেন তিনি।
মহান বিজয়ের মাসে মুক্তিনগর উচ্চ বিদ্যালয় কর্তৃক আয়োজিত মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক আলোচনা ও মুক্তিযোদ্ধা-সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের সম্মানিত শ্রোতৃবর্গ, এবার আপনাদের সামনে আসছেন আজকের প্রধান আকর্ষণ বীর মুক্তিযোদ্ধা মইনুল হাছান সাহেব। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণমূলক বক্তব্য পেশ করার জন্য তাকে সনির্বন্ধ অনুরোধ জ্ঞাপন করছি।
...আমাদের দলে শৈবালের বয়সী একজন বালক ছিল। সে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়েছিল মাতৃহত্যার প্রতিশোধ নিতে। পাকসেনাদের গতিবিধি ল রাখার কাজটা দিলাম তাকে। মিলিটারি আসছে― এই খবর পেয়ে আমরা রাস্তায় মাইন পুঁতে রাখি। ওৎ পেতে থাকি ঝোপের ভেতর। মধ্যরাতে গাড়ির শব্দ পাওয়ামাত্রই আমি ও আমার সহযোদ্ধারা বন্দুক হাতে নিয়ে দাঁড়াই। মাইনের ওপর চাপ পড়তেই সৈন্যভর্তি প্রথম লরিটা ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। হতভম্ব হয়ে দ্বিতীয় লরির সৈন্যরা লাফিয়ে নেমে পড়ল। আমরা গুলি চালাতে লাগলাম পাগলের মতো। সকল সৈন্য খতম। আমার পিঠ চাপড়ে ছেলেটি চিৎকার করে বলে উঠলো, জয় বাংলা।
তিনি এমন ভঙ্গিতে ‘জয় বাংলা’ বলেন যেন যুদ্ধেেত্রই আছেন এখনো। ছাত্ররাও সমস্বরে স্লোগান ধরে বসে। প্রধান শিকও তাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ফেলেন। মহাবিরক্ত আব্দুল আহাদ প্রশ্ন করেন, আপনি কোন দল করেন স্যার?
সব মানুষের দল থাকে না চেয়ারম্যান সাব।
তাহলে জয় বাংলা বললেন যে?
জয় বাংলা তো আমাদের স্বাধীনতার স্লোগান, বাঙালির আইডেনটিটির স্লোগান।
জবাব শুনে চুপসে যান চেয়ারম্যান। অস্বস্তিতে মুঠোফোন কানের কাছে ধরে বসে থাকেন। প্রধান শিক পুনরায় কান পাতেন মুক্তিযোদ্ধার স্মৃতিচারণে।
আমাদের বাহিনীর একজনের মরদেহ নিয়ে আমরা পাশের গ্রামে এলাম। সেই রাতে এই মুক্তিনগর ইশকুল মাঠে পাকসেনারা রাজাকারদের অস্ত্রচালনার ট্রেনিং দিচ্ছিল। আমরা ওদের ঘিরে ফেলি চারদিক থেকে। তারপর কী ভয়ঙ্কর যুদ্ধ! ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি ছুটছে, বিকট আওয়াজে গ্রেনেড ফাটছে। অল্পণেই ওদের প্রায় সবাই মারা পড়ল, দুয়েকজন হয়তো আহত হয়ে পালিয়ে গেল। আমরা জয়ী হলাম। কিন্তু রাজাকারদের বন্দুক থেকে ছোড়া একটা গুলি বিদ্ধ হলো আমার পায়ে।
এ কাহিনী শৈশবেই শোনেছে শৈবাল। তখন সে ভাবত, আরেকটা যুদ্ধ শুরু হলে প্রথমে রাজাকরদের হত্যা করতাম। প্রতিশোধস্পৃহা তার মগজে এমনভাবে সেঁটে যায় যে খেলনা পিস্তল কিংবা গুলতি দিয়ে কল্পিত রাজাকারের উদ্দেশ্যে গুলি ছুড়ে মারত। সেই প্রবণতা কমেনি তার। একই শামিয়ানার নিচে মুক্তিযোদ্ধার পাশে রাজাকারের বসে থাকা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না সে। শৈবালের ইচ্ছে হচ্ছে ডিউটিরত পুলিশের বন্দুক ছিনিয়ে নিয়ে এক গুলিতে আব্দুল আহাদের খুলিটা উড়িয়ে দিতে।
হাত ইশারায় প্রধান শিকের ডাকে বিনাসী ভাবনাবলয় থেকে ছিটকে পড়ে শৈবাল। বেঞ্চ থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ধীরপায়ে চলে যায় মঞ্চে। ফজর আলি কানাকানি করে বলেন, ইউএনও সাব আসছেন না। এ কথা তাকে বলার কারণ বুঝতে পারছে সে। তিনি চাচ্ছেন না আব্দুল আহাদের হাত থেকে মইনুল হাছান সম্মাননা ক্রেস্ট গ্রহণ করুক। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ফজর আলির ভূমিকা সম্বন্ধেও পরিষ্কার না শৈবাল। নানাভাইয়ের কাছে সে শুনেছে বাঙালির স্বাধীনতার স্বপ্নকে তিনি স্বাগত জানাননি। কিংবা বিশ্বাস করতে পারেননি পাকিস্তানের মতো শক্তিশালী বাহিনীকে পরাস্ত করে বাংলাদেশ স্বাধীন হতে পারবে। হয়তো তাই যুদ্ধে না গিয়ে কলেজ হোস্টেল থেকে পালিয়ে এসেছিলেন নিজগ্রামে। পথে মিলিটারির কবলে পড়ে গেলেন তিনি। মোটাসোটা ও নাদুসনুদুস হওয়ায় তাকে বেধড়ক পিটাল ওরা। পিঠে রাইফেলের বাঁট দিয়ে গুঁতিয়ে, পায়ে বেত দিয়ে বাড়ি মারতে মারতে একজন বলল, আসল দুস্কৃতিকারী ছাত্ররা। এরা নিজেরাও ফাইট করে, অন্যদেরও লেলিয়ে দেয় আমাদের বিরুদ্ধে। চল্ ব্যাটা, ক্যাম্পে চল্। অবস্থা বেগতিক দেখে ফজর আলি ব্যাগ থেকে পাকিস্তানি পতাকা বের করে দেখালেন। এভাবেই নাকি আত্মরা করলেন তিনি।
তা যাই হোক, মুক্তিযোদ্ধাবান্ধব প্রধান শিকের অর্থবহ ইঙ্গিতটাকে নাকচ করতে রাজি নয় শৈবাল। যেকোনো উপায়ে ভণ্ডুল করতে হবে আজকের এই অবমাননাকর অনুষ্ঠান, মাথা চুলকাতে চুলকাতে ভাবছে শৈবাল।
এদিকে নানাভাইয়ের মুক্তিযুদ্ধের কাহিনী শেষ হতেই চায় না। ডিনামাইট ফিট করে ব্রিজ উড়িয়ে দেওয়া, সাঁতার কেটে কাছে গিয়ে মাইন দিয়ে জাহাজ ডুবিয়ে ফেলা, ক্রলিং করে ট্রেঞ্জের ভেতর গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটানো, পাকিস্তানি আর্মিক্যাম্পে ট্যা ট্যা ট্যা শব্দে ব্রাশফায়ার করা, আরো কত কি।
শীতের মিঠেল সোনালি রোদে বসে উৎসুখ শ্রোতারা চুপচাপ উপভোগ করছে যুদ্ধের গল্প। মনঃসংযোগ করতে পারছে না শৈবাল আদিত্য। মুক্তিযোদ্ধা-সংবর্ধনা বানচাল করার পরিকল্পনায় বিভোর সে। নানাভাইয়ের বক্তব্য থেকে মাঝেমধ্যে কানে ভেসে আসছে শুধুমাত্র গোলাগুলির হাতিয়ারগুলির নাম। মেশিনগান, স্টেনগান, মর্টার, এলএমজি, এসএলআর। গুলতি দিয়ে কেউ গুলি ছোড়েনি কেন? বালকসুলভ প্রশ্নটি তার পরিকল্পনাকে পাকাপোক্ত করতে থাকে। মঞ্চে বসে উসখুস করতে থাকা রাজাকার আব্দুল আহাদের দিকে চোখ বড় করে তাকায় শৈবাল। চুপিসারে চলে যায় দৃশ্যের আড়ালে। আরেকটা মুক্তিযুদ্ধের আত্মগত আহ্বানে।
যুদ্ধের রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা বর্ণনার পর পরিমিতিবোধ হারিয়ে ফেলেন মইনুল হাছান। বক্তৃতা ধীরে ধীরে অসমঞ্জস হয়ে উঠছে।
এক দল রাজনীতিতে রাজাকারদের পুনর্বাসিত করেও মুক্তিযুদ্ধের বুলি কপচাল। আরেক দল যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রতিশ্র“তিতে মতায় গেল...
মইনুল হাছানের দ্রোহগন্ধি কথাগুলি উপজেলা চেয়ারম্যান সেলফোনে রেকর্ড করে রাখছেন। যদি তাকে ফাঁসানো যায় কোনোদিন!
...তার আগে রক্তের দামে কেনা বাঙলাকে রাজাকারমুক্ত দেখতে চাই। এরপর সবকিছুর হিসাব নেব। কড়ায় গণ্ডায়। পাই টু পাই। তৈরি থাকেন সকল দলের বেঁকাতেড়া নেতারা। কমবখ্ত এমপিরা। লুটেরা মন্ত্রিরা। স্বাধীন এই দেশটা আপনাদের পিতা বা পতির তালুক না। এটা সাধারণ মানুষের, মুক্তিযোদ্ধাদের...
উগ্রকণ্ঠি বক্তব্যে বিব্রত বোধ করছেন নিরীহ ফজর আলি। রাজনীতি সচেতন শিরিন সুলতানা রীতিমতো উদ্বিগ্ন। কী প্রলাপ বকছেন বাবা!
ওদিকে আড়াল থেকে শৈবাল আদিত্য গুলতি হাতে দাঁড়ায়। আব্দুল আহাদের কপাল তাক করে। শরীরটাকে টান টান করে সমস্ত শক্তি দিয়ে গুলতির ফিতা টানে। গুলি ছুটে যায় তীরের গতিতে। মার্বেল পাথরের গুলি আঘাত হানে চেয়ারম্যানের ডান চোখে। ‘আল্লা গো’ বলে ভয়ার্ত চিৎকার করে উঠে দাঁড়াতে চান তিনি। তাল সামলাতে না পেরে লুটিয়ে পড়েন মুক্তিযোদ্ধার পঙ্গু পায়ের কাছে।

সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই মার্চ, ২০১৬ রাত ১২:৪৮
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বরিষ ধরা-মাঝে শান্তির বারি

লিখেছেন বিষাদ সময়, ০৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:১৬





মাসের আধিক কাল ধরে দাবদাহে মানব প্রাণ ওষ্ঠাগত। সেই যে অগ্নি স্নানে ধরা শুচি হওয়া শুরু হলো, তো হলোই। ধরা ম্লান হয়ে, শুষ্ক হয়, মুমূর্ষ হয়ে গেল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=নীল আকাশের প্রান্ত ছুঁয়ে-৭ (আকাশ ভালোবেসে)=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:১৯

০১।



=আকাশের মন খারাপ আজ, অথচ ফুলেরা হাসে=
আকাশের মন খারাপ, মেঘ কাজল চোখ তার,
কেঁদে দিলেই লেপ্টে যাবে চোখের কাজল,
আকাশের বুকে বিষাদের ছাউনি,
ধ্বস নামলেই ডুবে যাবে মাটি!
================================================
অনেক দিন পর আকাশের ছবি নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

পানি জলে ধর্ম দ্বন্দ

লিখেছেন প্রামানিক, ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৫২


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

জল পানিতে দ্বন্দ লেগে
ভাগ হলোরে বঙ্গ দেশ
এপার ওপার দুই পারেতে
বাঙালিদের জীবন শেষ।

পানি বললে জাত থাকে না
ঈমান থাকে না জলে
এইটা নিয়েই দুই বাংলাতে
রেষারেষি চলে।

জল বললে কয় নাউযুবিল্লাহ
পানি বললে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সমস্যা মিয়ার সমস্যা

লিখেছেন রিয়াদ( শেষ রাতের আঁধার ), ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৭

সমস্যা মিয়ার সিঙ্গারা সমুচার দোকানে প্রতিদিন আমরা এসে জমায়েত হই, যখন বিকালের বিষণ্ন রোদ গড়িয়ে গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে, সন্ধ্যা পেরিয়ে আকাশের রঙিন আলোর আভা মিলিয়ে যেতে শুরু করে। সন্ধ্যা সাড়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

এই মুহূর্তে তারেক জিয়ার দরকার নিজেকে আরও উন্মুক্ত করে দেওয়া।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৬ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:২৬


তারেক জিয়া ও বিএনপির নেতৃত্ব নিয়ে আমি ব্লগে অনেকবারই পোস্ট দিয়েছি এবং বিএনপি'র নেতৃত্ব সংকটের কথা খুব স্পষ্টভাবে দেখিয়েছি ও বলেছি। এটার জন্য বিএনপিকে সমর্থন করে কিংবা বিএনপি'র প্রতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×