সেপ্টেম্বর মাস এলে দেশের সচেতন ও দায়িত্বশীল নাগরিক মহলে আয়কর সম্পর্কে অনেক উৎসাহ উদ্দীপনা লক্ষ্য করা যায়। এ মাসে ব্যক্তি শ্রেণীর করদাতা গণ তাদের আয়কর রিটার্ন জমা দিয়ে থাকেন। দেশের জনসংখ্যা অনুপাতে টি আই এন ধারীর সংখ্যা আশানুরূপ নয়। কারন আয়কর দেয়ার ঝক্কি ঝামেলা ও কম নয়। অনেকের নিকট আয়করের হিসাব মেলানো চিরতার রসের মত তিক্ত মনে হওয়ায় তারা এ পথে পা মাড়ান না। বিখ্যাত বিজ্ঞানী আইন্সটাইন পর্যন্ত বলেছিলেন – ‘ পৃথিবীতে সবচেয়ে জটিল বিষয় হচ্ছে আয়করের হিসাব' ; অবশ্য আয়কর প্রদানের পদ্ধতিগত জটিলতা নিরসনে এন বি আর ইদানিং বিভিন্ন রকম পদক্ষেপ নিয়েছে। কর অঞ্চল পুনর্বিন্যাস,আয়কর রিটার্ন জমা দেওার ফরম সহজীকরন , আয়কর মেলার আয়োজন, শ্রেষ্ঠ আয়করদাতাদের সম্মাননা প্রদানসহ অনলাইনে আয়কর প্রদানের প্রশংসনীয় উদ্যোগে ধীরে ধীরে সর্বসাধারণের মধ্যে আয়কর প্রদানের প্রতি আগ্রহ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। করদাতাদের সুবিধার্থে অনলাইনে চালু করা হয়েছে ইনকাম ট্যাক্স ক্যালকুলেটর। এটা ব্যবহার করে যে কেউ অতি সহজে নির্ণয় করে ফেলতে পারবেন নিজের জন্য প্রযোজ্য ট্যাক্সের পরিমান।
এখানে ক্লিক করুন
এ বছর সীমিত পরিসরে চালু হলেও আগামী বছর থেকে পুরো দমে চালু হয়ে যাবে অনলাইনে আয়কর রিটার্ন দাখিলের সুবিধা। । আশা করা যায় এতে আয়কর প্রদানের প্রতি জনগণের উৎসাহ উদ্দীপনা আরও বাড়বে। দেশের উন্নতি ও প্রবৃদ্ধি অক্ষুণ্ণ রাখতে আমাদের মধ্যে যারা আয়কর প্রদানে সক্ষমতা অর্জন করেছেন তাদের উচিত সময়মত নিজে আয়কর জমা দেওয়া এবং এ ব্যাপারে অন্যদের উদ্বুদ্ধ করা।
এ বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই ই –টি আই এন নম্বর নেয়ার বিষয়ে এন বি আর এর নির্দেশনা রয়েছে। এ জন্য এন বি আর এর ওয়েবসাইটে( http://www.incometax.gov.bd) গিয়ে রেজিস্ট্রেশন / রিরেজিস্ট্রেশন অপশনে গিয়ে ইউজার আইডি , পাসওয়ার্ড নির্ধারণ পূর্বক নিজের মোবাইল নম্বর , ই-মেইল ঠিকানা দিতে হয়। এরপর মোবাইল নম্বরে একটা এক্টিভেশন কোড আসে যা অনলাইনে সাবমিট করলে একটা ফরম আসে। এ ফরমে আপনার ব্যক্তিগত তথ্যাদি পূরণ করে সাবমিট করলেই আপনি পেয়ে যাবেন অটো জেনারেটেড ১২ ডিজিট বিশিষ্ট ই টি আই এন সার্টিফিকেট। তবে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে আপনার প্রদত্ত তথ্যের সাথে জাতীয় পরিচয় পত্রের তথ্যের গড়মিল থাকলে সেটা গ্রহন করা হবেনা। জাতীয় পরিচয় পত্রে যাদের নামের বানান ভুল রয়েছে তাদেরকে পড়তে হবে বিপত্তিতে। অবশ্য আয়কর মেলায় এ সংক্রান্ত ভুল ত্রুটি সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
নির্বাচন কমিশনের সার্ভার কাজ না করাতে কিছুদিন ই টি আই এন রেজিস্ট্রেশন/ রিরেজিস্ট্রেশনে সমস্যা হচ্ছিল। তবে ইদানিং সে সমস্যা আর নেই বলে জানা গেছে। এখন ই টি আই এন সনদে ভুল হলেও তা সংশোধনের সুযোগ থাকছে মেলায়।
যারা এখনো ই টি আই এন নিতে পারেননি তারা করমেলায় এসে
একটি ফরম পূরণ করে দিলে/জাতিয় পরিচয় পত্রের ফটোকপি দিয়ে দিলে কর কর্মকর্তারাই আপনাকে নতুন ই টি আই এন সনদ পাইয়ে দেবেন।
ই টি আই এন রেজিস্ট্রেশন
এখন যারা মনস্থির করেছেন আয়কর দেবেন কিন্তু কিভাবে আয়কর হিসাব করতে হয় জানেন না কিংবা যারা কর আইনজীবীর সহায়তা ছাড়া আয়কর রিটার্ন জমা দিতে পারেন না, তাদের জন্য আমার এ ক্ষুদ্র প্রয়াস। আমি উদাহরণ দিয়ে বুঝানোর চেষ্টা করব কিভাবে আয়করের হিসাব করতে হয়। নিচের ছকটি মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করুনঃ
• নাম: ব্লগার সামু
• পদবী : সাধারন ব্লগার
• ঠিকানাঃ ভার্চুয়াল দুনিয়া
মনে করি,
• ব্লগারের বাৎসরিক বেতনঃ ২, ৯৩, ৪০০ টাকা
• ব্লগারের বিনিয়োগঃ ১, ১৯, ৩২০ টাকা
• করমুক্ত আয়ের সীমাঃ ২,২০,০০০০ টাকা ( ব্লগার সামু সম্ভবতঃ পুরুষ, নারী হলে হবে ২, ৫০,০০০টাকা)
• সুতরাং করযোগ্য আয়ঃ (২, ৯৩, ৪০০- ২,২০,০০০) = ৭৩,৪০০ টাকা
• ধরে নিলাম ব্লগারের আর কোন আয় নেই, সুতরাং আরোপ যোগ্য আয়কর = মোট আয়ের ১০% = ৭৩,৪০০ এর শতকরা ১০ ভাগ= ৭৩৪০ টাকা
• কর রেয়াত= মোট আয়ের ( স্বীকৃত ভবিষ্যৎ তহবিলে বার্ষিক চাঁদা ব্যতিত) ৩০% এর ১৫% এবং বিনিয়োগ এর ১৫% অথবা ১,৫০,০০০০০ টাকার ১৫% এ তিনটার মধ্যে যাহা কম।
• মোট আয়ের ৩০% এর ১৫%= (২,৯৩৪০০-৭২,০০০) = ২,২১,৪০০ টাকার ১৫% =৯,৯৬৩ টাকা
• বিনিয়োগ ১,১৯,৩২০ টাকার ১৫%= ১৭,৮, ৯৮ টাকা
• সুতরাং কর রেয়াত=৯,৯৬৩ টাকা
• অতএব ব্লগার সামুর বর্তমান অর্থ বছরে প্রদেয় কর= আরোপ যোগ্য আয়কর- কর রেয়াত = (৭৩৪০-৯৯৬৩)= -২৬২৩ টাকা।
কিন্তু ন্যুন তম কর হল ঃ
সিটি কর্পোরেশন এলাকায় অবস্থিত করদাতা - ৩,০০০ টাকা
জেলা সদরের পৌরসভায় অবস্থিত করদাতা -২, ০০০ টাকা
অন্যান্য এলাকায় অবস্থিত করদাতা - ১,০০০ টাকা
বিনিয়োগের খাত সমূহঃ
• জীবন বীমার প্রিমিয়াম
• সরকারি কর্মকর্তার প্রভিডেন্ট ফান্ডের চাঁদা
• স্বীকৃত ভবিষ্যৎ তহবিলে নিয়োগকর্তা ও কর্মকর্তার চাঁদা
• কল্যান তহবিল ও গোষ্ঠী বীমা তহবিলে চাঁদা
• যে কোন আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও তফসিলি ব্যাংকের ডিপোজিট পেনশান স্কিমে বার্ষিক সর্বোচ্চ ৬০,০০০.00 টাকা বিনিয়োগ।
• সঞ্চয় পত্রে বিনিয়োগ
• আই পি ও এর মাধ্যমে কোম্পানির শেয়ার, স্টক, মিউচুয়াল ফান্ডের ইউনিট বা ডিবেঞ্চারে বিনিয়োগ
• বাংলাদেশ সরকার ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগ
• একটি কম্পিউটার বা ল্যাপটপ ক্রয়ে বিনিয়োগ
দান
যাকাত তহবিলে দান
বোর্ড কর্তৃক অনুমোদিত কোন দাতব্য হাসপাতালে দান
প্রতিবন্ধীদের কল্যাণে স্থাপিত প্রতিষ্ঠানে দান
আগা খান ডেভেলপমেন্ট ফান্ডে দান
আহসানিয়া ক্যান্সার হাসপাতালে দান
সরকার কর্তৃক অনুমোদিত জনকল্যাণ মূলক বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দান।
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি রক্ষার্থে নিয়োজিত জাতীয় পর্যায়ের কোন প্রতিষ্ঠানে দান
জাতির জনকের স্মৃতি রক্ষার্থে নিয়োজিত জাতীয় প্রতিষ্ঠানে অনুদান
এখন উপরোক্ত ফরম্যাট ব্যবহার করে আপনি সহজেই বের করে নিতে পারেন আপনার জন্য প্রযোজ্য কর।
করদাতাদের জন্য বিশেষ জ্ঞাতব্য বিষয়ঃ
• চলতি বছরের নীট সম্পদ থেকে পূর্ববর্তী বছরের প্রদর্শিত নীট সম্পদ বিয়োগ করে নীট সম্পদ বৃদ্ধি নিরুপিত হয়। নিরুপিত নীট সম্পদ বৃদ্ধির সাথে বার্ষিক ব্যয় ( আই টি -১০ বি বি অনুযায়ী) যোগ করে সম্পদের মোট পরিবৃদ্ধি নিরুপিত হয় যা করদাতার প্রদর্শিত উৎসের বিপরীতে মোট প্রাপ্তি দ্বারা সংকুলান যোগ্য / সমন্বয় যোগ্য হতে হবে।
• প্রদর্শিত মোট প্রাপ্তির পরিমান অপেক্ষা সম্পদের মোট পরি বৃদ্ধি বেশি হলে অতিরিক্ত অংশ টুকু আয়কর অধ্যাদেশ ১৯/৩৩ ডি ধারা মোতাবেক করদাতার অন্যান্য সূত্রের আয় হিসাবে গণ্য হয়ে মোট আয়ের অন্তর্ভুক্ত হবে যার উপর প্রযোজ্য হারে কর আরোপ হবে।
• সার্বজনীন স্বনিরধারনী পদ্ধতিতে আয়কর দেয়া সুবিধাজনক। এ ক্ষেত্রে করদাতা নিজে হিসাব করে যা – ই আয়কর দেন তা কর কর্মকর্তা কর্তৃক কোন প্রকার প্রশ্ন ব্যতিরেকে গ্রহন করা হয়।
• বিদেশ থেকে প্রাপ্ত আয় কর মুক্ত, তবে বিনিয়োগ থেকে প্রাপ্ত সুদ কর যোগ্য।
• পূর্বে প্রদর্শিত কোন সম্পদ যেমন বাড়ি , গাড়ি, জমি বিক্রয় করলে যদি লাভ হয় তবে লাভের উপর আয়কর দিতে হবে।
• কেউ যদি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে রিটার্ন দাখিলে ব্যর্থ হন, তবে উপ কর কমিশনের নিকট লিখিত আবেদন করে ৩ মাস সময় বর্ধিত করতে পারবেন। তবে এ ক্ষেত্রে সার্বজনীন স্ব নির্ধারণী পদ্ধতিতে রিটার্ন দাখিল করা যাবে না।
বেতন খাতে প্রাপ্ত আয়ের কত টুকু অংশ রিটার্ন ফরমে প্রদর্শিত হবে ?
সরকারি কর্মকর্তা / কর্মচারী ব্যতিত অন্যদের ক্ষেত্রে হিসাব নিম্ন রুপ ঃ
মূল বেতন- সম্পূর্ণ অংশ কর যোগ্য
বিশেষ বেতন - সম্পূর্ণ অংশ কর যোগ্য
মহার্ঘ্য ভাতা - সম্পূর্ণ অংশ কর যোগ্য
যাতায়াত ভাতা - ৩০,০০০ টাকার অতিরিক্ত অংশ কর যোগ্য
বাড়ি ভাড়া ভাতা - মূল বেতনের ৫০% বা ২,৪০,০০০ টাকার মধ্যে যেটি কম তার অতিরিক্ত অংশ করযোগ্য
চিকিৎসা ভাতা - প্রাপ্ত ভাতার অব্যায়িত অংশ কর যোগ্য
পরিচারক ভাতা, ছুটি ভাতা, সম্মানী, পুরস্কার, ফি, ওভারটাইম, বোনাস, শ্রান্তি -বিনোদন , স্বীকৃত ভবিষ্যৎ তহবিলে নিয়োগকর্তা কর্তৃক প্রদত্ত চাঁদা , ছুটি নগদায়ন - সম্পূর্ণ অংশ কর যোগ্য।
স্বীকৃত ভবিষ্যৎ তহবিলে অর্জিত সুদ- মূল বেতনের তিন ভাগের এক অংশ অথবা ১৪ দশমিক ৫০ শতাংশ পর্যন্ত সুদ এর মধ্যে যেটি কম তার অতিরিক্ত অংশ কর যোগ্য।
যানবাহন সুবিধার জন্য বিবেচিত আয়- মূল বেতনের ৭ দশ মিক ৫ শতাংশ আয় হবে ।
আয়করের হারঃ
২,২০,০০০ পর্যন্ত -০
পরবর্তী ৩,০০০০০ টাকা পর্যন্ত - ১০%
পরবর্তী ৪,০০০০০ টাকা পর্যন্ত -১৫%
পরবর্তী ৩,০০০০০ টাকা পর্যন্ত - ২০%
অবশিষ্ট মোট আয়ের উপর- ২৫%
বিঃ দ্রঃ সরকারি সামরিক ও অসামরিক কর্মকর্তা - কর্মচারীদের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র মূল বেতনের উপর আয়কর প্রযোজ্য হবে।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৩ সন্ধ্যা ৭:২৯