ছবিঃ Bing AI এর সাহায্যে প্রস্তুতকৃত
১৯৪৬ কিংবা ১৯৪৭ সাল।
দাবানলের মত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়েছে সারাদেশে।
যে যেভাবে পারছে, নিরাপদ আশ্রয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। একটাই লক্ষ্য সবার-যদি কোনভাবে ঘরে ফেরা যায়।
এমনই এক অস্থির সময়ে বাড়িগামী একটা ট্রেনের থার্ডক্লাসে চড়ে বসল যুধিষ্ঠির।
একটু ধাতস্থ হতেই আশেপাশে তাকাল সে। বগির চারপাশে গিজগিজ করছে মানুষ, পা ফেলারও জায়গা নেই বলতে গেলে। প্রায় প্রত্যেকেই পরিবার-পরিজন আর মালপত্রের বিশাল বহর নিয়ে গাড়িতে চেপে বসেছে। হয়ত এটাই স্থায়ীভাবে যাওয়া, এই শহরে ফেরা হবে না আর কোনদিন!
-এরা কি সবাই মুসলিম? মনে মনে নিজেকে প্রশ্ন করল যুধিষ্ঠির।
পোশাক-আশাক দেখে প্রায় সবাইকেই মুসলমান বলে মনে হচ্ছে, তবে নিশ্চিত হওয়ার উপায় নেই। দাঙ্গার ভয়ে এখন নিরীহ লোকজন নিজেদের ধর্মীয় পরিচয় লুকিয়ে রাখছে, কোথায় আবার কোন বিপদে পড়া লাগে!
অবশ্য যেখানে ও যাচ্ছে, সেটা একটা মুসলিমপ্রধান এলাকা। ফলে ট্রেনের অধিকাংশ যাত্রীর মুসলিম হওয়াটা অস্বাভাবিকও নয়।
-শালা, বাপটাকে এত করে বললাম, ওখানে জমি নিও না। বুড়োটা কোনভাবেই কথা শুনল না। পুরনো কথা মনে করে নিঃশব্দে গজগজ করতে লাগল যুধিষ্ঠির। বুড়োর এক কথা, এত সস্তায় আর কে জমি দেবে? তা এই দাঙ্গার সময় সেই জমি আর বাড়ি ধরে রাখতে পারবে? এর মধ্যে জিন্নাহ্র পাকিস্তান হয়ে গেলে কলকাতা যাওয়া ছাড়া আর গতি আছে?
মনে মনে কথা গুছিয়ে নিল যুধিষ্ঠির। বাবাকে এবার এভাবেই বলতে হবে। আর কোন উপায় নেই। বাড়ি পৌছেই সে কলকাতার টিকেট কাটবে সে সবার জন্য। এই ম্লেচ্ছপাড়ায় আর এক মুহূর্তও নয়।
-টিকিট।
শব্দ শুনে তাকাল যুধিষ্ঠির। টিটি এসে পড়েছে।
পকেট থেকে টিকিট বের করল সে।-এই যে।
-নাম কি? টিকিট চেক করতে করতে হঠাৎ প্রশ্ন করল টিটি।
-টিকিটতো ঠিকই আছে। নাম দিয়ে কি করবে? পালটা প্রশ্ন করল সে।
-সামনে যে কটা স্টেশন পড়বে, সবগুলো মহামেডান পাড়া। জানতো?
-হ্যা, জানি। তো?
-তুমি হিঁদুর ছেলে, তাই বললাম। দিনকালতো ভাল না।
-কে বলল আমি হিঁদুর ছেলে?
-মুসলিম নাকি? দেখেতো মনে হচ্ছে না।
-কেন?
-দাড়ি কোথায়?
-আমার ইচ্ছা, রাখিনি। আমি শহরে থাকি, কলেজে পড়ি। দাড়ি না রাখলেও টুপি আছে। এই দেখ। বলতে বলতে পকেট থেকে একটা টুপি বের করে মাথায় পড়ল যুধিষ্ঠির।
আর কোন কথা বাড়াল না টিটি, এগিয়ে গেল পরের যাত্রীর টিকিট চেক করতে।
-বাঁচলাম। হাফ ছাড়ল যুধিষ্ঠির। এই যাত্রায় কোনভাবে বাঁচা গেল। ভাবতে ভাবতে এক কোণায় বসে পড়ল সে।
যুধিষ্ঠিরের ঘুম ভাঙ্গল প্রচন্ড ঝাঁকুনি খেয়ে।
কি হয়েছে- ব্যাপারটা বুঝতে কয়েক মিনিট সময় লাগল তার। ট্রেন থেমে গেছে, সম্ভবত চেইন টানা হয়েছে।
জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল সে। সন্ধ্যা হব হব করছে।
তারমানে আরও কয়েক ঘন্টার রাস্তা বাকি আছে। এরমধ্যে ট্রেন থামল কেন?
বগির চারদিকে তাকাল সে। অনেকে ইতিমধ্যেই নেমে গেছে, অনেকে মালপত্র গোছাতে শুরু করেছে।
পাশের লোকটাকে সব জিজ্ঞেস করার সিদ্ধান্ত নিল সে।
-ব্যাপারটা কি? আস্তে করে জানতে চাইল সে। সচেতনভাবেই দাদা কিংবা ভাই বলাটা এড়িয়ে গেল।
-কারা নাকি সামনে রেললাইন উপড়ে ফেলেছে, গাড়ি আর সামনে যাবে না। তাই সবাই নেমে যাচ্ছে।
-কোন জায়গা এটা?
-জানি না।
বগিটা প্রায় খালি হয়ে এসেছে। এখানে আর একা থাকাটা নিরাপদ হবে না। যুধিষ্ঠিরও নেমে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল।
নেমেই অবাক হয়ে গেল যুধিষ্ঠির। ঘুম ঘুম চোখে ভেবেছিল হয়ত কোন স্টেশনে থেমেছে গাড়ি। কিসের স্টেশন? গাড়িটা দাঁড়িয়ে পড়েছে একেবারে জঙ্গলের মাঝখানে!
মুসলিম এলাকা কি শুরু হয়ে গেছে? বোঝা যাচ্ছে না।
রিস্ক নেওয়ার দরকার নেই। চেহারা দেখেই টিটি তাকে হিন্দু ভেবে নিয়েছিল, এবার কোন চান্স নেওয়া যাবে না। টুপিটা মাথায় ভালমত পড়ে নিল সে।
মিনিট দশেক হাঁটতেই আঠার-বিশ বছর বয়সী কয়েকটা ছোকরার দেখা পাওয়া গেল।পরনে মলিন লুঙ্গি, গায়ে ময়লা ফতুয়া।
-এরা কি স্থানীয় কৃষক?
মনে হচ্ছে।
ওদের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল যুধিষ্টির। তার আগে আরেকবার ঠিক করে নিল মাথার টুপিটা। এবার তাকে দেখে মুসলিম না ভাবার কোন উপায়ই নেই।
-বাবারা, রেললাইন নাকি উপড়ে ফেলেছে? এবারও ইচ্ছে করেই দাদা কিংবা ভাই বলে সম্বোধন করল না যুধিষ্ঠির।
-হ্যা, দাঙ্গাবাজদের কাজ আর কি। মাটির ওপর একদলা থুথু ফেলতে ফেলতে বলল একজন। আপনি কোথায় যাবেন?
-সদরে। সদরে যাওয়ার গাড়ি পাওয়া যাবে?
-ওইদিকে। আর দুই ক্রোশ হাঁটা লাগবে।
ছেলেটার ইশারা করা হাতের দিকে তাকাল যুধিষ্ঠির। এই অন্ধকারে আরও দুই ক্রোশ হাঁটতে হবে একা একা?
-শুকরিয়া। ছেলেটার দিকে হাত তুলল যুধিষ্ঠির। আসি, সালাম।
-মুসলমান? ছেলেটা হঠাৎ শীতল কন্ঠে জানতে চাইল।
ছেলেটার কন্ঠ শুনেই একটা শীতল স্রোত বয়ে গেল যুধিষ্ঠিরের শিরদাঁড়া বেয়ে।
তাহলে কি ওর ধারণা ভুল? ছেলেটা কি তবে মুসলমান নয়? তাহলে পরনে লুঙ্গি কেন?
-কি হল? জবাব দিচ্ছিস না কেন? কর্কশ কন্ঠে জানতে চাইল ছেলেটা।
তখনই ছেলেটার হাতের দিকে চোখ গেল যুধিষ্ঠিরের। মুষ্টিবদ্ধ হাতে একটা ছুরি, কব্জিতে পেচানো একটা লাল সুতা!
-না, না। আমি মুসলিম না। চিৎকার করে উঠল যুধিষ্ঠির।
-তাহলে তোর মাথায় এই 'জিন্নাহ টুপি' কেন?
-আমি তুমি আমরা
০৭.০৫.২০২৪
=====================
আমার লেখা আরও কিছু অণুগল্পঃ
=====================
অণু গল্পঃ হক
অণুগল্পঃ ধোঁয়াটে শহরে একদল ঘোলাটে মানুষ
অণুগল্পঃ আবেগ-বিবেক এবং গতিবেগ
অণুগল্পঃ ইঁদুর দৌড়
অণু সাইকোলজিক্যাল থ্রিলারঃ অনিশ্চিত বিদ্রোহী
অণু হররঃ কন্ঠ
অণু হররঃ অতিথি
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:০০