আমাদের দেশের বর্তমান তরুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ দেখে নি। দেখার কথাও নয় তাদের। মাঝে কেউ কেউ হয়তো শুনেছে জেনেছে শুধু স্বাধীনতা তথা পাক বাহিনীর হাত থেকে দেশকে মুক্ত করার জন্য আমাদের সেই সব তরুন যুবক যুবতীদের দৃপ্ত কঠোর কঠিন সংগ্রামের কথা । এখন তারা গভীরভাবে জানতে চায় আমাদের এই মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সঠিক ইতিহাস টুকু । সে সময়কালের বাঙালী মননে এই স্বাধীনতার আকাঙ্খা কতোখানি তীব্র হয়ে উঠেছিল । তারাও অনুভব করতে চায় সে আকাঙ্খার গভীরতা, তীব্রতা, সেই সময়কার গৌরবজ্জ্বল পাক সেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনা সেই সব মুক্তি পাগল সেনাদের মত করেই ।
মহান স্বাধীনতা এই দিবসকে সামনে রেখে মনে হল , সে আকাঙ্খার একটি ছবি যদি আমি এঁকে দিতে পারি আমাদের তরুন প্রজন্মের চোখে তবে হয়তো তারা কিছুটা বুঝবে কিসের বিনিময়ে আমাদের এই অর্জন,আমাদের গর্ব, আমাদের এই স্বাধীন বাংলাদেশ ।
এই লেখাটি আমার নিজের লেখা নয় । সেই এক তরুন মুক্তিযোদ্ধা, যিনি আজও জীবিত। আমার অনেক দিনের অনেক অনুরোধে অনেক ব্যস্ততার মাঝেও তিনি তাঁর জীবনের গৌরবজ্জ্বল এই অধ্যায়টি লিপিবদ্ধ করেছেন। যার একটি হরফও হেরফের না করে আমি শুধু ব্লগের জন্য টাইপ করে গিয়েছি এই আশায় যে, আমার মতো আরও কেউ কেউ ওরা আসবে বলে সবকটি জানালা খুলে দেবেন, যে যার সাধ্যমতো ব্লগের পাতায় বা অন্য কোথাও লিখে লিখে।
আমি আজ যার গৌরবগাথা তুলে ধরছি তিনি হচ্ছেন গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ১৭৯০৪৫ নম্বর সনদ প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা মনসুরুল আজীম, পিতা মোঃ আবদুল আজীম, গ্রাম খিলগাঁও,পোষ্ট অফিস খিলগাঁও, থানা রমনা, জেলা ঢাকা।
মুক্তিযোদ্ধা মনসুরুল আজীমের নিজ হাতে লেখা স্বাধীনতা সংগ্রামের নয় মাস ব্যাপী যুদ্ধে তাঁর গৌরবজ্জ্বল ভুমিকার দিনলিপি :-
আমার নাম মনসুরুল আজীম তবে আপনজনরা আমাকে শফিক নামেই চেনে। ছোটবেলা থেকেই আমার খেলাধুলার প্রতি প্রচন্ড আগ্রহ ছিল। কিন্ত লেখাপড়াটাও যে জীবনের জন্য ভীষন প্রয়োজন একজন শিক্ষক পিতার সন্তান হিসেবে সে উপলব্ধিটুকু আমার সে সময় ততটা ছিল না। তবে পড়ালেখায় যে একদম অমনোযোগী ছিলাম তাও বলা যাবে না। এভাবেই হেসে খেলে জীবন চলছিল আমার।
স্কুল জীবন প্রায় শেষ পর্যায়ে, তখন হঠাৎ করেই বিশেষ করে পরিবেশগত কারনে একটা রাজনৈতিক ধারণা মনে স্থান করে নেয়। মনের ভেতর কেমন একটা বিদ্রোহী ভাব জমাট বাঁধে । বিশেষ করে একটা শ্লোগান জানিনা কখন কি ভাবে আমার মনে প্রচন্ড নাড়া দিয়ে যায়। সেই শ্লোগানটি ছিল ‘কেউ খাবে কেউ খাবে না, তা হবে না তা হবে না’। সে সময় কমিউনিজম এর এক ব্যাপক প্রভাব আমাদের দেশের মধ্যবিত্ত এবং নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের উপর প্রচন্ডভাবে আলো ছড়াচ্ছিল। অনেক শিক্ষিত এবং ধনী ঘরের সন্তান এই রাজনৈতিক ধারায় নেতৃত্বসহ বিভিন্ন স্তরে গভীরভাবে জড়িয়ে পড়েছিল। আর তারই ফলশ্রুতিতে আমিও ধীরে ধীরে সেই আলোতে আলোকিত হয়ে জড়িয়ে পড়লাম সক্রিয় রাজনৈতিক বলয়ে।
উনসত্তুরের গন-আন্দোলনের জোয়ারে সকল ধারার রাজনীতি এক হয়ে বাঙ্গালীর মনে যে স্বাধীনতার বোধ জন্ম দিয়েছিল তা আমাকেও গ্রাস করেছিল। যার ফলশ্রুতিতে ভারতে পাড়ি জমিয়েছিলাম দেশকে মুক্ত করার এক দৃপ্ত শপথ নিয়ে।
আমি তখন ঢাকা কলেজের ইন্টারমিডিয়েট এর প্রথম বর্ষের ছাত্র।বয়স ১৮ এর কাছাকাছি।প্রথম বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা চলছিল, অর্ধেক পরীক্ষা শেষ না হতেই বেজে উঠলো মুক্তিযুদ্ধের দামামা।আমিও নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না। মানসিকভাবে তৈরী হোলাম মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহনের জন্য।
কিন্ত বল্লেইতো আর যাওয়া যায়না,বাসায় জানানো মাত্র সবাই নিশ্চুপ হয়ে গেল।আমি ছিলাম চার ভাই এক বোনের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ,সবার আদরের। কিন্ত আমার মা সেই পরিস্থিতিতে আমাকে ভীষন ভাবে সহযোগীতা করেছিলেন। সেই সাথে আমার বড় দুই ভাই সার্বিক এবং বিশেষ করে অর্থনৈতিক সহযোগীতা্র হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন বলেই হয়তো সেদিন আমার সেই মুহুর্তে মহান মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার স্বপ্ন সফল হয়েছিল। আর হয়ে গেলাম বাংলার সর্বাপেক্ষা গৌরবময় ইতিহাসের একজন সক্রিয় সাক্ষী।
মা সব ব্যাপারে প্রচন্ড সাহসী এক মহিলা বলে পরিচিত ছিলেন। মনে আছে আমার কথা শুনে মা বলেছিলেন, “ঘরের কোনায় ইদুরের মত মৃত্যু বরণ করার চেয়ে দু চারটা পাকিস্তানি মেরে মরে যাওয়াটাও অনেক সন্মানজনক”।
বলতে গেলে পরিবারের এই ইতিবাচক ভুমিকার কারনেই আমি দেশকে হানাদার বাহিনীর হাত থেকে মুক্ত করতে সক্রিয় ভুমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছিলাম। এর প্রথম ধাপ হিসেবে আমি প্রথমেই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহনের জন্য ভারত থেকে একবার ঘুরে আসা এক বছরের সিনিয়র বন্ধু ( মুক্তিযুদ্ধের সেকটর কমান্ডার) আবদুল্লাহ হেল বাকী এবং তার সঙ্গী বাবুলের সাথে যোগাযোগ করি । তাদের উপর আদেশ ছিল আরো মুক্তিযোদ্ধা সংগ্রহ করে নিয়ে যাওয়ার। তারই ফলশ্রুতিতে আমি ও আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু মোস্তাকউদ্দিন লুলু মে মাসের কোন এক দিনে (তারিখটা স্মরণে নাই )বাকী ও বাবুলের সাথে ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা হই।
ঢাকা থেকে সে সময় চার জন তরুনের এক সাথে বের হওয়াটা বিপদজনক ছিল।তাই আমরা দুজন দুজন করে নিজেদের ভাগ করে নিলাম, এবং যাবার পথ নিয়ে নিজেদের মধ্যে বিস্তারিত আলোচনা করে ঠিক করে নিলাম কি ভাবে কোন পথে যাবো । সকালে চারজন একত্রিত হোলাম এবং আগের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কিছুটা বিরতির ব্যবধানে যাত্রা হলো শুরু।
প্রথমে রিকশায় গুলিস্তান আসলাম এরপর যতদুর মনে পড়ে নারায়নগঞ্জের লঞ্চ ঘাট পৌছালাম।সেখান থেকে লঞ্চে করে নরসিংদী। এরপর সেই নরসিংদী থেকে একদম সোজা আগরতলা সীমান্তের দিকে হাটতে শুরু করলাম । প্রথমদিন যে জায়গাতে রাত হয়েছিল তার নাম নবীনগর।গ্রামের এক বাড়ীতে রাত কাটলো। তাদের সেই আন্তরিক আপ্যায়নের বর্ননা করা সম্ভব নয়।মনে আছে খাওয়া দাওয়ার পর তাদের দেয়া বিছানাতেই ভীষন ক্লান্ত আমরা শোয়া মাত্রই ঘুমিয়ে পরেছিলাম।খুব সকালে অন্ধকার থাকতে থাকতেই তাদের দেয়া চা ও মুড়ি খেয়ে রওনা হয়ে গিয়েছিলাম।কারণ লক্ষ্যে পৌছাতে তখনো অনেক পথ বাকি।
যা হোক হাটছি তো হাটছিই চলার আর বিরাম নাই। সত্যি বলতে কি এমন হাটার অভ্যাস তো কখনই ছিল না । সকাল গড়িয়ে দুপুর, দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা, সারাদিনে এক মুঠো খাবারও জোটে নি।শুধু মনে আছে পথের মাঝে এক টিউবওয়েল পেয়ে চারজনই পানি পান করেছিলাম। বিশ্রাম নেয়ার কোন উপায় নেই, কারণ আমাদের তখনো অনেক পথ পেরুতে হবে।বাকী বারবার তাগাদা দিচ্ছিল জোরে চলার জন্য কিন্ত আমরা আর পারছিলামনা। ক্ষুধা আর ক্লান্তিতে শরীর যেন ভেঙ্গে আসছে। পা ফুলে উঠেছে। তারপর ও দেশকে মুক্ত করার এক গভীর প্রত্যয় নিয়ে হেটে চলেছি গন্তব্যের দিকে।
হঠাৎ দেখি বর্ডার আমাদের দৃষ্টিসীমার মধ্যে। সাথে সাথে সারা শরীরে একটা ভয়ের শিহরণ বয়ে গেল। কারণ আমাদের ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে মনে হচ্ছিল সেখানে হয়তো পাকবাহিনী আছে এবং তারা দেখা মাত্রই আমাদের গুলি করবে। আবার ভারতের সৈন্যরাও তো সীমান্ত পাহারা দিচ্ছে, তাদের পক্ষেও তো আমাদের পরিচয় বোঝা সম্ভব নয়। তাদের লক্ষ্য বস্তুতেও তো পরিনত হতে পারি । সেই দোদুল্যমান ভয়ানক পরিস্থিতিতে অসম্ভব সাহসী সেই তরুন মুক্তিযোদ্ধা আবদুল্লাহ্ হেল বাকী আমাদের প্রচন্ড সাহস যুগিয়েছিল যা ভাষায় ব্যাক্ত করা আজ আমার পক্ষে সম্ভব নয়।তারই অনুপ্রেরণায় আমরা আবার দ্বিগুন উৎসাহ নিয়ে চলতে লাগলাম এবং এক সময় ভারতের নিরাপদ মাটিতে নিজেদেরকে আবিস্কার করলাম।
যেখানে পৌছালাম সেটা বেশ বড় এক পাহাড়ের উপরিভাগ এবং সেখানে একটি কাঁচা বাজারও রয়েছে।সময় তখন যতদুর মনে পড়ে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার মত। বাকী তখন জানালো এখন আর আমাদের পাকিস্তানী ফৌজের ভয় নেই। শুনে মন থেকে এক বিশাল বোঝা যেন নেমে গেল।
প্রচন্ড ক্লান্ত আমরা চারজন শুধু চারটে ইট যোগাড় করে মাথায় দিয়ে গভীর ঘুমে ঘুমিয়ে পরেছি। সেদিনের কথা আর কোন কিছু মনে নেই।
খুব সকালে ঘুম ভাঙ্গলো লোকজনের ধাক্কাধাক্কিতে। বলছে “উঠো, উঠো আমাদের দোকান বসাতে হবে”।আস্তে আস্তে চোখ খুলে দেখি মাছের বাজারে শুয়ে আছি।
তাড়াতাড়ি উঠে নিজের ছোট্ট ব্যাগটা হাতে নিয়ে আমরা চারজন বাজার থেকে বের হয়ে দেখি আগরতলা শহরের বেশ কাছাকাছি পৌছে গেছি। ক্লান্তি এবং ক্ষুধায় তখন দাঁড়িয়ে থাকতেও পারছিলাম না।কোথা থেকে একটু পানি এনে মুখটা ধুয়েছিলাম। বাকীকে বললাম খাবারের ব্যবস্থা করতে। আমাদের সবার কাছেই কিছু কিছু টাকা ছিল কিন্ত সেতো পাকিস্তানি টাকা। সে টাকা কি এখানে ভাঙ্গানো যাবে ? না হলে কি উপায় হবে ? খোজ নিয়ে জানলাম সেই টাকা চলবে শুনে মনে আনন্দের সীমা রইলোনা।
সেই টাকায় মুড়ি আর ঘুগনি কিনে খেয়ে খোলা আকাশের নীচে ঘাসের উপর শুয়ে আবার ঘুমিয়েছিলাম প্রায় ঘন্টা দুয়েকের মত।
ঘুম থেকে উঠে এবার আমরা চারজন আগরতলা কলেজে যে মুক্তিযোদ্ধা রিক্রুট ক্যাম্প করেছিল সেখানে উপস্থিত হই। সেখানে চলছিল দুপুরের খাবারের আয়োজন। তা দেখে ক্ষুধার্ত আমরা চারজনও সেই লাইনে বসে পড়ি।কিছুক্ষন পর সবার সামনে একটা করে কাঁসার থালা দিয়ে গেল, একটু পর তাতে ভাত দিয়ে যায় একজন। বেশ কিছুক্ষন অপেক্ষার পর ডাল নামে এক বাটি পানি আসলো। এরপর তরকারী আর সেটা ছিল একটা ডিমের চার ভাগের এক ভাগ আর ছোট দু টুকরা আলু।সেই খাবারই যে কত তৃপ্তি নিয়ে খেয়েছিলাম তা আজ লিখে বোঝাতে পারবো না।
সেদিনই আমাদের রিক্রুটের জন্য একজন একজন করে ডাক পরে।আমাকে যেখানে ডাকা হয় সেখানে ছিলেন চার খলিফা নামে পরিচিত ছাত্রনেতার দুজন আঃসঃমঃ আবদুর রব এবং আবদুল কুদ্দুস মাখন।যথারীতি প্রথমদিকেই বাকীর ডাক পড়ে এবং তাকে কমান্ডার ইন চীফ গ্রুপে নিয়ে নে্যা হলো। এরপর আমার পালা।কিন্ত যেহেতু আমি ভাসানী গ্রুপের আদর্শে বিশ্বাসী তা শুনে আমাকে বাতিল করে দিল অর্থাৎ সিএনসি গ্রুপে ঢোকার যোগ্যতা হারিয়ে ফেললাম। কারণ তারা শুধুমাত্র তাদের আদর্শের তরুনদেরই প্রাধান্য দিচ্ছিল। পরবর্তীতে বাকী বহুত দেন দরবার করে ফজলুল হক মনি ভাই এর সহযোগীতায় আমাকে রিক্রুট করতে সক্ষম হয়।
এবার আমাদেরকে এনে রাখা হয় বিএস এফ ৯১ এ যেখানে আগে থেকেই আসা অনেক ছেলে ছিল। আমরা কেউই জানতাম না কোথায় আমাদের নিয়ে যাওয়া হবে আর কোথায়ই বা ট্রেনিং ক্যাম্প।সন্ধ্যায় সবার ডাক পড়লো জড়ো হবার জন্য। কাতার ধরে দাড়ালাম সবাই।সেখানে কিছু বাঙ্গালী অফিসার আমাদের উদ্দ্যেশ্যে কিছু বক্তব্য দিলেন এবং জানালেন যথাসময়ে জানানো হবে ট্রেনিং ক্যাম্প সম্পর্কে। এ ব্যপারে মনে হয় গোপনীয়তা বজায় রাখছিল তারা।আমাদের সাত আটজনের জন্য বরাদ্দ ছিল এক একটি রুম এবং সেই সাত জনের জন্য বরাদ্দ ছিল মাত্র একটি ফৌজী কম্বল।
খাবারের জন্য যেতে হবে এক কিঃমিঃ দূরে পাহাড়ের উপর এক লঙ্গরখানায়। সন্ধ্যার পর পরই সেখানে গিয়ে একটি টিনের থালা হাতে নিয়ে লাইনে দাড়াতে হতো। সেই লাইনে প্রায় হাজার খানেক লোক ছিল।খাবার ছিল মোটা চালের ভাত তাতে কখনো শুধু ডাল বা সব্জী, কখনো শুধু শুটকীর ঝোল।এই ভাবেই চলতে লাগলো দুবেলার খাওয়া।
চলবে :-
২য় পর্ব
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে জুন, ২০১৮ রাত ৮:৫৭