somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমার কথা - ৪

০৮ ই নভেম্বর, ২০১৫ ভোর ৬:৫৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

"আমার কথা - ৩" পড়ুন এখানেঃ আমার কথা - ৩

ভেবেছিলাম, এখান থেকেই চলে যাবো আমার ক্যাডেট কলেজে ভর্তি পরীক্ষার যুদ্ধে অবতীর্ণ হবার কাহিনীতে। কিন্তু একজন পাঠকের কৌতুহল মেটাতে তার আগে আরো কিছু কথা বলে নিচ্ছি। এই সিরিজের আমার আগের লেখাগুলো পড়ে জনৈক পাঠক একদিন আমাকে কথাচ্ছলে বললেন, “আপনাদের ক্লাসের সবচেয়ে অবহেলিত ছেলেটির কথা জানতে চাই।" তার প্রশ্নের উত্তরে সরাসরি যার কথা আমার মনে এসেছিলো, এখন তার কথা দিয়েই এ লেখাটা শুরু করছি।

সে ছিলো যেমন সবচেয়ে অবহেলিত, তেমনি সবচেয়ে উজ্জ্বল প্রতিভা। যে ক’টা বছর ঐ স্কুলে ছিলাম, দুই সেকশন মিলে তাকে বরাবরই প্রথম হতে দেখেছি। শিক্ষকগণ যেমনি তাকে ভালোবাসতেন, আমরাও তেমনি। আমাদের ক্লাসের সবচেয়ে দুষ্ট ছেলেরাও কোনদিন তার সাথে দুষ্টামি করতোনা। তার প্রথম নামটাই শুধু আজ মনে আছে- শহীদ। মোটা পুরু ফ্রেমের সস্তা চশমা পড়তো। প্যান্ট শার্টে তালি রিপু থাকলেও তা পরিস্কার থাকতো। মুখে লেগে থাকতো বিনম্র হাসি। অত্যন্ত নম্র ভদ্র ছেলে। কখনো খেলার মাঠে যেত না। ক্লাস শেষে তড়িঘড়ি করে বাড়ী দৌড়াতো। প্রথমে বুঝতে পারিনি, তাই কারণ জিজ্ঞেস করতাম। জবাবে পেতাম শুধুই তার একটা বিনম্র হাসি। পরে ফাহিয়ানের কাছে জেনেছিলাম, বাড়ীতে তার সৎ মা ছিলো। তাকে স্কুলে পড়তে অনুমতি দিয়েছিলো শুধু এই শর্তে যে সে স্কুলে যাবার আগে ও পরে বাড়ীর ধোয়া পাকলা, সাফ সুতরোর মত ডমেস্টিক কাজগুলো করে যাবে। মোটকথা, বাসার সবার কাপড় কাচা, থালা বাসন ধোয়া, ঘর ঝাড়ু দেওয়া, বাজার করা ইত্যাদি ছিল তার নিত্যদিনের কাজ। এর মাঝে যেটুকু সময় সে পেতো, সেটুকুই অধ্যয়নের কাজে ব্যবহার করে ক্লাসে প্রথম হতো। তবে একটু উপরের ক্লাসে উঠে সে তার এই স্থানটা আর ধরে রাখতে পারেনি। শুনেছিলাম, মেট্রিক পরীক্ষায় সে শুধু সাধারণ একটা ফার্স্ট ডিভিশন পেয়ে স্বাধীনতার ঠিক আগে আগে স্টেট ব্যাঙ্ক অব পাকিস্তানে (বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাঙ্ক) একটা নিম্ন পদের চাকুরীতে যোগ দিয়েছিলো। নয় মাসের স্বাধীনতা যুদ্ধে সে কোথায় যে হারিয়ে গেলো, তার খোঁজ আর কেউ রাখেনি। আসলে তার কোন ঘনিষ্ঠ বন্ধুও ছিলনা, যাকে জিজ্ঞেস করে কিছু জানতে পারতাম। ওর পরিস্থিতিতে কারো সাথে বন্ধুত্ব রাখাটাও বড় কঠিন বিলাসিতা ছিলো, তা আজ বেশ সহজেই বুঝি।

স্মৃতি আজকাল বড়ই প্রতারণা করে। তাই ভুলে যাবার আগে আমি এই পর্যায়ে কিছু ভালোলাগা বন্ধুদের নামোল্লেখ করতে চাই এই আশায়, যে হয়তো পরিচিত কারো নজরে লেখাটা পড়ে গেলে তাদের সাথে একটা যোগসূত্রের সম্ভাবনা দেখা দিলেও দিতে পারে। ইগ্নিশিয়াস গোমেজ ওরফে বিজু নামে আমার একজন ভালো বন্ধু ছিলো। নামেই বোঝা যায়, সে খৃষ্টান ছিলো। নিবাস কর আর সুবাস কর নামে দুই ভাই ছিলো। ওরা হিন্দু ছিলো। পূজো পার্বনে বাতাসার ভাগ পেতাম। ওদের বড় বোন দীপালী কর আমার বোনেরও বান্ধবী ছিলেন। মহীউদ্দীন আব্দুল কাদের নামে আমাদের চেয়ে বয়সে বড় একজন নামাযী ছেলে ছিলো, খুবই ভদ্র। তার দাঁতগুলো খুবই চকচকে সাদা ছিলো। রেজাউল করিম নামে একজন চঞ্চল প্রকৃ্তির বন্ধু ছিলো। সে প্রশংসনীয় প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের অধিকারী ছিলো। আর ইকবাল নামে আরেক ভালো বন্ধু ছিলো, যার সাথে পরে যোগাযোগ হয়েছিলো তার ছোটভাই ইসতিয়াক এর মাধ্যমে। তার বড় বোন লাইলীও আমার বড় বোনের বান্ধবী ছিলেন।

এখন ফিরে আসছি আবার ক্যাডেট কলেজে ভর্তি পরীক্ষার কথায়। ফরম পূরনের পর থেকে মূলতঃ আব্বার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানেই আমার প্রস্তুতি পর্ব শুরু হলো। আব্বা অঙ্ক আর ইংরেজীটা খুব ভালো পড়াতেন। অঙ্ক এমন করে বুঝাতেন যে একবারেই বুঝে যেতাম। ইংরেজী ট্র্যান্সলেশনের উপর খুব জোর দিতেন। ওটা করতে গিয়েই স্টক অব ওয়ার্ডস বেড়ে যেত। বাসায় ইংরেজী পেপার রাখা হতো রেগুলার। সেখানেও ইংরেজী চর্চার উপকরণ পাওয়া যেতো। তখনকার দিনে “গেট এ ওয়ার্ড” নামে পেপারে একটা সাপ্তাহিক প্রতিযোগিতা হতো। সেখান থেকেও নতুন নতুন কঠিন ইংরেজী শব্দের সাথে পরিচিত হওয়া যেতো, তবে কাঠিন্যের কারণে ওটা আমার ততটা কাজে দেয়নি এবং আমিও মোটেই উৎসাহী ছিলাম না। আব্বার দেখিয়ে দেয়া টেকনিক ধরেই আমি অনুবাদ করতাম এবং ক্লাসে সবসময় অনুবাদের জন্য সর্বোচ্চ নম্বরটা আমারই জন্য বরাদ্দ থাকতো। বড় হয়ে একদিন আব্বাকে লেখা পোস্ট কার্ডে (তখনকার দিনের দুই পয়সার) আমার দাদার ইংরেজীতে লেখা একটা চিঠি পড়ে বুঝতে পেরেছিলাম, আব্বার ইংরেজী শেখাটাও আমার দাদার কল্যানেই হয়েছিলো। অথচ আমার দাদার শিক্ষাগত ডিগ্রী খুব বেশী ছিলনা। তিনি দেওবন্দে আরবী ও ধর্মশিক্ষায় শিক্ষাগ্রহণ করে নীলফামারী সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ে আরবীর শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন এবং অবসর গ্রহনের পর আমাদের বাড়ীর কাছের মাসজিদে আজীবন ইমামতি করে গেছেন। তিনি আমার জন্মের আগেই প্রয়াত হন, সে কারণে তাঁকে চোখে না দেখলেও তাঁর একটা ইমেজ আমার মনে গেঁথে আছে। তিনি আরবী ও ফারসী ভাষায় একজন বিজ্ঞ ও পারদর্শী ব্যক্তি হিসেবে দূরদূরান্তে বেশ সুপরিচিত ছিলেন বলে লোকমুখে শুনেছি।

একদিন স্কুল থেকে বাসায় ফিরে দেখি সবাই খুব উৎসাহ নিয়ে কিছু একটা আলাপ করছে। বুঝতে পারলাম, আমার ক্যাডেট কলেজে ভর্তি পরীক্ষা সংক্রান্ত কিছু হবে। আব্বার হাতে একটা লম্বা খোলা হলুদ খাম ধরা। আমাকে দিলেন। খামের উপরটা মনোনিবেশ সহকারে পড়লাম। আমাদের বাসার ঠিকানা লেখা, আর খামের বামদিকে একটা সীলমোহরে “MOMESHAHI CADET COLLEGE” কথাটা গোল করে লেখা। মোমেনশাহী নামটা শুনতে আমার খুব ভাল লাগতো, এর ইতিহাস কিছুটা জানা ছিলো বলে। লক্ষ্য করেছিলাম, সীলে ইংরেজী N অক্ষরটা মিসিং ছিলো। অনেকদিন ঐ সীলটা ওভাবেই ব্যবহৃত হয়েছিলো। বোধকরি, স্বাধীনতার পরে সব সীল বাংলায় পরিবর্তনের আগে পর্যন্ত ওটা ওভাবেই ছিলো। খাম খুলে দেখি সেখানে আমার ছবি সম্বলিত একটা এডমিট কার্ড। ভেতরে ভেতরে একটা আশঙ্কা এবং সেই সাথে চ্যালেঞ্জের অনুভূতি স্পর্শ করে গেলো।

চলবে......
(ইতোপূর্বে প্রকাশিত)

ঢাকা
০৭ জুলাই ২০১৫
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।


সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই নভেম্বর, ২০১৫ সকাল ৮:১৫
১৮টি মন্তব্য ১৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি করাটা প্রফেসরদেরই ভালো মানায়

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৩


অত্র অঞ্চলে প্রতিটা সিভিতে আপনারা একটা কথা লেখা দেখবেন, যে আবেদনকারী ব্যক্তির বিশেষ গুণ হলো “সততা ও কঠোর পরিশ্রম”। এর মানে তারা বুঝাতে চায় যে তারা টাকা পয়সা চুরি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×