"আমার কথা - ২" পড়ুন এখানেঃ Click This Link
এর কিছুদিন পর আমার সদ্য তোলা পাসপোর্ট সাইজের ছবিটা আব্বা সেই পূরণকৃ্ত ফরমটার উপর আঠা দিয়ে সেঁটে দিয়ে ফরমটা আমাকে পড়তে দিলেন। আগে ক্যাডেট কলেজ সম্বন্ধে আমার কোন ধারণা ছিল না, তখনই প্রথম ক্যাডেট কলেজ কথাটার সাথে পরিচিত হ’লাম। পূরণকৃ্ত ভর্তি ফরমটা পড়ে বুঝলাম, এটা আমার স্কুলের চেয়েও উন্নত মানের কোন প্রতিষ্ঠান হবে। তবে উন্নত নতুন প্রতিষ্ঠানে যোগদানের কথা ভেবে পুলকিত হবার চেয়ে আমার ভালো লাগার পুরনো স্কুলটিকে ছেড়ে যাবার বেদনাই আমাকে বেশী আচ্ছন্ন করে রাখলো। স্কুলে আমার এক বন্ধু ছিলো, নাম আবুল হাসানাত ফাহিয়ান। তখনো খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেনি, কারণ সে ছিলো অন্য সেকশনে। শুধু আরবী ক্লাসে আমরা একসাথে হ’তাম। তখনকার দিনে ৫ম-৮ম শ্রেণীতে তৃতীয় ভাষা হিসেবে আরবী অথবা উর্দু নিতে হতো। আমাদের সেকশনের যারা উর্দু নিয়েছিলো, তারা আমাদের সেকশন থেকে ওদের সেকশনে যেত, আর ওদের যারা আরবী নিয়েছিলো, তারা ওদের সেকশন থেকে আমাদের সেকশনে আসতো। ফাহিয়ান আরবী নিয়েছিলো, তাই শুধু আরবী ক্লাসেই আমরা একসাথে বসতাম। সেই ফাহিয়ান একদিন অত্যুচ্ছ্বাসে আমাকে জানালো যে তার বাবা তাকে মোমেনশাহী ক্যাডেট কলেজে ভর্তি করানোর জন্য একটা ফরম কিনে এনেছে এবং সে অতি শীঘ্রই এই স্কুল ছেড়ে সেখানে চলে যাবে। স্কুল ও পরিবার ছেড়ে যাবার আনন্দ তার চোখে মুখে ঝিকিমিকি করে জ্বলছিলো। কেন, সেকথা পরে বলছি।
আমি তাকে আস্তে করে জানালাম যে আমার বাবাও একই কলেজ থেকে একটা ফরম এনেছেন এবং তা পূরণ করাও শেষ হয়েছে। এ ব্যাপারে আমার মধ্যে তেমন কোন উচ্ছ্বাস দেখতে না পেয়ে ফাহিয়ান আমাকে ক্যাডেট কলেজের আকর্ষণগুলোর কথা সবিস্তারে বর্ণনা করতে লাগলো, যার মধ্যে প্রধানতম ছিল বাবার শাসন থেকে মুক্তি। ফাহিয়ানের বাবা ছিলেন একজন প্রবাদ পুরুষ। তিনি তার ৬ ছেলে আর ১ মেয়েকে কঠোর নিয়মের বেড়াজালে আবদ্ধ রেখে মানুষ করেছিলেন। অবশ্য এ কারণেই হয়তো তারা সবাই ‘মানুষ’ হতে পেরেছে। তিনি তার ৬ ছেলের প্রত্যেকের নাম রেখেছিলেন ‘আবুল হাসানাত’ দিয়ে শুরু করে এর পর একজন বিখ্যাত ব্যক্তির নাম বসিয়ে। যেমন, চীনা পর্যটক ফা হিয়েন এর নামে আমার বন্ধুর নাম আবুল হাসানাত ফাহিয়ান, সে রকমভাবে ওর অন্যান্য ভাইদের নাম ফুয়াদ, ফারুক, ফেরদৌস, ফয়েজ ইত্যাদি। তিনি PTI এর সুপারিন্টেন্ডেন্ট ছিলেন। তার ছেলেরা সবাই আজ সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত।
ফাহিয়ান সরকারী বৃত্তি নিয়ে পোল্যান্ডের মেরিন একাডেমীতে প্রশিক্ষণ শেষ করে বেশ কিছুদিন জাহাজে চাকুরী করেছিলো। কিন্তু ওর ধরণ ধারণ ওরকম শৃঙ্খলাবদ্ধ চাকুরীর জন্য সাযুজ্যপূর্ণ ছিলনা। তাই, সে ক্যাপ্টেন পদে পদোন্নতির পর নাবিকের চাকুরী থেকে ইস্তফা দিয়ে ব্যবসায়ে নেমেছিল। সে যে নিজ থেকে ঐ বিষয়ে পড়াশোনা করতে আগ্রহী ছিলো, মোটেই তা নয়। বরং কোন রকমে দেশ ছেড়ে জগতের যে কোন প্রান্তরে গিয়ে সে মুক্তির নিঃশ্বাস নিতে চেয়েছিলো। নইলে সে জানতো, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হয়েও তাকে বাবার সামনে বসে থেকে পড়াশোনার মহড়া চালাতে হতো। তখন সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশকে পোল্যান্ডের সদাশয় সরকার বাংলাদেশী ছাত্রদের জন্য সেখানকার মেরিন একাডেমীতে পড়ার নিমিত্তে কিছু বৃত্তি দেয়। ফাহিয়ান সেটার জন্য আবেদন করলো এবং নির্বাচিতও হলো। পড়াশোনা ও প্রশিক্ষণ শেষে সে এক রুশ মহিলাকে বিয়ে করে প্রথম সংসার শুরু করেছিলো, কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে (কিংবা সৌভাগ্যক্রমে, হয়তো বা,) সে সংসার টিকেনি। পরে সে আবারো আরেক রুশ স্থপতি রমণীর পাণি গ্রহণ করে স্থায়ীভাবে চেক প্রজাতন্ত্রে আবাস গড়ে তোলে এবং সেখানে সে আজও সুখী জীবন যাপন করছে। তার আগের ঘরের ছেলেটাকেও তার দ্বিতীয় স্ত্রী পরম মমতাভরে লালন করেছেন এবং তারা এখনও একই ছাদের নীচে বসবাস করেন। চেক প্রজাতন্ত্রে ফাহিয়ান এখন একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী, প্রতি বছর সে একবার করে দেশে আসে। বৃদ্ধা মাকে দেখার টান তো আছেই, তবে ঠিক এর পরের আকর্ষণটি তার এমসিসি'র বন্ধুদের সাথে আড্ডা। যে ক'টা দিন সে দেশে থাকে, আমাদের সাথেই সে কয়েকদিন এক সাথে আড্ডা আর খাওয়া দাওয়া করে চলে যায়। ওর সবচেয়ে বড়ভাই আবুল হাসানাত ফারুক পিতার ন্যায় শিক্ষা বিভাগে যোগদান করেন এবং গভঃ ল্যাবোরেটরি স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে অবসর নেন। ওর ইমিডিয়েট বড় ও ছোট ভাই যথাক্রমে ফুয়াদ ও ফেরদৌস রাজশাহী ক্যাডেট কলেজ থেকে পাশ করে। ফুয়াদ গণপূর্ত বিভাগের চীফ আর্কিটেক্ট হিসেবে অবসর নেয়। ফেরদৌস বিভিন্ন পাবলিক মেডিক্যাল কলেজেগুলোতে ফার্মাকোলজির প্রফেসর হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর এখন অবসরপ্রাপ্ত। সবচেয়ে ছোট ভাই এক মালয় মহিলাকে বিয়ে করে মালয়েশিয়াতে স্থায়ীভাবে বসবাস করছে। সেও বুয়েট থেকে পাস করা একজন প্রকৌশলী। ওর বাকী আরেক ভাইয়ের কাহিনী একাই একটা উপন্যাস হবে। তার কথা অন্য আরেকদিন প্রসঙ্গান্তরে বলা যাবে।
ফাহিয়ানের ভাইদের এতটা বর্ণনা দিলাম এই কারণে যে তারা বড় ছোট সবাই আমার ও আমার অন্যান্য বন্ধুদের কাছেও বন্ধুর মতই ছিলো। আর তারা সবাই নিজেদেরকে তাদের পিতার শাসনের যাঁতাকলে নিষ্পেষিত বলে মনে করতো। সবার পরিস্থিতি এক হওয়াতে সবাই বন্ধুর মত হয়ে গিয়েছিলো। আমরা, মানে ফাহিয়ানের বন্ধুরা তাদের ৭১, শান্তিনগর এর বাসায় (জোনাকী সিনেমা হলের পেছনে) যখন যেতাম, তখন রীতিমত একটা রেকী করে জেনে নিতাম যে ওর বাবা বাসায় আছেন কিনা। তাঁর সামনে পড়ে গেলে আমরাও একই রকম ট্রীটমেন্ট পেতাম, অর্থাৎ ফাহিয়ান এবং তার ভাইদের সাথে আমাদেরকেও বই নিয়ে বসে যেতে হতো। একবার কয়েকজন বন্ধু মিলে জোনাকীতে একটা ম্যাটিনী শো দেখবো বলে টিকিট কেটে ফাহিয়ানকে ডাকার জন্য ওর বাসায় গেলাম। দুর্ভাগ্যক্রমে সরাসরি পড়ে গেলাম তার বাবার সামনে। কারণ, কি কারণে যেন সেদিন তিনি অফিসে যান নি। বলাবাহুল্য, সেদিন জোনাকিতে আমাদের সীট গুলো ফাঁকাই রয়ে গিয়েছিলো, আর আমরা সবাই টানা আড়াই ঘন্টা ফাহিয়ানের বাবার সামনে বসে পাটিগণিতের অংক কষে বিকেলে চা মুড়ি খেয়ে বাড়ী ফিরেছিলাম। আসলে তখন আমাদের গার্জেনরা সন্তানদের দেখভালের ব্যাপারে সবাই বোধহয় কম বেশী এরকমই ছিলেন। তারা ছেলেমেয়ের বন্ধুদেরকে নিজ সন্তানের মত আদরও যেমন করতেন, শাসনও তেমন করতেন। আমরা ওর বাবার আদেশপ্রাপ্ত হয়ে যেমন ভয়ে ভয়ে এক টেবিলে পড়তে বসতাম, তেমনি ওর মায়ের ডাকে ওদের পাশে বসেই এক সাথে খাবার খেতাম। আমার বাসায়ও ওদের মত অতটা কঠোর না হলেও, মোটামুটি কড়াকড়ি নিয়ম ছিল। নতুন কোন বন্ধু প্রথম এলে বাবা, মা কিংবা অন্য কারো না কারো একটা ছোটখাট ইন্টারভিউ এর বৈতরণী পার হয়েই কেবল সে নিজেকে ওয়েলকাম ফীল করতে পারতো। আর এখন আমরা বাবা মা হিসেবে অন্যের ছেলেকে কেন, নিজের ছেলেকেও শাসন করার আগে দু’বার চিন্তা করে নেই!
চলবে...
ঢাকা
০৬ জুলাই ২০১৫
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই আগস্ট, ২০২২ সকাল ১০:৪৩