somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমার কথা - ৮

১৩ ই নভেম্বর, ২০১৫ ভোর ৪:৫৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

"আমার কথা - ৭" পড়তে হলে এখানে ক্লিক করুনঃ আমার কথা - ৭

দিনটি ছিলো শুক্রবার, বাংলা ক্যালেন্ডার মোতাবেক ২৩শে আষাঢ়। তখন সাপ্তাহিক ছুটির দিন ছিলো রোববারে, শুক্রবার ছিলো অর্ধদিবস, জুম্মার নামাযের জন্য বেলা ১২টায় অফিস আদালত ছুটি হয়ে যেতো। আমাকে মোমেনশাহী ক্যাডেট কলেজে রেখে আসার জন্য আব্বা ঐ দিনটা ছুটি নিয়েছিলেন। সকাল থেকেই আমর মনটা খুব খারাপ ছিলো। কলেজে যাবার দিন যতই ঘনিয়ে আসছিলো, বাসার সবাই আমার সাথে ততই একটু বেশী সদয় আচরণ করা শুরু করেছিলো। এমনকি ভাইবোনদের সাথে সচরাচর যেসব বিষয়ে খুনসুটি হতো, সেসব বিষয়ে তারা আমাকে ছাড় দিতে শুরু করলো। অন্যান্য সময়ের চেয়ে বেশী বেশী পাওয়া এই আদর আপ্যায়ন আমাকে কেন জানি আরও বেশী ব্যথিত করে তুলছিলো। আম্মা সেদিন পোলাও কোর্মা রেঁধেছিলেন। আমি যা যা খেতে পছন্দ করতাম, মেন্যুতে তার অধিকাংশই ছিলো। কিন্তু কি আশ্চর্য, খেতে বসে দেখি আমার সে পছন্দের খাবারগুলো কিছুতেই গলা দিয়ে নীচে নামছেনা। ঢোক গিলে গিলে আর পানি খেয়ে খেয়ে কোনমতে গিলে উঠলাম।

কলেজের নির্দেশানুযায়ী বানানো নতুন পোষাক পড়ে নিলাম। পকেটে নতুন রুমাল। রওনা হবার সময় সবার চোখে পানি। আম্মার দিকে তাকাতে পারছিলাম না। বাসার সবাই একে একে নানা ধরনের মায়া লাগানো উপদেশ দিয়ে যাচ্ছিলো। আমার ঢোক গিলতে কষ্ট হচ্ছিলো। দুপুর দুটোর দিকে আমি আর আব্বা বাসা থেকে রওনা হয়ে ফুলবারিয়া রেল স্টেশনের পেছনে (এখনকার গুলিস্তানের পেছনে) এসে নামলাম। তখন টাঙ্গাইল ও ময়মনসিংহের বাসগুলো ওখান থেকেই ছাড়তো। আর টাঙ্গাইল জেলায় কোন রেলপথ ছিলনা। আমার মত আব্বাও এর আগে কখনো টাঙ্গাইল জেলার কোথাও যান নাই। সেজন্য তিনি একদিন আগে এসে সব খোঁজ খবর নিয়ে গিয়েছিলেন, কোথা থেকে বাস ছাড়বে, কিভাবে কিভাবে মোমেনশাহী ক্যাডেট কলেজে যেতে হবে। আড়াইটার দিকে বাস ছাড়লো, সেটা ছিলো ইপিআরটিসির (বর্তমানে বিআরটিসি) একটা বাস। তখন আজকের দিনের মত মহাখালী টু এয়ারপোর্ট রাস্তাটা ছিলোনা। টাঙ্গাইল ময়মনসিংহের বাসগুলো ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের ভেতর দিয়ে যাতায়াত করতো। পুরনো ক্যান্টনমেন্ট রেলস্টেশন পার হয়ে কুর্মিটোলা দিয়ে এয়ারপোর্ট এর কাছে গিয়ে উঠতো। ওখান থেকেই মোটামুটি নিরিবিলি রাস্তা শুরু হতো। উত্তরার অস্তিত্ব ছিলনা, একেবারে টঙ্গীতে গিয়ে কিছু জনবসতি ছিলো। রাস্তাগুলো খুব সরু ছিলো। বিপরীতমুখী যানবাহনগুলো একে অপরকে অতিক্রমের সময় একটু স্লো হয়ে রাস্তার একপাশে দু’চাকা নামিয়ে অপরকে যেতে দিতো। যানবাহনের স্বল্পতার কারণে কদাচিৎ ওভারটেকিং এর প্রয়োজন হতো।

টঙ্গীর পর থেকেই রাস্তা খালি। জয়দেবপুর (বর্তমানে গাজীপুর) চৌ্রাস্তার পর থেকে সবকিছু একেবারে শুনশান, শুধু বাসের চাকার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছিলো। মৌচাক এর কাছাকাছি থেকে শুরু হলো গজারীর বন। আকাশে চলছিলো মেঘ আর রোদের লুকোচুরি খেলা। ধীরে ধীরে এ্যাংজাইটি অব দ্য আনসার্টেন- অজানার আশঙ্কা আমাকে গ্রাস করতে লাগলো। যতই গজারীর বনের গভীরে প্রবেশ করছিলাম, ততই যেন সাইলেন্স অব দ্য গ্রেভ- ক্ববরের নীরবতা আমাকে আচ্ছন্ন করে তুলছিলো। ভাবছিলাম, এই অজ পাড়াগাঁয়ে আমি দিনের পর দিন থাকবো কী করে! গন্তব্য যতই নিকটবর্তী হচ্ছিলো, আমার, এবং সেই সাথে আব্বারও অস্থিরতা তত বাড়ছিলো। তিনি বারে বারে বাসের কন্ডাক্টরকে নানা প্রশ্ন করছিলেন। একটা জায়গায় এসে দেখলাম রাস্তার উপর বাজার বসেছে। তখন আম কাঁঠালের সীজন ছিলো। রাস্তা জুড়ে শুধু আম আর কাঁঠালের ছড়াছড়ি। জায়গাটার নাম কালিয়াকৈর। জানালা দিয়ে দেখলাম, রাস্তার পাশেই একটা সিনেমা হলও ছিলো। সেদিনের দেখা সেই সিনেমা হলের প্রসঙ্গ পরে আবারো আসবে। বাসের কন্ডাক্টর ঘোষণা দিল, ক্যাডেট কলেজ আর দশ মিনিটের পথ। ঘোষণা শুনে আমি নড়ে চড়ে বসলাম।

মাত্র দেড় ঘন্টার মাথায় আমরা সেদিন ফুলবাড়িয়া থেকে পাবলিক বাসে করে ক্যাডেট কলেজ স্টপে পৌঁছেছিলাম। অথচ আজকের এই ডিজিটাল যুগে নিজস্ব গাড়ীতেও সে পথ মাড়াতে কম করে হলেও তিন ঘন্টা সময় গুনতে হয়। অথচ পীচ ঢালা পথ অনেক মসৃণ হয়েছে এবং চারগুণ প্রশস্ত হয়েছে। সত্যিই, মনুষ্য শক্তি আর শ্রম ঘন্টার কি নিদারুন অপচয়! এদিকটায় যদি সমাজবিজ্ঞানীরা একটু খেয়াল দিতেন! যাহোক, বাস থেকে নেমে জানলাম, সেখান থেকে কলেজের অভ্যর্থনা এলাকা অনেকটা পথ। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কৌ্তুহলী দৃষ্টি নিয়ে চারিদিকে তাকাতে থাকলাম। একটা ত্রিকোনাকৃতির খোলা প্রাঙ্গণে কংক্রিট নির্মিত একটা সাদা রঙের বিশাল তিরের ফলার (Arrowhead) উপরে লাল রঙে জ্বল জ্বল করে লেখা ছিলো, "MOMENSHAHI CADET COLLEGE"।

ঢাকা-টাঙ্গাইল সড়কে ঐ তির টা একটা উল্লেখযোগ্য ভূমিচিহ্ন (Landmark) ছিল। সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে পা ব্যথা হয়ে গেলো, তবু কোন রিক্সা চোখে পড়লোনা। পথচারীরা জানালো, রিক্সা মাত্র গুটি কয় ছিলো, তবে তারা অভ্যাগতদের ফেরী করতে ব্যস্ত, প্রয়োজনের তুলনায় নিতান্তই অপ্রতুল। তাই আমরা ব্যাগ হাতে করে হাঁটা শুরু করলাম। কিছুদের গিয়েই অবশ্য একটা খালি রিক্সা পেয়ে তাতে চড়েছিলাম। কলেজের গেটে দেখলাম খাকী পোষাক পড়া প্রহরী দাঁড়িয়ে। প্রহরীরা আমাদের দেখে গেট খুলে দিলো। সেই বিশাল আবদ্ধ ফটকের পাল্লা খোলা ছিল আমার জীবনের একটা প্রশস্ত ফটকের প্রতীকী দ্বারোদ্ঘাটন।



চলবে…
(ইতোপূর্বে প্রকাশিত)

ঢাকা
১১ জুলাই ২০১৫
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই জুলাই, ২০১৯ সকাল ১০:০৬
২১টি মন্তব্য ২০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মৃত্যুর আগে ইবলিশ ঈমান নিয়ে টানাটানি করে

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:০২



ইউটিউব হুজুর বললেন, মৃত্যুর আগে ইবলিশ ঈমান নিয়ে টানাটানি করে। তখন নাকি নিজ যোগ্যতায় ঈমান রক্ষা করতে হয়। আল্লাহ নাকি তখন মুমিনের সহায়তায় এগিয়ে আসেন না। তাই শুনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মহিলা আম্পায়ার, কিছু খেলোয়ারদের নারী বিদ্বেষী মনোভাব লুকানো যায় নি

লিখেছেন হাসান কালবৈশাখী, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯



গত বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল প্রাইম ব্যাংক ও মোহামেডানের ম্যাচে আম্পায়ার হিসেবে ছিলেন সাথিরা জাকির জেসি। অভিযোগ উঠেছে, লিগে দুইয়ে থাকা মোহামেডান ও পাঁচে থাকা প্রাইমের মধ্যকার ম্যাচে নারী আম্পায়ার... ...বাকিটুকু পড়ুন

জানা আপুর আপডেট

লিখেছেন আরাফআহনাফ, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৫৭

জানা আপুর কোন আপডেট পাচ্ছি না অনেকদিন!
কেমন আছেন তিনি - জানলে কেউ কী জানবেন -প্লিজ?
প্রিয় আপুর জন্য অজস্র শুভ কামনা।



বি:দ্র:
নেটে খুঁজে পেলাম এই লিন্ক টা - সবার প্রোফাইল... ...বাকিটুকু পড়ুন

বন্ধুর বউ কে শাড়ি উপহার দিলেন ব্যারিস্টার সুমন। বাটার প্লাই এফেক্ট এর সুন্দর উদাহারন।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:০৭



এক দেশে ছিলো এক ছেলে। তিনি ছিলেন ব্যারিস্টার। তার নাম ব্যারিস্টার সুমন। তিনি একজন সম্মানিত আইনসভার সদস্য। তিনি সরকার কতৃক কিছু শাড়ি পায়, তার জনগণের মাঝে বিলি করার জন্য।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×