আমার কথা - ৬ পড়ুন এখানেঃ আমার কথা - ৬
ভাইভার পর মেডিকেল টেস্টকে নিছক আনুষ্ঠানিকতা বই অন্য কিছু মনে হয়নি আমার, যদিও সেখানেও প্রায় ২০/২৫ জন প্রার্থী বিভিন্ন কারণে বাদ পড়েছিলো। শেষ বৈতরণীটি পার হবার পর থেকে মনটা বেশ ফুরফুরে থাকতো। আমারও, বাড়ীর আর সবারও। পাড়া পড়শীর কাছে আমার সম্মান অনেক বেড়ে গিয়েছিলো। পাড়াতো চাচারা, চাচীরা ডেকে নিয়ে আমাকে দেখিয়ে তাদের ছেলেমেয়েদেরকে বলতো, ওর মত হতে চেষ্টা করো। চূড়ান্ত ভাবে নির্বাচিত হয়েছি, এটা জানার পর আর স্কুলে যাবার তাগিদ অনুভব করতাম না, বাড়ী থেকেও তেমন কোন চাপ ছিলোনা। এই প্রথম জীবন প্রণালীর শক্ত বুনটে কেমন যেন এক ঢিলে ঢালা ভাব অনুভব করতে শুরু করলাম। অবশেষে সেই প্রতীক্ষার পালা শেষ হলো। হাতে এলো কলেজে যোগদানের নির্দেশাবলী। অপেক্ষা করতে লাগলাম, কবে আসবে ০৭-০৭-১৯৬৭।
বাসার ছোটখাট বাজার সদাই করার দায়িত্বটা অনেক ছোট বয়সে আমার কাঁধে চাপে। কারণ ভাইবোনদের সিরিয়ালে আমার অবস্থানটা ঠিক মধ্যখানে। আমার ওপরেও বোন, নীচেও বোন। বড় বোনের ওপরের ভাইটা বাজার করার জন্য অতিশয় মুরুব্বি। আর ছোটবোনের ছোট ভাইটা অতিশয় পিচ্চি। মাসের বাজারটা আব্বা নিজেই করতেন। দৈনন্দিনের দায়িত্বটা তাই এসে পড়েছিল আমার উপর। তখন তো আর এখনকার মত জায়গায় জায়গায় শপিং মল ছিলোনা। পাড়ায় পাড়ায় দুই একটা মুদি দোকান ছিলো বটে, তবে সেখানে সব্জী, মাছ মাংসের মত কোন "ফ্রেশ" আইটেম পাওয়া যেতোনা। বাজারের আভ্যন্তরীণ বিচিত্র অভিজ্ঞতা তো রয়েছেই, বাজারে যাওয়া আসার পথেও যে প্রতিদিন কত চমকপ্রদ ঘটনার সম্মুখীন হতাম! ছোটবেলায় যোগীন্দ্রনাথ সরকারের “কাজের ছেলে” কবিতাটা পড়ে খুব মজা পেয়েছিলাম। বাজার করা শুরু করার পর থেকে আমার অবস্থাটাও অচিরেই সেই কাজের ছেলেটার মতই হয়ে গেলো। কবিতাটা আপনারা ভুলে গিয়ে থাকলে এখানে পাবেনঃ কাজের ছেলে
গ্রামে গঞ্জে গেলে দেখা যায় যে প্রতি তিন চারশ' গজ দূরে দূরে একেকটা মাচা বা টং এ মুদি দ্রব্যের কিংবা চা পান এর পসরা সাজিয়ে বসা আছে একজন যুবক অথবা মধ্যবয়স্ক দোকানদার বা চা ওয়ালা, অপেক্ষায় কখন তার দোকানে ক্রেতা কিংবা শুধুই একজন গসিপিস্ট আসবে, আর চায়ের কাপে ঝড় তুলবে। পৃথিবীর আর কোন দেশে যুবশক্তির এমন অপচয় হয়না। অবশ্য বাল্যকালে, এমনকি কিশোরবেলায় আমিও পথেঘাটে ক্যানভাসারদের আহ্বানে সোৎসাহে সাড়া দিতাম এবং তাদের উৎসুক শ্রোতার সারিতে ভিড়ে যেতাম। বলাই বাহুল্য, তাদের চমৎকার বাকপটুতা আর মার্কেটিং স্কিল দেখে আমি এতটাই বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে যেতাম যে প্রায়শঃ আমাকে পকেটমারদের খপ্পরে পড়ে পকেটে যা দু'চার টাকা থাকতো, সেটাও হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে বাড়ী ফিরতে হতো।
পরিবারের জন্য বাজার করার দায়িত্বটা আমার কাঁধে fait accompli হিসেবে চেপে বসেছিলো। এর কারণ কিছুটা হাল্কাভাবে আগেই উল্লেখ করেছি। তবে এই দায়িত্বপালন আমাকে অনেক সমৃদ্ধ করেছে। প্রথমতঃ, নানান কিসিমের ঠগ-বাটপারের সাথে পেরে ওঠার বুদ্ধিটুকু ছোটবেলা থেকেই রপ্ত করতে শিখেছিলাম। তারপর, এটা আমার নিজের উপর আত্মবিশ্বাস অনেকটা বাড়িয়ে দিয়েছিলো। বাজারে যাওয়া আসার পথের নানারকম বৈচিত্র আমাকে আকর্ষণ করতো। বাকপটু ক্যানভাসারদের একনিষ্ঠ শ্রোতা হিসেবে আম জনতার সাথেও টুকটাক আলাপ সালাপ হতো। মাস পিপল এর সাথে এই যোগাযোগ আমাকে আত্মবিশ্বাসী করে তুলতো এবং আমার ভেতরের জড়তাকে কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করতো। পঁচা মাছ চিনতে শিখেছিলাম, কয়েকদফা বাসায় নিয়ে আসার পর। ওজনের কারচুপি ধরতে শিখেছিলাম। সবচেয়ে উপকার হয়েছিলো আরেকটা বিষয়ে। সেটা এ প্রজন্মের লোকেরা বুঝতে পারবে কিনা কে জানে। আমি যখন বাজার করতাম, তখনো দেশে মেট্রিক সিস্টেম চালু হয়নি। পণ্য ক্রয় বিক্রয় হতো মণ, সের, ছটাক আর তোলার হিসেবে। তখন পাটিগণিতে নানারকম আর্যা (some kind of rhymed arithmetical formulae) শেখানো হতো। আমরা শ্লোকের সাহায্যে সেগুলো ধারাপাতের Tables এর ন্যায় মুখস্থ করতাম। বাজার করার সময় সেগুলো ম্যাজিকের ন্যায় কাজে দিতো। দুর্ভাগ্যজনক, যে সেসব আর্যা বা শ্লোক আজ আর আমার মনে নেই। থাকলে দুই একটা উদাহরণ দিলে সহজে বুঝা যেতো। তবে, উদাহরণস্বরূপ সহজ ভাষায় বলি, কোন জিনিসের মূল্য মণপ্রতি যত টাকা হবে, আড়াই সের এর দাম ঠিক তত আনা হবে। চালের মণ ৪০ টাকা হলে আড়াই সের এর দাম হবে ৪০ আনা, অর্থাৎ আড়াই টাকা। এভাবে পাটিগণিতের আর্যা প্রয়োগ করে আমি খুব দ্রুত ক্রয়কৃ্ত পণ্যের হিসেব মানসিকভাবে বের করতে পারদর্শী হয়ে উঠেছিলাম। পরবর্তীতে চাকুরী জীবনে যখন একাউন্টস ক্লার্ক তার একাউন্টস লেজার সাইন করানোর জন্য আমার কাছে নিয়ে আসতো, আমি পুরো পৃষ্ঠার সব এন্ট্রির যোগফল মুখে মুখে বের করে ফেলতে পারতাম কোন ক্যালকুলেটর ছাড়াই। একাউন্টস ক্লার্ক ক্যালকুলেটরের সাহায্য নিয়ে যতক্ষণে রেজাল্ট বের করতো, আমি তার অর্ধেক সময়ে নির্ভুলভাবে ফলাফল বের করতে পারতাম।
সাব্যস্ত হয়েছিলো, ০৭-০৭-৬৭ তে বাসায় আর্লি লাঞ্চ করে আমি আর আব্বা দু’জনে মিলে রওনা হবো আমার নতুন ঠিকানার উদ্দেশ্যে। বাসার সবাই মিলে সানন্দে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো যে ঐ দিনের বাজারটা আমার না করলেও চলবে। কিন্তু আমার কাছে এ দায়িত্বমুক্তির সিদ্ধান্তটা ভালো লাগছিলো না। বরং খুব চাচ্ছিলাম, শেষ দিনের দায়িত্বটাও ঠিকভাবে পালন করে যেতে। উসখুস করতে করতে আম্মার কাছে গিয়ে আমার ইচ্ছেটার কথা জানালাম। আম্মা প্রথমে কিছুটা আপত্তি করলেও আমার পীড়াপীড়ীতে বাজারের থলেটা হাতে ধরিয়ে দিলেন। তবে হয়তো তাঁর সেদিন আমার উপর খুব মায়া হয়েছিলো। আমি সবসময় হাঁটাপথেই বাজারে যাওয়া আসা করতাম। রিক্সায় যেতে হলে চার আনা (২৫ পয়সা) ভাড়া গুনতে হতো। আম্মা কোন কোন দিন রিক্সাভাড়া বাবদ আমার হাতে অতিরিক্ত চার আনা ধরিয়ে দিলে আমি সেটা বাঁচিয়ে আমার পছন্দমত খরচ করতাম। সেদিন আম্মা আমাকে পাঁচ আনা দিয়ে বললেন, তাড়াতাড়ি বাজার করে যেন রিক্সায় করে বাসায় আসি। আমি রওনা হবার সাথে সাথে আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি এলো। আজ ১০-৭-১৫ তারিখে যখন এই মুহূর্তে আমি এই লেখাটা লিখছি (১২ টা ১২), এখন যেমন আকাশটা মুষলধারে ঝরছে, ঠিক তেমন করেই সেদিন আকাশটা ভেঙ্গে এসেছিলো। অন্যদিন হলে দৌড়ে কোথাও কাভার নিতাম। কিন্তু সেদিন তা ইচ্ছে হলোনা। আমার কোন দুঃখে আমি কখনো কারো সামনে কাঁদতে পারতাম না। ভীষণ লজ্জা লাগতো। কেন যেন সেদিন সকাল থেকেই আমার মনের মধ্যে খুব দুঃখ দুঃখ একটা ভাব এসে জমা হচ্ছিলো। প্রকৃ্তি তার অপার উদারতায় আমার জন্য ইমোশনাল ক্যাথার্সিস (emotional catharsis) এর একটা ব্যবস্থা করে দিলো। আমি বৃষ্টিতে ভিজে পথ চলতে চলতে প্রাণভরে কাঁদতে শুরু করলাম।
চলবে…
(ইতোপূর্বে প্রকাশিত)
ঢাকা
১০ জুলাই ২০১৫
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই নভেম্বর, ২০১৫ সকাল ৭:১৯