সমস্যা মিয়ার সিঙ্গারা সমুচার দোকানে প্রতিদিন আমরা এসে জমায়েত হই, যখন বিকালের বিষণ্ন রোদ গড়িয়ে গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে, সন্ধ্যা পেরিয়ে আকাশের রঙিন আলোর আভা মিলিয়ে যেতে শুরু করে। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা থেকে আটটা, এর মাঝেই আমাদের সবার আসন দখল করা হয়ে যায়। মিশু ডাক ছাড়ে, “সমস্যা মিয়া, আমাদের পাঁচটা সমস্যা দাও।”
আমাদের এ জীবনে সমস্যার কমতি নেই, তবু আয়োজন করে এই সমস্যা খাওয়া আমাদের নিত্যদিনের কাজে পরিণত হয়েছে।
এ দোকানের মালিক মধু মিয়া। দোকানের কোনো নাম নেই। টং দোকানের নাম হওয়ার জন্য, যতখানি যোগ্যতা লাগে- এই যেমন মাথার উপর অন্তত বাঁশের আড়ায় আটকানো টিনের ছাউনি, তেল চিকচিকে টেবিলের এক কোণায় লবণের বৈয়াম, সে টেবিল ঘিরে অন্তত কাঠের না হোক, প্লাস্টিকের নড়বড়ে চেয়ার, কিছু চেয়ারের কোণায় আধ ভেজা টেবিল মোছার রং ঝলসে যাওয়া তোয়ালে, বাঁশের আড়া ধরে বিকট শব্দ ছেড়ে পৃথিবী কাঁপানো ফ্যানের ঘূর্ণন, তার কিছুই এ দোকানে খুঁজে পাওয়া যাবে না। এখানে খোলা আকাশের নিচে, হলদে আলো দেয়া ফিলামেন্টের বাল্বের ঝলকে কেরোসিনের চুলায় কালো কুচকুচে কড়াইয়ে টগবগে তেলে সিঙ্গারা, সমুচা ভাজা হয়। আমরা যে আকারের বাটিতে চানাচুর কিংবা বিস্কুট পরিবেশন করি বাসা বাড়িতে, সে আকারের কিছু মেলামাইনের বাটি, যা কি-না এই দোকানের মতন কিংবা আমাদের মতন জীর্ণ দশায় জর্জরিত, তাতে সিঙ্গারা সমুচা দেয়া হয়। উপর দিয়ে ছিটিয়ে দেয়া হয়, কোল্ড ড্রিংকসের আড়াইশ মিলির বোতলে জমাট বাধা বিট লবণ, সাথে পেয়াজ, আস্ত কাঁচা মরিচ কিংবা শসা কুচি। এক্ষেত্রে একটা বিষয় মনে রাখা উচিত, যেবারে পেয়াজের দাম বাড়বে সেবার কাঁচা মরিচ ও শসা কুচি পাওয়া যাবে। কাঁচা মরিচের দাম বাড়লে, ও জিনিস বাদ যাবে। তবে যখন পেয়াজ ও কাঁচা মরিচ উভয়েই নাগালের মধ্যে, তখন আমরা নিশ্চিন্তে আমাদের বাটির পাশে তিন রকম অতিরিক্ত জিনিসই পেয়ে থাকি। সে হিসাবে বলা যায়, শসা এখানে ভাগ্যবান। কোনো অবস্থাতেই সে বাদ যাচ্ছে না।
এ দোকানে সারি করে সাজানো গোটা তিনেক বেঞ্চের একটা আমরা দখল করে বসে থাকি, অনেক রাত অবধি। আমাদের পাঁচখানা সমস্যা এসে হাজির হয়। আমি সদ্য কাটা পেয়াজে কামড় বসাতে বসাতে, সমস্যা গলাধঃকরণ করা শুরু করি।
আমাদের এই আসন গ্রহণ তালিকার সর্বশেষে সবসময় হাজির হয় মোনেম। মোনেম অফিসের জন্য বের হয় সবার আগে, ছুটিও আগে। তবু আসতে আসতে নিত্যদিনই ওর দেরী হবে। সকাল সাতটা থেকে বিকাল পাঁচটা অফিস মোনেমের। কিন্তু পাঁচটার পর, অফিসের ম্যানেজারের জন্য ঘন্টা দুয়েক অতিরিক্ত ঘাটুনি ওর প্রতিদিনকার রুটিনে পরিণত হয়েছে। এই অতিরিক্ত ঘাটুনি, মোনেমকে অতিরিক্ত উপার্জনের পথ করে দেয় না কখনও। তবু চাকরি বাঁচাবার তাগিদে, মোনেম খেটে যায়। মাস শেষে অফিসের টার্গেট পূরণের জন্য অতিরিক্ত সম্মানি ম্যানেজারের কপালে জুটলেও, মোনেমের নাম কখনও উচ্চারিত হয় না। মোনেম মোটামুটি ভালো বেতন পেলেও, মাঝে মধ্যেই ওর বিস্তর অবসর চলে আসে, ঠিক তখন যখন ওর অফিস আর্থিক টানাপোড়নে পড়ে যায়। সে টানাপোড়নের প্রভাব, যে ক’জনার উপর পড়ে, তার মধ্যে মোনেম অন্যতম। ও মাঝে মাঝেই বছরে এক দুই মাসের জন্য ছুটি পায়, বিনা বেতনে ছুটি। আবার যখন অফিসের কাজের ব্যস্ততা বেড়ে যায়, মোনেমের ডাক পড়ে। এই বছর চারেক আগে, লকডাউনের দিনে, ছ’মাসের বিশাল ছুটি কাটিয়ে মোনেম যোগদান করেছিল অফিসে। মোনেম গাধার খাটুনি খেটেও, অফিসের অবিচ্ছেদ্য অংশ হতে পারে না। তাই হয়ত, সালাদের বাটিতে পেঁয়াজ কিংবা কাঁচা মরিচের অনুপস্থিতি মোনেমকে ভীষণ পীড়া দেয়। পেঁয়াজ কিংবা কাঁচা মরিচের অনুপস্থিতিতে শসার উপর অভিমান হয়। তিনখানা সালাদ উপাদান বাটিতে না থাকলে, মোনেম সালাদ ছুঁয়ে দেখে না। আমরা তা দেখি, খেয়াল করি, মোনেমের থমকে যাওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে, কিছু বলার সাহস পাই না।
আমাদের মধ্যে সবচেয়ে অর্থাভাবে দিন কাটায় সাদেক। একেকদিন একেকজনের সমস্যার বিল পরিশোধের ঘূর্ণনে, আমরা সাদেককে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করি। তবে একেবারে বাদ দেয়া যায় না, পাছে সাদেক মনে করে আমরা ওকে করুণা করছি। যে সময় হতে বন্ধুত্বের সম্পর্কে বোঝাপড়ার অপর নাম করুণা হয়ে যায়, সে সময় হতেই বন্ধুত্বে মরচে ধরা শুরু করে। ফেঁপে ওঠা হাওয়াই মিঠাই যেমন মুখে পড়লেই চুপসে যায়, ঠিক তেমন করুণা জমে জমে ফেঁপে ওঠা বোঝাপড়া এক নিমিষেই মিলিয়ে যায়।
সাদেক কিছুটা ভুলোমনা হলেও, সাদেককে ওর কাজের ধরণের জন্য অফিসে ভালো সমাদর করা হয়। যদিও তা সমাদর না করুণা সে সমীকরণ সাদেক মিলাতে পারে না, কখনও মিলাতেও হয়ত যায় না। আমরা সবাই যখন পড়ালেখায় ব্যস্ত, নিজে উপার্জন করে সংসার চালানো সম্ভব কি-না তা বুঝতেও শিখিনি, সে বয়সে পিতা হারিয়ে সাদেক সংসারের দায়িত্ব নিজের কাধে তুলে নিয়েছিল পড়াশোনা বাদ দিয়ে। একদম নতুন এক কোম্পানিতে চাকরি নিয়ে, সে কোম্পানির ম্যানেজার যে কর্তব্য পালন করে, তা থেকে শুরু করে অফিসের বসের বাজার করা পর্যন্ত সকল দায়িত্ব পালন করেছে। সাদেকের করুণ অর্থাভাবের বিষয়ে অবগত হয়ে, অফিসের বস সাদেককে তার একান্ত সহকারী করে চাকরি দিয়েছিল, পোস্টের নাম কী জানতে চাইলে, সাদেক উত্তর পেয়েছিল বসের কাছ থেকে, “তুমি শুধু আমার সাথে সাথে থাকবে।” সাদেক সাথে থেকেছে, কোম্পানির প্রথম থেকেই। সে কোম্পানি এখন বেশ বড়, প্রতি পোস্টে নির্দিষ্ট যোগ্যতা সম্পন্ন লোক আছে। শুধু যোগ্যতাহীন সাদেকের কোনো পোস্ট নেই, অর্থনৈতিকভাবে স্বচ্ছলতা নেই।
সাদেক নিজেই নিজের পোস্টের একটা নাম ঠিক করেছে, ‘তুমি শুধু আমার সাথে সাথে থাকবে।’
এই সাথে সাথে থাকার পাল্লায়, সাদেকের কোনো যোগ্যতা গড়ে ওঠেনি, সংসারে স্বচ্ছলতা আসেনি, ভীষণ ভালোবাসার মানুষটাকেও সাথে রাখতে পারেনি। যোগ্যতাহীনের সাথে স্বার্থ ছাড়া কেইবা থাকতে চায়?
প্রতিবার যখন আমাদের কোম্পানিতে প্রমোশন হয়, পোস্ট বদলায়, সাদেক তখন হেসে বলে, “আমার একটা পাক্কা পোস্ট, নামটাও চমৎকার, কিন্তু কোনো নড়চড় নাই।”
সাদেকের সে কথায় কন্ঠ হতে ঝরে পড়ে আক্ষেপের সুর। সাদেক নিত্যদিন খেটে যাওয়া পোস্টের কোনো নাম পায় নি, শুধু সমাদরের রূপে করুণা পেয়েছে। হয়ত পোস্টের একটা নাম থাকার জন্য যতখানি যোগ্যতা থাকা প্রয়োজন, তা কখনও অর্জন করতে পারেনি সাদেক।
আমরা মোটে পাঁচটা সমুচা খাওয়ার জন্য এই ঘন্টার পর ঘন্টা এখানে বসে থাকি, সে বিষয়টা ভালো চোখে দেখেন না দোকান মালিক মধু মিয়া। হরহামেশা তার চোখে মুখে ফুটে ওঠে তীব্র অসন্তোষের ছাপ। আমাদের কিছু না বলতে পেরে, সে রাগ ফলায় সাধারণ রিকশা চালক, দিন মজুর খদ্দেরদের সাথে। সমেস্যা মিয়া সে দৃশ্য দেখে, মিটিমিটি হাসে। আমাদের চোখে সমেস্যা মিয়া, যেমন দুঃখ কাষ্ঠরোদে অকালমেঘোদয়ের অনুভূতি নিয়ে হাজির হয়, মধু মিয়া ততটাই ছেলেবেলা বিকেল হারানো অকালসন্ধ্যার মতন অনুভব দেয়। তবু আমরা ফিরে আসি মধু মিয়ার দোকানে প্রতিদিন। এ দোকানের সাথে আমাদের যে স্নেহবন্ধন সৃষ্টি হয়েছে, আমরা তা এড়িয়ে যেতে পারি না।
আমাদের যাবতীয় সমস্যার সমাধান মিশু। মিশু কোনো চাকরি বাকরি করে না। সারাদিন একটা মোটর সাইকেল চড়ে ঘুরে বেড়ায়, এখানে ওখানে যায়। মিশুর ঠিক কত রকম ব্যবসা কিংবা ধান্ধা আছে, আমাদের কাছে সে হিসাব নেই। আমরা সে হিসাব নিতেও যাই না। আমাদের হুট করে টাকার প্রয়োজন হলে, আমরা মিশুর কাছে আমতা আমতা করি। মিশু এক গাল হেসে আমাদের বলে, “কত লাগবে শালা? আমার লগে এত ফর্মালিটি মারাইস না তো।”
আমাদের যা লাগে আমরা পেয়ে যাই। সে টাকা আমরা শোধ করি ধীরে ধীরে। মিশুর কোনো তাড়া থাকে না। মিশু কখনও হিসাব রাখে না। বন্ধুদের মাঝে এই গোছের ছেলেরা সব বিষয়ে তর্কহীনভাবে নেতার আসন দখল করে। মিশুও আমাদের মাঝে নেতার মতন। কোথাও ঘুরতে যাব, মিশু আয়োজন করবে। টাকার কমতি, মিশু দিয়ে দিবে। চা-সিগারেট খেলাম, মিশুর সামনে মানিব্যাগ বের করা যাবে না। কারও কোনো অনুষ্ঠান, মিশু সব ব্যবস্থা করবে। কারও বাবা-মা অসুস্থ, মিশু আমাদের বলবে, “অফিস মিস দিস না তো। আমি নিয়া যাই।” আমাদের জীবন মিশুর কারণে ভীষণ সহজ মনে হয় মাঝে মাঝে।
আমাদের চোখে মিশু যেমন, ঠিক তার উলটো বাহিরের অন্য মানুষের চোখে। মিশুর কাছ থেকে অনেকেই বিনা সুদে টাকা ধার নেয়। কিন্তু শর্ত একটাই, যে তারিখ বলবে ফেরত দেবার, সে তারিখেই ফেরত দিতে হবে। কোনো নড়চড় হবে না। সে তারিখে টাকা ফেরত না দিতে পারলে, মিশুর যে রুদ্রমূর্তি দেখা যায়, তা অবিশ্বাস্য। আড়ালে আবডালে অনেকে মিশুকে অমানুষ বলে ডাকে। মিশু সেসব জানে, তবু কিছুই বলে না। মিশুকে অপছন্দের পরও ওর কাছেই সবাই ফিরে আসে। আমরা যেমন মধু মিয়ার দোকানে আসি।
সমস্যা মিয়ার আসল নাম আমাদের কখনও জানা হয় নি। আমরা যখন হতে এ দোকানে সমুচা খেতে আসি, তখন হতেই এখানে সমস্যা মিয়াকে দেখি। সমস্যা মিয়া এ দোকানের সিঙ্গারা, সমুচার কারিগর। একই সাথে সবার বাটিতে সিঙ্গারা, সমুচা পরিবেশনের দায়িত্বও পালন করে। আমাদের দেখে হাসি মুখে বলে প্রতিবার, “মামা, সিঙ্গারা না সমস্যা?” সমুচাকে সমেস্যা ডাকতে ডাকতে, তার নামও হয়ে গেল সমস্যা মিয়া। সমস্যা মিয়ার বড় ছেলেও এ দোকানে কাজ করত। তার বড় ছেলে বুঝতে পেরেছিল, এ দোকানের যা নাম ডাক সবই সমস্যা মিয়ার হাতের যাদুতে। বড় ছেলে তাকে বলেছিল, একটা নতুন দোকান খুলবে ও। বাবাকে সে দোকানের প্রধান কারিগর বানাবে। মধু মিয়ার থেকেও ঢের বহু গুণ চলবে।
সমস্যা মিয়া ভয় পেলেও সায় দিয়েছিল। ব্যবসা শুরুর জন্য কিছু মূলধন তো লাগে, সে মূলধনের যোগাড় করে সমস্যা মিয়ার গ্রামের বাড়ি হতে ফেরার পথে, সমস্যা মিয়ার বড় ছেলে ছিনতাইকারীর কবলে পড়ে। কোনোভাবে টাকা দিতে চায় না। জীবন দিবে তবু স্বপ্নের এই যোগানকে হারাতে দিবে না। শেষমেশ জীবন এবং স্বপ্ন দুটোই হারায় সমস্যা মিয়ার বড় ছেলে।
সমস্যা মিয়া এখনও বড় ছেলের দেখা স্বপ্নকে ছোট চারা গাছের মতন বুকের ভিতর বপন করে বসে আছেন। তাকে ঝড় ঝঞ্ঝা থেকে বাঁচিয়ে ফিরছেন। হয়ত একদিন তার স্বপ্ন পূরণ হবে, ঠিক যেমন স্বপ্ন দেখেছিল আদর্শ হিন্দু হোটেলের হাজারি ঠাকুর।
আমরা চারজন সমুচা শেষ করে, পঞ্চম সমুচার দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমরা প্রতিবার এ কাজ করি, সচেতন মনে কিংবা অবচেতন মনে। শেষ সমুচাটা বাহিরে দাঁড়ানো টিপুকে দিয়ে দেই। টিপু এই পাশের বস্তিতে থাকে। বয়স আট-নয় হবে। সমুচা খাবার লোভে প্রতিদিন এসে দাঁড়ায় এখানে। যদিও ইদানীং ও বলছে, অন্য কাউকে ওর জায়গায় দিয়ে যাবে। টিপু বড় হয়ে যাচ্ছে। ওর এখন এভাবে সমুচা খাওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে থাকাটা মান সম্মানে বাধে। তাই ওর জায়গায়, একটা পাঁচ ছ’বছরের এক ছেলেকে দিয়ে যাবে। কী দারুণ পরম্পরা!
আমাদের পঞ্চম বন্ধু হিমেল, আমাদের মধ্যে সবচেয়ে ব্যস্ত। ওর দেখা সাক্ষাৎ পাওয়াটা রীতিমত দুঃসাধ্য বিষয়। সেই ভোর বেলা বের হয়, বেশির ভাগ দিনই আমরা চলে যাবার আগে আগে হন্তদন্ত হয়ে ফিরে এসে বলবে, “দেরী হয়ে গেল। নতুন টিউশনি পেলাম একটা। ওটাতেই দেরী হলো।”
আমরা হিমেলের জীবনিশক্তি দেখে ভীষণ অবাক হতাম সবসময়। পাশ করে চাকরিতে ঢুকল না। কোচিং আর টিউশনি নিয়েই রইল। সকাল থেকে রাত এর পিছনেই ছুটল। এলাকায় একখানা জমিও কিনে ফেলল।
আমার বিয়ের ঠিক দিন দশেক আগে আমার কাছে এসে হিমেল বলে, “বন্ধু লাখ ছয়েক টাকা হবে? ধার?”
আমি ওর কথায় হাঁ হয়ে থাকি। এত টাকা আমি পাব কোথায়? আমি বলি, সামনে বিয়ে দিন দশেক পর, খরচপাতি আছে। টাকা যা আছে, দেয়া সম্ভব হবে না। আমি এও বলি, মিশুর কাছে টাকা চাইতে।
কোনো কারণে মিশুকে খুব একটা পছন্দ ছিল না হিমেলের। ও কথায় হিমেল জবাব করে, “আমি পাপের টাকায় আমার ব্যবসা শুরু করতে চাই না।”
মিশুর টাকা কীভাবে পাপের টাকা, তা আমরা জানতাম না। জানার চেষ্টাও করিনি কখনও। আমি হিমেলের কাছে জানতে চাই, “এত টাকা দিয়ে কী করবি?”
“আমি নিজে একটা কোচিং খুলব। রুমের এডভান্স লাগবে এক লাখ। আর বাকি টাকায় রুমের বেঞ্চ, ডেকোরেশন এসি এসব। আমিও না, তোর কাছেই চাইলাম। তোর যে বিয়ে ওটা ভুললাম কীভাবে?”
হিমেল সেদিন চলে যায়। টাকার যোগাড় হিমেল করে। আমার বিয়ের তিনদিন আগে অনেকে ব্যস্ততার মাঝেও আমি হিমেলের নতুন কোচিং সেন্টার দেখতে যাই। বেশ গুছিয়ে সাজিয়ে মাঠে নামছে হিমেল বুঝতে পারি।
এর মাঝে আমার বিয়ে হয়ে গেলো। বিশ সালের মার্চ মাসের ছয় তারিখ। বিয়ে দুদিনের মাথায় আট তারিখে দেশে প্রথম করোনা রুগী ধরা পড়ল। ধীরে ধীরে পুরো দেশে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল। আঠারো তারিখে প্রথম করোনা রুগীর মৃত্যুর পর, ধীরে ধীরে পুরো দেশ লক ডাউনে চলে যায়। আমরা যারা অফিস করতাম, বাসা থেকে সে কাজ সারতে পারলেও, হিমেল পড়ে যায় নিকষকালো অন্ধকারে। টিউশনি বন্ধ, মাত্র টাকা ঢালা কোচিং বন্ধ, উপার্জন বন্ধ। নিজের একমাত্র সম্বল জমিটা সস্তায় বিক্রি করে, হিমেল কোচিং সাজিয়েছিল। আশা ছিল, সব ঠিক গুছিয়ে নিয়ে আবার সব করতে পারবে। কিছুই করতে পারেনি হিমেল। ঘরবন্দি জীবনে, প্রবল হতাশায় হিমেল নিজেকে প্রচণ্ড নিস্ফল, বৃথা ভেবে নিমজ্জিত হয়েছে। যে বাবা,মা, ভাইয়ের জন্য ছাত্র জীবন থেকেই টিউশনি করিয়ে সব করে গিয়েছে, তাদের ধার দেনা শোধের জন্য নিজে কিছুই করতে পারেনি। তারাও সে বিপদের দিনে কথা শোনাতে ছাড়েনি। হিমেল চাপা স্বভাবের ছেলে, সহজে নিজের দুঃখ বেদনা কাউকে জানাতে পারত না। মাঝে মাঝে আমাকে ফোন দিয়ে ধরে আসা গলায়, কিছু কিছু বলত। একদিন তাও বন্ধ হয়ে গেল। নিজেকে অকালকুষ্মাণ্ড ভেবে নিজের ঘরের বিদ্যুতের লাইনে পুড়ে মরে গেল। হয়ত সবাই ভাবল এ দুর্ঘটনা। কিন্তু আমি জানি, এটা হিমেলের অভিমানের প্রকাশ।
হিমেল হারিয়ে গিয়েছে। আমাদের পাঁচটা সমস্যার একটা এখন নেই। তবু আমরা পাঁচখানা সমস্যা অর্ডার করি প্রতিদিন। হিমেলের ভাগেরটা এখন টিপু নিচ্ছে, টিপুও আবার কাউকে হয়ত আমাদের কাছে দিয়ে যাবে।
বেঞ্চি ছেড়ে উঠে আসি আমরা। আমি পকেট থেকে পঞ্চাশ টাকার একটা নোট বের করে মধু মিয়ার কাউন্টারে দিয়ে দেই। মাথায় আসলো, আজ আমার বিয়ে পঞ্চাশ মাস পূরণ হলো। প্রতি মাস পূরণ শেষে আমি ভাবি, আমিও কি দায়ী হিমেলের মৃত্যুর জন্য? সেদিন যদি আমি টাকাটা ধার দিতাম হিমেলকে, তবে কি হিমেল বেঁচে থাকত? জানি না আমি। তবে এতটুকু জানি, আমরা হিমেলের একটা স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছি। হিমেলের সে কোচিংটা আমরা চালাই। টিচার রেখে ক্লাস নেয়াই। সাদেক মাঝে মাঝে ঐ কোচিং-এ গিয়ে বসে থাকে। নিজেকে কোচিং-এর ম্যানেজার বলে দাবী করে। মোনেমের যে সময় চাকরি না থাকে, তখনও মোনেম পুরোটা সময় কোচিং-এ দেয়। লিফলেট বিলি, নতুন ছাত্র ছাত্রী ধরে আনা, সব কাজ করে বেড়ায়। মিশুকে আবার কোচিং-এর টিচারেরা খুব সমাদর করে। মিশুর হাত থেকে সব টাকা পয়সা পায় তারা তাই। অন্যান্য কোচিং-এর তুলনায় বেশ ভালো বেতন দেয়া হয় তাদের। মাস শেষে সব খরচ বাদে বাকি টাকা আমি তুলে দিয়ে আসি হিমেলের বাবা মায়ের হাতে। তাদের চোখে মুখে আনন্দ খেলা করে যায়।
এ জীবনে আমাদের কিছু অবসর লাগে। কিছু বিচ্ছিন্ন দুঃখ,সুখের একটা স্থিরতা লাগে। পাশে থাকা সবকিছু আমাদের মতন, কিংবা আমরা আমাদের পাশে থাকা সব কিছুর মতন। এ জীবনের জটিলতাগুলো নিমিষে হারায় না জানি। তবু জটিলতার ফাঁক ফোঁকরে থাকা সুখেদের দেখা আমরা পাই, শুধু একটু খুঁজে দেখতে হয়।
ঘরে চলে আসি আমি। স্ত্রীকে বিয়ের পঞ্চাশ মাসে শুভেচ্ছা জানানো শেষে বলি, “ভেবেছি চাকরি ছেড়ে একটা সমুচা,সিঙ্গারার দোকান দিব। সমস্যা মিয়াকে প্রধান কারিগর বানাব। কী বল তুমি?”
আমার স্ত্রী এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুই বলতে পারে না।
রিয়াদুল রিয়াদ
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:৩৪