"আমার কথা - ১২" এখানে পড়ুনঃ আমার কথা - ১২
আমাদের ক্লাসের প্রথম এক্সট্রা ড্রিলঃ (যারা কখনো কোন ক্যাডেট কলেজের ক্যাডেট ছিলেন, কিংবা কোন শৃঙ্খলা বাহিনীর(Disciplined Force) অফিসার ক্যাডেট, কিংবা মেরিন একাডেমীর, তারা ‘এক্সট্রা ড্রিল’ কথাটার সাথে অবশ্যই পরিচিত হয়ে থাকবেন। যারা এর বাইরে রয়েছেন, তাদের জন্য বলছি, ‘এক্সট্রা ড্রিল’ হচ্ছে ঐ সমস্ত প্রতিষ্ঠানের কোন শৃঙ্খলা ভঙ্গের জন্য ক্ষুদ্র শাস্তি বা মাইনর পানিশমেন্ট।
এমসিসিতে আমাদের প্রথম বছরের প্রথম টার্মের কথা। নজরুল হাউসের পেছনে ছিলো প্রিন্সিপাল কর্ণেল আনসারী স্যারের বাসা। রাতের বেলায় নজরুল হাউসের রুমে লাইট জ্বালানো থাকলে কে কি করছে তা তিনি নিজ গৃহ থেকে বেশ দেখতে পেতেন। একদিন লাইটস আউটের আগে নজরুল হাউসের আমার তিন সতীর্থের খুব হাউস চাপলো বক্সিং বক্সিং খেলার। যথারীতি খেলা শুরু হলো। রুম ক্যাপ্টেন মনে হয় ঐ সময় বাথরুমে ছিলেন। এর মধ্যে লাইটস আউটের সময় হয়ে গেলে তিনি এসে তাদেরকে থামিয়ে আলো নিভিয়ে দিলেন। আলো নেভানোর পর যে যার বিছানায় হুমড়ি খেয়ে পড়লো। অপরাধীদের একজন, যার বিছানা জানালার পাশেই ছিলো, খেয়াল করলো যে প্রিন্সিপালের বাসা থেকে আলোর দুটো গোল চক্ষু যেন তাদের দিকে ধেয়ে আসছে। প্রিন্সিপালের একটা মেরুন রঙের মাইক্রোবাস ছিলো। বেশীরভাগ সময়ে তিনি সেটা নিজেই চালাতেন। কিছুক্ষণ পরে বারান্দায় প্রিন্সিপাল স্যারের গলার আওয়াজ পাওয়া গেলো। তিনি রুমের সামনে এসে রুম ক্যাপ্টেনকে আলো জ্বালাতে বললেন। সবাইকে বিছানা ছেড়ে বেড়িয়ে আসতে বললেন। বক্সিংরত তিনিজনের কপাল থেকে তখনো দরদর করে ঘাম ঝরছিলো, তাই অপরাধী সনাক্ত করতে দেরী হলোনা। পরের দিন নোটিশ বোর্ডে ঐ তিনজন আগ্রহী বক্সারদের নাম শোভা পেলো আমাদের ক্লাসের প্রথম “এক্সট্রা ড্রিল” এর অনার্সধারী হিসেবে। তাদের দুজন আজ আমেরিকার নাগরিক। একজন আরিযোনার ফিনিক্সে, অপরজন নিউ ইয়র্কের লং আইল্যান্ডসে বসবাসরত। তৃ্তীয়জন বহু যুগ থেকে নিরুদ্দেশ, তার কথা এখন আমাদের ব্যাচের আর কারো জানা নেই।
গণজ্বরঃ
প্রথম টার্মেই আমার এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা হলো। টার্মের প্রায় মাঝামাঝি সময়, তখনো শ্রাবন মাস চলছে। বৃষ্টি বাদলের দিনে এক আধটু জ্বরজারি সবারই হয়, আমাদেরও দুই একজনের হলো। তবে যখন জ্বর আসতো, বেশ গা ফাটিয়েই আসতো। তখনো আমাদের কলেজে কোন আবাসিক ডাক্তারের ব্যাবস্থা করা হয় নাই। প্রয়োজন হলে মির্জাপুরের কুমুদিনি হাসপাতাল থেকে একজন ‘সফদার ডাক্তার’ টাইপের টেকো মাথা ডাক্তারকে ডেকে আনা হতো। বাকী সময়ে কম্পাউন্ডার রইস সাহেবই টুকটাক ডাক্তারী করতেন। উল্লেখ্য, তখনো আমাদের কলেজে কোন হাসপাতাল বিল্ডিংও নির্মাণ করা হয় নাই। আমাদের হাউসেরই নীচতলার একটা কক্ষকে এম আই রুম (মেডিকেল ইনস্পেকশন রুম) হিসেবে ব্যবহার করা হতো। যাদের জ্বর এসেছিলো, তাদেরকে ড়াক্তার সাহেব ভালো করে দেখে টেখে “এ্যটেন্ড সি” দিলেন, যার মানে আমরা অর্থাৎ জ্বরে না ভোগারা যখন পিটি, প্যারেড, ক্লাস, গেমস, ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত থাকবো, তারা তখন শুধুই নিজ নিজ বিছানায় শুয়ে ঘুমাবে। এমনকি খাওয়ার জন্য তাদেরকে ডাইনিং হলেও যেতে হবেনা। হাউস বেয়ারারগণ তাদের খাবার রুমে পৌঁছে দেবে। এমন লোভনীয় ব্যাবস্থাপনা অন্যান্য ক্যাডেটদেরকে ঈর্ষান্বিত করে তুললো। তারাও পথ খুঁজতে লাগলো, কিভাবে শরীরে জ্বর ফাঁদানো যায়। ক্যাডেটদের মধ্যে একজন সবজান্তা টাইপের সিনিয়র বুদ্ধি দিলেন যে বগলের নীচে একটা রশুন কিছুক্ষণ চেপে রেখে রৌদ্রে দাঁড়িয়ে থাকলে তাড়াতাড়ি শরীরে জ্বর আসে।
কিন্তু সমস্যা হলো, রশুন পাবো কোথায়? আমাদের হাউস বেয়ারা রউফ ভাই আর আহসানউদ্দিন ভাইকে এ্যপ্রোচ করা হলো। রউফ ভাই তখন তরুণ বয়সের, আমাদের একাদশ শ্রেণীর বড়ভাইদের সমবয়সী কিংবা তার চেয়ে সামান্য কিছুটা বড় হবে। আমরা কলেজে জয়েন করার মাস খানেক আগে তার চাকুরী হয়। আর চাকুরীর আগে আগে তার বিয়েও হয় ১৯/২০ বৎসর বয়সে। তিনি আমাদের দুষ্টুমিটা কিছুটা আঁচ করতে পেরেছিলেন হয়তোবা, তাই তিনি তার নতুন চাকুরী হারাবার ভয়ে আমাদেরকে কাঙ্ক্ষিত দ্রব্যটি সরবরাহ করতে রাজী হলেন না। অপরদিকে আহসানউদ্দিন ভাই (এখন থেকে প্রায় পঁচিশ ত্রিশ বছর আগে তিনি ইন্তেকাল করেছেন) অনেক বয়স্ক লোক ছিলেন। দারিদ্র্যের কশাঘাতে তিনি জর্জরিত ছিলেন। তবে তার মিনিটে মিনিটে বিড়ি ফোঁকার বদ অভ্যাস ছিলো। আমাদের স্ট্রাটেজিস্ট সিনিয়র ভাইয়েরা ঐ দুর্বলতাটুকু এক্সপ্লয়েট করলেন। তাকে এক মুঠা বিড়ির মূল্য দেয়ার প্রলোভনে দ্রব্যটি সরবরাহ করতে রাজী করানো হলো।
সত্যি সত্যিই বগলের নীচে রশুন রাখার কারণে কিনা জানিনা, তবে গণহারে জ্বর আসা শুরু হলো। অন্য দুই হাউসের জ্বরাক্রান্তদেরকেও আমাদের হাউসে নিয়ে আসা হলো, কারণ এম আই রুমটা আমাদের হাউসে ছিলো। কমনরুমে ঢালাও বিছানা পাতা হলো। আন্তঃহাউস নানামুখী তীব্র প্রতিযোগিতার কারণে ভিন্ন ভিন্ন হাউসের ক্যাডেটদের মাঝে তেমন একটা মিল মহব্বত থাকতোনা, বরং একটা বৈরীতার সম্পর্ক থাকতো। কিন্তু জ্বরের কারণে এবং সেই সুযোগে অবাধ দুষ্টুমি করার সুযোগপ্রাপ্ত হওয়ায় তখন জ্বরাক্রান্ত ক্যাডেটদের মাঝে এক অভূতপূর্ব ঐক্য আর ভ্রাতৃ্ত্বের বন্ধন লক্ষ্য করা গেলো। এমনকি একাদশ শ্রেণীর (প্রথম ব্যাচ) একজন ছোটখাটো ফর্সা রঙের বড়ভাইকে নির্দ্বিধায় সপ্তম শ্রেণীর ছোটবাবুকেও তার গোপন “মাসুদ রানা”র সংগ্রহ থেকে উদারভাবে বই বিলি করতে দেখা গিয়েছিলো। উল্লেখ্য, আমাদের বয়সীদের জন্য তখন “মাসুদ রানা” পড়া নিষেধ (ট্যাবু) ছিলো।
সিনিয়র স্ট্রাটেজিস্ট বড়ভাইটি ঘোষণা দিলেন যে আর গোটা দশেক ক্যাডেটকে যদি জ্বরাক্রান্ত করা যায়, তবে কলেজ কর্তৃপক্ষ বাধ্য হবে কলেজ বন্ধ ঘোষণা করতে। এক অপ্রত্যাশিত ছুটি প্রাপ্তির সম্ভাবনায় যে যার মত নিজ নিজ পন্থায় চেষ্টা করে যেতে থাকলো শরীরে জ্বর ডেকে আনতে। যারা সমর্থ হলো, তারা ইন্সট্যান্টলি সেই সিনিয়র স্ট্রাটেজিস্ট বড়ভাই এর গুডবুকে চলে গেলো। জ্বরাক্রান্তদেরকে বেশ কিছু বাড়তি সুযোগ সুবিধা দেওয়া হলো, যেমন বিকেলে চা এর পরিবর্তে চিকেন স্যুপ। সকালে দুধও বরাদ্দ করা হলো। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো সপ্তম শ্রেণীর যে যতটা কাঁদতে পারলো, সে তত বেশী আদর যত্ন পেতে থাকলো। বিশেষ করে শিক্ষক, সিনিয়র ভাই, বেয়ারা, ডাক্তার, সবার কাছ থেকে পাওয়া এই বাড়তি আদরটুকুর জন্য আমারও ইচ্ছে হলো, জ্বর আসুক!
রোগীর সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেতে থাকলে আমাদের হাউস টিউটর, হাউস মাস্টার, ডাক্তার, সবাইকেই কিছুটা চিন্তিত দেখাতে শুরু করলো। প্রিন্সিপাল স্যারও দিনে রাতে কয়েকবার করে আসতে থাকলেন পরিস্থিতি স্বচক্ষে দেখতে। সকালের পিটি বন্ধ হয়ে গেলো। ক্লাসগুলোও হাল্কাভাবে চলছিলো। একদিন দুপুরে ক্লাসে বসে আমিও জ্বর জ্বর অনুভব করতে থাকলাম। মাথাটাও ধরে এলো। ক্লাস শেষে কোনরকমে ডাইনিং হলে গেলাম, কিন্তু কিছু খেতে পারলাম না। রুমে আসার পর রুম ক্যাপ্টেন আমাকে এম আই রুমে রিপোর্ট করতে বললেন। বিকেলে কম্পাউন্ডার সাহেব আমার জ্বর মেপে আমাকে জ্বরাক্রান্ত ঘোষণা করলেন। আমারও কমনরুমে অন্যান্য রোগীদের মাঝে ঠাঁই হলো। ততদিনে প্রথম দিকের আক্রান্তদের জ্বর ছাড়া শুরু হলো, তাই তাদের দুষ্টুমিও বেড়ে গেলো, আর নিজেদের মাঝে খুনসুটিও শুরু হলো। কিন্তু জ্বর ছাড়া শুরু হলে কী হবে, আমাদের সেই সিনিয়র স্ট্রাটেজিস্ট বড়ভাইটির কথা সত্য প্রমাণ করে ঢাকা থেকে হুকুম এলো, কলেজ অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণার। এই ঘোষণা পেয়ে ক্যাডেটদের মাঝে আনন্দের বন্যা বইতে শুরু করলো। রাতে ঘোষণা দেয়া হলো, যাদের গায়ে জ্বর থাকবে, তারা ছাড়া বাদবাকী সবাই পরদিন সকালে কলেজ ব্যাবস্থাপনায় নিজ নিজ বাড়ীর উদ্দেশ্যে রওনা দিবে। ঘোষণাটা শুনে সবাই ব্যাগ গোছাতে শুরু করলো।
পরদিন সকালে যথারীতি ডাক্তার এলেন। তিনি পরীক্ষা করে দেখলেন যে আমার এবং আরও তিন চারজনের গায়ে জ্বর অনেক বেশী, তাই তিনি ঘোষণা দিলেন যে আমরা ছুটিতে যেতে পারবোনা। জ্বর ভাল না হওয়া পর্যন্ত আমাদেরকে কলেজেই থাকতে হবে। এই রয়ে যাওয়া দলের মধ্যে একমাত্র আমিই ছিলাম সপ্তম শ্রেণীর। ভেবে অবাক হলাম যে কি করে যাদের শরীরে দুই তিনদিন আগে হুড়মুড় করে জ্বর এসেছিলো, কলেজ ছুটির কথা শুনে আবার তাদেরই জ্বর হুরমুড় করেই চলে গেলো! বেলা দশটা এগারটার দিকে সবাই হৈ হুল্লোর করে নির্দিষ্ট বাসে চেপে বসলো। আমদেরকে ঐ কমনরুমে রেখেই সবাই যার যার বাড়ীর উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেলো।
চলবে…
ঢাকা
২১ জুলাই ২০১৫
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ দুপুর ১:৪৮