"আমার কথা - ১১" পড়তে চাইলে এখানে ক্লিক করুনঃ আমার কথা - ১১
এমসিসিতে রোজাঃ
এমসিসিতে প্রথম রোজাটা পেয়েছিলাম মাঘের শীতে। যেদিন আকাশে প্রথম রোজার বাঁকা চাঁদটি ওঠার কথা, আমরা সবাই সেদিন হাউসের ছাদে উঠেছিলাম তাকে স্বাগত জানাতে, আর রোজা শুরু করার ব্যাপারে নিশ্চিত হতে। কিন্তু আমরা তার দেখা পাইনি। পরে রাতে খবরে শুনেছিলাম রাওয়ালপিন্ডির কোথাও চাঁদ দেখা গেছে, তাই পরদিন থেকে রোজা শুরু, অর্থাৎ ঐ রাতেরই শেষরাত থেকে সেহেরী খেতে হবে। কলেজে যাবার আগেও বাসায় রোযার মাসে রোযা রাখতাম, তবে তখনো সম্ভবতঃ পুরো মাসব্যাপী রোযা রাখা হয়নি। মনে মনে শপথ নিলাম, এবারের রোযা পুরো মাসব্যাপী রাখবো। ঈদের ছুটিতে বাসায় গিয়ে যে ক’টা রোযা পাবো, সে ক’টার একটাও ভাংবোনা। তখন আমাদেরকে শীতের সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কম্বল আর জার্সি পুলওভার দেয়া হতো। ওগুলো যথেষ্ট গরম ছিলো, কিন্তু শেষরাতে বের হয়ে দেখি পুলওভার পড়ার পরেও শীতে শরীর অবশ হয়ে আসছে। ঐ রকম শীতে ‘ফল-ইন’ এর জন্য দাঁড়িয়ে থাকার কোন অবকাশ ছিলোনা। যে যার মত দৌড়ে ডাইনিং হলে প্রবেশ করলাম আর ভেতরে প্রবেশ করে কিছুটা উষ্ণতা পেলাম। তবে মুশকিল হলো, যে উৎসাহ নিয়ে সেখানে এসেছিলাম, খাবার খেতে বসে সে উৎসাহ উধাও হলো। কোনরকমে কিছুটা খাবার গলধঃকরণ করে পানি খেয়ে উঠে এলাম।
এর পরদিন থেকে আমরা শীতের হাত থেকে বাঁচার জন্য নতুন পদ্ধতি অবলম্বন করতাম। তিন চারজন মিলে একটা কম্বল পেঁচিয়ে আমরা ধীরে ধীরে হেঁটে ডাইনিং হলে যেতাম। খাওয়া শেষে আবার একই পদ্ধতিতে হাউসে ফিরে আসতাম। দ্বিতীয় দিনে আমাদের স্থানীয় আকাশেও চাঁদ দেখা গেলো। আমরা কয়েকজন চাঁদ দেখে হৈ হৈ করে উঠলাম। আমাদের হাউস টিউটর দোহা স্যার আবির্ভূত হলে তাকেও আমরা সোল্লাসে চাঁদ দেখালাম। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, চাঁদ দেখার পর কী দোয়া পড়তে হয়, তা কে বলতে পারবে? আমরা কেউই জানতাম না, তাই সবাই নিরুত্তর থাকলাম। উনিও এ ব্যাপারে নিরুত্তর থেকে গেলেন। মনে হলো, দোয়াটা তারও জানা ছিলোনা।
সো হোয়াট?
বাংলা মিডিয়াম থেকে ইংরেজী মিডিয়ামে পড়তে এসে আমাদের জবানে প্রথম যে বুলিটি সার্বজনীনতা খুঁজে পেলো, তা ছিলো “সো হোয়াট?” কথায় কথায় এটা আওড়ানো অনেকের অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেল। কথাটার উপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে না পেরে মাঝে মাঝে আমরা সেটা টীচারদের সাথেও বলে ফেলা শুরু করলাম। কোন কোন টীচার সেটা সহজে গ্রহণ করলেও, অনেকেই বুঝিয়ে দিলেন যে সেটা কাম্য নয়। ছুটির আগে আমাদের বাংলা শিক্ষক আবদুল্লাহ আল আমিন স্যার আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন, আমরা বাড়ীতে গিয়ে যেন দুটো জিনিস না করিঃ গুরুজনদের সামনে কথায় কথায় “সো হোয়াট?” যেন না বলি। তবে বন্ধু বান্ধবদের সাথে আর সিবলিংসদের সাথে বলতে আপত্তি নেই। আর দ্বিতীয় কথাটা ছিলো, বাড়ীতে গিয়ে যেন আমরা খাবার টেবিলে কাঁটাচামচ না খুঁজি। ছুটি থেকে ফিরে আমাদের ময়মনসিংহীয় সতীর্থদের কাছ থেকে জেনেছিলাম, সানকিপাড়া নিবাসী আমাদের জনৈক বন্ধু দুটো নিষেধাজ্ঞাই অমান্য করেছিলো। এমনকি তাকে কলেজের টাই পড়ে সিনেমা হলেও যেতে দেখা গিয়েছিলো।
স্ল্যাং এর কথকতাঃ
আমাদের ইংরেজী মিডিয়ামের বন্ধুদের কথোপকথন শুনে মাঝে মাঝে কিছু কিছু শব্দের অর্থ উদ্ধার করতে পারতাম না। চুপে চুপে অভিধান খুঁজে সেখানেও ওসব শব্দের সন্ধান পেতাম না। নিজের অজ্ঞতা গোপন রাখার লক্ষ্যে সেগুলোর কথা ওদেরকে জিজ্ঞেসও করতে পারতাম না। একদিন সকালে পিটি’র সময় প্রিন্সিপাল স্যার দূরে দাঁড়িয়ে থেকে সবকিছু লক্ষ্য করছিলেন। একজন ক্যাডেট পিটিতে একটু ফাঁকি দিচ্ছিল। ঠিক ফাঁকি দিচ্ছিল বললে ভুল বলা হবে। সে আর সবার সাথে তাল মিলাতে পারছিল না। কোন একটি আইটেম যেখানে দশবার করার কথা, দশবারের পর যখন সবাই থেমে যাচ্ছিলো, তখনও সে আনমনা অবস্থায় একাই কন্টিনিউ করছিলো। হয়তো সে বাড়ীর কথা বা অন্য কারো কথা ভাবছিলো। প্রিন্সিপাল তার কাছে এসে ‘ফল-আউট’ হতে বললেন। সে দল থেকে বেরিয়ে আসলে তিনি তাকে পুরো মাঠে চক্কর লাগাতে বললেন। যেহেতু প্রিন্সিপাল স্যার নিজে তাকে পয়েন্ট আউট করেছেন, সেহেতু সকল ওস্তাদগণ সাথে সাথে তার উপর হামলে পড়লো। সে চক্কর দিতে শুরু করলে প্রিন্সিপাল বললেন, “লেট দ্যাট শিট রান!”
আমি প্রথমে ভেবেছিলাম, প্রিন্সিপাল হয়তো তাকে ‘শীপ’ বলেছেন, শিট নয়। কেননা এর আগেও তার মুখে ব্ল্যাকশীপ কথাটা আমরা বহুবার শুনেছিলাম, আর ব্ল্যাকশীপ কথাটার মানে আমিও জানতাম। কিন্তু ঘটনা ও চরিত্রের সাথে শীপ এর কোন মিল খুঁজে পাচ্ছিলাম না। রুমে ফিরে অভিধান খুললাম। তখনকার দিনে অভিধানগুলোতে এখনকার মত স্ল্যাং আর ট্যাব্যু ওয়ার্ডস থাকতো না। একজন ইংরেজী মিডিয়ামের বন্ধুকে, যে ততদিনে আমার প্রতি বেশ বন্ধুভাবাপন্ন হয়ে গিয়েছিলো, তাকে শিট কথাটার মানে জিজ্ঞাসা করলাম। সে প্রথমে একচোট হেসে নিলেও পরে আমাকে শব্দটার মানে ব্যাখ্যা করেছিলো। তখন থেকে কোন অপরিচিত ইংরেজী শব্দ শুনলে আমার কান দুটো খাড়া হয়ে যেতো।
চলবে…
ঢাকা
১৯ জুলাই ২০১৫
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে নভেম্বর, ২০১৫ সকাল ৮:১৯