"আমার কথা - ১৩" পড়তে চাইলে এখানে ক্লিক করুনঃ আমার কথা - ১৩
একাকীত্বঃ
যারা দুষ্টুমি করে নানা কৌশলে জ্বর এনেছিলো, তারা মহা আনন্দে বাড়ী চলে গেলো। আমার সত্যি সত্যি জ্বর এলো, তাই আমি রয়ে গেলাম শুনশান, ক্যাডেটবিহীন এমসিসি’র নিস্তব্ধ প্রান্তরে। বড্ডো একাকী বোধ করতে লাগলাম। দিন কাটেনা। আমি ছাড়া আর বাকী যে তিন চারজন ছিলেন, তারা সবাই সিনিয়র, কিন্তু খুবই ভদ্র। তারা আমার প্রতি অত্যন্ত সদয় ব্যবহার করতেন। আমার কাজ ছিলো তারা যদি কখনো কোন আলাপ শুরু করেন, তা মন দিয়ে শোনা। আমার নিজের কিছু বলার মত কথা খুব কমই ছিলো। জানালার পাশে গিয়ে গুই সাপের আনাগোনা দেখতাম। কাঁঠাল গাছের ডালে ডালে আর পাতায় পাতায় টুনটুনি পাখির নেচে বেড়ানো দেখতাম। সিনিয়ররা একটু এদিক সেদিক সরে গেলে বয়োবৃদ্ধ হাউজ বেয়ারা আহসানউদ্দিন ভাইকে ডেকে তার জীবন কাহিনী শুনতাম। তিনি কলেজের ভেতরে কোন সরকারী বাসা বরাদ্দ পান নাই। তার বাড়ী ছিলো কলেজ সীমানার বাইরের একটি গ্রামে। রাত দশটা পর্যন্ত তাদের ডিউটি থাকতো। গ্রামীণ পরিবেশে সেটা ছিল শহরের মধ্যরাতের সমান। রাত দশটার পরে যখন তিনি ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্য দিয়ে একলা হেঁটে কেবল একটা ছাতা আর টর্চলাইট হাতে কর্দমাক্ত পিচ্ছিল পথ ধরে নিজ বাড়ীর উদ্দেশ্যে রওনা হতেন, তখন আমি অবাক বিস্ময়ে ভাবতে থাকতাম, এতটা বৃষ্টি মাথায় নিয়ে অন্ধকার পথে তিনি বাড়ী পৌঁছবেন কী করে! অপর হাউস বেয়ারা রউফ ভাইও থাকতেন কলেজ সীমানার বাইরে। তার বয়স তখন কুড়ির নীচে হলেও তিনি তখনই ছিলেন সদ্য বিবাহিত। নব বিবাহিত বধূকে ঘরে রেখে এসে তিনি আমাদের সেবায় নিয়োজিত থাকতেন। মাঝে মাঝে তাকে গালে হাত দিয়ে কিছু একটা নিয়ে ভাবনা চিন্তায় মগ্ন থাকতে দেখতাম। আমাদেরকে সেবা প্রদানের জন্য আষাঢ় শ্রাবন মাসের ঝমঝমে বৃষ্টির মাঝ দিয়ে তারা যখন ঘড়ির কাঁটা ধরে একটা টর্চ ও ছাতা সম্বল করে নিকষ কালো আঁধার রাতে কলেজে আসা যাওয়া করতেন, তখন তাদের কর্তব্যনিষ্ঠা ও সাহস দেখে আমি বিস্ময় ও শ্রদ্ধায় অভিভূত হয়ে যেতাম। তাদের যাওয়ার পথের দিকে আমি তাকিয়ে থাকতাম।
দুপুরের দিকে আমার জ্বর বেড়ে যেতো, তখন গায়ে কম্বল মুড়ি দিয়ে স্বপ্ন দেখার চেষ্টা করতাম। আমি আজীবন স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসি, এমনকি এখনো সে অভ্যেস বলবৎ আছে। মাঝে মাঝে কোন না কোন শিক্ষক, কিংবা ডাক্তার কিংবা স্বয়ং প্রিন্সিপাল স্যার এসে কপালে হাত রেখে দেখতেন জ্বর আছে কিনা, তখন চোখ খুলে বিছানায় উঠে বসতাম। আমি সবার ছোট ছিলাম বলে প্রিন্সিপাল স্যার অন্যান্যদের চেয়ে আমার পাশেই বেশীটা সময় কাটাতেন। মুশকিল হতো তখন, যখন তিনি আমার কপালে মাথায় হাত বুলিয়ে বলতেন, আমি দু’দিনেই ঠিক হয়ে যাবো। এরকম আদর পেয়ে আমি বিগলিত হয়ে যেতাম, মাঝে মাঝে চোখের পাশ দিয়ে দু’ফোঁটা অশ্রু নীরবে গড়িয়ে যেতো। চোখে সানগ্লাস আঁটা, হাতে ব্যাটন ধরা, সব সময় সাদা শার্ট, সাদা প্যান্ট আর কালো বেল্ট পরা এই দীর্ঘদেহী ফর্সা মানুষটাকে ভীষণ ভয় পেতে শুরু করেছিলাম যেদিন তিনি পিটি গ্রাউন্ডে একজন ক্যাডেটকে বের করে দৌড়ের শাস্তি লাগিয়ে বলেছিলেন, “লেট দ্যাট শিট রান”! আবার তাকেই খুব ভালো লাগলো যখন তিনি আমার তপ্ত চোখের অশ্রু মুছে দিয়ে বললেন, “ডোন্ট ক্রাই মাই বয়, ইউ’ল বি অররাইট, সূন”!
প্রিন্সিপালের বাসায় একটা জাম্বুরা গাছ ছিলো। তার একজন বাবুর্চি ছিলো, নাম খুদু মিয়া (জাতীয় কবির মত দুখু মিয়া নয়)। খুদু মিয়া সবসময় বেশ খোশ মেজাজে থাকতো। প্রতিদিন বেলা এগারটার দিকে খুদু মিয়া লবণ তেল মাখানো জাম্বুরা নিয়ে আসতো আমাদের জন্য। জ্বরের মুখে খেতে বেশ ভালই লাগতো। মাত্র কয়েকজন রোগী ছিলাম বলে চা বিস্কুট পাওয়া যেতো হিসেব ছাড়া। তবে কলেজ থেকে দেয়া চা এর কোয়ালিটি খুব খারাপ ছিলো। খুব ইচ্ছে হতো, কেউ যদি একটু ভাল চা খাওয়াতো! খাওয়া দাওয়ার সময়টাতে সিনিয়র ভায়েরা বেশ গল্প গুজব করতেন। তাদের মুখে শুনেছি বৃষ্টিতে ফুটবল খেলতে গিয়ে কি করে মাহবুব হাসান ভাই হাত ভেঙ্গেছিলেন। তাকে কুমুদিনি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো। ভুল প্লাস্টারের কারণে তার ভাঙ্গা হাতটাতে পচন ধরেছিলো, আর শেষ পর্যন্ত তা কেটে ফেলতে হয়েছিলো। এসব গল্পের পর সিনিয়র ভায়েরা নিজ নিজ সংগ্রহে রাখা গল্পের বইপত্র কিংবা ম্যাগাজিন পড়ায় মনোনিবেশ করতেন। আমি ভালো লাগলে পেছনের জানালায় গিয়ে বসতাম অথবা সামনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে বিরান খেলার মাঠের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। দূরের গ্রামগুলোর দিকে তাকিয়ে গ্রামবাসীদের জীবন যাত্রা প্রণালীর কথা চিন্তা করতাম। মাঝে মাঝে আমাদের গ্রামের বাড়ীর কথাও মনে পড়ে যেতো। স্কুলের সাংবাৎসরিক ছুটিতে আমরা লালমনিরহাটে আমাদের নানাবাড়ী, দাদাবাড়ীতে বেড়াতে যেতাম। এভাবে একাকীত্বের মাঝে নানাকিছু ভেবে ভেবে সময় পার করতাম।
একাকীত্বের অবসান
কয়েকদিন পরে একদিন দুপুরে হঠাৎ দেখি আব্বা আর বড়ভাই আমাকে দেখতে এসেছেন। আমার জ্বর হবার খবর বাসায় জানানো হয়েছিলো। সে খবর পেয়েই তারা আমাকে দেখতে এসেছিলেন। ঐ দিনই আমার জ্বর রেমিশন হয়েছিলো, তাই ওনারা এসে আমাকে ভালোই দেখতে পেয়েছিলেন। আব্বা সাথে করে কিছু শুকনো খাবার এনেছিলেন। অন্যসময় হলে সেগুলো আনতে পারতেন না। কিন্তু সেদিন তাদেরকে কিছু বলা হয়নি। এ ব্যাপারে আমাদের হাউস টিউটর দোহা স্যার বেশ সহায়তা করেছিলেন। আব্বার সাথে সাথে প্রিন্সিপাল স্যারও এসেছিলেন। আব্বা আমাকে সাথে করে নিয়ে যেতে চাইলেন। প্রিন্সিপাল তাঁকে জানালেন, ঢাকার অনুমতি পেলে আমাদের সবাইকে একসাথে পরেরদিন কলেজের গাড়ীতে করে ঢাকায় পাঠিয়ে দেয়া হবে। আব্বা আর বড়ভাই আমাকে সান্ত্বনার বাণী শুনিয়ে বাড়ী ফিরে গেলেন। পরেরদিন সত্যি সত্যি আমাদের চার পাঁচজনকে একসাথে কলেজের গাড়ীতে করে একজন এনসিও’র তত্ত্বাবধানে ঢাকায় পাঠানো হয়েছিলো।
বিভিন্ন আন্তঃহাউস প্রতিযোগিতা
কিছুদিন পর আবার যখন কলেজে ফিরে এসেছিলাম, তখন বিভিন্ন আন্তঃহাউস প্রতিযোগিতা গুলো শুরু হয়েছিলো। তার মধ্যে ইনডোর আউটডোর উভয় ধরনের প্রতিযোগিতা ছিলো। সবচেয়ে কনিষ্ঠতম ব্যাচ হিসেবে আমাদের কাজ ছিলো মূলতঃ হাততালি দেয়া। তবে ইনডোর গেমসে আমাদের মধ্যে ঐ বয়সেই কয়েকজন প্রতিভাবান খেলোয়ার ছিলো, যারা ধাপে ধাপে বিজয়ী হয়ে শেষ পর্যন্ত চ্যাম্পিয়ন না হলেও প্রায় কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিলো। তাদের মধ্যে নামোল্লেখ করতে হয় আমাদের বন্ধু মরহুম কে এম আলী মুনীর রানা’র। সে ক্যারম, দাবা আর টেবিল টেনিসে খুব ভালো ছিলো। আগেই জেনেছিলাম, যারা ভালো দাবারু হয়, তাদের সাধারণতঃ উচ্চ আইকিউ থাকে। তারা অঙ্কে খুব ভাল হয়। এর প্রমাণ আমি আমার রুমেই দেখতে পেয়েছিলাম। আমার বন্ধু ও রুমমেট সালেহ আহমেদ তানভীর ঐ বয়সেই খুব ভাল দাবা খেলতো। সে আজ সারা বিশ্বে একজন বিখ্যাত ম্যাথস অধ্যাপক। আমাদের রুম ক্যাপ্টেন আবেদ আহাদ চৌধুরী ভাইও একজন তুখোড় দাবারু ছিলেন। তিনিও অঙ্কে খুব ভালো ছিলেন। তিনি বর্তমানে আমেরিকা প্রবাসী আছেন।
আমার মনে হয়, আমাদের সময় প্রায় সবাইকে ইনভল্ভ করে যে প্রতিযোগিতাটা হতো সেটা ছিলো আন্তঃহাউস আর্টস এ্যন্ড ক্র্যাফ্টস প্রতিযোগিতা। সেখানে প্রায় সবারই কিছু না কিছু অবদান রাখার সুযোগ ছিলো। প্রতিযোগিতার অজুহাতে সপ্তাহ দুয়েক ধরে রাত দশটায় লাইটস আউট এর কোন বালাই থাকতোনা। তাই এর সুযোগে অলস ব্যক্তিরাও কাজ করার নামে কমনরুমে গিয়ে কর্মরতদের সাথে খোশগল্প জুড়ে দিতো। যারা সত্যিই কিছু করে দেখাতে পারতো, তারা সিনিয়রদের গুডবুকে চলে যেতো। অকর্মণ্যরা খুশীমনে অন্যদের ফুট ফরমাশ খেটে বেড়াতো। বলাবাহুল্য, আমি দ্বিতীয় দলেই ছিলাম। এই প্রতিযোগিতাটার কথা স্মরণ করলে আমার মনে শুধু একজনের নামই সবার আগে উজ্জ্বলভাবে মনে পড়ে। তিনি দ্বিতীয় ব্যাচের খন্দকার বদরুল হাসান, আমাদের তখনকার হাউস প্রিফেক্ট। অসাধারণ প্রাণশক্তির অধিকারী এই ব্যক্তির কর্মক্ষমতা ছিলো কিংবদন্তীতুল্য। তিনি একজন উচ্চমানের টাস্ক মাস্টার ছিলেন, তবে নেতা হিসেবে ততটা জনপ্রিয় ছিলেন না। কারণ তিনি কনিষ্ঠদের মন জয় করে কাজ আদায় করার প্রতি ততটা মনোযগী ছিলেন না। তবে হাউসের জন্য তিনি নিঃস্বার্থভাবে সদা সর্বদা জান প্রাণ দিয়ে কাজ করতেন। এর জন্য পড়াশোনাসহ অন্যান্য বিষয়ে তার ব্যক্তিগত ক্ষয়ক্ষতির প্রতি তিনি ভ্রূক্ষেপ করতেন না। পরবর্তীতে কর্মজীবনেও তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে তার কর্মক্ষমতার জন্য সুপরিচিত ছিলেন। আরেকজনের নাম মনে পড়ে, সেটা প্রথম ব্যাচের জাহাঙ্গীর ভুঁইয়া ভাই এর নাম। হট হেডেড হিসেবে তার পরিচিতি থাকলেও কনিষ্ঠদের প্রতি তিনি স্নেহবৎসল ছিলেন। প্রতিটি প্রতিযোগিতায় তিনি কোন না কোন সায়েন্স প্রজেক্ট উপস্থাপন করতেন। তিনি ইংলিশ ডিবেট করতেও খুব পছন্দ করতেন। তবে আমার কাছে তখন মনে হতো, অন্যান্য তার্কিকদের তুলনায় তার পারদর্শিতা কম ছিলো। কেন জানি মনে হতো, তিনি যুক্তির বদলে অনেকটা গায়ের জোর দিয়ে তার পয়েন্টসমূহ উপস্থাপনা করতেন। আর লক্ষ্য করতাম, তাকে কেন জানি কেউ তেমন একটা ঘাটাতে চাইতো না।
এটাই ছিলো আমার 'হাউস' - তখনকার জিন্নাহ হাউস এবং পরবর্তীতে ফজলুল হক হাউস। দোতালার মাঝামাঝি একটা রুমে প্রথম উঠেছিলাম। সামনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ডানদিকে কোণাকুণি তাকালে বিরান খেলার মাঠ দেখা যেতো। জ্বরের সময় সেদিকে প্রায়ই তাকিয়ে থাকতাম। আর আরও দূরে তাকালে নীচু জলাভূমি আর কিছু বিক্ষিপ্ত গ্রাম দেখা যেতো, যেগুলোর মাঝে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ছিল নৌকা।
চলবে…
ঢাকা
২২ জুলাই ২০১৫
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে নভেম্বর, ২০১৫ রাত ৯:০৮