somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমার কথা -২৬

১৫ ই জানুয়ারি, ২০১৬ ভোর ৬:২৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

"আমার কথা -২৫" পড়তে হলে এখানে ক্লিক করুনঃ

আমার শিক্ষকেরাঃ
জনাব মাহতাব উদ্দিন আহমেদ

আমরা যখন প্রথম কলেজে যোগদান করি, তার মাত্র কয়েক মাস আগে জনাব মাহতাব উদ্দিন আহমেদ এমসিসিতে যোগদান করেছিলেন। মাহতাব স্যার তখন ছিলেন সদ্য ভার্সিটি থেকে বের হওয়া একজন তরুণ শিক্ষক। তাঁর বাড়ী ছিল রাজশাহী এলাকায়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই তিনি অঙ্ক শাস্ত্রে অনার্স মাস্টার্স শেষ করে আমাদের কলেজে প্রভাষক পদে যোগ দিয়েছিলেন। তিনি একজন অমায়িক মানুষ ছিলেন, অত্যন্ত নিরীহ, নির্বিরোধ, শান্তশিষ্ট প্রকৃতির ছিলেন। ক্লীন শেভড মুখের তাঁর উজ্জ্বল ফর্সা চেহারাটা খুব সহজেই লাল হয়ে যেত, রাগে নয়, আমাদের মত নিরীহ প্রজাতির ক্যাডেটদের সামান্য দুষ্টুমিমাখা জোকস শুনেও। তিনি খুব পরিপাটি পোষাক পরিধান করতেন, পড়াতেন খুব আন্তরিকতা সহকারে। যতক্ষণ পর্যন্ত না অংকের ক্লাসে অঘা মার্কা ছাত্রটিও অঙ্কটা বুঝতে পারতো, ততক্ষণ পর্যন্ত বুঝাবার ব্যাপারে তিনি দমার পাত্র ছিলেন না। অমনযোগী কিংবা কিংবা অংকে অনুৎসাহী কারো কারো মুখে ব্ল্যাঙ্ক লুক প্রত্যক্ষ করে তিনি বলতেন, “কি! বোঝা গেলোনা?” বলে আবার তিনি প্রথম থেকে বোঝাতে শুরু করতেন। রাজশাহীর আর সবার মত তাঁর কথায়ও আঞ্চলিকতার টান ছিলো, তবে তাঁর সরলতার কারণে এ নিয়ে কখনো আমরা তাঁর লেগ পুল করতাম না। কয়েক বছরের মধ্যেই তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলেন এবং তাঁর সদ্য বিবাহিতা সুন্দরী স্ত্রীকে নিয়ে এসে কলেজ ক্যাম্পাসে বসবাস শুরু করলেন। যেহেতু স্যারদের পরিবারের সাথে আমাদের যোগাযোগের কোন উপায় ছিলোনা, সেহেতু দূর থেকে শুধু সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আর টার্ম এন্ড ডিনারগুলোতে দেখেই আমরা এই দম্পতি যুগলকে কপোত কপোতী হিসেবেই ভাবতাম। ম্যাডামকে দেখে সহজেই ধারণা করা যেত যে তিনি একজন সুশীলা, স্নেহশীলা রমণী ছিলেন। দেশ স্বাধীন হবার পর যখন অনেক কয়টা আসন খালি হলো, তখন একাদশ শ্রেণীতে আমাদের ক্লাসে ১৫/১৬ জন নতুন ক্যাডেটকে নেয়া হয়। সেই দলে স্যারের এক শ্যালকও ছিলো। পরবর্তীতে আমাদের সেই নতুন ব্যাচমেটের সুবাদে ম্যাডামের আরো বহু গুনের কথা জেনেছিলাম। এখানে বলে রাখি যে মাত্র দু’ বছরের জন্য ভর্তি হওয়া এই ১৫/১৬ জন ক্যাডেটকে আমরা কলেজে বহুভাবে হেনস্থা করেছি। তাদেরকে আমরা হাফ ক্যাডেট বলতাম এমনকি প্রথম ক’দিন হাল্কা র‌্যাগিং ও করেছিলাম। আমাদের মাঝে একজন মেডিকেল অফিসার সেজে তাদের মেডিকেল টেস্টও নিয়েছিলো। পরে এ নিয়ে হাস্য কৌতুকের কোন অন্ত ছিল না। কিন্তু দলগতভাবে তারা খুব রিসিলিয়েন্ট ছিলো। ফলে দ্রুতই তাদের আর আমাদের মূল ক্যাডেটদের মাঝে যেটুকু ব্যবধান ছিল তা ঘুচে যেতে থাকে আর তারা আমাদের দলে মিশে যেতে থাকে। আজ পেছনে তাকিয়ে আমার স্বীকার করতে এতটুকু দ্বিধা নেই যে দল হিসেবে তাদের cumulative মান আমাদের, অর্থাৎ অরিজিনাল ক্যাডেটদের চেয়ে মোটেই কম ছিলনা, বরং হয়তো একটু বেশীই ছিলো। সে কারণেই আমাদের মতই তাদেরও অনেকেই আজ স্ব স্ব পেশায় আপন মহিমায় দীপ্যমান।

পেশাগত জীবনের শেষ প্রান্তে এসে মাহতাব স্যার এমসিসি’র প্রিন্সিপাল পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। ১৯৯৮/৯৯ সালের দিকে এক প্যারেন্টস’ ডে তে তিনি আমাকে দেখে তাঁর অফিসে ডেকে নিলেন এবং বল্লেন, পুত্র আর ছাত্ররা কোনদিন পিতা আর শিক্ষকের কাছে বড় হয়না। আসো, আজ তোমাদের ছোটবেলার সম্পর্কে কিছু কথা বলি। এই বলে তিনি আমাদের ক্লাসের কে কোথায় আছে তা জানতে চাইলেন। বিশেষ করে তিনি আমাদের ক্লাসের অঙ্কের দিকপাল সালেহ আহমেদ তানভীরের সম্বন্ধে জানতে চাইলেন। এখানে বলে রাখি, তানভীর ছিলো আমাদের ক্লাসের এক অনন্য সাধারণ প্রতিভা। যে বোর্ডের কোন পরীক্ষাতেই প্রথম না হলেও আমরা, তার ব্যাচমেটরা মানি এবং তার শিক্ষকেরাও একবাক্যে মেনে নেবেন যে তানভীর এমসিসি’র সর্বকালের এক অন্যতম শ্রেষ্ঠ মেধাবী ক্যাডেট। নবম দশম শ্রেণীতেই দেখতাম অঙ্ক স্যারেরা কোন কঠিন প্রসঙ্গ এলে তানভীরের সাহায্য কামনা করতেন, আর একাদশ দ্বাদশ শ্রেণিতে তো এমন ঘটনা হরহামেশাই ঘটতো। তানভীর অনেক সময়েই স্যারদের ভুল ধরিয়ে দিত বিনয়ের সাথে, স্যারেরাও যুক্তি তর্কে হেরে গিয়ে তানভীরকে ক্রেডিট দিতে কসুর করতেন না। এর আগের পর্বে বলেছি, তানভীর বর্তমানে ওহায়ো স্টেট ইউনিভার্সিটিতে প্রফেসর হিসেবে কর্মরত। ও ২০০৫-০৬ সালে লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজের Institute For Mathematics Sciences এ ভিজিটিং ফেলো হিসেবে কাজ করেছিলো। ও আমাকে জানিয়েছে যে আমরা যখন কলেজ ছেড়ে চলে আসি, তখন মাহতাব স্যার তাকে ডেকে নিয়ে বলেছিলেন, “তোমার ভবিষ্যৎ সাফল্য ও সমৃদ্ধি কামনা করি। তোমার যেকোন সাফল্যে আমি তোমার শিক্ষক হিসেবে সারাজীবন গর্ব বোধ করবো” (বা এ ধরণের কিছু কথা)। তানভীর এখনো সে কথা স্মরণ করে, এবং আমার কাছে মাহতাব স্যারের অবর্তমানে তাঁর পরিবারের বর্তমান অবস্থা সম্বন্ধে জানতে চায়।

জীবনের শেষ ক’টা দিন মাহতাব স্যার ঢাকা সিএমএইচের শয্যায় শুয়ে অনেক অশ্রুপাত করতেন বলে তখন ঢাকায় থাকা আমার বন্ধুদের কাছে শুনে আমি খুব ব্যথিত হয়েছিলাম। আমি তখন ঢাকার বাইরে কর্মরত ছিলাম। তাঁর এক ছেলে সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলো। ঢাকা সেনানিবাসে সেনাসদরে উচ্চপদে কর্মরত আমার এক ব্যাচমেটকে প্রায়ই মাহতাব স্যার ডেকে নিতেন আর তাঁর দুঃখের কথা বলতেন। তিনি মরণব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছিলেন এবং এ রোগটা একেবারে শেষ পর্যায়ে এসে সনাক্ত হয়েছিল। আমার সেই বন্ধু আমাকে জানিয়েছিল যে সে যতবার সিএমএইচে তাঁকে দেখতে গিয়েছিলো, ততবারই সে ম্যাডামকে তাঁর শয্যাপাশে ভেজা চোখে দেখতে পেয়েছে। কপোত কপোতীর কথা আগেই বলেছি। কথাটা শুনে আমার সেদিন ব্যাধের শরবিদ্ধ হয়ে গাছ থেকে পুরুষ পাখিটি পড়ে যাওয়া আর তার বিহনে তীব্র বেদনায় জোড়া পাখিটার আকুল ক্রন্দন এবং শোকাহত হয়ে ক্রন্দনরত অবস্থায় মৃত্যুবরণের কথা মনে হয়েছিল, যা দেখে রামায়ন রচয়িতা বাল্মিকি ব্যাধকে অভিশাপ দিয়েছিলেন। আমার সে বন্ধুটি তার প্রভাব খাটিয়ে স্যারের ছেলেকে ঢাকায় বদলী করিয়ে এনেছিলেন, যেন এর ফলে স্যারের লজিস্টিক সমস্যার কিছুটা সমাধান হয়। যাহোক, রোগ দেরীতে সনাক্ত হবার কারণে স্যারকে খুব বেশীদিন হাসপাতেলের শয্যায় কাটাতে হয়নি। আল্লাহ এই সহজ সরল ভালো মনের মানুষটিকে ক্ববরে ও আখেরাতে শান্তিতে রাখুন, অন্তর থেকে এই দোয়া করে ভারাক্রান্ত হৃদয়ে আজকের এই পর্বটা এই একজন মাত্র শিক্ষকের কথা দিয়ে এখানেই শেষ করছি।


চলবে…

ঢাকা
১৭ অক্টোবর ২০১৫
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই জানুয়ারি, ২০১৬ ভোর ৬:৩২
১১টি মন্তব্য ১১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

লালনের বাংলাদেশ থেকে শফি হুজুরের বাংলাদেশ : কোথায় যাচ্ছি আমরা?

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:১৪



মেটাল গান আমার নিত্যসঙ্গী। সস্তা, ভ্যাপিড পপ মিউজিক কখনোই আমার কাপ অফ টি না। ক্রিয়েটর, ক্যানিবল কর্পস, ব্লাডবাথ, ডাইং ফিটাস, ভাইটাল রিমেইনস, ইনফ্যান্ট এনাইহিলেটর এর গানে তারা মৃত্যু, রাজনীতি,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমেরিকার গ্র্যান্ড কেনিয়ন পৃথিবীর বুকে এক বিস্ময়

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৪১


প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে হাতে গাছের ডাল আর পরনে সাধা পোশাক পরিহিত এক মহিলার ভাটাকতে হুয়ে আতমা গ্র্যান্ড কেনিয়নের নীচে ঘুরে বেড়ায়। লোকমুখে প্রচলিত এই কেনিয়নের গভীরেই মহিলাটি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি! চুরি! সুপারি চুরি। স্মৃতি থেকে(১০)

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৪


সে অনেকদিন আগের কথা, আমি তখন প্রাইমারি স্কুলে পড়ি। স্কুলে যাওয়ার সময় আব্বা ৩ টাকা দিতো। আসলে দিতো ৫ টাকা, আমরা ভাই বোন দুইজনে মিলে স্কুলে যেতাম। আপা আব্বার... ...বাকিটুকু পড়ুন

যেকোন বাংগালীর ইন্টারভিউর সময়, 'লাই-ডিটেক্টটর' যোগ করে ইন্টারভিউ নেয়ার দরকার।

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৫ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:০৭



আপনার এনলাকার এমপি, প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী কামাল সাহেব, যেকোন সেক্রেটারী, যেকোন মেয়র, বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান, বিএনপি'র রিজভী, আওয়ামী লীগের ওয়ায়দুল কাদের, আপনার থানার ওসি, সীমান্তের একজন বিজিবি সদস্য, ঢাকার... ...বাকিটুকু পড়ুন

তাবলীগ এর ভয়ে ফরজ নামাজ পড়ে দৌড় দিয়েছেন কখনো?

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:২৬


আমাদের দেশের অনেক মসজিদে তাবলীগ এর ভাইরা দ্বীন ইসলামের দাওয়াত দিয়ে থাকেন। তাবলীগ এর সাদামাটাভাবে জীবনযাপন খারাপ কিছু মনে হয়না। জামাত শেষ হলে তাদের একজন দাঁড়িয়ে বলেন - °নামাজের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×