ভারতের আসাম রাজ্যের গুয়াহাটী শহরে খনি ও খনিজ শিল্প সম্পর্কিত দুই দিনের এক সম্মেলনে গেছি সম্প্রতি।আমি একে দীর্ঘদিন ধরে গৌহাটি নামে জানতাম। গিয়ে দেখি ওরা লিখছে ''গুয়াহাটী''( ইংরেজীতে লেখে Guwahati)। অবশ্য সরাসরি ''য়'' ব্যবহার করে না। ব্যবহার করে ''প'' বর্গীয় ''ব'' ছাড়া শ এর আগে যে ''ব'' আছে সেটি। এটি স্বাধীন,স্বদেশ,স্বজন ইত্যাদি লিখতে ব্যবহৃত হয়। ইংরেজীতে w, আরবীতে ''ওয়া'' এর প্রতিবর্ণীকরণেও এটি ব্যবহৃত হয়। সিলেট ও আসাম এলাকায় ''গুয়া'' অর্থ ''সুপারি''। গুয়াহাটী মানে সুপারি বাজার। সুউচ্চ পাহাড়ঘেরা বিশাল এক উপত্যকায় এই শহরের অবস্থান। এ শহরের ''দিস পুর'' এলাকাটি আসাম রাজ্যের রাজধানী। এই শহরের পাশ দিয়ে ব্রক্ষ্মপুত্র নদের বিপুল সূচনাধারা বয়ে গেছে। এই শহরে বাস করেন গণসঙ্গীতের কিংবদন্তী পুরুষ (বর্তমানে বিজেপি নেতা) ড.ভূপেন হাজারিকা। কর্মব্যস্ততার জন্য শহরটি ভালো করে দেখতে পারিনি বটে কিন্তু এই দুই দিনে (৫ নভেম্বর রাত থেকে ৮ তারিখ সকাল পর্যন্ত) গুয়াহাটি শহরসহ আসাম রাজ্যের জন্য অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে।
প্রস্তুতি
যাত্রার প্রাথমিক প্রস্তুতির পর বিমানের টিকিট বুকিং দিয়ে শুরু করলাম ভিসার প্রস্তুতি। এটা আমার জীবনের এক মর্মান্তিক আর অপমানকর অভিজ্ঞতা। ভারতীয় হাইকমিশনের কর্মকর্তাদের কাছ থেকে এক সহকর্মীসহ আমরা যে অপমানকর ব্যবহারের সম্মুখিন হয়েছি তাতে আমরা যে একটা স্বাধীন দেশের নাগরিক, এই স্বাধীনতা যে আমরা মুফতে বা কারো দয়ায় পাইনি, ত্রিশ লক্ষ প্রাণ আর দু'লাখ মা-বোনের চরম ত্যাগের বিনিময়ে বীরবিক্রমে লড়াই করে পেয়েছি সেটা ভুলে যাবার দশা। পরদিন সকালে ফ্লাইট। তার আগের দিন সন্ধ্যা ৬টায় শেষ পর্যন্ত দয়া (!?) করে ভিসা দিলেন তাঁরা। ততক্ষণে বুকিং দেয়া টিকিট বিক্রি হয়ে গেছে অন্যের কাছে। এদিকে ব্যাঙ্কের লোককে অনেক অনুরোধ করে বসিয়ে রেখেছি। কিন্তু কনফার্মড টিকিট ছাড়া স্বভাবত:ই তিনি ডলার এনডোর্স করতে পারবেন না। এখন টিকিট কোথায় পাই। শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ বিমানে কোলকাতা, সেখান থেকে জেট এয়ারে গুয়াহাটী। আসা যাওয়ার সময় কোলকাতায় প্রায় সাড়ে পাঁচ ঘন্টা করে বসে থাকতে হবে। অগত্যা তাই মেনে টিকিট নিলাম। সেই টিকিট নিয়ে দৌড়ে গিয়ে অনেক কষ্টে ডলার এনডোর্স করে ডলার নিলাম। ততোক্ষণে ভ্রমনের সব আনন্দ মহাবিষাদে পরিণত হয়ে গেছে। হাইকমিশনের লোকজনের দুর্ব্যবহার আর হয়রানীর কথা মনে হলে এখনো বেদনায় নীল হয়ে যাচ্ছি।
যাত্রারম্ভ
পরদিন (৫ নভেম্বর) বেলা ২টা ২০-এ বিমানে চড়লাম। এই প্রথম বাংলাদেশ বিমানে যাচ্ছি। ঢুকেই মন খারাপ হয়ে গেলো। জরাজীর্ন চেহারা দেখে মনে হলো এটা বিমানকূলের মুড়ির টিন সার্ভিস। আমাদের পাইলটদের দক্ষতা আর দু:সাহসকে আমি এখন ভীষণ শ্রদ্ধা করি। পৃথিবীর আর কোন দেশের পাইলটরা এই বিমান চালাতে রাজী হবেন কিনা আমার সন্দেহ আছে। আমাদের বিস্মিত করে প্রায় নির্ধারিত সময়েই বিমান আকাশে উড়লো। জানালার পাশে বসে বাংলাদেশ দেখতে দেখতে যাচ্ছি। কোলকাতার কাছাকাছি আসার পর ভীষণ জোরে শব্দ হলো সাথে ভালো রকমের একটা ঝাঁকিও খেলাম। জোরে ছুটেচলা গাড়ির চাকার নীচে বিশাল সাইজের ইট পড়ার মতো শব্দ।এর আগেও অনেকবার বিমান ভ্রমন করেছি দেশে বিদেশে। কিন্তু এই অভিজ্ঞতা প্রথম। পাশের একজন বললেন, চাকা খোলার শব্দ। তারপর ভয়মুক্ত হলাম। শেষ পর্যন্ত ভালোয় ভালোয় কোলকাতায় নেমেও পড়লাম।
প্রায় সাড়ে পাঁচ ঘন্টা পর ওখানকার সময় সন্ধ্যা ৬টায় জেট এয়ারে চড়লাম। ঝকঝকে নতুন বোয়িং ৭৩৭-৯০০। মন ফুরফুরে হয়ে গেলো। কিন্তু যাত্রার শুরুর পর আরেকটা ধাক্কা খেলাম। এয়ার হোস্টেজ ছোট্ট একটা পানির বোতল দিলেন। ২০০ এমএল পানি ! এক ঘন্টা ১০ মিনিটের ফ্লাইটে এইটুকুই খেদমত। নাস্তা খেতে হলে কিনে খেতে হবে। এটাও আমার জন্য নতুন অভিজ্ঞতা। আমাদের দেশের ভেতর ৪০/৪৫ মিনিটের ফ্লাইটেও কমপক্ষে নাস্তা দেয়া হয় কোল্ডড্রিঙ্কসসহ। ভাঙ্গাচোরা বিমানের ৪০ মিনিটের ফ্লাইটেও কেক, স্যাণ্ডউইচ আর কোক দিয়েছিলো। বাঙালী ধনকূবের সুব্রত রায়ের সাহারা গ্রুপেরই অঙ্গপ্রতিষ্ঠান জেট এয়ার। এরপর থেকে আমি বলি ''২০০এমএল পানি এয়ার''।
গুয়াহাটী পৌঁছে দেখি নির্ধারিত টেক্সি আসেনি। ফোনও করার উপায় নেই। উপস্থিত টেক্সিচালকরা ঘিরে আছে জোঁকের মতো। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর সেই মহান টেক্সিওয়ালা হাজির হলেন। নাম কামাক্ষা নাথ। আসামের কামরূপ জেলার কামরূপ আর গুয়াহাটী শহরের কামাক্ষার জাদুবিদ্যার সুনাম শৈশব থেকে শুনে আসছি। কামাক্ষানাথের চেহারা দেখে মনে হলো কোন জাদুকরের ডেকে আনা জাদুই চরিত্র।
এয়ার পোর্ট থেকে সোজা পূর্ব নির্ধারিত হোটেল নক্ষত্রে গেলাম পার্টিতে যোগ দিতে। এখানেই আমাদের ওঠার কথা ছিলো। কিন্তু বুকিং মিললো না। পরে ঠিক হলো হোটেল নন্দনে থাকবো। যাই হোক, হোটেল নক্ষত্রে পৌঁছে দেখি পুলিশে পুলিশারণ্য ! সাথে আরো বিচিত্র পোষাকের নানা বাহিনী। সৈন্যও কিছু দেখলাম। বহু কষ্টে হোটেলে ঢুকলাম। এই হোটেলে সিট না পাওয়া আর কড়া নিরাপত্তার কারণ জানলাম, পরদিন ৬ তারিখে অস্ট্রেলীয় ক্রিকেট টিম উঠবে ৮ তারিখে গুয়াহাটীতে ভারত-অসি ম্যাচ খেলার জন্য।
পার্টি সেরে হোটেল নন্দনে পৌঁছাতে রাত এগারটা হয়ে গেলো। এই রাতেও রাস্তায় যে জ্যাম দেখলাম আর কামাক্ষানাথের কাছে যা শুনলাম তাতে শুরুতেই আমার দৃঢ় বিশ্বাস জন্মালো গুয়াহাটীর যানজটের কাছে ঢাকার যানজট হেরে ভূত হয়ে যাবে। ( চলবে )
পরের পর্ব-
Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই আগস্ট, ২০১০ দুপুর ১:১৫

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




