somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একি খেলা আপন সনে - ৫

২৮ শে অক্টোবর, ২০১৭ রাত ১:০৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ঝুমকি ফুপু ফিরে যাবার আগে এক ছুটির দিনের সকালে আমাকে নিয়ে চললেন পাড়ার সঙ্গীত বিদ্যায়তনে। সেখানে নাচ, গান, তবলা, এমনকি পিয়ানো শেখানোরও বন্দোবস্ত ছিলো কিন্তু বেহালা শিখানোর কোনো শিক্ষক ছিলেন না। তবে ঐ স্কুলের মালিক ফুপুর বিশেষ পরিচিত হওয়ায় উনি কথা দিলেন যত শীঘ্র সম্ভব উনি একজন বেহালা শিক্ষকের ব্যাবস্থা করবেন। ফুপুর যাবার তখনও সপ্তাহ দুয়েক বাকী ছিলো তার আগেই বেহালা শিক্ষকের ব্যাবস্থা হয়ে গেলো। ঝুমকি ফুপু যাবার আগে তার সাধের বেহালাখানা আমাকে দিয়ে গেলেন। বেহালাতে কারুকার্য্যমন্ডিত হরফে খোদাই করা ছিলো গুলশান আরা চৌধুরী। বেহালাটা আজ পুরোনো কালচে হয়ে গেছে। ঝুমকি ফুপুও আজ বার্ধক্যের দ্বারপ্রান্তে। তবুও সেসব স্মৃতি লিখতে গিয়ে মনে হয় যেন সেদিনেরই কথা।

এই বিশাল মৃত্যুপুরী টাইপ বাড়িটাতে ঝুমকি ফুপু ছিলেন যেন এক আলোর ঝলক। নতুন বাবা, তার রাশভারী গুরু গম্ভীর মা এবং এই বাড়িতে পা দেবার পর হতে আমার চির অচেনা মায়েরও আরও বেশি অচেনা হয়ে পড়া ও দূরে সরে যাওয়া এমন একটি দূর্বোধ্য অস্বোয়াস্তিকর পরিবেশে ঝুমকি ফুপু ছিলেন এক দমকা হাওয়া। সতেজ প্রাণবন্ত এক ঝলক নিঃশ্বাস টেনে নেওয়া মাধবীলতা ফুলের ঘ্রাণ। ফুপুর ফিরে যাওয়াটা তাই বিশেষ কষ্টের ছিলো আমার কাছে। তবে বেহালায় হাত দিলেই আমি এক অদ্ভুত কোমল স্পর্শ পেতাম। সে ছিলো তার স্পর্শ। ঝুমকি ফুপু যাবার আগে আমাকে একটা পারফিউম দিয়ে গিয়েছিলেন "লেডি ম্যানহাটন"। ফুপুর কথা মনে হলেই আমি সেই পারফিউমর বোতল খুলে তার গন্ধ নিতাম। অনেক রাতেও বন্ধ ঘরের ভেতরটা ভরে যেত ফুপুর গন্ধে।

তখনকার দিনে ছিলো শুধুই টি এন্ড টি ফোন। ফুপু বিদেশ থেকে ফোন দিতেন ছুটির দিনের দুপুরে। মায়ের সাথে কথা বলাটাই তার উদ্দেশ্য ছিলো। কিন্তু তার ফোনের রিংটা পেলেই আমি কি করে যেন বুঝে যেতাম এটা ফুপুর ফোন। দৌড়ে গিয়ে ফোনটা ধরতে ইচ্ছে হত আমার তবে কোন সে অদৃশ্য অজানা নিষেধ বারন আমাকে আটকে দিত। আমি অতি কষ্টে নিজেকে সামলে রাখতাম শুধু কান খাড়া করে রাখতাম কখন ফুপু আমাকে ডাকবেন একটু কথা বলার জন্য। আমাকে নিয়ে ফুপুর এত আদিখেত্যা তার মায়ের একদমই পছন্দ হত না। তবুও একমাত্র জেদি মেয়েকে তিনি মনে মনে ভয় পেতেন। পৃথিবীর কাউকে যে উনি ভয় পেতে পারেন এটা আমার কখনও মনে হয়নি ফুপুর সাথে তার আচরণ দেখার আগে। তবে ফুপু বেশ জিদ্দি ছিলেন এবং কোনো এক অজ্ঞাত কারণে ফুপুকে সবাই বাড়িতে একটু সমীহ করে চলতো তা আমি বেশ বুঝতাম তবে কারণটা তখনও আমার অজ্ঞাত ছিলো।

আমার প্রায়ই মধ্যরাতে ঘুম ভেঙ্গে যেত। ঘুম ভেঙ্গে গেলেই আমি জানালায় বসে থাকতাম। নিস্তব্ধ রাতের তারায় ভরা আলোকিত আকাশ কালো রাতের কালীতেও যেন ঢেলে দেয় এক হালকা জ্যোসনার ছায়া। সাদা সাদা মেঘের আড়ালে লুকিয়ে থাকা পূর্নিমার চাঁদের অপূর্ব সৌন্দর্য্যের খেলা আমি সে সময়গুলোতে খুব অবাক হয়ে দেখেছি।

একদিন সকালে উঠে দেখলাম সারাবাড়িতে আনন্দের রেশ। ডাইনিং টেবিল বোঝাই মিষ্টির বাক্স। নতুন বাবার মায়ের মুখে আনন্দোচ্ছাস। আমি কাউকেই কিছু জিজ্ঞাসা না করে নিজেই পরিস্থিতি আঁচ করার চেষ্টা করছিলাম। হঠাৎ শিউলি আমাকে আড়ালে ডেকে বললো, জানো একটা খুশির সংবাদ আছে। আমি বললাম, কি? সে জানালো আমার নাকি নতুন ভাই বা বোন হতে যাচ্ছে। নতুন ভাই বা বোন, সেই আনন্দে আমার মন ভরে উঠলো। আমার ছোট ভাই বা বোন কি হবে সে? আমাকে কি বলে ডাকবে? আমি তাকে অনেক আদর করবো অনেক ভালোবাসবো। আমার খেলার সাথী হবে সে। নতুন ভাই বা বোনের স্বপ্নে আমি পরবর্তী কিছুদিন মশগুল হয়ে রইলাম।

এরপর এলো স্কুলে বাৎসরিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পালা। আমাদের ক্লাসের মেয়েরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের "সামান্য ক্ষতি" কবিতাটির নৃত্যনাট্য করবে। ক্লাসের শেষের দুই পিরিয়ড রিহার্সেল হবে। আমরা সকলে অপেক্ষা করছি। আমাদের মধ্যে অনেকেই নাচ শিখে, অনেকেই গান, অনেকেই আবৃতি জানে। আমিই মনে হয় একমাত্র মানুষ যে কিছুই জানিনা। কার কি প্রতিভা আছে তা জানার পরে আমাদের কালচারাল হেড শামীম আপা সিলেক্ট করতে বসলেন কে কোন পার্ট পাবে। সবাইকে সব পার্ট দেবার পরে উনি আমাকে বললেন ঐ নির্মম রাজমহিষীর অংশটুকু আমাকে করতে হবে। আমি সামান্য ক্ষতি কবিতাটি আগেই পড়েছিলাম এবং ঐ রাজমহিষীর উপরে আমার বরাবরের ঘৃনা ছিলো বরং মহানুভব ভূপতি বা রাজার উপর ঐ বয়সে আমার অশেষ অগাধ শ্রদ্ধা ভালোবাসার শেষ ছিলোনা। তবে শামীম আপা আমাকে বললেন, রাজমহিষীর চরিত্রটি এখানে নির্মম হতে পারে তবে এ চরিত্রের প্রতিটি ক্ষুদ্র অংশ ফুটিয়ে তোলার দায়িত্ব আমার। আমি আপার কথা মেনে নিলাম।

রিহার্সেলের প্রথম দিনটিতেই বাঁশীর সুরে সুরে কবিতার সাথে সাথে কি করে পা মিলিয়ে চলতে হবে মানে এই নৃত্যনাট্যের প্রথম অংশের নাচের সাথে সখীদেরকে নিয়ে এইটুকু শিখতে গিয়েই আমি প্রেমে পড়লাম। গভীর প্রেমে পড়লাম আমি এই শিল্পের। নাচ শিখাতে এসেছিলেন মুনমুন আহমেদ। আমি উনার তেজস্বিনী ঋজু দেহ, দীপ্ত ভঙ্গিমা কিংবা নম্র কোমল প্রতিটি ভঙ্গির সাথে এমনভাবেই মিশে গেলাম যে তখন আমার ধ্যান জ্ঞান স্বপ্নে নেচে চলেছিলাম ঠিক উনার মত করেই।

আজও মাঝে মাঝেই প্রখর শীতে, মাঘ কিংবা পৌষে গরম জলের উষ্ণতায় স্নান সেরে উঠেও মনে পড়ে যায় -
স্নান সমাপন করিয়া যখন কূলে ওঠে নারী সকলে
মহিষী কহেন উহু শীতে মরি-
সকল শরীর উঠিছে শিহরি
জ্বেলে দে আগুন ওলো সহচরী
শীত নিবারিব অনলে....

একি খেলা আপন সনে- ৪

একি খেলা আপন সনে - ৩

একি খেলা আপন সনে- ২

একি খেলা আপন সনে - ১
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে অক্টোবর, ২০১৭ সকাল ৮:২৬
২৬টি মন্তব্য ২৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বিসিএস দিতে না পেরে রাস্তায় গড়াগড়ি যুবকের

লিখেছেন নাহল তরকারি, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৫৫

আমাদের দেশে সরকারি চাকরি কে বেশ সম্মান দেওয়া হয়। আমি যদি কোটি টাকার মালিক হলেও সুন্দরী মেয়ের বাপ আমাকে জামাই হিসেবে মেনে নিবে না। কিন্তু সেই বাপ আবার ২০... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। আমের খাট্টা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৪



তাতানো গরমে কাল দুপুরে কাচা আমের খাট্টা দেখে ব্যাপারটা স্বর্গীয় মনে হল । আহা কি স্বাদ তার । অন্যান্য জিনিসের মত কাচা আমের দাম বাড়াতে ভুল করেনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ডাক্তার ডেথঃ হ্যারল্ড শিপম্যান

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:০৪



উপরওয়ালার পরে আমরা আমাদের জীবনের ডাক্তারদের উপর ভরশা করি । যারা অবিশ্বাসী তারা তো এক নম্বরেই ডাক্তারের ভরশা করে । এটা ছাড়া অবশ্য আমাদের আর কোন উপায়ই থাকে না... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার ইতং বিতং কিচ্ছার একটা দিন!!!

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:০৩



এলার্ম এর যন্ত্রণায় প্রতিদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গে আমার। পুরাপুরি সজাগ হওয়ার আগেই আমার প্রথম কাজ হয় মোবাইলের এলার্ম বন্ধ করা, আর স্ক্রীণে এক ঝলক ব্লগের চেহারা দেখা। পরে কিছু মনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কে কাকে বিশ্বাস করবে?

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৩৯


করোনার সময় এক লোক ৯৯৯ এ ফোন করে সাহায্য চেয়েছিল। খবরটা স্থানীয় চেয়ারম্যানের কানে গেলে ওনি লোকটাকে ধরে এনে পিটিয়েছিলেন। কারণ, ৯৯৯ এ ফোন দেওয়ায় তার সম্মানহানি হয়েছে।

সমাজে এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×