নিজের মুখে মুখ ফুটে কখনও কিছু চাইতাম না কারো কাছে। নিজের মত থাকতাম নিজের মাঝে। শুধু খুব কাছের বা খুব আপন মনে হত রমেশ চাচাকে। উনি আমাকে শিখিয়েছিলেন ফুল আর পাখিদের নাম। আজও নীল অপরাজিতা, প্রগাঢ় ঘ্রাণের গন্ধরাজের ঘ্রান কিংবা হাস্না হেনার স্নিগ্ধতা মানেই আমার ছেলেবেলার রমেশ চাচার তৈরী সেই স্বর্গীয় ঊদ্যান। বসন্ত বৌরী পাখি কিংবা সাদা শঙ্খচিল বা দুপুরবেলা পেয়ারা ডালে বসে "ঘু ঘু" এক মন খারাপ করা ডাকের ঘুঘু পাখি চেনাটাও উনারই কাছে। উনি ছাড়া ঐ যে মিষ্টি মত মেয়েটা এ বাড়ির ফুট ফরমাশ খাঁটা কাজের মানুষই সে। সেও আমাকে অনেকটাই বুঝতো। কোনো এক অদৃশ্য নির্দেশনায় সে আমার থেকে অদৃশ্য দূরত্ব বজিয়ে রাখতো বটে তবে অনেকদিন অনেক অনেক প্রয়োজনে আমি তাকে ছায়ার মত পেয়েছিলাম আমার পাশে। এক রাতে আমার খুব জ্বর আসলো। পিপাসায় বুক ফেঁটে যাচ্ছিলো আমার। ঘোরগ্রস্ত আমি আমার রুম থেকে বেরিয়ে মায়ের ঘরের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। অতো জ্বরের ঘোরেও দরজায় ধাক্কা দিতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালাম আমি। ফিরে আসছিলাম যখন তখনই দেখলাম শিউলীকে। শিউলী অর্থাৎ ঐ কাজের মেয়েটি। সারারাত আমার শিওরে বসে রইলো সে। মাথায় জলপটি দিলো। পানি খাওয়ালো। ভোরের দিকে যখন আমার খুব খিধে পেয়েছিলো। আমি না বলতেও সে ভেঁজে এনেছিলো মাখন ছড়িয়ে তাওয়ায় সেকা দু স্লাইস ব্রেড আর এক মাগ চা। সেই অমৃত খাবারের স্বাদ আমি আর পৃথিবীর কোথাও কখনও পাইনি।
ইচ্ছে করলেই আমি ফিরে যেতে পারতাম আমার নিজের দাদুর বাড়িতে। নিজের দাবীতে সকলের চোখের মনি হয়ে সেখানে থাকাটা মোটেও অসম্ভব কিছু ছিলো না আমার জন্য। তবুও আমি যেতে চাইতাম না বা চাইনি তার একটা মাত্র কারনই ছিলো। সে আমার মা। মায়ের কাছাকাছি না থাকতে পারলেও একই বাড়িতে আছি। তাকে দেখতে পাচ্ছি সেই বা কম কি। আমার নিজের বাবা যতদিন ও বাড়িতে ছিলেন কোনো একটা দিনও আমার মনে পড়ে না বাবার সাথে মাকে হাসিমুখে কথা বলতে দেখেছি। কিন্তু এ বাড়িতে প্রতি সন্ধ্যায় মা বেরিয়ে যেতেন বাবার সাথে ক্লাবে কিংবা পার্টিতে। মা বেরিয়ে যাবার পরেও সারাবাড়িতে ছড়িয়ে থাকতো কড়া বিদেশী পারফিউম এবং প্রসাধনীর গন্ধটা আরও বেশ কিছুক্ষন। আমি সেই গন্ধ নিয়ে সারা সন্ধ্যা ঘুরে বেড়াতাম। মা ফিরতেন গভীর রাতে। আমি তখন গভীর ঘুমে আছন্ন, এমনই ভাবতেন হয়তো তারা। কিন্তু মা কোনোদিন জানবেনা, মা না ফেরা পর্যন্ত আমি কোনোদিনই চোখের পাতা এক করতাম না। আমার ঘর থেকে জানালা দিয়ে দেখতে পাওয়া বড় গেটটাতে চোখ মেলে বসে থাকতাম ঐ প্রায় মধ্যরাতেও, অপেক্ষায় থাকতাম কখন দেখা যাবে গাড়ির হেড লাইট বা শোনা যাবে নতুন বাবার বড় গাড়িটার হর্ণ ।
ঠিক ও বয়সটাতে আরও বুঝে গেলাম এই সুবিশাল পৃথিবীতে আমার পথচলা আমার একারই। আমাকে একাই লড়তে হবে। রমেশচাচা প্রায়ই বলতেন, পড়ালেখা করে বড় হও আর কোনো দুঃখ থাকবে না মা। আমি অবাক হয়ে ভাবতাম আমি তো কখনও উনাকে আমার কোনো দুঃখ বলিনি। তবে উনি কেনো আমাকে এত দুঃখী ভাবেন সব সময়! এ বাড়িতে আসার আগে আমি কিছুদিন লিটিল জ্যুয়েলস স্কুলে গিয়েছিলাম কিন্তু এখানে আসার পরে আমাকে ভর্তি করে দেওয়া হলো অগ্রনী স্কুলে। একে নতুন পরিবেশ, তার উপরে নতুন স্কুল, বন্ধুরাও নতুন। কিন্তু কি এক অজ্ঞাত কারণে আমার ক্লাসের সহপাঠীরা বেশিভাগই আমাকে ভীষন পছন্দ করে ফেল্লো। স্কুলের বুলি আপা
একদিন একটি রচনা লিখতে দিলেন, বিষয় ছিল আমগাছ। আমি আগে কোনোদিন রচনা লিখিনি। তারপরও ভাবনা আর কল্পনা দিয়ে লিখে ফেলেছিলাম একটি একাকী আমগাছের কাহিনী। বুলি আপা বিস্মিত হলেন! উচ্ছসিত হলেন। আমার লেখায় উনার মুগ্ধতা বা অনাদরে অভ্যস্থ হয়ে যাওয়া এই আমির এত আদর, এত প্রশংসাতে নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করলাম আমি। বুঝে গেলাম নিজেকে গড়ে তোলার লড়াইটাই হলো নিজের ভেতরের সকল শক্তি বা মেধাকে কাজে লাগিয়ে তোলা। এই একমাত্র অবজ্ঞার জবাব হতে পারে।
এ বাড়িতে এক বিশাল আবিষ্কার আমার, তিনতলার বারান্দার কোনে এদের সুবিশাল লাইব্রেরী রুম। দেশী বিদেশী কত রকম বই যে তাকে থরে থরে সাজানো। একটা মইও আছে, উঁচু তাকগুলো হতে বই নামাবার জন্য। রোজ স্কুল থেকে ফিরেই আমার কাজ ছিলো চুপ করে একটা বই এনে নিজের রুমের লাগোয়া বারান্দায় বসে পড়া। আবার চুপি চুপি সেখানেই ফিরিয়ে রেখে আসা। পথের পাঁচালী, শরৎচন্দ্র, সঞ্চয়িতা কিংবা মেঘনাদবদ কাব্য সবই পড়তাম আমি বুঝে বা না বুঝেই। রবিঠাকুরের কবিতার "মাকে আমার পড়ে না মনে" পড়ে চোখের জলে বুক ভাসাতাম। কবিতার ভেতরের মেয়েটা তখন আমি।
একদিন লাইব্রেরী রুমের তাকের ড্রয়ারে আবিষ্কার করলাম আমি এক আশ্চর্য্য যন্ত্র। সুদৃশ্য কাঠের তৈরী বাদ্যযন্ত্রটিতে ছিলো তারের ছড়া। আঙ্গুল দিয়ে স্পর্শ করতে গম্ভীর এক অদ্ভুত স্বর বেরুলো। তাড়াতাড়ি রেখে দিলাম ড্রয়ারেই। এর কিছুদিন পরেই খুব কাকতালীয়ভাবেই
ঐ যন্ত্রটির সাথে পরিচয় হলো আমার। বিদেশ থেকে এলেন আমার নতুন বাবার একমাত্র বড় বোন। মা যেমন তার মোটা সোটা রাশভারী, মেয়ের সাথে তার একটু মিল নেই। স্কুল থেকে ফিরে আমি দেখলাম এক ছিপছিপে ফরসা ববকাট চুলের মহিলাকে। আগেই জানতাম উনি আসবেন কাজেই আঁচ করে নিলাম। উনি খুব হাসি খুশি আর চঞ্চল চরিত্রের মানুষ ছিলেন। আমাকে দেখেই কাছে ডাকলেন। বললেন, আহা কি মিষ্টি মুখটা। মায়ের মতই হাসি, চোখ নাকের আদল পেয়েছে কিন্তু রঙটা পায়নি। চমকে উঠলাম আমি। মনে পড়ে গেলো বাবাকে গালমন্দ করা মায়ের সেই উপমা আবলুশ কাঠ রঙ!
একদিন বিকেলে উনি উনার বেহালার খোঁজ করলেন। বেহালা কই আমার বেহালা! কেউ খুঁজে পাচ্ছিলো না তার বেহালা। আমি জানতাম কিন্তু ভয়ে বলিনি। শেষ পর্যন্ত নিজেই আবিষ্কার করলেন তিনি। ধুলো ঝেঁড়ে মুছে বাঁজাতে বসলেন। কি মায়াময় সুর। কোন অচীনদেশে নিয়ে যায় মন। আমি মুগ্ধ হয়ে শুনলাম আর সেদিনই জানলাম এটি বাঁজাতে একটি কাঁঠির মত অস্ত্রের প্রয়োজন হয়। আমার আগ্রহ দেখে ঝুমকি ফুপু আমাকে শিখাতে বসলেন। খুব অল্পদিনেই আমি শিখে ফেল্লাম । সুর তুলে বাঁজাতে শুরু করলাম পুরানো সে দিনের কথা, ভুলবি কিরে হায়, ও সেই চোখের দেখা প্রাণের কথা সে কি ভোলা যায়!
না কিছুই আসলে ভুলে যাওয়া যায় না । স্মৃতি সে দুখের হোক বা সুখেরই সবই হীরা, মনি, মুক্তা হয়ে জ্বলজ্বল জ্বলে মনের গহীন কুঠুরীতে।
একি খেলা আপন সনে - ৩
একি খেলা আপন সনে- ২
একি খেলা আপন সনে - ১