somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একি খেলা আপন সনে- ৬

৩০ শে অক্টোবর, ২০১৭ রাত ৮:৫১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


মাস ছয়েকের মধ্যেই এই বাড়ির পরিবেশ এবং নতুন নতুন যে সব ঘটনাবলীর সাথে পরিচয় হলো তা আমার জন্য যেমনই ছিলো চমকপ্রদ তেমনই ছিলো অজানাও। মায়ের আচরণে বেশ বড়সড় এক পরিবর্তন আসলো যেন। মাকে যদিও আগেও তেমন খুব বেশি স্নেহশীলা হতে দেখিনি বরং কি এক অকারন ক্ষোভ আর রাগ পুষে রাখতেন সর্বদা মনে মনে। আমার বাবার প্রতি, আমার দাদুর বাড়ির প্রতি, বিশেষ করে আমার দাদুর প্রতি। যেন উনি পছন্দ করে ও বাড়িতে মাকে এনে অনেক বড় অপরাধই করে ফেলেছিলেন এমন। এ বাড়িতে প্রবেশের পর হতেই মায়ের মাঝে সেই ক্ষোভের ছায়াটা দেখিনি বটে তবে কোনো এক অজ্ঞাত কারণে মায়ের সাথে আমার দূরত্ব বাড়তে শুরু করলো। আমার মনে হত মা ইচ্ছাকৃতভাবেই আমাকে এড়িয়ে চলেন এখানে। হয়তো অনাহুত রবাহুত এই আমির প্রতি এ বাড়ির সকলের বিরুপ মনোভাব দেখেই এই বিরুপতা দেখানোর শুরু, এটা হয়ত আমার ভালোর জন্যই, এমনও মনে হত আমার। আমার প্রতি বেশি ভালোবাসা দেখালে তারা যদি আবার বিরক্ত হয় এমনটা ভেবেই মা হয়তো দূরে থাকতেন আমার থেকে।


তবে একটা সময় আমার মনে হলো, আসলে মা তার অতীত ভুলতে চান। মা আমার নানুবাড়ির সাথেও যোগাযোগ রাখতেন না তেমন। আমার বাবার অন্তর্ধান বা মাকে ছেড়ে যাওয়া ব্যাপারটাকে মা কখনও সহজভাবে নিতে পারেননি বরং সেটা তিনি তার হার ধরে নিয়েছিলেন। এই কারণে অতীতের সকল কিছুর সাথে যোগাযোগ ছিন্ন করার জন্য তার ছিলো সকল প্রচেষ্টা কিন্তু আমি? আমাকে ছিন্ন করবেন কিভাবে! আমাকে ছিন্ন করতে পারেননি তিনি । এই একটি মাত্র নাড়ীর বাঁধনকে। তবে আমি তার চোখের সামনে থাকলেই সেই অতীত স্মৃতির কালো সুতোয় টান পড়তো হয়ত তার। তাই তার বিরক্তিটাও বাড়ছিলো নিজের অজান্তেই হয়তোবা। এই ভাবনাটা আমার প্রকট হলো মায়ের প্রেগন্যান্সীর সময়টাতে। উনার ধারে কাছে গেলেও উনি কি রকম যেন বিরক্ত হতেন, বলতেন কি ব্যাপার রেস্ট নাওনি কেনো? পড়তে বসনি কেনো? যাও চুল বাঁধো বা মুখ ধোও। মুখখানা তো একদম কালী মাড়া করে রেখেছো। চমকে উঠতাম আমি। আমার মনে হত আমাকে দেখলে বাবাকে মনে পড়ে যাচ্ছে মায়ের। মায়ের জীবনের চরম হার। বাবা মাকে রেখে চলে গেছেন। এই ব্যাপারটা অসহ্য মানষিক পীড়ার কারণ ছিলো তার।


মা আমার থেকে একেবারেই দূরে চলে গেলেন সেটা নতুন বাবুটা জন্মের পর পরই। কি সুন্দর লাল টুকটুক পুতুল পুতুল বাবু। সারাদিন ঘুমায়। ঘুমের মাঝে হাসে, কাঁদে। মাঝে মাঝে জেগে উঠে চিল চিৎকারে কান্না করে। আমি কাছে গেলেই মা বলেন, ধরো না ধরোনা। ব্যাথা পাবে, পড়ে যাবে। যাও নিজের ঘরে যাও। ঘুমাও, পড়তে যাও। নতুন বাবার মাও ছুটে আসেন। বাবুর আশে পাশে আমাকে দেখাটা উনারও যে পছন্দ না সে আমি বেশ বুঝতে পারি। বাড়িটা সারাদিনই অতিথি অভ্যাগতদের সমাগমে ভরপুর থাকে। কত রকম উপহার, কত রকম খাদ্য খানা, হাসি তামাশা, গল্প গুজব। ওদের মাঝে আমার উপস্থিতি ওদের জন্য বেশ অস্বোয়াস্তিকর সে আমি আমার ঐ বয়সেও খুব বুঝে যাই।

একদিন বিকেলে স্কুল থেকে ফিরে দেখলাম মোটা মত এক ভদ্র মহিলার সাথে নতুন বাবার মা উচ্ছসিত হয়ে গল্প করছেন। আমার নাতনীটা তো হয়েছে যেন পরী। মায়ের মত গাঁয়ের রঙ আর বাবার মত চেহারা পেয়েছে। আমার ছেলেও কি কম সুপুরুষ! ঐ মোটা মত ভদ্র মহিলা বললেন, তা বৌমার আগের ঘরের মেয়েটা কই? ডাকেন তো দেখি তাকে। দরজার কোনে থমকে দাঁড়ালাম আমি। আমার নতুন বাবার মায়ের মুখ সে প্রশ্নে আঁধার হয়ে এলো। বললেন, আছে কোথাও বা স্কুল থেকে ফেরেনি। এই এক আপদ। আমার ছেলে তো বউ এর রুপে অন্ধ হয়ে বিয়ে করে আনলো, সাথে নিয়ে আসলো এক আবর্জনার বাক্স। কলিকাল। ছেলের মুখে চেয়ে কিছু কইতেও পারিনা সইতেও পারিনা।

আমার চোখ ভরে উঠলো জলে। আমি আবর্জনার বাক্স? আমিই যে সেই আবর্জনার বাক্স তা বুঝে উঠতে সময় লাগলো না আমার। একটি শীতল হাতের স্পর্শে কেঁপে উঠলাম আমি। শিউলী। আমার চোখ মুছিয়ে দিলো ওর শাড়ির আঁচলে। ওর বুকের মধ্যে মুখ লুকিয়ে ফুঁপিয়ে উঠলাম আমি .....



আমার স্কুল গরমের ছুটি হলো। ও বাড়ি থেকে আমার দাদু আসলেন আমাকে নিয়ে যাবেন কিছুদিনের জন্য। এত কিছুর পরেও আমি যেতে চাইছিলাম না মনে মনে। খুব ভয় হত মা যদি আমাকে এখানে আর কখনও না নিয়ে আসে। তবুও কিছু না বলেই সেখানে যেতে সন্মত হলাম।

পুরোনো বাড়িতে ফিরে এসে মন আরও বেশি খারাপ হলো আমার। চারিদিকে শুধু বাবা মায়ের স্ম্বতি। আমি বাবা মায়ের বেডরুমটাতে একা একা চুপ করে বসে থাকতাম। ভাবতাম আবার আগের মত সব কিছু আছে। বাবা একটু পরেই ফিরবেন। মা মুখ গম্ভীর করে খাবার খেতে ডাকবেন। খালি সাইড টেবিলটাতে হাত বুলাতাম। এখানে একটা অনেক বড় চীনামাটির কারুকাজ করা ফুলদানী ছিলো। এক বিকেলে মা বাবার ঝগড়ার এক পর্যায়ে মা ফুলদানীটা ছুড়ে ফেললেন। সেই বিকট ঝন ঝন ঝন ঝন শব্দে সারা বাড়ি কেঁপে উঠেছিলো সেদিন। আজ কোথাও সেই ভাঙ্গা কাঁচের এক টুকরোও নেই। প্রশস্ত টেবিলটা শূন্য পড়ে আছে। তবুও কি নিদারুণ তীক্ষ্ণতায় একটি কাঁচের টুকরো ঠিকই বিঁধে আছে আমার বুকের মধ্যে।

পুরোনো সেই দিনগুলোর কষ্টকর স্মৃতিগুলিও কেনো এত মায়াময়! আমি মায়ের আলমারী খুলি। হ্যাঙ্গারে থরে থরে সাজানো মায়ের শাড়িগুলি। আমি জানি এই শাড়িগুলি আর কখনও মা পরবেন না। মা কখনই কোনোদিন ফিরবেন না এ বাড়িতে। তবুও আমার দাদী পরম যতনে আগলে রেখেছে শাড়িগুলিকে। হয়তো উনি আশা করে কোনো না কোনোদিন মা আসবেন এ বাড়িতে। আমি আমার বাবার সাথে মায়ের বিয়ের আকাশ নীল রঙ্গ শাড়ির ভাঁজে নাক ডুবিয়ে ঘ্রান নেই। মায়ের ঘ্রান। বাবার শেরওয়ানী একটি বড় পলিথিনে করে এক সাইডে হ্যাঙ্গারে ঝুলানো আছে। বিয়ের পাগড়ী ঘোলাটে প্লাস্টিকের মোড়কে উপরের তাকে তেমনি রাখা আছে।

এই পাগড়ীর নীচে আছে আলমারীর ড্রয়ারের চাবী যা মা আমাকে আগে কখনও ধরতে দিতেন না। কি মনে করে আমি চাবীটা হাতে নেই। ড্রয়ারটা খুলি । ভেতরে শুধুই একটি গোলাপী আর রুপোলী রঙ অদ্ভূত সুন্দর ফাউন্টেন পেন। আর একটি ডায়েরী। আমি ডায়েরীটার গায়ে হাত বুলোই। খুলে দেখতে বা কি লিখেছে মা তাতে পড়ে দেখতে একটা বারও ইচ্ছে হয় না আমার। আমি তো জানি আমার বাবার নামে শত অভিযোগ বা মায়ের সকল অপ্রাপ্তিগুলিই লেখা থাকবে তাতে। চাবি ঘুরিয়ে ড্রয়ার বন্ধ করে চাবীটাও যথাস্থানে রেখে দেই।

আচ্ছা মা এসব নিয়ে যায়নি কেনো? মা তো এত বেহিসাবী নন। তাহলে কি মা ইচ্ছা করেই রেখে গেছেন যেন তার না বলা কথাগুলো এ বাড়ির সকলেই জানতে পারেন। নতুন বাবা বাড়ি থেকে এখানে বেড়াতে এসে আমি নতুন করে সব কিছু আবিষ্কার করি। মনে হয় আমার ছোট্ট জীবনের এই পৃথিবীটা একেবারেই আমূল বদলে গেছে।

রাতের খোলা আঁকাশ আরও বেশি স্মৃতি জাগানিয়া। আমার বাবাকে মনে পড়ে। কোথায় আছে বাবা? আমার কথাও কি একটু মনে পড়ে না তার! সবার উপরে এক আকাশ অভিমান জন্মাতে থাকে আমার। মনে পড়ে ছোট্ট পুতুলের মত বাবুটাকে। আমাকে দেখলেই যে হাঁসে। আমি ওর গালে হাত দিলে হা করে খেতে আসে আমার আঙ্গুল। আমার বাবুটার জন্যও মন কেমন করে। বাচ্চারা নাকি ফেরেস্তা। বড়দের মত এত কুটিলতা, জটিলতা নেই ওদের মনে। সে নিশ্চয়ই আমাকে ভুলে যায়না। সে নিশ্চয়ই আমাকে খুঁজে বেড়ায়।

সবার জন্য আমার খুব কষ্ট হয়। আমি সবাইকেই মিস করি একা একা কিন্তু কেউ হয়তো আমাকে মিস করে না। এই পৃথিবীতে আমি এক অপাংক্তেয়, জঞ্জাল। আবর্জনার বাক্স...আমাকে কারো কোথাও দরকার নেই...





একি খেলা আপন সনে - ৫

একি খেলা আপন সনে- ৪

একি খেলা আপন সনে - ৩

একি খেলা আপন সনে- ২

একি খেলা আপন সনে - ১
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই নভেম্বর, ২০১৭ রাত ১০:২৭
৪১টি মন্তব্য ৪১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বারবাজারে মাটির নিচ থেকে উঠে আসা মসজিদ

লিখেছেন কামরুল ইসলাম মান্না, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৪০

ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার বারবাজার ইউনিয়নে মাটির নিচ থেকে মসজিদ পাওয়া গেছে। এরকম গল্প অনেকের কাছেই শুনেছিলাম। তারপর মনে হলো একদিন যেয়ে দেখি কি ঘটনা। চলে গেলাম বারবাজার। জানলাম আসল... ...বাকিটুকু পড়ুন

সৎ মানুষ দেশে নেই,ব্লগে আছে তো?

লিখেছেন শূন্য সারমর্ম, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:৪৮








আশেপাশে সৎ মানুষ কেমন দেখা যায়? উনারা তো নাকি একা থাকে, সময় সুযোগে সৃষ্টিকর্তা নিজের কাছে তুলে নেয় যা আমাদের ডেফিনিশনে তাড়াতাড়ি চলে যাওয়া বলে। আপনি জীবনে যতগুলো বসন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

পরিবর্তন অপরিহার্য গত দেড়যুগের যন্ত্রণা জাতির ঘাড়ে,ব্যবসায়ীরা কোথায় কোথায় অসহায় জানেন কি?

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:৫৭


রমজানে বেশিরভাগ ব্যবসায়ীকে বেপরোয়া হতে দেখা যায়। সবাই গালমন্দ ব্যবসায়ীকেই করেন। আপনি জানেন কি তাতে কোন ব্যবসায়ীই আপনার মুখের দিকেও তাকায় না? বরং মনে মনে একটা চরম গালিই দেয়! আপনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯

মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা বলতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

×