আরবাজ খুব মন খারাপ করেছিলো সে আমি বুঝেছি কিন্তু আমার মতামতের প্রতি সে পূর্ণ সন্মান জানিয়েছে। কারো মতের বিরুদ্ধে কিংবা জোর করে কারো চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্তের শিকার কাউকে বা কোনোকিছুকেই সে সমর্থন করতে পারে না। আমার কাছে আরবাজকে মনে হয় মানুষ জনম এমনই হওয়া উচিৎ। আরবাজ মনুষ্য সমাজের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। মানুষের জন্য তার এত সমবেদনা, এত সহানুভুতিপূর্ন মন, এত সহমর্মিতা আমি আমার জীবনে আর কাউকে দেখিনি। আমি আরবাজের প্রতি কৃতজ্ঞ হয়ে পড়ি। আমার খুব কষ্ট হয় যে আমি আরবাজের মনের ইচ্ছেটাকে পূরণ করতে পারছি না। আরও যেটা কষ্ট পেয়েছি। আরবাজ আমার কাছে প্রত্যাখ্যাত হয়ে ফিরে যাচ্ছে আর কাউকেই বিয়েটা না করেই। সে আমাকে বলেছে সে আমার জন্যই নাকি শুধু অপেক্ষা করবে। যদি কোনোদিন আমি মত বদলাই, যদি কোনোদিন আমার মনে হয় আমার চলার পথে কোনো একজন জীবনসাথী দরকার তখন যেন আমি তার কথাটাই মাথায় রাখি। এটাই তার শেষ কথা।
আমার খুব খারাপ লাগে। আমি জানিনা কখনও আমার মনে এমন কোনো ইচ্ছে হবে কিনা। কখনও আমি আমার এই বিক্ষত মনকে কারো সুশীতল পরশে বা ভালোবাসার প্রলেপে আবারও উষ্ণ করে তুলতে পারবো কিনা। কিন্তু আমার জীবনে আরবাজ এক আশীর্বাদ। দোলনের উপরে অভিমান হোক বা দোলন থেকে থমকে যাওয়াটাই হোক যেটাই বলি না কেনো এই প্রাথমিক ক্ষত শুকোতে আমার বেশ কিছুটা সময় লাগতো হয়তো যা ঠিক তারপর পরই আরবাজের আগমনে আমি অনেকটাই সামলাতে পেরেছি। আরবাজের পরম বন্ধু মনোভাবাপন্নতা ও মমতাময় সাহচর্য্যে ভুলে থাকতে পেরেছি সেই বেদনাকে। তাই আরবাজের কাছে থাকবে আমার চিরকৃতজ্ঞতা। যদি কখনও এতটুকু সুযোগ হয় আমার থেকে আরবাজের কোনো উপকারের, আমি আমার প্রাণ দিয়ে হলেও সেই চেষ্টাটাই করবো। শুধু পারবোনা ওকে এই মুহুর্তে বিয়ে করতে। আরবাজ বলেছে তার উপরে আমি পূর্ন বিশ্বাস রাখতে পারি। আমি চাইলে সে আমার জন্য অস্ট্রেলিয়ায় থাকবার বা প্রতিষ্ঠিত হবার ব্যাবস্থাও করতে পারে। আমি রাজী হইনি আসলে আমি আর কারো করুণা চাচ্ছি না যদিও আরবাজের কাছে এটাকে করুনা বলাটা আমার অন্যায় হবে আরবাজের সাথে আসলে এই করুনা কথাটা যায় না।
প্রায় তিনমাস কাঁটিয়ে আরবাজের ফিরে যাবার সময় এলো। এর মাঝে সে প্রায় এক মাসেরও বেশি চিটাগং ছিলো তার ফ্যামিলীর সাথে। তার মা নাকি বড় আশা করেছিলেন এবারেই বউ এর মুখ দেখবেন বলে। তার সে আশা পূর্ণ না হওয়ায় নাকি খুব মন খারাপ করেছে। আরবাজের এসব কথায় আমি বিমর্ষ হয়ে পড়ি। নিজেকে অপরাধী লাগে আমার। কিন্তু কি করবো আমি যে নিরুপায়। হঠাৎ এত বড় ধাক্কাটার পরপরই আরবাজের আগমন আসলে আমাকে নিজের সম্পর্কেও ভাবতে দেয়নি মন দিয়ে। আমি আরবাজকে নিয়েই ব্যাস্ত ছিলাম। হঠাৎ আমার জীবনে এমন একজন সহানুভুতিশীল মানুষের আগমন আমাকে নাড়িয়ে দিয়েছিলো। আরবাজের ব্যাক্তিত্বের ঔজ্জ্বলতায় চারিদিক ঝলমল করে হেসে উঠেছিলো যা আমার জন্য হয়তো দরকার ছিলো। আমার জীবনে আরবাজের আবির্ভাব এক আশীর্বাদ হয়েই এসেছিলো। আরবাজ আমার এই প্রত্যাখানের দায়িত্ব সম্পূর্নই নিজের উপরে তুলে নিলো। সে আমার আর তার উভয় পরিবারেই জানালো যে সে নিজেই সিদ্ধান্ত বদলেছে। ঠিক এবারে সে বিয়ে করতে চাচ্ছে না, আরও কিছুদিন সময় চাচ্ছে এবং সে আমাকেই বিয়ের পাত্রী হিসাবে নির্বাচন করেছে। হঠাৎ এই আশাভঙ্গে মা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন। আমাকে ফের অকথ্য কথার বর্ষনে ভাসিয়ে দিলেন। খুব ভালো ভাবেই বুঝিয়ে দিলেন আরবাজের এই মত পরিবর্তনের কারণ যে আমি তা তার ভালোই জানা আছে। আমি মনে মনে হাসলাম।
আরবাজ ফিরে যাবার পরপরই হঠাৎ একরাশ স্মৃতি হুড়মুড় করে নামলো আমার চোখের পাতায়। সেই স্মৃতিতে কখনও দোলন কখনও আরবাজ। দোলনের উপরে যে একগুঁয়ে রাগ বা ক্রোধটা জন্মেছিলো আমার। হঠাৎ সেই রাগ, ক্রোধ বা ক্ষোভের মাঝে নিজের ভুলটা বুঝতে শুরু করলাম আমি। এই বোধটার কারণ হয়তো আরবাজও হতে পারে। আরবাজকে যেদিন আমি দোলনের কথা বললাম। সব শোনার পরে সে বললো, "দোলনের কোনো ভুল আমি দেখতে পেলাম না। এই বৈরী পরিবেশে সে এসেই বা কিবা করতো বলো? সে যা করেছে কোনো ভুল করেনি।" আমি বিস্ফারিত নেত্রে তাকিয়ে ছিলাম সেদিন আরবাজের দিকে। আরবাজ আমার কাছে একজন বোধ বুদ্ধিসম্পন্ন খাঁটি মানুষ। সে কোনো ভুল করতে পারেনা এমনটাই বিশ্বাস জন্মেছিলো আমার। আমি তাকে বিস্মিত হয়ে জিগাসা করলাম " তুমি হলে কি করতে?" সে বললো "একই কাজ করতাম হয়তো...." আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলাম! সে আমার বিস্মিত চেহারা দেখে স্মিত হাস্যে আমাকে আশস্থ করলো। বললো, "আমি খুবই বাস্তববাদী মানুষ। আবেগে চলিনা মেয়ে।"
আরবাজ যতই বলুক সে আবেগে চলে না তার মত আবেগী মানুষ আসলে আমি কমই দেখেছি। সে আসলে আবেগ ঢেকে রাখে কিন্তু কোথাও কোথাও সে তার আবেগের ঝাঁপি খুলে দেয় অবলীলায় অপকটে। আর সেই ঝাঁপিটাই খুলে দেওয়ার জায়গাটাই হয়ত আমিসহ গুটিকয় মানুষ। যেদিন ও বললো, বিয়ের পরপরই ওর ইচ্ছে ছিলো নেপালে হানিমুন করবার আর এ কারনে সে দেশে আসার আগেই নেপালের পোখারার এক রিসোর্টে মোটামুটি কথা পাকাপাকি করেও রেখেছিলো। হানিমুন হিসাবে তার পোখারা পছন্দের কারণ সে তার স্টুডেন্ট লাইফেই পোখারা ভ্রমনে এতই আপ্লুত হয়েছিলো সে তার জীবনসঙ্গিনীকে নিয়ে জীবনের প্রথম দিনগুলি সেখানেই কাটিয়ে আসতে চেয়েছিলো। নীল শাড়ি নিয়ে আরবাজের আদিখ্যেতা প্রায় প্রেমিক কবিদের পর্যায়ে পড়ে। প্রথমদিনে আরবাজ আমাকে যে ছোট বড় মাঝারি সাইজের সোনালী র্যাপিং এ মোড়ানো উপহার দিয়েছিলো তার বড় প্যাকটাতেই ছিলো ঘন নীল শিফন শাড়িতে রুপালী বুটির কারুকাজ। এই শাড়িতে তার প্রিয়তমাকে দেখবার বড় সাধ ছিলো তার। যদিও আমি তার বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছি বটে তবুও সে তার প্রিয়তমা হিসাবে এই আমাকেই ভাবে। সে শাড়ি পরে আমাকে তাকে দেখাতেও হয়েছিলো।
আরবাজের দেওয়া আর তিনটি উপহারের প্যাকেটে ছিলো পারফিউম, গাঢ় নীল রঙের একটি ভ্যানিটি ব্যাগ আর একটি ছোট্ট হীরে বসানো আংটি। ডিজাইনটা এমন যেনো দুটি হাত দুটি দিক থেকে এসে ঐ ছোট্ট ডায়ামন্ডটিকে ধরে রেখেছে। শাড়ি, ব্যাগ ও পারফিউম আমি নিজে ব্যাবহার করলেও ঐ আংটিটি আমি তুলে রেখেছি। আমি সেটা ফেরৎ দিতেই চেয়েছিলাম। কিন্তু আরবাজ নেয়নি। তবে আমি প্রতিজ্ঞা করেছি। যেদিন আরবাজ বিয়ে করবে সেদিন ওর বউকেই আমি ফিরিয়ে দেবো এই আংটিটি। হয়তো আরবাজ খুব রাগ করবে, ওর নতুন বউটা হয়তো কখনই জানবে না সেই আংটির ইতিহাস তবুও আমি ফিরিয়ে দেবো ওকে। ঐ আংটির মূল্য আমি তো রাখতে পারিনি। ঐ আংটিটির যোগ্যও নই আমি।
আমার চারিপাশ ঘিরে শূন্যতা প্রগাঢ় হতে থাকে। আমার জীবনে দোলনের আবির্ভাব যেমনি ছিলো হঠাৎ হাওয়ায় ভেসে আসা কোনো অমূল্য পরশ ঠিক তেমনই আরবাজের আগমনও ছিলো এক ঝড়ো হাওয়ায় মাতাল করা রাতে এক পশলা বৃষ্টির পরের প্রশান্তির আমেজ। দোলনের অন্তর্ধান আমাকে যতখানি নিঃশেষ করে দিয়ে যেতে পারতো আরবাজের আগমন সেটা প্রতিহত করেছে বটে তবে আরবাজের পুনরায় প্রবাসে প্রত্যাবর্তনটা আমার কাছে বেদনাময় হয়ে উঠলো । হঠাৎ যেন পায়ের তলায় মাটি নেই। শুন্যতার উপরে দোদুল্যমান অনুভুতি। একবার মনে হলো আমি বুঝি ভুলই করলাম। এই দূর্বিসহ জীবন থেকে মুক্তির পথটি বুঝি আরবাজই ছিলো। কিন্তু সেটা কি আরবাজকে একরকম প্রতারনাই হত না? যতই বলি বা ভুলে থাকি আমি দোলনকে। সত্যিই কি আমি সেটা পেরেছি! এ তো আমার ভুলে থাকার অভিনয়! এই দুটি বছরে প্রতিটি ক্ষন, মুহুর্ত ঘন্টা কেটেছে যার কথা স্মরণ করে চাইলেই কি তাকে এত সহজেই ভোলা যায়! আবারও সাত পাঁচ ভাবনায় জড়িয়ে পড়ি আমি। আমার সদ্য ফেলে আসা দু'বছরের অতীত আমাকে কুরে কুরে খায়।
আমি ফের নিজের কাছে নিজেই গৃহবন্দিনী হয়ে পড়ি।
হঠাৎ একদিন ঝুমকী ফুপুর ফোন এলো.......এই ফোনটাই বদলে দিলো আমার জীবনের বাঁকটা একদম নতুনভাবে নতুন পথে .......
(চলবে)
একি খেলা আপন সনে - ১৬
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৯ সন্ধ্যা ৭:১৩