somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ঈদ উপহার ঃ বাংলা ব্যান্ড সংগীত ইতিহাসের 'সেরা ১০' এর গল্প

২৬ শে অক্টোবর, ২০১২ সন্ধ্যা ৭:৩৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সবাইকে ঈদের গরু ছাগল কুরবানির রক্তিম শুভেচ্ছা ও অনেক অনেক ঈদ মোবারক জানাই। ঈদ আমার কাছে এখন বছরের কোন বিশেষ দিন হিসেবে পালিত হয় না বা আমি পালন করিনা। আমার কাছে বছরের ৮/১০ টি দিনের মতোই একটি নিরানন্দ বিষাদ মাখা একটি দিন। তাই ঈদ নিয়ে আমার কোন বিশেষ পরিকল্পনাও নেই। আমার কাছে ঈদ যতই সাধারন দিনের মতো হোক না কেন কিন্তু অন্য সবার কাছে ঈদ মানেই আলাদা ও বিশেষ কিছু। আমি আনন্দ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করলেও বন্ধুদের বঞ্চিত করতে পারিনা। তাই বন্ধুদের জন্যই এই বিশেষ আয়োজন ।।

প্রথমে শুনুন বাংলা ব্যান্ড সংগীত ইতিহাসের সর্বকালের সেরা তিনটি ব্যান্ড এর গল্প ঃ

সোলস :


স্বাধীনতার ঠিক পরের বছর ১৯৭২ এ চট্টগ্রামের কিছু গানপাগল তরুণ সাজিদ উল আলম (গিটার), লুলু (গিটার) নেওয়াজ (পারকিউশন), রনি বড়ুয়া(ড্রামস) ও তাজুল (ভোকাল) মিলে বিদেশী গানের দলের অনুকরণে গানের একটি দল গঠন করে যার নাম দেয় 'সোলস' অর্থাৎ বাংলার যার অর্থ দাঁড়ায় 'আত্মারা'। সেই ৭২ থেকে চট্টগ্রামে শুরু করে সময়ের বিবর্তনে অনেক চড়াই উতরাই পার হয়ে ২০১২ তে উজ্জ্বল মহিমায় দীর্ঘ ৪ দশক নিজেদের ধরে বাংলা ব্যান্ড সঙ্গীতে অবদান রেখে চলেছে জনপ্রিয় 'সোলস'।
১৯৭২ এর শেষের দিকে প্রতিষ্ঠাতা সদস্য লুলু ব্যান্ড ত্যাগ করার পূর্বে 'নকীব খান" নামক এক তরুণ দলে যোগ দেয় যিনি পরবর্তীতে আমাদের প্রিয় 'রেনেসাঁ' ব্যান্ড এর প্রতিষ্ঠাতা ও ভোকাল এবং বাংলা ব্যান্ড সঙ্গীতের এক জীবন্ত কিংবদন্তি হয়ে আছেন। নকীবের পথ অনুসরণ করে এরপর ব্যান্ড এ যোগ দিলেন নকীবের বড় ভাই পীলু খান ও তপন চৌধুরী । শুরু হলো সব গানপাগল তরুণের একসাথে সপ্নবোনা আর গানবোনা । তখনও সোলস শুধু চট্টগ্রাম দাপিয়ে বেড়াচ্ছিল। এরই মধ্য ১৯৭৭ এ ব্যান্ড এ যোগ দেয় আরেক তরুণ নাসিম আলী খান এবং ১৯৭৮ এ যোগ দেন বাংলা ব্যান্ডের আরেক 'ক্ষ্যাপা' তরুণ আজকের কোটি কোটি স্রোতা ভক্তদের 'বাচ্চু ভাই' অর্থাৎ আইয়ুব বাচ্চু। শুরু হলো বাংলার সর্বকালের সেরা একটি ব্যান্ড দলের যাত্রা যেখান থেকে বাংলা আধুনিক ও ব্যান্ড সঙ্গীতের আকাশে সমহিমায় ঠাই করে নিয়েছে একটি একটি নক্ষত্র। সেদিন তরুণ আইয়ুব বাচ্চু ছিলেন ব্যান্ডের একজন গিটারিস্ট , ভোকাল, গীতিকার ও সুরকার। ১৯৭৯ সালের মাঝামাঝি সময়ে যোগ দেয় বাংলা আধুনিক গানের আরেক দিকপাল কুমার বিশ্বজিৎ। প্রিয় ব্লগার বন্ধুরা এবার উপরের সবগুলো নামগুলো পাশাপাশি সাজিয়ে লিখুন - নকীব খান,পিলুখান, তপন চৌধুরী, নাসিম আলী খান, আইয়ুব বাচ্চু, কুমার বিশ্বজিৎ ,রনি বড়ুয়া, নেওয়াজ , সাজেদ। প্রথম ৬ জনের নাম দেখলেই তো বুঝা যায় যে কতটা দুর্দান্ত ছিল তখনকার 'সোলস' । এমন সেরা লাইনআপ বাংলা ব্যান্ড ইতিহাসে ২য় আর কারো হয়নি। ১৯৮০ সালে বের হয় 'সোলস' এর প্রথম অ্যালবাম 'সুপার সোলস' শিরোনামে যা ছিল
বাংলা ব্যান্ড ইতিহাসের প্রথম কোন ব্যান্ডের অ্যালবাম। যেখানে পেয়েছিলাম বাংলা ব্যান্ড এর কালজয়ী চিরসবুজ ''মন শুধু মন ছুঁয়েছে'' গানটি আরও পেয়েছিলাম '' তোরে পুতুলের মত করে সাজিয়ে'' ''ও পাগল মনরে'' ''দরগায় মোম জ্বেলে কি হবে'' '' প্রতিদিন প্রতিটি মুহূর্ত'' ''চলো না হারিয়ে যাই'' '' এই মুখরিত জীবন'' এর মতো গানগুলি। প্রথম অ্যালবাম এর সাফল্যর পর ১৯৮২ তে প্রকাশিত হয় ২য় অ্যালবাম ''কলেজের করিডোরে' অ্যালবামটি। যেখানে পাই '' কলেজের করিডোরে'' ''ফরেস্ট হিল'' ''ফুটবল ফুটবল'' ''খুঁজিস যাহারে'' গানগুলি। এই অ্যালবাম এর পর নকীব খান ও পীলু খান ব্যান্ড ছেড়ে চলে যায় যারা পরবর্তীতে রেনেসাঁ ব্যান্ড গঠন করেন। নকীব -পিলুর পথ অনুসরণ করে একক ক্যারিয়ার গড়ে তোলার জন্য কুমার বিশ্বজিতও ব্যান্ড ছেড়ে চলে যান। তিনজন সেরা সদস্য হারিয়েও 'সোলস' থেমে থাকেনি। তখন 'সোলস' ব্যস্ত হয়ে পড়ে লাইভ কনসার্ট এ। ১৯৮৭ সালে প্রকাশিত হয় ৩য় অ্যালবাম ''মানুষ মাটির কাছাকাছি'' যেখানে পাই "এইতো এখানে বৃষ্টি ভেজা'' ''এক ঝাঁক পাখী'' ও ''মুঠোর ভেতর পদ্ম'' গানগুলি। তখন ব্যান্ড এর ভোকাল তপন এর পরেই ছিলেন নাসিম আলী ও আইয়ুব বাচ্চু। তিনজনেই সমান্তালে গান গাইতেন। ইতোমধ্যে 'সোলস' এর পথ ধরে 'চাইম' 'অবসকিউর' 'মাইলস' 'ঝিঙ্গা' সহ আরও কয়েকটি ব্যান্ড এর তাদের পথচলা শুরু করেছিল। ধীরে ধীরে বাংলা গানে 'ব্যান্ড সঙ্গীত' নামের একটি ধারার শাখা প্রশাখা বিস্তার লাভ করা শুরু করলো। সেই সময় আমি মাত্র শৈশব পার করে সদ্য কিশোর বেলায় পা দিয়েছি। সেই সময়ে 'সোলস' বাংলাদেশ টেলিভিশনের যে কোন অনুষ্ঠানে শুধু গিটার, ড্রাম, কিবোর্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে কোন তরুণদের গান গাইতে দেখলেই দুটো চোখ সহ পুরো মস্তিষ্কের মনযোগ থাকতো সামনে থাকা বাক্সের দিকে অর্থাৎ টেলিভিশনের দিকে। কি গাইছে সেইটা তখন আমাদের মূল বিষয় ছিল না, এতো গুলো ছেলে একসাথে হাসিমাখা মুখে যার যার বাদ্যযন্ত্র বাজাচ্ছে আর একজন হেলেদুলে গান গাইছে এই দৃশ্যটাই ছিল অনেক মধুর,অনেক আনন্দের। যেন সবগুলো তরুণ তারুণ্যর উচ্ছ্বাস এর এক একটা প্রতীক।
যাই হোক ,আমার স্মৃতি অনুভুতির কথা বাড়িয়ে লাভ নেই ! আবার 'সোলস' এর কথা ফিরে আসি। 'মানুষ মাটির কাছাকাছি ' র পর ১৯৮৮ সালে 'সোলস' বের করে 'ইষ্ট এন্ড ওয়েস্ট' শিরোনামের ৪র্থ অ্যালবাম ,যেখানে ছিল ৬ টি বাংলা ও ৬ টি ইংরেজি গান। যা ছিল বাংলাদেশের অডিও জগতে একই অ্যালবাম এ দুই ভাষার সমান সংখ্যক গানের প্রথম অ্যালবাম। সেই সাথে 'সোলস' বাংলা গানের পাশাপাশি ইংরেজি গানও পরিবেশনা শুরু করে। উল্লেখ্য যে বাংলা গানের মতো সবগুলি ইংরেজি গান লিখা ও সুর করা ছিল 'সোলস' এর। এই অ্যালবাম এর পরেই ১৯৮৯ সালের দিকে আইয়ুব বাচ্চু 'সোলস' ত্যাগ করেন। আইয়ুব বাচ্চুর শূন্যস্থান পূরণ করতে তখন চট্টগ্রামের আরেক সদ্য তরুণে পা দেয়া গিটারিস্ট ও ভোকাল হিসেবে দলে যোগ দেয় পার্থ বড়ুয়া। শুরু হয় নতুন অ্যালবাম এর কাজ। ১৯৯২ সালে 'সোলস' এর ২০ বছর পূর্তি উপলক্ষে সারগাম থেকে প্রকাশিত হয় 'এ এমন পরিচয়' অ্যালবামটি। এই অ্যালবামটি ছিল সোলস এর সাথে তপন চৌধুরীর শেষ অ্যালবাম। এই অ্যালবাম পরেই তপন চৌধুরী পুরোপুরি একক অ্যালবাম এর দিকে নিজের পথ চলা শুরু করেন। এখানে উল্লেখ্য যে 'সোলস' এ থাকাকালীন সময়েই ৮৫/৮৬ এর দিকে তপন চৌধুরী তাঁর প্রথম একক অ্যালবাম বের করেন । সেই অ্যালবাম এর ' মনে কর তুমি আমি'' ''অনাবিল আশ্বাসে'' ''হারানো দিনকে যদি '' গানগুলো আজো স্রোতাদের হৃদয়ে গেঁথে আছে । ছাড়াও ৮৬ সালে আইয়ুব বাচ্চু 'রক্ত গোলাপ' ও '' ময়না'' নামে দুটি একক অ্যালবাম বের করে স্রোতাদের কাছে নিজের জনপ্রিয়তা বাড়িয়ে তুলেন এবং ৮৭ সালে নাসিম আলী খান সেলফ টাইটেলড একক অ্যালবাম বের করে জনপ্রিয়তা লাভ করেন। 'এ এমন পরিচয়' অ্যালবামটি 'সোলস' এর জন্য একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে। এই অ্যালবাম এর অধিকাংশ গান যেমন- ''এ এমন পরিচয় (তপন)'' ''কেউ নেই করিডোরে (তপন)'' '' এই তো সেদিন (পার্থ) , "কেন এমন হলো (নাসিম আলী" "সাগরের ঐ প্রান্তরে (নাসিম আলী) '' "এক চোখে শুধু স্বপ্ন (নাসিম আলী), "ভালোবাসি ঐ সবুজ (নাসিম আলী) " গানগুলো ছিল সবার মুখে মুখে যা আজো সেইদিনের স্রোতাদের সোনালি স্মৃতি হয়ে আছে।
একে একে সব ভোকাল চলে গেলে দলের সবচেয়ে পুরনো সদস্য রনি বড়ুয়া ব্যান্ড লিডার ও নাসিম আলী খান কে মূল ভোকাল করে পার্থ কে নিয়ে সোলস আবার নতুন রূপে শুরু করে। যার ফলাফল " আজ দিন কাটুক গানে'' নামক একটি অসাধারণ মেলোডিয়াস অ্যালবাম। সেই অ্যালবাম এর প্রথম গান 'কেন এই নিঃসঙ্গতা '' গানের ব্যাপক সাফল্য দিয়ে পার্থ স্রোতাদের নজরে আসেন।এই অ্যালবামটিও 'সোলস' এর চরম একটি সফল অ্যালবাম যার রেকর্ড এরপরের কোন অ্যালবামই 'সোলস' আজো ভাঙতে পারেনি। এরপর একে একে বের হয় ''অসময়ের গান (১৯৯৫) , আনপ্লাগড ''মুখরিত জীবন'' (২০০০) , ''তারার উঠোনে (২০০২) , টু-লেট (২০০৫) (সাউনড ইঞ্জিনিয়ার মবিন এর মৃত্যুর পূর্বের শেষ কাজ), ''ঝুট ঝামেলা '' ২০০৮ এবং সর্বশেষ ২০১১ তে 'জ্যাম' বের হয়।
'সোলস' ইতিমধ্যে বাংলা ব্যান্ড ইতিহাসের সর্বকালের সেরা ব্যান্ডগুলোর একটি স্থান দখল করে নিয়েছে। এই ব্যান্ড থেকেই বাংলা সঙ্গীতের অনেক জনপ্রিয় কণ্ঠ ও কিংবদন্তীর জন্ম। যা বাংলা গানকে করেছে সমৃদ্ধ। বাংলা ব্যান্ড সঙ্গীতে 'সোলস' অবদান কোনদিন ভুলার নয়। আজকের প্রজন্মের ব্যান্ড গুলোর কাছে 'সোলস' হতে পারে একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত যারা বারবার প্রতিকুল অবস্থা কাটিয়ে সদর্পে ঘুরে দাঁড়িয়েছে এবং বাংলা ব্যান্ড সঙ্গীতে চিরস্থায়ী একটি সম্মানের আসন দখল করে আছে। শুধুমাত্র গান ও স্রোতাদের প্রতি ভালোবাসার একটি দায়বদ্ধতা থেকে গত ৪ দশক আমাদের অনেক সমধুর গান উপহার দিয়ে গেছে।
মাইলস -


ফরিদ, হ্যাপি আখন্দ, কমল, মুসা, ল্যারি, ইশতিয়াক ও রবিন কে নিয়ে ১৯৭৯ সালে গড়ে উঠে ব্যান্ড দল ‘মাইলস’। ঐ সালেই কিছু সদস্য ব্যান্ড ছেড়ে গেলে হামিন আহমেদ ও শাফিন আহমেদ মাইলস-এ জয়েন করেন। সেই-ই শুরু। আজকের এই বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে ব্যান্ডটি অতিক্রম করেছে দীর্ঘ তিন যুগেরও কিছুটা বেশী সময়। দাপিয়ে বেড়িয়েছে দেশবিদেশের উন্মক্ত মঞ্চে। রেড়িও, টিভি কিংবা খবরের কাগজের রঙ্গীন পৃষ্ঠা জুড়ে এঁকে দিয়েছে তারুণ্যের হৃদপিন্ডের স্পন্দন। জয় করেছেন খ্যাতির পুষ্পমালা। হামিন আহমদে ও শাফিন আহমেদ, এই দুই ভাইয়ের হাতের ছোঁয়ায় বাংলাদেশের ব্যান্ড মিউজিকে শুরু হয়েছে সৃষ্টিশীল নান্দনিকতার আরেক অধ্যায়, যার নাম ‘মাইলস . . . . . .’
হামিন আহমেদ, বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় ও ট্রু-রক ব্যান্ড ‘মাইলস’-এর ব্যান্ড লিডার, গিটারিস্ট ও কণ্ঠশিল্পী। বাংলাদেশ মিউজিক্যাল ব্যান্ড অ্যাসোসিয়েশান (বামবা) এর বর্তমান সভাপতি। এসব খ্যাতির আড়ালে উনি নিজে একজন দুর্দান্ত গীতিকার ও সুরকার।
শাফিন আহমেদ, বর্তমান মাইলসের বেইজিস্ট ও মেইন ভোকালিস্ট। তিনিও একাধারে দুর্দান্ত গীতিকার ও সুরকার। ব্যান্ডের বাইরেও সলো ক্যারিয়ারে তুমুল জনপ্রিয় এই সঙ্গীত তারকা। একটা সময় ব্যান্ড মিক্সড অ্যালবাম গুলোতে দাপটের সাথেই বিচরণ করেছেন শ্রোতা হৃদয়ে। মাইলসের বাইরে সলো কিংবা মিক্সড অ্যালবামেও রয়েছে এই তারকার অধিক সংখ্যক জনপ্রিয় গান।

১৯৮২ এবং ১৯৮৬ তে ‘Miles’ & ‘A Step Farther’ নামে দুটি ইংলিশ অ্যালবাম প্রকাশ করে। ‘Miles’ শিরোনামের অ্যালবামটি তিনটি মৌলিক গানসহ সাতটি কাভার সং এবং ‘A Step Farther’ অ্যালবামে থাকে সাতটি মৌলিক গান ও তিনটি কাভার সং। এরই মাঝে হ্যাপি আখন্দ ব্যান্ড ছেড়ে চলে গেলে ১৯৮২ সালে কীবোর্ডিস্ট ও ব্যাক ভোকালিস্ট হিসেবে জয়েন করেন বাংলাদেশের অন্যতম সেরা কীবোর্ড বাদক ও একজন সফল সুরকার মানাম আহমেদ। এবং ১৯৮৭ সালে রক-স্টারটার মাহবুব রশীদ মাইলসের ড্রামার হিসেব জয়েন করেন।

বিভিন্ন রদবদলের মধ্য দিয়ে ১৯৯১ সালে হামিন, শাফিন, মানাম ও মিল্টন(On Drums)কে নিয়ে বাংলা ব্যান্ড মিউজিকে অনবদ্য সঙ্গীত রচনার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বের হয় মাইলসের প্রথম বাংলা অ্যালবাম ‘প্রতিশ্রুতি’। প্রথম বাংলা অ্যালবামেই শ্রোতা হৃদয়ে রক-ফিউশানের ঝড় তুলে দিয়ে শুরু হয় নতুন যাত্রা। ‘প্রতিশ্রুতি’ প্রকাশের ২০ বছর পরে আজকের বর্তমান সময়ে একুশ শতকের হাওয়া গায়ে লাগিয়ে ঐ অ্যালবামের একটি গানও পুরোনো মনে হয় না (বরং সেই সময়ে করা গানের গুণগত মান ও স্বাদের কথা ভেবে মনটা খারাপই হয়ে যায়, কত চমৎকার চমৎকার গান সৃষ্টি হত যার স্বাদ বর্তমান সময়ে করা গানে আর পাইনা তেমন)। আবেদন কমে যায় নি এতটুকুও। ‘চাঁদ তারা সূর্য’, ‘সে কোন দরদিয়া’, ‘প্রথম প্রেমের মত’, ‘ঘরে লইয়্যা যাও’, ‘পাতা ঝরে যায়’, ‘এ মনতো আর মানে না’ কিংবা ‘গুঞ্জন শুনি’ এই বর্তমান সময়েও চূড়ান্ত রকমের আবেদন নিয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে শ্রোতা থেকে শ্রোতা হৃদয়ে।
‘প্রতিশ্রুতি’র জনপ্রিয়তায় মাইলস জোয়ারে ভাসছে তখন। মাঝে এক বছরেও কিছুটা বেশী সময় বিরতি দিয়েই মাইলস আবারও তাদের নতুন প্রজেক্ট নিয়ে ফিরে আসে শ্রোতাদের কাছে। সেই সাথে ১৯৯৩ সালেই মাইলসে আবারও ফিরে আসেন ড্রামার মাহবুব রশীদ। শ্রোতাদের দেয়া প্রতিশ্রুতির কথা মাথায় রেখেই শ্রোতা হৃদয়ের প্রত্যাশা পূরণের অঙ্গীকার দিয়ে ১৯৯৩ সালে মাইলস প্রকাশ করে তাদের দ্বিতীয় বাংলা অ্যালবাম ‘প্রত্যাশা’। অতীতের সমস্ত রেকর্ড ভেঙ্গে দিয়ে এবং শ্রোতা হৃদয়ের সমস্ত প্রত্যাশাকেও ছাপিয়ে মাইলসের ‘প্রত্যাশা’ অ্যালবামটি হয়ে উঠে সর্বাধিক জনপ্রিয় অ্যালবাম। ভিন্ন মাত্রার কথা, সুর ও সঙ্গীতায়োজনে খুব সহজেই শ্রোতাদের ভাললাগার শীর্ষ তালিকায় স্থান করে নেয় এই অ্যালবামটি। মাইলসের সর্বাধিক জনপ্রিয় গানগুলোও এই অ্যালবামেরই। এমনকি কিছু শ্রোতা মাত্রই তারা শুধু গান শুনে যান, গানের পেছনের ব্যাক্তিটি কে বা কারা এমনটি খোঁজ নেবার প্রয়োজন বোধ করেন না, তাদের কাছেও ‘ফিরিয়ে দাও, আমারই প্রেম তুমি ফিরিয়ে দাও’, ‘নীলা’, ‘ধ্বিকি ধ্বিকি’, ‘যাদু’, ‘আর কতকাল খুঁজবো তোমায়’, ‘পাহাড়ি মেয়ে’ কিংবা ‘এক ঝড় এসে ভেঙ্গে দিয়ে গেল, তাই জীবনটা এলোমেলো/স্বপ্ন ভঙ্গ’ স্বাভাবিক ভাবেই পরিচিত, যা জনপ্রিয়তার স্বাক্ষর বহন করে। (প্রতিটি গানই আলাদা আলাদা ভাবে উল্লেখ করার মত। বরং গানগুলোর উল্লেখ করছি না বলে আমার নিজেরই খুব কষ্ট হচ্ছে। তবে পোষ্টের শেষের দিকে মাইলসের জনপ্রিয় গানগুলো এবং গানগুলোর পেছনে যে মানুষগুলোর অবদান রয়েছে তার কিছুটা তুলে ধরতে চেষ্টা করব।)

তারপর প্রায় তিন বছরের দীর্ঘ বিরতি। এই বিরতির মাঝেই আমেরিকা থেকে মাইলসের জনপ্রিয় গানগুলো নিয়ে ‘বেস্ট অব মাইলস’ শিরোনামে একটি অডিও সিডি প্রকাশ করে ব্যান্ডটি এবং এটিই বাংলাদেশী কোন ব্যান্ডের প্রথম সিডি প্রকাশ। ঐ সময়টাতে ভারত সহ দেশ-বিদেশের প্রচুর কনসার্টে অংশগ্রহণ করে মাইলস। ১৯৯৬ সালে ‘প্রতিশ্রুতি’ এবং ‘প্রত্যাশা’র ব্যাপক সফলতার পরে মাইলস তাদের ব্যান্ডের পঞ্চম ও বাংলা তৃতীয় অ্যালবাম ‘প্রত্যয়’ তুলে দেয় শ্রোতাদের হাতে। জনপ্রিয়তার ধারাবাহিকতা ধরে রেখে এই অ্যালবামটিও জনপ্রিয় ও বৈচিত্র্যময় গানের সমাহারে ভরপুর। সর্বাধিক জনপ্রিয় গানগুলোর মধ্যে ‘জ্বালা জ্বালা’, ‘তুমি নাই’, ‘এ সময়’, ‘ফ্রাসট্রেশান’, ‘এইতো সেদিন’ ও ‘ভুলবোনা তোমাকে’ উল্লেখযোগ্য।

‘প্রত্যয়’ অ্যালবাম প্রকাশের মধ্য দিয়ে ড্রামার মাহবুব রশীদ ব্যান্ড ছেড়ে চলে গেলে সেই বছরই মাইলসের ড্রামার হিসেবে জয়েন করেন জিয়াউর রহমান তূর্য। এবং এখন অব্দি ড্রামার হিসেবে মাইলসের সাথে সম্পৃক্ত আছেন সফল ভাবে।

১৯৯৭, দুটি গান নিয়ে প্রকাশিত ‘প্রয়াস’ নামের অ্যালবামটি Extended Dance Music হিসেবে বেশ জনপ্রিয় হয় এবং ১৯৯৮ সালে ভারত থেকে ‘Best of Miles – Vol I’ এবং ‘Best of Miles – Vol II’ দুটি সংকলিত অ্যালবাম প্রকাশ পায় যা ভারতে মাইলসের জনপ্রিয়তা ব্যাপক বাড়িয়ে দেয়।
‘পিয়াসী মন’, ‘পলাশীর প্রান্তর’, ‘শেষ ঠিকানা’, ‘বিষ্ময় যাত্রা’ ও ‘পারিনা বোঝাতে’র মত তুমুল জনপ্রিয় গান নিয়ে ১৯৯৯ সালে বের হয় ব্যান্ডের পঞ্চম বাংলা অ্যালবাম ‘প্রবাহ’। আবারও জনপ্রিয়তায় চূড়ায় ভাসতে থাকে ব্যান্ড দল মাইলস। অসংখ্য শ্রোতাপ্রিয়তা পাওয়া গানের গীতিকার লতিফুল ইসলাম শিবলী প্রথম বারের মত এই অ্যালবামেই মাইলসের জন্য তিনটি গানের কথা সংযোজন করেন। শ্রোতা থেকে শ্রোতাতে, শত শত পলাতক হৃদয়ে কানে কানে কি যেন বলে যায় এই অ্যালবামটি। মাইলসের অন্যসব অ্যালবামের মত এই অ্যালবামটিও বিপুল জনপ্রিয়তার স্বাক্ষর বহন করে। সেই সাথে মাইলসের পঞ্চম বাংলা অ্যালবাম ‘প্রবাহ’র মধ্য দিয়েই গিটার হাতে মাইলসের পঞ্চম সদস্য হিসেবে ব্যান্ডটিতে জয়েন করেন ইকবাল আসিফ জুয়েল।

তারপর ছয় বছরের আরো একটি দীর্ঘ বিরতি। অনেকটা সময় শ্রোতাদের আড়ালে থেকে অবশেষে ২০০৬ সালে ‘প্রতিধ্বনি’ নিয়ে আবারও হাজির হয়। আর সঙ্গীত জগতে প্রতিধ্বনিত হতে থাকে সেই গানগুলো। তবে শ্রোতাদের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির কাঠগড়ায় আগের অ্যালবামগুলোর জনপ্রিয়তার মানদণ্ডে বিচার করলে বলতে হবে আগের অ্যালবাম গুলোর তুলনায় অনেকটাই মুখ থুবড়ে পড়ে ‘প্রতিধ্বনি’। তবুও ‘জাতীয় সঙ্গীতের দ্বিতীয় লাইন’, ‘অসহায়’ কিংবা ‘প্রতীক্ষা’ সহ বেশ কিছু গান মাইলসের অস্তিত্বের জানান দেয় শ্রোতা মহলে। ‘জাতীয় সঙ্গীতের দ্বিতীয় লাইন’ গানটি একক ভাবে বেশ শ্রোতাপ্রিয়তা পায়। যদিও অধিক শ্রোতাপ্রিয়তা গানের ছড়াছড়ি নেই এই অ্যালবামটিতে তবুও বেশ কিছু চমৎকার গান রয়েছে যা মাইলসের সৃষ্টিশীলতা ও নান্দনিকতার স্বাক্ষর বহন করে।

২০১২ সাল। জনপ্রিয়তার ঘোড়দৌড়ে কিছুটা পিছিয়ে গেলেও থেমে নেই জনপ্রিয় এই ব্যান্ডটি। ব্যান্ডটির সর্বশেষ অ্যালবাম ‘প্রতিচ্ছবি’ গ্রামীণফোন মুঠোফোনে ডিজিটাল প্রকাশ পেয়েছে। এরই মাঝে ‘প্রিয়তমা মেঘ’ নামের গানটি রেডিওতে অধিক সংখ্যকবার প্রচারিত হয়েছে। সেই সাথে পেয়েছে শ্রোতাপ্রিয়তাও। অধীর অপেক্ষায় বসি আছি অ্যালবামটির জন্য। জানিনা কবে অডিও সিডি প্রকাশ পাবে। হয়ত কপিরাইট আইনের সঠিক বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত হাতে পাবো না প্রিয় এই ব্যান্ডটির নতুন অ্যালবামটি।

মাইলস . . . . সস্তা জনপ্রিয়তার সাথে আপোষহীন এই ব্যান্ডটি জন্মলগ্ন থেকেই মেধা, মননশীল ও সৃষ্টিশীল নান্দনিকতায় শ্রোতা হৃদয়ে তুলেছে সঙ্গীতের ঝড়, পত্রিকা থেকে টেলিভিশন কিংবা ক্যাসেটের ফিতা থেকে উন্মত্ত মঞ্চে কাঁপিয়েছেন অজস্র দর্শক শ্রোতা। বাংলাদেশের ব্যান্ড সঙ্গীতে গড়ে তুলেছে নিজেদের ভিন্ন মাত্রার মৌলিক এক ধারার, অনবদ্য সঙ্গীতের আলোকোজ্জ্বল এক অধ্যায়ের যার মটো Miles To Go .. .. ..
ওয়ারফেইজ -


‘ওয়ারফেইজ’ নামটি নূতন করে পরিচয় করিয়ে দিবার দুঃসাহস আমার নেই! গত প্রায় তিন দশক ধরে সমানতালে সব দশকের শ্রোতাদের মাতিয়ে রেখেছে বাংলা হার্ড রক যে ব্যান্ডটি তার নাম ‘ওয়ারফেইজ’।আমার সমবয়সীরা যারা ওয়ারফেইজ এর উত্থান নিজের চোখে দেখেছি তাদের কাছে আজো বাংলা রক গানের কথা আসলেই প্রথমে সবার আগে যে নামটি উচ্চারিত হয় তাঁর নাম 'ওয়ারফেইজ'। আজ যারা বাংলা রক/ হেভি মেটাল গান দিয়ে এই প্রজন্মকে কাঁপাচ্ছে তাঁদের কাছে 'ওয়ারফেইজ' একটি রোল মডেল হয়ে আছে। 'ওয়ারফেইজ' এর মতো এতো নিখুঁত এতো দুর্দান্ত বাংলা রক গান আর কেউ উপহার দিতে পারেনি। ওয়ারফেইজ প্রমান করেছে যে শুধু চিৎকার ,চেঁচামেচি আর বাদ্যযন্ত্রের ধুম ধুম দিয়ে রক গান হয় না। রক গানের নিজস্ব একটা স্টাইল/ ধরন আছে। গানের কথা থেকে শুরু করে সুর, গায়কী সবকিছুতে একটা নিখুঁত কম্পোজিশন আছে। যার কারনে গত তিন দশক ধরে 'ওয়ারফেইজ' বাংলা রক গানের ১নং আসনটি ধরে রেখেছে। এখন সেই 'ওয়ারফেইজ' এর কিছু অজানা গল্প আপনাদের বলবো কিভাবে তাঁরা দেশের শীর্ষ রক ব্যান্ড হলো।
১৯৮৪ সালে ঢাকা শহরের স্কুল পড়ুয়া গানপাগল কয়েকজন ক্ষ্যাপা কিশোর 'ওয়ারফেইজ ' নামে একটি ব্যান্ড গঠন করে। সেই কিশোরদের লাইনাপ ছিল এমন কমল- বেজগিটার , ড্রামস- হেলাল, মীর- লিড গিটার, নাইমুল- লিড গিটার, বাপ্পি- ভোকাল । পরবর্তীতে মির,হেলাল ও বাপ্পি ব্যক্তিগত কারনে ব্যান্ড ছেড়ে চলে গেলে কমল লিড গিটারের দায়িত্ব নেয়, বাবনা বেজ গিটার ,টিপু ড্রামস ও রাসেদ ভোকাল এর দায়িত্ব নিয়ে ব্যান্ড এ যোগ দেয়। পরবর্তীতে নাইমুল ও রাসেদ চলে গেলে রাসেল কিবোর্ড ও সাঞ্জয় ভোকাল এর দায়িত্ব নেয়। অবশ্য তাঁরা দুজন আসার আগে ইন ঢাকা ব্যান্ড এর মাসুক ও ফুয়াদ অথিতি হিসেবে বিভিন্ন শোতে অংশগ্রহন করে। সেই কিশোররা (বাবনা,রাসেল,সাঞ্জয়,কমল টিপু) সবাই তখন স্কুলের ছাত্র। তারা অবসরে তাদের সেই ব্যান্ড নিয়ে অনুশীলন করতো। তখনো বাংলাদেশ এর মানুষরা তাদের চিনতো না। তারা প্রথম থেকেই সবসময় ইংরেজি গান গাইতো। তখন স্টেজ এর পারফর্ম বেশি চলতো। তাই যারা স্টেজ শো গুলো দেখত তাদের সবাইকে তাক লাগিয়ে দিতো সেই কিশোর রা। এমন কি তখনকার নামিদামি ব্যান্ড ফিডব্যাক, সোলস, অবসকিউর সহ সবাইকে তারা চমকে দিয়েছিলো তাদের অসাধারণ পারফরমেন্স এর কারনে। এইভাবেই চলছিল কিশোরগুলোর ব্যান্ড ‘ওয়ারফেইজ’ যারা তখনো কোন বাংলা গান গাইতে জানতো না। ১৯৯০ সালের এক বিকেলে বাংলা ব্যান্ড সঙ্গীত এর অন্যতম পুরাধা, জনপ্রিয় মাকসুদ ভাই একদিন মিরপুর পল্লবীতে সেই কিশোরদের নিয়ে বসলেন। আলচনার বিষয় ‘কেন সেই কিশোররা শুধু ইংরেজি গান গাইছে”? সেই কিশোরদের সাথে প্রিয় মাকসুদ ভাই টানা ৪ ঘণ্টা একা তর্কযুদ্ধ করে গেলেন। একসময় সেই কিশোররা বাংলা ব্যান্ড এর এই পুরাধার কথা মেনে নিয়ে রাজি হলো ইংরেজি গান বাদ দিয়ে পুরোপুরি বাংলা গান করার এবং পুরো বাংলায় একটি হার্ডরক অ্যালবাম বের করবে শ্রোতাদের জন্য। প্রিয় বন্ধুরা এতক্ষণ খুব সংখিপ্ত করে বললাম ‘ওয়ারফেইজ’ এর একটি ইতিহাস। আজকের ‘ওয়ারফেইজ’ কে পাওয়ার পেছনে যে মানুষটার সবচেয়ে বড় অবদান তিনি আর কেউ নন একমাত্র আমাদের সবার প্রিয় এবং ব্যান্ড ব্যান্ড সঙ্গীত এর কিংবদন্তি মাকসুদুল হক মাকসুদ ভাই। আমি ‘ওয়ারফেইজ’ এর একজন পাগল ভক্ত হয়ে প্রিয় মাকসুদ ভাইকে এর জন্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই, কারন তাঁর জন্যই আমরা আজকের এই ওয়ারফেইজ কে পেয়েছি। যারা আজ হার্ড রক ব্যান্ড এর বাংলাদেশের প্রতিকৃতি হয়ে আছে। এই হার্ডরক নিয়ে কত ব্যান্ড এসে হারিয়ে গিয়েছে এবং যাচ্ছে, কিন্তু ‘ওয়ারফেইজ’ শত ভাঙা গড়ার মাঝেও মাথা উঁচু করে আজো টিকে আছে এবং বাংলাদেশ এর ১ম সারির ব্যান্ড হিসেবে গত ৩ দশক ধরে নিজেদের অবস্থান ধরে রেখেছে।
ওয়ারফেইজ ১৯৯১ সালে প্রথম যে অ্যালবাম বের করেছিল সেইটা ছিল তাদের ৩য় বার এর লাইন আপ বদল করার পর।ওয়ারফেইজ এর প্রথম অ্যালবাম সেলফ টাইটেলড যা বাংলা ব্যান্ড সঙ্গীতের ইতিহাসে ঠাই করে নেয় অসাধারণ সব হার্ডরক গানের জন্য। সেদিন বাংলাদেশের শ্রোতারাও বুঝতে পারলো যে আমাদের ছেলেরাও পারে হার্ডরক/হেভি মেটাল গান গাইতে। অবশ্য এর আগে রকস্টারটা তাদের অ্যালবাম বের করে কিন্তু ওয়ারফেইজ এর মত এতো আলোড়ন তুলতে পারেনি।তবুও রকস্টারটা বেশ ভালোই গেয়েছিল। প্রথম অ্যালবাম এর ‘একটি ছেলে’ ‘বসে আছি’ ‘কৈশোর ‘ ‘স্বাধিকার’ গানগুলো আজো ২০ বছর পরেও একইরকম নাড়া দেয়। আজো শ্রোতারা ভুলতে পারেনি। সেই অ্যালবাম এ শ্রোতারা সঞ্জয় এর সাথে পায় বাবনা (বর্তমানে আমেরিকায় প্রবাসী) নামের আরেক বিস্ময় কে। যে ‘বৃষ্টি’ গান দিয়ে শ্রোতাদের হৃদয়ে ঠাই করে নেয়। যার গান শুনলে মনে হয় ওয়ারফেইজ এর কেউ না, উদাসী কোন এক শিল্পী নিজের মনে গেয়ে চলেছেন।
আজ ২০ বছর পরেও বাংলা হার্ডরক গানের কথা উঠলেই ‘বসে আছি একা’ ‘একটি ছেলে’ গান দুটোর নাম চলে আসে সবার আগে। ২০ বছরেও এই গান দুইটির বিকল্প কোন গান কেউ করতে পারেনি। ১৯৯২ ও ১৯৯৩ সালে ‘কোকাকোলা ব্যান্ড এ্যাওয়ার্ড’ এর শ্রেষ্ঠ ব্যান্ড এর পুরস্কার লাভ করে ওয়ারফেইজ যা পরপর ২বার তা লাভ করে তারা। ১৯৯৪ সালে বের হয় ওয়ারফেইজ এর ২য় অ্যালবাম ‘অবাক ভালোবাসা’। প্রথমটার মত এটিও শ্রোতারা লুফে নেয় এবং ওয়ারফেইজ আবারো তাদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমান করে। এই অ্যালবাম এর কভার ডিজাইনের জন্য ‘কোকাকোলা ব্যান্ড এ্যাওয়ার্ড ‘’ এর শ্রেষ্ঠ কভার পুরস্কার লাভ করে ওয়ারফেইজ এবং শ্রেষ্ঠ ড্রামার হিসেবে পুরস্কৃত হয় টিপু। যিনি আজো বাংলাদেশ এর একজন অন্যতম শ্রেষ্ঠ ড্রামার হিসেবেই আছেন। ‘অবাক ভালোবাসা’ অ্যালবাম এর টাইটেল গানটি গায় সেই বিস্ময় ও উদাসীন শিল্পী বাবনা। যা তারে সারাজীবনের জন্য শ্রোতাদের মনে ঠাই করে দিয়েছে। এই অ্যালবাম এর অন্যতম হিট গানগুলো ছিল ‘ অন্ধ জীবন’ ‘অন্য ভুবন’ ‘যখন মেঘের চাদর ‘ ‘বন্দী নিয়তি’, ‘এক+এক=দুই’’ ‘’শেখানো বর্ণনা ‘’ গানগুলি আজো শ্রোতাদের মনে পড়ে। এদিকে বাবনা মিক্সড অ্যালবাম এ (প্রিন্স মাহমুদ এর) নিজের আলাদা একটা জনপ্রিয়তা তৈরি করে ফেলেছে। মিক্সড অ্যালবাম এর মাঝে বাবনার ‘মেঘাচ্ছন্ন আকাশ (শক্তি)” “ছিলে তুমি জীবনে আমার (শক্তি)” “একা হয়ে যাই (ঘৃণা)” “ কোথায় হারালে (ক্ষমা) “ গানগুলো আজো শ্রোতাদের কাঁদায়! বাবনা আজো শ্রোতাদের কাছে এক বিস্ময় রয়ে গেলো। ১৯৯৬ সালের ঈদে বের হয় ওয়ারফেইজ এর ৩য় অ্যালবাম ‘জীবনধারা’ । যেখানে পুরনো সবার সাথে যোগ দেয় নতুন একজন যার নাম ফুয়াদ ইবনে রাব্বি । এই অ্যালবাম এ ওয়ারফেইজ সম্পূর্ণ হার্ডরক থেকে বের হয়ে একটু সফট রক গান বেশি করেছিলো। শুধু ‘জীবনধারা” গানটি ছিল বরাবরের মত একটি জটিল গান। যা শ্রোতারা তাদের প্রিয় তালিকায় নিয়ে নেয়। এছাড়া বিস্ময় কণ্ঠের বাবনা ‘ মৌনতা’ ‘মা’ গান দুটি ছিল অসাধারণ। আর সঞ্জয়ের ‘ধুপছায়া’ গানটি ছিল মেঘ না চাইতে বৃষ্টির মত একটি গান। যা আজো শ্রোতাদের সেই দিনগুলোতে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। এই অ্যালবাম বের হওয়ার আগেই বাবনা ও রাসেল আমেরিকায় চলে যায়। শুধু মাঝে মাঝে বাবনা এসে অ্যালবাম এর কাজে নিজেকে জড়াতে পারলেও রাসেল এর তা সম্ভব হয়নি। ‘জীবনধারা’ অ্যালবামটিই বলতে গেলে ওয়ারফেইজ এর সাথে বাবনার শেষ অ্যালবাম। এরপর বাবনা পুরোপুরি প্রবাসী হয়ে যায়। ১৯৯৮ সালের রোজার ঈদে মুক্তি পায় ওয়ারফেইজ এর ৪র্থ অ্যালবাম ‘অসামাজিক’ যা হার্ডরক অ্যালবাম গুলোর ইতিহাসে ওয়ারফেইজ এর আরেকটি চমৎকার সংযোজন। যেখানে ওয়ারফেইজ এর সাথে যোগ দেয় বাংলাদেশের সেরা বেইজ গিটারিস্ট সুমন (অর্থহীন) ও অন্যতম প্রতিভাবান লিড গিটারিস্ট ইকবাল আসিফ জুয়েল (লিজেন্ড) । এই অ্যালবাম এ ‘অসামাজিক’ ‘নেই প্রয়োজন’ ‘বন্ধু’ অশনি সংকেত ‘’ ‘ধুসর মানচিত্র’ ‘প্রতিচ্ছবি (সুমন)’ ‘মহানগর’ ও ‘ এমন দিনে’ গানগুলো তুমুল জনপ্রিয়তা পায়। বিশেষ করে ‘অসামাজিক’ ‘নেই প্রয়োজন’ ‘ধুসর মানচিত্র’ ‘’ এমন দিনে’ গানগুলো আমাদের বাংলা ব্যান্ড সঙ্গীতে স্থায়ী আসন নিয়ে নিয়েছে। এই অ্যালবাম এর পরপরই ব্যক্তিগত ব্যস্ততার কারনে মূল ভোকাল সাঞ্জয় ব্যান্ড ছেড়ে চলে যায় যা ছিল শুধু ওয়ারফেইজ এর জন্য নয় পুরো ব্যান্ড সঙ্গীত ও শ্রোতাদের জন্য বিরাট একটি ধাক্কা। এই অ্যালবাম এর একটি চমৎকার ব্যাপার ছিল যে কমল, সুমন ও জুয়েল এর একসাথে চমৎকার দুর্দান্ত পারফর্ম। যা শ্রোতাদের মুগ্ধ করে। এতো সুন্দর গিটার ও ড্রামের সংমিশ্রণ এখনকার অনেক হার্ডরক ব্যান্ড গুলো করতে পারেনি। এটাই ওয়ারফেইজ কে অন্য সব হার্ড রক ব্যান্ড এর কাছ থেকে আলাদা করে রেখেছে। যে দলে আছে বাংলাদেশ এর শ্রেষ্ঠ এক ড্রামার (টিপু) ও বাংলাদেশ এর শ্রেষ্ঠ একজন গিটারিস্ট (কমল) তাঁরা তো সবার আলাদা হবেই এটাই স্বাভাবিক। ওরাফেইজ এর সবচেয়ে মূল শক্তি তাদের অসাধারণ সব কম্পোজিশন। তাঁরা খুব ভাল করেই জানে যে কোন কথার গানে কেমন কম্পোজিশন করতে হবে। এরপর হলো গানের কথার গভীরতা। যার কারনে এতো ভাঙ্গাগড়ার মাঝেও ওয়ারফেইজ আজো সবার সেরা। অন্য সব হার্ডরক ব্যান্ড গুলোর অনুপ্রেরণা।
আজো বাংলাদেশের বিশ্বমানের হার্ডরক ব্যান্ড বলতে সবাই যে নামটি উচ্চারন করবে তা হলো ওয়ারফেইজ ও সাঞ্জয়। বাংলাদেশের মতো একটি দেশে একটি হার্ডরক ব্যান্ড এর প্রায় ৩ দশক টিকে থাকা ওয়ারফেইজ এর শ্রেষ্ঠত্ব প্রমান করে। এই রেকর্ড অন্য কোন হার্ড রক ব্যান্ড ভাঙতে পারবে বলে আমি ব্যক্তিগত ভাবে বিশ্বাস করি না। বাংলাদেশ এর হার্ডরক ব্যান্ড এর ইতিহাসে ওয়ারফেইজ কে ১ নং আসন থেকে সরিয়ে ফেলা কোনদিন সম্ভব নয়।
১৯৯৮ সালের ‘অসামাজিক’ অ্যালবাম দিয়ে আমাদের কাছ থেকে বিদায় নেন অদ্ভুত সুন্দর ও রকগানের সর্বসেরা শিল্পী সাঞ্জয়। সাঞ্জয় এর চলে যাওয়া আমাদের মতো হতভাগা শ্রোতাদের জন্য ছিল এক বিরাট ধাক্কা ও ক্ষতি। যে ক্ষতি আমরা আজো কাটিয়ে উঠতে পারিনি। সাঞ্জয়, সুমন, জুয়েল, ফুয়াদ চলে যাবার পর ওয়ারফেইজ এ বিরাট এক শুন্যতা সৃষ্টি হয়। কিন্তু দলনেতা কমল এর আন্তরিক চেষ্টায় ও টিপুর পরিশ্রম ফলে তা কাটিয়ে উঠে। মাঝে কিছুদিন পেনটাগন এর রুমেল অতিথি গিটারিস্ট হিসেবে বিভিন্ন শোতে অংশগ্রহন করে। তখন ব্যান্ড এ যোগ দেয় কীবোর্ডিসট –শামস, গিটার ও ভোকাল- বালাম (বাবনার মামাতো ভাই) , বেজ গিটার – বিজু, ভোকাল- মিজান । আর পুরনো দুই যোদ্ধা কমল ও টিপু তো আছেনই। এই লাইনআপ নিয়ে ২০০১ সালের কুরবানির ঈদে মুক্তি পায় ‘আলো’ অ্যালবামটি। যেটার কভার ছিল খুব চমৎকার। নতুন এই লাইনআপ নিয়েও ‘আলো’ অ্যালবাম বাজারে শ্রোতাদের আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়। বলা যায় ‘আলো’ ওয়ারফেইজ এর আরেকটি সফল অ্যালবাম। যেখানে শুরুতেই মিজান এর ‘হতাশা’ গানটি দিয়ে শুরু করেই বালাম এর ‘যত দুরেই থাকো’ গানটি শুনে শ্রোতারা চমকে উঠে। বালাম এর আগেও তার ব্যান্ড নিয়ে থাকলেও মুলত ‘আলো’ অ্যালবাম দিয়ে এই দশকের শ্রোতারা সহ পুরনো শ্রোতাদের কাছে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা ও জনপ্রিয়তা পায়। ‘আলো’ অ্যালবাম এ শ্রোতারা সঞ্জয় এর ঝাঁঝালো বারুদ না পেলেও বেশ কয়েকটি চমৎকার গান পায়। যার কারনে ‘আলো’ অ্যালবামটি ব্যবসাসফল হয়। এই অ্যালবাম এর সবচেয়ে আলোচিত ও জনপ্রিয় গানটির নাম ‘বেওয়ারিশ’ যা মিজান কে বিপুল জনপ্রিয়তা এনে দেয়। এছাড়াও বালাম এর ‘ সেই সৃতিগুলো’ , ‘সময়ের ছলনায়’ ‘ মিজান এর ‘আলো’, ‘বৃষ্টি’, গানগুলোও বেশ চমৎকার ও শ্রোতাপ্রিয় হয়। এই অ্যালবাম এর হিট গান এর সংখ্যা ৮টি। গানগুলো। যা এই অ্যালবামটিকে সাঞ্জয় ও বাবনার পরবর্তী যুগের সবচেয়ে ব্যাবসাসফল অ্যালবাম বলা হয়। এই অ্যালবাম টি উৎসর্গ করা হয় অ্যালবাম এর কাজ চলাকালীন সময়ে প্রিয় কমল ভাইয়ের আপন ছোট ভাই কনক আমেরিকার এক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয় তাকে।
এই অ্যালবাম এ হার্ডরক এর পাশাপাশি বেশকিছু সফট রক ও মেলোডি গান ছিল যা সত্যিই চমৎকার। আর সব গানেই অসাধারণ কমল ভাইয়ের গীটারের কথা নাইবা বললাম।
‘আলো’ অ্যালবাম এর পর ভোকাল মিজান এর সাথে অন্য সদস্যদের বনিবনা না হওয়ায় মিজান ব্যান্ড ছেড়ে চলে যায়। তখন মূল ভোকাল হিসেবে বালাম ব্যান্ড এর দায়িত্ব নেয়। বালাম কে মূল ভোকাল করেই ২০০৩ সালে বের হয় ওয়ারফেইজ এর অ্যালবাম ‘মহারাজ’ যার অ্যালবাম এর কভার সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে । তবুও ‘আলো’র মত এই অ্যালবাম এতো ব্যবসাসফল হয়নি। মহারাজ অ্যালবাম এর ‘মহারাজ’ গানটি ওয়ারফেইজ এর এই দশকের একটি জনপ্রিয় ও সফল গান। যা সব কনসার্টে ওয়ারফেইজ কে বসে আছি, একটি ছেলে’র মত নিয়মিত এখনও গাইতেই হয়। মহারাজ অ্যালবাম এর অন্য গানগুলো ছিল ‘বাঙ্গালিরা আর কত দেখবে’ ‘যে পথে সুখ তুমি খুঁজেছ’ ‘সন্ধ্যার আলো ‘ সহ আরও কিছু গান । মহারাজ অ্যালবাম এ শ্রোতারা বালাম এর হার্ডরক গানে বেশ পারদর্শীতা আছে তা বুঝতে পারে। মহারাজ অ্যালবাম এর পর বালাম দল ছেড়ে একক অ্যালবাম নিয়ে নিজেকে গড়তে যায়। অথচ আজকের এই বালাম এর জনপ্রিয়তার পেছনে ওয়ারফেইজ এর অবদান সবচেয়ে বেশি। বালাম কিশোর বেলা থেকে গান করলেও তাকে শ্রোতারা ওয়ারফেইজ এর মাধ্যমেই বেশি গ্রহন করে নেয়। যা তার পরবর্তী একক অ্যালবাম এর সফলতার পেছনেও ব্যাপক প্রভাব ফেলে। এখনও শ্রোতারা বালাম কে ওয়ারফেইজ এর বালাম হিসেবে সহজে চিনে নেয়।
বর্তমানে ওয়ারফেইজ এ আবার মিজান ফিরে এসেছে এবং মূল ভোকাল এর দায়িত্ব পালন করছে। গত রোজার ঈদে (২০১১) মিক্সড অ্যালবাম সমর্পণে ওয়ারফেইজ লালনের তিনটা চমৎকার গান অতি চমৎকার ভাবে পরিবেশন করে। সমর্পণ অ্যালবাম এ মুলত ওয়ারফেইজ এর সবগুলি গানেই একমাত্র দুর্দান্ত হয়েছে যা তাদের শ্রেষ্ঠত্ব আবারো প্রমান করলো।
সবশেষে শুধু এইটুকু বলবো আমাদের দক্ষিন এশিয়া তথা এশিয়ার সেরা একটি ব্যান্ড হলো 'ওয়ারফেইজ'। ইউরোপ, আমেরিকার বিখ্যাত সব ব্যান্ডের সাথে যাদের তুলনা করা যায় তাঁর নাম 'ওয়ারফেইজ'। 'ওয়ারফেইজ' বাংলা ব্যান্ড সঙ্গীতের একটি গর্ব এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়।

ওয়ারফেইজ এর অ্যালবামগুলি -
ওয়ারফেইজ (সেলফ টাইটেল ১৯৯১)
অবাক ভালোবাসা (১৯৯৪)
জীবনধারা (১৯৯৬)
অসামাজিক (১৯৯৮)
ধুন (ব্যান্ড মিক্সড ১৯৯৬)
আলো (২০০০)
মহারাজ (২০০৩)
পথ চলা (আনপ্লাগড ২০০৯)
সমর্পণ (ব্যান্ড মিক্সড ২০১১)
সত্য (২০১২)

তিনটি সেরা ব্যান্ড এর গল্পের পর এবার আপনাদের শুনাবো বাংলা ব্যান্ড সংগীতের ইতিহাসের সেরা ৭ জন এর গল্প যারা কেউ গান গেয়ে আর কেউ গান লিখে ও সুর করে বাংলা ব্যান্ড সংগীত কে করেছেন সমৃদ্ধ ও শ্রেষ্ঠ সম্পদে।।

হ্যাপি আখন্দ ঃ


স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে পপসম্রাট গুরু আজম খান যখন তাঁর চার বন্ধুদের (ফকির আলমগীর, পিলু মমতাজ, ফিরোজ সাই ও ফেরদৌস ওয়াহিদ) নিয়ে বাংলা সঙ্গীতে একটি নতুন ধারার জন্ম দিয়েছিলেন সেই নতুন ধারার শুরুর দিকে ১৫ বছর বয়সের এক গানপাগল কিশোর হাতের গীটারে ঝড় তুললেন আর নিজের কণ্ঠের গান দিয়ে সবাইকে মাতিয়ে দিলেন। তখন ছেলেটিকে সেই সময়ের সিনিয়র সকলে আশীর্বাদ করলেন যে ' এই ছেলেটি একদিন অনেক বড় হবে'' । ছেলেটি বড় হওয়া শুরু করতেই হঠাৎ একদিন সবাইকে কাদিয়ে দিয়ে মাত্র ২৭ বছর বয়সে সবাইকে কাদিয়ে চিরবিদায় নিলেন যা ছিল আমাদের সঙ্গীতের এক অপূরণীয় ক্ষতি। আপনারা কেউ কি বুঝতে পারছেন আমি কার কথা বলছি? হ্যাঁ। আমাদের বাংলা পপ ও ব্যান্ড সঙ্গীতের এক ক্ষণজন্মা প্রতিভা, কিনবদন্তি প্রয়াত হ্যাপি আখন্দ এর কথা বলছি।
১৯৬০ সালের ১২ই অক্টোবর জন্মগ্রহন করা হ্যাপি আখন্দ যার বড় ভাই আমাদের সঙ্গীতের আরেক উজ্জ্বল নক্ষত্র প্রিয় লাকী আখন্দ। ছোটবেলা থেকেই গানের প্রতি ছিল হ্যাপির প্রচণ্ড আগ্রহ। বড় ভাই লাকী যখন তাঁর বন্ধুদের নিয়ে গীটার বাজিয়ে সুর তোলার চেষ্টা করতো তখন কিশোর হ্যাপি চুপচাপ তাঁদের পাশে বসে তা মনযোগ দিয়ে দেখতো। কখনও কখনও লুকিয়ে ভাইয়ের গীটার নিয়ে নিজে 'টুং টাং' করে সুর তুলার চেষ্টা করতো। ছোট ভাইয়ের এই আগ্রহ দেখে বড় ভাই তাঁর সাথে হ্যাপিকে রাখতো এবং বড় ভাই ভাই লাকীর কাছ থেকে গীটারটাও শিখে ফেললো। ব্যস, শুরু হয়ে গেলো দুই ভাইয়ের সঙ্গীত জীবনে একসাথে পথচলা। হ্যাপি যতনা নিজে গাইতো তাঁর চেয়ে বেশী অন্যকে দিয়ে গাওয়াতো, অন্যর গানের সুর তুলতে সাহায্য করতো এবং অন্যদের তুলে সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করতো অর্থাৎ হ্যাপি নিজেকে সবসময় নিজে অবহেলা করতো। হ্যাপি ছিল একজন কণ্ঠশিল্পী, সুরকার , সঙ্গীত পরিচালক, একজন গিটারিস্ট এবং ব্যান্ডের একজন নিয়মিত সদস্য। এমন অনেক জনপ্রিয় গান আছে যেখানে সরাসরি হ্যাপি সঙ্গীত পরিচালনায় যুক্ত ছিল যেমন ফেরদৌস ওয়াহিদ এর 'এমন একটা মা দে না'' কুমার বিশ্বজিৎ এর ''তোরে পুতুলের মত করে সাজিয়ে'' এর অন্যতম। ১৯৭৫ সালে দুর্গাপুর এক কনসার্টে অথিতি শিল্পী হিসেবে হ্যাপি সাতটি গান পরিবেশনা করে উপস্থিত সবাইকে তাক লাগিয়ে দেয়। যে কনসার্টের প্রধান শিল্পীরা ছিলেন উপমহাদেশের বিখ্যাত গীতিকার, সুরকার,কণ্ঠশিল্পী আর ডি বর্মণ এবং আরেক কিংবদন্তী আশা ভোঁসলে। সেই কনসার্টে হ্যাপি নিজের কণ্ঠের গানের সাথে হ্যাপি ও লাকী দুজনেই গীটার পরিবেশনা করেন। হ্যাপির কিশোর বেলার ওমর সৃষ্টি 'আবার এলো যে সন্ধ্যা' গানটি তো আমাদের পপ ও ব্যান্ড সঙ্গীতের একটি ইতিহাস হয়ে আছে। যে গানটি পরবর্তীতে ১৯৮০ সালে সৈয়দ সালাউদ্দিন জাকী পরিচালিত 'ঘুড্ডি'( রাইসুল ইসলাম আসাদ, সুবর্ণা মোস্তফা) ছবিতে ব্যবহৃত হয়।


এছাড়াও হ্যাপির অন্যান্য জনপ্রিয় গানগুলোর মাঝে ছিল ''কে বাঁশি বাজায়রে'' , ''নীল নীল শাড়ি'' ''কে ঐ যায়রে'' ''স্বাধীনতা তোমাকে নিয়ে গান তো লিখেছি, ''তুমি কি দেখেছো পাহাড়ি ঝর্না , ''পলাতক সময়ের হাত ধরে'' ''এই পৃথিবীর বুকে আসে যারা'' এর মতো অসাধারন সব গান। বিশেষ করে ''এই পৃথিবীর বুকে আসে যারা'' গানটি ছিল হ্যাপির নিজের ভেতর লুকানো এক কষ্টের বহিঃপ্রকাশ। ১৯৮৭ সালের ২৮ শে ডিসেম্বর আমাদের সবাইকে কাঁদিয়ে অনেক অভিমান নিয়ে এই ক্ষণজন্মা সঙ্গীত প্রতিভা ও কিংবদন্তী চিরতরে পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন।

হ্যাপির মৃত্যুর পর আমার সমবয়সী যারা আমাদের প্রজন্ম যারা হ্যাপিকে পেয়েছিল তাঁরা ছাড়া হ্যাপি আজকের এই প্রজন্মের কাছে শুধুমাত্র একজন ''আবার এলো যে সন্ধ্যা'' ও ''কে বাঁশি বাজায়রে'' নামক গান দুটির শিল্পী ছাড়া কিছুই নয়। যা খুবই দুঃখজনক। হ্যাপির পুরনো গানকে রিমিক্স বানিয়ে জনপ্রিয়তা পাওয়ার চেষ্টা করেছে বর্তমান সময়ের তরুন সুপারস্টার সঙ্গীত পরিচালকরা কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে তাঁরা কেউ হ্যাপিকে এই প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার চেষ্টা করেনি। যার কারনে গত এক দশকের তরুন শ্রোতাদের কাছে হ্যাপির কোন ১/২ টি গান ছাড়া বাকী গানগুলোও নেই। কিন্তু আমাদের বাংলাগানের জনপ্রিয় ওয়েবসাইটগুলোতে অলিগলির শিল্পীদের গান ভরা, বস্তাপচা চটুল গান সংরক্ষন করা এমনকি সদ্য প্রকাশিত গানের অ্যালবাম পাইরেটেড করে সবার মাঝে ছড়িয়ে দেয়ার অপচেষ্টা কিন্তু প্রিয় হ্যাপির কোন পূর্ণাঙ্গ সংগ্রহ কারো কাছে নেই যা দিয়ে হ্যাপিকে এই প্রজন্ম চিনতে পারতো, জানতে পারতো। আমরা দিন দিন যে মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে যাচ্ছি এবং পরনির্ভরশীলতার মাঝেই বেশী আনন্দ পাই এটি হলো তারই এক বাস্তব উদাহরণ। তাই নতুন প্রজন্মের কাছে প্রিয় হ্যাপির হারানো গানগুলো তুলে দিতে ও হ্যাপিকে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার জন্য একটি চেষ্টা করলো মাত্র । আপনাদের সকলের সহযোগিতা পেলে ভবিষ্যতে হ্যাপির পুরো সংগ্রহ প্রকাশ করার অঙ্গিকার ব্যক্ত করছি।

''স্বাধীনতা তোমাকে নিয়ে কত গল্প লিখেছি'' এই গানটি আমার কিশোর বেলার খুব প্রিয় একটি গান যা আজো গাই যা ছিল স্বাধীনতাকে নিয়ে একটি দুর্দান্ত সুন্দর গান । কিন্তু কেন জানিনা এই শতাব্দীর নতুন প্রজন্মের কাছে হ্যাপির এই গানটিকে প্রকাশ করা হয়নি , ছড়িয়ে দেয়া হয়নি, যদি দেয়া হতো তাহলে অন্তত স্বাধীনতা দিবসেও আমাদের হ্যাপিকে এই প্রজন্ম মনে করতে পারতো। ভবিষ্যতে হ্যাপির পুরো সংগ্রহ আপনাদের হাতে তুলে দিয়ে নবজাগরণ এর প্রত্যয় ব্যক্ত করে সবশেষে কবির ভাষার অনুকরনে দুটি লাইন উল্লেখ করে আজকের মতো বিদায় নিচ্ছি- '' ১৬ কোটি সন্তানের হে মুগ্ধ জননী
রেখেছো বাঙালি করে ,মানুষ করোনি"।।

‘এবি’ বা আইয়ুব বাচ্চু ঃ


বাংলা ব্যান্ড মিউজিকের কিংবদন্তী ও সেরা লীড গিটারিস্ট। চট্রগ্রামের ছেলে এবি'র যাত্রা শুরু মূলতঃ ততকালীন সময়ের জনপ্রিয় ধারার ব্যান্ড সোলস দিয়ে, যার উত্থান চট্রগ্রাম থেকে। বাংলাদেশের মিউজিক ইন্ড্রাস্টীতে যদি একক ভাবে কোন ব্যান্ডকে সন্মাননা দেওয়া হয় তবে সেটা নির্ধিদ্বায় সোলসের ঝুড়িতে গিয়ে পড়বে। লুলু, নেওয়াজ, রনি, তাজুল ও সাজেদ যুদ্ধপরবর্তী বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে গড়ে তোলেন ব্যান্ড দল সোলস। এরপর একে একে জয়েন করেন নকীব খান, পিলু খান, আইয়ুব বাচ্চু, কুমার বিশ্বজিৎ, তপন চৌধুরী, নাসিম আলী খান এবং পার্থ বড়ুয়া। নকীব খান ও পিলু খান সোলস ছেড়ে গড়ে তোলেন বিকল্পধারার ব্যান্ড দল রেঁনেসা। তপন চৌধুরী (ভোকাল), কুমার বিশ্বজিৎ(ভোকাল) সোলস ছেড়ে গড়ে তোলেন সলো ক্যারিয়ার। কুমার বিশ্বজিৎ আজও ঠায় দাড়িয়ে আছেন এই বাংলা মিউজিকে। তপন চৌধুরী ততকালীন সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় সলো আর্টিস্ট অনেক অভিমান নিয়ে পড়ে আছে বিদেশে। নাসিম আলী খান ও পার্থ বড়ুয়া আজও সোলসের হাল টেনে চলছে। সোলসের জনপ্রিয় গানের অভাব নেই। লিখতে গেলে পুরো একটা পোষ্ট লিখতে হবে এই সোলসকে নিয়ে। তবুও কিছু গানের কথা উল্লেখ করার লোভ সামলাতে পারছিনা। মন শুধু মন ছুয়েছে, তোরে পুতুলের মত করে সাজিয়ে, আইছ্যা পাগল মনরে, নদী এসে পথ, এই মুখরিত জীবনের, সুখ পাখি এলো উড়িয়া, সাগর বেলায়, একটি ঝিনুক মালা, ভালবাসি এই সবুজ মেলা, সাগরের ঐ প্রান্তরে, কুহেলী জানে কি, এই এমনও পরিচয়, কেউ নেই করিডোরে, আজ দিন কাটুক গানে, নীরবে, ব্যস্ততা, কেন এই নিঃস্বঙ্গতা, এরই মাঝে, আইয়্যোনা আইয়্যোনা, ঐ দূর নীলে, যেতে যেতে পরিচয় সহ এমন আরো অনেক অনেক অনেক গান। সদ্য সোলস ছেড়ে আসা এবি নতুন উদ্দ্যম নিয়ে গড়ে তোলে ব্যান্ড দল এল.আর.বি। প্রথম ব্যান্ড অ্যালবামেই জানিয়ে দেয় "ঝরে পড়ার জন্য আসেনি। এসেছি তারুণ্যের উন্মদনা নিয়ে।" ১৯৯২ সালে এল.আর.বি প্রকাশ করে তাদের ব্যান্ডের প্রথম ডাবল অ্যালবাম "হকার" ও "ঘুম ভাঙ্গা শহরে"। এল.আর.বি-ই বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রথম ব্যান্ড যাদের ফার্স্ট অ্যালবাম ছিল ডাবল। এবং এল.আর.বি- ই প্রথম বাংলা ব্যান্ড যারা এ পর্যন্ত দুটি ডাবল অ্যালবাম প্রকাশ করে। দ্বিতীয় ডাবল অ্যালবামটি প্রকাশ পায় ১৯৯৮ সালে "আমাদের" ও "বিষ্ময়" শিরোনামে। "হকার" অ্যালবামের আড্ডা, হ্যাপি, হকার, স্মৃতি নিয়ে, পেনশান, রিটায়ার্ড ফাদার ও "ঘুম ভাঙ্গা শহরে" অ্যালবামে ঢাকার সন্ধ্যা, ফেরারী মন, ঘুম ভাঙ্গা শহরে, মাধবী, শেষ চিঠি সহ সর্বাধিক শ্রোতানন্দিত গান "সেই তুমি কেন এত অচেনা হলে"। এক একটি গান শুধু গান নয়, শুধু বাদ্য যন্ত্রের যান্ত্রিকতা নয়, নয় চিৎকার করে চেঁচিয়া যাওয়া। একটি গান কথা, সুর ও সঙ্গীতায়োজনে ছিল অনন্য। প্রতিটি গানের কথায় আবেগ খেলা করে, প্রতিটি গানের সুর বুকের ভিতরে গিয়ে আঘাত করে, প্রতিটি ইন্সট্রুমেন্ট বিভোরতায় মুগ্ধকরে।। আর গায়কী ! ! ! সে আপনাদের বিবেচ্য।

এরপর একে একে নিয়ে আসে "সুখ(১৯৯৩)", "ঘুমন্ত শহরে(১৯৯৪)", "ফেরারী মন(১৯৯৬)", "স্ক্রু-ড্রাইভার(১৯৯৬) with Feelings","ক্যাপসুল-৫০০mg(১৯৯৬) with Feelings","স্বপ্ন(১৯৯৬)","আমাদের(Second Double-1998)","বিষ্ময়(Second Double-1998)","মন চাইলে মন পাবে(২০০১)","অচেনা জীবন(২০০৩)","মনে আছে নাকি নাই(২০০৫)","স্পর্শ(২০০৮)"। প্রতিটি অ্যালবাম এক একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে বাংলা ব্যান্ড মিউজিকে। ময়না(১৯৮৬), কষ্ট(১৯৯৫), একা(১৯৯৯), সময়(১৯৯৯), প্রেম তুমি কি?(২০০০), দুটি মন(২০০২), কাফেলা(২০০২),প্রেম প্রেমের মত(২০০৩) সহ বেশ কিছু সলো অ্যালবাম উপহার দিয়েছেন।
অন্যদিকে বাংলা ব্যান্ড মিক্সড অ্যালবামের সূচনা লগ্ন থেকে ২০০৪ পর্যন্ত ম্যাক্সিমাম ব্যান্ড মিক্সড অ্যালবামের ফার্স্ট ট্র্যাক ছিল এবি'র করা। এমন মিক্সড অ্যালবামের সংখ্যা কম যেখানে এবি পারফর্ম করেনি। মিক্সড অ্যালবামে করা জনপ্রিয় গানগুলোর কিছু তুলে দিলামঃ "এখন অনেক রাত(অ্যালবাম-টুগেদার), তখনো জানতে বাকী(ঝড়), সারারাত তুমি(স্টার্স ২), ভাঙ্গা মন(ভাঙ্গা মন), সুখের পৃথিবী(সুখের পৃথিবী), কোথাও নেই আমি তুমিহীনা(তুমিহীনা সারাবেলা), ঈশারায় ডেকোনা(রাজকুমারী), রাজকুমারী(রাজকুমারী), সেই তারাভরা রাতে(তারা ভরা রাতে), পালাতে চাই(শক্তি),কার কাছে যাবো(ওরা ১১ জন), শেষ দেখা(শেষ দেখা), কতদিন দেখেনি দুচোখ(এখনো দু'চোখে বন্যা), বেলা শেষে(দাগ থেকে যায়), তুমি সেই মেয়ে(মিলেনিয়াম), মেয়ে(মেয়ে), ও আমার প্রেম(ও আমার প্রেম), কি করে বল্লে তুমি(বিতৃষ্ণা জীবন আমার), অভিমান নিয়ে(স্রোত), কোন অভিযোগ(আলোড়ন), ১২ মাস(১২ মাস), জানার কথা নয়(তারকা মেলা), তোমাকে ডেকে ডেকে(একটি গোলাপ), লোকজন কমে গেছে(ধুন), নীলাঞ্জনা(শুধু তোমারই কারণে), চিরদুঃখী(চিরদুঃখী), ফেরারী আমি তোমারই জন্য ফেরারী(চিরদুঃখী), হাসতে দেখ গাইতে দেখ(ক্যাপসুল ৫০০মিলিগ্রাম), নীল বেদনায়(ক্যাপসুল ৫০০মিলিগ্রাম), আহা ! জীবন(ক্যাপসুল ৫০০মিলিগ্রাম), জয়ন্ত(স্ক্রু-ড্রাইভার), নীরবে(স্ক্রু-ড্রাইভার), আমার ভালবাসা(স্ক্রু-ড্রাইভার), কিশোর কিশোরী(হারজিৎ), চোখের জলের কোন রং হয় না(মেহেদী রাঙ্গা হাত), আজ থেকে আর কখনো বলবো না ভালবাসি(দহন শুধু তোমার জন্য), বাড়ালে হাত বন্ধু সবাই হয় না(চিঠির উত্তর দিও), একা উদাসী মনে(একা উদাসী মনে), মন কেন যেতে চায় উড়ে(প্রেম), কেউ ভালবেসে কাছে টানে(টি & টি), সবুজ ঘর(টি & টি), একটায় মনে(অপরিচিতা), কিছু আশা ছিল(অপরিচিতা), অতশী(নীরবতা), যে রাতে রাত ছাড়া(ফিরে আয়), নীরবতা(নীরবতা), উদাসী মনে(নেই তুমি), দক্ষিণা বাতাস(দুঃখিনী মা), একটি নারী অবুঝ(একটি নারী অবুঝ) সহ এরকম শ-খানেক চরম শ্রোতানন্দিত গানের কথা বলা যাবে। এখানে উল্লেখ করা এক একটি গান এক একটি মাইলস্টোন। প্রতিটি গানের কথা নিয়ে আলাদা ভাবে গল্প তৈরী করা যাবে। এই গানগুলো যেমন ছিল। ঠিক তেমনই আছে। এই গানগুলোর স্থায়িত্ব কমে যায়নি। আবেদন কমে যায়নি। কমে যায়নি ভাললাগা। আমি চোখ বন্ধ করে বলে দিতে পারি এই গানগুলো আপনাকে সতেজ ভাললাগা দেবে। কোন কৃত্রিমতার ছোয়া নেই এই গানগুলোতে।।। প্রতিটি গানের কথা আপনাকে ভাবাবে।। প্রতিটি সুরে আপনি যত্ন ও আবেগের ছোয়া পাবেন। প্রতিটি গান আপনাকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখবে।। কিছু কিছু গান আপনার বুকের ভেতরে জমিয়ে রাখা অব্যাক্ত কথা গুলো বলে যাবে গানে গানে কানে কানে। কিছু গান হয়তো আপনাকে চোখের বর্ষায় ভাসাবে। হয়তো এই বর্ষার জন্য-ই আপনি অপেক্ষায় ছিলেন
জেমসঃ

যার পুরো নাম ফারুক মাহফুজ আনাম জেমস। তাঁর বাবা ছিলেন সরকারি চাকুরেজীবি, সেই সুত্রে ছোট বেলা থেকেই দেশের বিভিন্ন জেলায় ঘুরে বেরিয়েছিলেন। তাঁর বাবা যখন চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারমান ছিলেন তখন সেই চট্টগ্রাম থেকেই তাঁর সঙ্গীতের পাগলামি শুরু মানে সেখান থেকেই তারে সবাই চিনতে শুরু করে। ৯ম শ্রেণী পড়া অবস্থায় বাবা তাঁর বখে যাওয়া সন্তান টিকে একদিন ঘর থেকে বের করে দেয় পড়াশুনায় মনোযোগ না থাকায়। সেই সময় চট্টগ্রামের “আজিজ বোর্ডিং” হয় তাঁর গানের কারখানা । যে “আজিজ বোর্ডিং “ নিয়ে সম্পূর্ণ একটা গান তিনি পরে গেয়েছিলেন। “আজিজ বোর্ডিং” এর সব গুলো কথা তাঁর সৃতিময় সেই দিনগুলো থেকে নেয়া যা সব সত্যি ঘটনা। তাঁর উপর ক্ষুব্ধ থাকা তাঁর সেই স্বর্গীয় পিতা নিশ্চয় আজ স্বর্গ থেকে ছেলের সফলতা দেখে খুশী মনে আছেন! তিনি যাকে শিক্ষিত করে তাঁর মতো বড় কোন সরকারী কর্মকর্তা বানাতে চেয়েছিলেন আজ হয়তো তাঁর সেই দুঃখ নেই। কারন তাঁর ছেলে যে আজ বাংলাদেশের সঙ্গীতের অভিভাবক হয়ে বিদেশেও সমান জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন।
১৯৮৭ সালে বের হয় জেমস এর প্রথম একক অ্যালবাম “অনন্যা”। যার সবগুলো গান ছিল আসলেই অনন্যা ও ব্যতিক্রম। আজ যদি কেউ সেই অ্যালবাম প্রথম শুনে তাহলে তারও বিশ্বাস করতে কষ্ট হবে যে গানগুলো জেমস এর গাওয়া। এর মূল কারন সেই গানগুলোতে ছিল সদ্য টগবগে এক তরুনের মিষ্টি মধুর পরিশীলিত সুর। আজ জেমস এর মাঝে খুব কম গানে পাওয়া যায়। ১৯৮৮ সালে চট্টগ্রামের জনপ্রিয় ব্যান্ড 'ফিলিংস' এ যোগ দেন। তখন কুমার বিশ্বজিৎ বিহীন 'ফিলিংস'এর ভোকাল ছিলেন আরেক অসাধারণ প্রতিভা ও কণ্ঠ পাবলো। সে সময় ঘর ছাড়া জেমস ও' ফিলিংস' ব্যান্ড যাদের অনুশীলন থেকে শুরু করে থাকা ,খাওয়া সব হতো সেই “আজিজ বোর্ডিং” এর এক কামরায়। সেই কামরায় তাঁদের কত বিনিদ্র রাত কেটেছে শুধু গান তৈরির নেশায়। ১৯৮৯ সালে বের হয় “ফিলিংস’ এর ১ম অ্যালবাম “স্টেশন রোড”। যেখানে সেই “অনন্যা জেমস” আবারো একইরকম অন্য কিছু ভালোলাগা নিয়ে হাজির হয়। সেই অ্যালবাম এর “ঝর্না থেকে নদী”, “স্টেশন রোড” “দুঃখ কেন কররে মন” “আমায় যেতে দাও” “রুপসাগরে ঝলক মারিয়া” “সত্যই সুন্দর” সহ সবগুলো গানই ছিল অপূর্ব। যেখানে জেমস এর নীরব হাহাকার, প্রেমের আকুতি,অন্যায়ের প্রতিবাদ সব কিছু ফুটে উঠেছে এক অদ্ভুত সুন্দর ভাবে। এরপর টানা ৯০-৯২ জেমস এবং ফিলিংস এর কোন নতুন খবর তাঁদের ভক্তরা পায়নি। এর মধ্যে ৯২ সালে জেমস ভালোবেসে বিয়ে করেন মডেল ও পরবর্তীতে অভিনেত্রী ও রথি(চাঁদনী) কে (১৯৯২ সালে নায়ক আমিন খান এর সাথে জুটি হয়ে “অবুজ দুটি মন” ছবিতে অভিনয় করেন যা ছিল তাঁর একমাত্র ছবি ও সুপারহিট) বিয়ে করেন এবং ২০০১ সালে তাঁদের বিচ্ছেদ হয়। যিনি পেশগত ভাবে একজন শিক্ষিকা ছিলেন। ১৯৯৩ সালে আবার চুপচাপ থাকা জেমস ও “ফিলিংস” শ্রোতাদের সামনে নিয়ে আসেন “জেল থেকে বলছি “ অ্যালবাম। মুলত এই অ্যালবাম দিয়ে নতুন দশকের শ্রোতাদের কাছে জেমস ও ফিলিংস এর পরিচয় ঘটে। তখন এই অ্যালবামটি কিছুদিন আগে বাজারে আসা এল.আর.বি এর প্রথম ২টা অ্যালবাম এর জনপ্রিয়তায় ভাগ বসায় এবং অডিও বাজারে একটা বড় ধরনের ঝাঁকুনি দেয়। যার ফলে ১ম অ্যালবাম দিয়ে চুপ করে থাকা “মাইলস” তাদের প্রত্যাশা অ্যালবাম প্রকাশ করে সেই ঝাঁকুনিটা আরও বাড়িয়ে দেয়। শ্রোতারা তখন একসাথে ৪ টি অ্যালবাম (হকার, ঘুম ভাঙা শহরে (এল.আর.বি), জেল থেকে বলছি (ফিলিংস), প্রত্যাশা (মাইলস) নিয়ে দিশেহারা হয়ে যায়, কোনটা রেখে কোনটা শুনবে এই ভেবে। আর অডিও বাজারও তখন চরম সফলতার যুগে প্রবেশ করে। সেই “জেল থেকে বলছি’ এক ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামীর করুন অনুভুতি ও আর্তনাদ নিয়ে জেমস তাঁর আসন পাকাপোক্ত করে নেন। তখন ব্যান্ড এর কন্সার্ট এ জেমস কে পাওয়া মানে শ্রোতাদের অন্যরকম উম্মাদনা। ১৯৯৫ সালে বের হয় জেমস এর ২য় একক অ্যালবাম “পালাবে কোথায়” যেটি ছিল এক প্রেমিকের প্রেমিকার প্রতি কঠিন প্রশ্ন ! যে তাঁর ভালোবাসার অস্রু ও সুখময় সৃতি দিয়ে তাঁর প্রেমিকাকে বেঁধে রাখতে চায়। এই অ্যালবাম টিও তখন শ্রোতা প্রিয়তা পায়। জেমস তখন হয়ে যায় “গুরু জেমস”। যেন নতুন যুগের এক কাণ্ডারি যে কিনা যেমন নাচাতে চায় শ্রোতারাও তেমনি নাচে। একই বছরে বের হয় প্রিন্স মাহমুদের প্রথম ব্যান্ড মিক্সড অ্যালবাম “শক্তি” যেখানে জেমস এর গান ২টি ছিল শ্রোতাদের আকাশের চাঁদ হাত পাওয়ার মত। একই বছরে মিক্সড ও একক অ্যালবাম এর মাধ্যমে জেমস শ্রোতাদের কাছে এক উম্মাদ ঝড়ের নাম হয়ে উঠে। চারিদিকে তখন ২টা পক্ষ “জেমস এর ভক্ত” ও “জেমস এর বিরোধী” স্পষ্টত মুখোমুখি অবস্থান নেয়। হয়তো এই অনিবার্য সংঘাত এড়ানোর জন্যই সেই ফেলে আসা ৯৬ তে জেমস আরও একটি চমৎকার উপহার দেন ফিলিংস এর ৩য় অ্যালবাম “নগর বাউল” যেখানে “মান্নান মিয়ার তিতাস মলম” , “আমি এক নগর বাউল”, “আমি তারায় তারায় রটিয়ে দিবো”, “নাগ নাগিনির খেলা” “হুমায়রা নিঃশ্বাস চুরি হয়ে গেছে” গানগুলো । জেমস তাঁর বিরোধী শিবিরে যে আঘাত এনেছিলেন তাঁর শেষ আঘাত দিয়ে বিরোধী শিবির কে একেবারে নিশ্চিনহ করতে তিনি নিয়ে আসেন তাঁর একক অ্যালবাম “দুঃখিনী দুঃখ করোনা”। যা দিয়ে তিনি তাঁর বিরোধী শিবির কে একেবারে লণ্ডভণ্ড করে দেন। সেই অ্যালবাম এর সবগুলো গান এতোটাই জনপ্রিয় হয় যে তাঁর বিরোধী শিবির এর লোকেরাও সবাই তাঁর ভক্ত হয়ে যায়। বিশেষ করে “যদি কখনও ভুল হয়ে যায়” গানটি জেমস এর সর্বকালের সেরা একটি গানে পরিণত হয়। যে গানে জেমস এর আবেগ এতোটাই ভয়াবহ ছিল যে কোন মানুষ এর চোখে জল আনতে বাধ্য করতো।৯০ দশকে জেমস ও ফিলিংস নিয়ে আসে “লেইস ফিতা লেইস” অ্যালবামটি (যেটি ছিল ফিলিংস নাম নিয়ে সর্বশেষ অ্যালবাম) । যে অ্যালবাম এ “পথের বাপ” “বায়স্কোপ” “সিনায় সিনায়” “হাউজি” “পুবের হাওয়া” “দে দৌড়” “নিরান্নব্বই নামে তিনি” সহ সবগুলো গান চরম শ্রোতাপ্রিয়তা পায়। যার ফলে “গুরু” নামটি জেমসের সাথে পাকাপোক্ত ভাবে বসে যায়। তখন জেমস ছিল অবাধ্য ও বিশৃঙ্খল তরুণদের শান্ত করার এক যাদুকর। জেমস কন্সার্টে আসা আগ পর্যন্ত যে তরুণরা তাকে দেখার অপেক্ষায় উদগ্রীব হয়ে থাকতো তাদের উদ্দেশে মঞ্চে উঠেই জেমস বলতেন” তোরা শান্ত হয়ে যা! আমি এসে গেছি!” ব্যস, সবাই সেই যাদুকরের কথায় শান্ত হয়ে যেত আর তাঁর গানগুলোতে ঠোঁট মিলিয়ে গাইত। “লেইস ফিতা লেইস “অ্যালবাম দিয়ে তাঁর আগে আরেকটি কথা না বললেই নয় তখনকার সমান জনপ্রিয় এল.আর.বি এর সাথে ফিলিংস এর পরপর ২ টি যৌথ অ্যালবাম “ক্যাপসুল ৫০০ এম.জি” এবং “স্ক্রু ড্রাইভার” নামক অ্যালবামগুলো। যা শ্রোতাদের কাছে আজো একটি লোভনীয় অ্যালবাম হিসেবে পরিচিত। গত দশকে এই গুরু জেমস কে আমরা যেভাবে পেয়েছিলাম এই দশকে তাঁর কোন ছিটেফোঁটাও আজো পাইনি। বিশেষ করে সেই দশকে জেমস এর ফিলিংস,নগরবাউল ও একক অ্যালবাম ছাড়াও প্রতিটি মিক্সড অ্যালবাম এ গাওয়া গানগুলো অসাধারণ! বিশেষ করে প্রিন্স মাহমুদের সুর ও সঙ্গীতের মিক্সড অ্যালবাম এর “ জানালা ভরা আকাশ”(শক্তি),”আমি ও আঁধার” (শক্তি),”শেষ দেখা “(শেষ দেখা),”মা”(এখনও দু চোখে বন্যা), “ফুল নিবে না অস্রু নিবে” (দেয়াল),”মন আমার পাথরের দেয়াল তো নয়” (দেয়াল),"কিছু ভুল ছিল তোমার" ( দাগ থেকে যায়)”নিশপাপ আমি” (স্রোত), জুয়েল বাবুর সুর ও সঙ্গীতে “ওরে দেখে যারে তুই” (মেয়ে),”পদ্ম পাতার জল” (ও আমার প্রেম), “আরও কিছুক্ষণ রবে কি বন্ধু” (নিরবতা),”তুমি বল বৃষ্টি পড়ছে” /সাদা কালো (নীরবতা), “কিছুটা আশা তুমি রেখো” (নীরবতা), “বর্ষা আমার চোখের প্রিয় ঋতু /বর্ষা” (সন্ধি), ‘’যত দূরে যাও বন্ধু আমার” (তারকা মেলা),লাকি আখন্দ এর সুর ও সঙ্গীতে “লিখতে পারি না কোন গান “ (বিতৃষ্ণা জীবনে আমার),”ভালবেসে চলে যেও না”(বিতৃষ্ণা জীবনে আমার) সহ আরও অনেক অনবদ্য অসাধারণ সব গান আজো সে যুগের এবং এ যুগের শ্রোতাদের মুখে মুখে ফিরে। প্রিন্স মাহমুদ ও জুয়েল-বাবু তাঁরা সব সময় তাদের মিক্সড অ্যালবাম এর গানগুলোতে জেমস কে তাঁর সেরাটা বের করে আনতেন যা জেমস নিজেও খুব উপভোগ করতেন। তখনকার সেরা সব গীতিকার যারা ছিলেন তাঁর মধ্যে লতিফুল ইসলাম শিবলি,বাপ্পি খান,দেহলভি, আনন্দ,তরুন,মারজুক রাসেল, গোলাম মোরশেদ, প্রিন্স মাহমুদ ও জুয়েল-বাবু জেমস এর জন্য আলাদা ভাবে গান লিখতেন। যে গানের কথাগুলো ছিল একটার চেয়ে আরেকটা অসাধারণ সব কথায় ভরপুর যা একবার শুনে মন ভরতো না। শ্রোতারাও দ্বিধায় পড়ে যেতেন কোন গান থেকে কোন গান বেশি সেরা এই নিয়ে আড্ডায় তুমুল তর্ক চলতো। যা মনে পড়লে আজো খুব কষ্ট হয়।
আজ 'জেমস' বাংলাদেশের সীমানা ছাড়িয়ে অন্য দেশেরও একটি প্রিয় কণ্ঠের নাম। ভারতের বিখ্যাত ও জনপ্রিয় প্রযোজক, পরিচালক মহেশ ভাট এর 'গ্যাংস্টার' ছবিতে 'ভিগি ভিগি' গান দিয়ে হয়েছেন ভারতের কোটি জনতার প্রিয় শিল্পী। এরপর একই প্রযোজকের 'ওহ লামহে' 'মেট্রো' ছবিতেও কণ্ঠ দিয়ে বিশ্বের মাঝে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে দিয়েছেন এবং প্রমান করেছেন যে ভারতের শিল্পীরাই শুধু হিন্দি গানের প্লেব্যাক এ সেরা নয় সুযোগ পেলে বাংলার শিল্পীরাও কাঁপিয়ে দিতে পারে। এখানেই ‘জেমস’ অন্য সবার চেয়ে আলাদা ও চিরস্মরণীয় একজন যাকে বাদ দিয়ে কোনদিন বাংলাদেশের পূর্ণ সঙ্গীত ইতিহাস লিখা সম্ভব নয়। কেউ যদি তা করার দুঃসাহস দেখায় আমি নিশ্চিত তাঁর লিখা সেই ইতিহাস কেউ গ্রহন করবে না।
জেমস এর অন্যান্য অ্যালবামগুলো-
ঠিক আছে বন্ধু (একক)
দুষ্ট ছেলের দল (নগর বাউল)
আমি তোমাদেরই লোক (একক)
জনতা এক্সপ্রেস( একক)
কাল যমুনা (একক)
তুফান (একক)
মাকসুদুল হকঃ-


হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল (পরবর্তীতে হোটেল শেরাটন এবং বর্তমানের রুপসী বাংলা) এ লাইভ মিউজিক প্রোগ্রাম হত নিয়মিত। সেখানে মূলত ইংরেজী গানের পরিবেশনা থাকত। একদল মানুষ সেই সব ইংরেজী গানের সাথে তাল মিলিয়ে ড্যান্স করত।। আর মঞ্চ থেকে ভেসে আসতো মেলোডিয়াস পপ, রক ও জ্যাজ ঘরানা'র গান; পরিবেশনায় তরুণ গানের দল "ফিডব্যাক"। ফিডব্যাকের দলনেতা প্রতিভাবান সুরকার, কম্পোজার ও কিবোর্ডিষ্ট ফোয়াদ নাসের বাবু, পিয়ারু খান(Drums & Vocal), সেলিম হায়দার(Guitars), মুরাদ রহমান (Bass) এবং মাকসুদুল হক ফিডব্যাকে জয়েন করে ১৯৭৬ সালে। পরবর্তীতে তুমুল শ্রোতাপ্রিয়তা পাওয়া ও সারা বাংলাদেশ কাঁপানো ব্যান্ড ফিডব্যাক অবশ্য ১৯৮৫ সালের আগ পর্যন্ত কোন অ্যালবাম রিলিজ করেনি।
১৯৮৫ সাল। মাকসুদুল হক'কে ফিচার না করেই ফিডব্যাক নিয়ে আসে "ফিডব্যাক ভলিউম-১" নামে তাদের ব্যান্ডের প্রথম প্রকাশ।(অনেকের কাছেই শুনেছি ফিডব্যাকের প্রথম অ্যালবামের কথা।
১৯৮৭ সালে আবারো ফিরে আসে ফিডব্যাক। সেই সাথে রদবদল ঘটে লাইন-আপে। মাকসুদুল হক ফিরে আসেন পুরোদস্তুর কন্ঠ নিয়ে (মেইন ভোকাল ), মুরাদ রহমান ব্যান্ড ছেড়ে চলে গেলে ফিডব্যাকে বেইজ গিটার নিয়ে জয়েন করেন সেকান্দর আহমেদ খোকা, লীড গিটারিস্ট ও ভোকার হিসেবে আসেন লাবু রহমান , ড্রামসের সেই পুরোনো পিয়ারু খান এবং কিবোর্ডিস্ট ও দলনেতা ফোয়াদ নাসের বাবু। নতুন আঙ্গিকে, নতুন কথা ও সুরে, নতুন সঙ্গীতের নতুন পরিবেশনায় ফিডব্যাক নিয়ে আসে বাংলা ব্যান্ড মিউজিকের অন্যতম সফল অ্যালবাম ও বাংলা ব্যান্ডে বিকল্পধারার রক মিউজিকের উজ্জল দৃষ্টান্ত "উল্লাস"। সারগাম থেকে থেকে প্রকাশ পাওয়া এই অ্যালবামের কাভার পেইজটাও ছিল দীপ্ত ও বৈচিত্র্যময়। একদল মানুষ, কেউ গিটার বাজাচ্ছে, কেউ গাইছে, কেউ ড্রামস বাজাচ্ছে এরকম একটার উপড় আরেকটার অবয়ব। কভার দেখেই বোঝা গিয়েছিল "উল্লাসে" মেতেছে ফিডব্যাক। অ্যালবামের ফার্স্ট ট্র্যাক " মৌসুমি পর্ব ১"। জনপ্রিয় অনেক অনেক গানের গীতিকার ও বর্তমানের প্রথম আলো'র জ্যোতিশী কাওসার আহমেদ চৌধুরীর লেখা প্রথম গানটি দিয়েই সব-ঘরানার শ্রোতা হৃদয় কেড়ে নেয় ফিডব্যাক।। অসম্ভব চমৎকার এই গানের কথা, সুর ও সঙ্গীতায়োজনের তুলনা হতে পারেনা। আর মাকসুদুল হক তার তরুণ কোমল কন্ঠে এতটায় আবেগী কন্ঠে গেয়েছেন যে এর আর অন্য কোন বিকল্প থাকতেই পারেনা। এতো গেল শুধু প্রথম গান !!! এরপর একে একে "চিঠি", "চোখ", "মাঝি", "সেই দিনগুলি", "উদাসী", "জানালা", "ঐ দূর থেকে দূরে", "কেমন করে হায়", "আমার নতুন আকাশে", "এই দিন চিরদিন রবে", "ঝাউ বনে", "মহাশূণ্য" ও "দিন যায় দিন চলে যায়" আজও বাংলা ব্যান্ড মিউজিকের এক একটি হীরাখন্ড। (পরবর্তী কালে ফিডব্যাকের সেরাগান নিয়ে করা অ্যালবাম "জোয়ার" এর সর্বাধিক গান নেওয়া হয় "উল্লাস" থেকেই)। উল্লাসে সর্বাধিক গানে কন্ঠ দিয়েছিলেন মাকসুদুল হক এবং নিজের কন্ঠ গাওয়া গানের লিরিকগুলোর সর্বাধিক-ই মাকসুদুল হকের নিজের লেখা। কোন কোন গানে উঠে এসেছে ভালবাসার উন্মাদনা, হাজারো প্রশ্নে জানতে চাওয়া নির্মম সত্য অথচ জানার কতই না আকুতি !!! "চোখ", "চিঠি", "উদাসী" সহ প্রতিটি গানের কথা এত বৈচিত্রময়, এত বাস্তবধর্মী এর আগে কোন ব্যান্ডের অ্যালবামে এত প্রকট ভাবে উঠে আসেনি। সেই দিক থেকে বলতে গেলে এমন অসম্ভব শক্তিশালী গানের কথায় খুব খুব নিয়মিত অ্যালবাম করেছে এমন কম সংখ্যক ব্যান্ড-ই বাংলাদেশে পাওয়া যাবে যারা তাদের প্রতিটি অ্যালবামেই এর সফল ধারাবাহিকতা দেখিয়েছে একমাত্র ব্যান্ড ফিডব্যাক ছাড়া। বাংলা ব্যান্ড মিউজিক-এর এক অনবদ্য অ্যালবাম হিসেবে যতদিন বাংলা ব্যান্ড মিউজিক টিকে থাকবে ততদিন এই উল্লাস থাকবে। শুধু উল্লাসই নয় মাকসুদুল হক সহ ফিডব্যাকের প্রতিটি অ্যালবাম বাংলা ব্যান্ড মিউজিকের এক একটি উজ্জল নক্ষত্র। গতানুগতিক ধারার গান কখনোই ফিডব্যাক শ্রোতাদের উপহার দেয়নি মাকসুদুল হক থাকা অবস্থায়। প্রতিটি অ্যালবামের কথা, সুর ও সঙ্গীতায়োজন ছিল এমনই শক্তিশালী যেঃ যেই ব্যাক্তি প্রথম বারের মত ফিডব্যাকের গান শুনবে, তাকে অবশ্যই অবাক হতে হবে বিষ্ময়ে, সমস্ত দ্বিধা ছুড়ে ফেলে মেনে নিতে হবে তাদের একছত্র সৃষ্টিশীলতাকে, বলতে হবে এক একটি মিউজিক একটি একটি ক্ল্যাসিক। আর প্রতিটি গানের সঙ্গীতায়োজন ও গায়কী যে কাউকেই সহজে বশীভূত করতে বাধ্য।।
এভাবেই অনেক বৈশাখ এলো আর গেলো। রমনা বটমূলে মঞ্চ বানিয়ে রং-চঙ্গা পোশাকে গাওয়া রবিঠাকুরের চমৎকার ঠান্ডা মেজাজের সমবেত সঙ্গীত "পুরানো সেই দিনের কথা/ভুলবি কিরে হায়/ও সে চোখের দেখা/প্রাণের কথা সেকি ভোলা যায়" দিয়ে বর্ষ বরণ হতে থাকল। যেখানে নেই বাংলার ঐতিহ্যবাহী ঢোলের বাড়ি, নেই রমণীর খোঁপার সেই হরেক রকমের ফুলের মালা'র কথা, নেই উন্মত্ত রোদে আনন্দ মিছিলের কথা, নেই কোন হট্টগোলের কথা, নেই রমণীদের উৎপাত করা বখাটে ছেলেদের কথাঃ যখন প্রেমিক মন বিদেশী সুগন্ধী মেখে ঘুড়ে বেড়ায় ভালবাসার মানুষটি জন্য। নেই কোন নতুন প্রাণের কথা, নেই প্রকৃতি'র রুপে আগুন ধরে যাবার কথা। সর্বোপরি নেই প্রাণ খুলে সুতীব্র চিৎকারে জানানো বৈশাখের কথা। এরপর এলো ১৯৯০। বাঙ্গালী ১৩৯৭ সালের বৈশাখ ছিল অন্য সব বৈশাখ থেকে পুরো আলাদা। বাংলা ব্যান্ড মিউজিকে নতুন ধারার এক অনন্য ও সর্বযুগের উপযোগী সংযোজন হিসেব আত্মপ্রকাশ পেল ফিডব্যাকের তৃতীয় অ্যালবাম "মেলা"। বৈশাখের দিনে ঘরে ঘরে, পাড়াতে পাড়াতে, বাজারে বাজের, মেলার মাঠে, ক্লাব ঘরে বাজতে থাকল মাকসুদুল হকের লেখা ও কন্ঠ দেওয়া গানঃ "মেলায় যায়রে, মেলায় যায়রে, মেলায় যায়রে, মেলায় যায়রে/বাসন্তী রং শাড়ি পড়ে ললনারা হেটে যায়/মেলায় যায়রে, মেলায় যায়রে, মেলায় যায়রে, মেলায় যায়রে/ঐ বখাটে ছেলের ভীড়ে ললনাদের রেহায় নাই/ . . . মেলায় যায়রে, মেলায় যায়রে, মেলায় যায়রে, মেলায় যায়রে" (এ অংশটুকুতে যেই সময়ের কথা বলেছি, সেই সময়ের কথা আমি জানিনা। পরিবেশ কেমন ছিল তাও জানা নেই। প্রথম বৈশাখে "মেলায় যায়রে" গানটা সারা বাংলাদেশের মানুষ কতবার করে শুনেছে তাও জানা নেই। তবে ঠিক এইরুপ একটি অভিজ্ঞতা আমার ব্যাক্তিগত ভাবেই আছে। সেখান থেকেই কল্পনায় ১৩৯৭ এ চলে গিয়েছি। প্রতিটি বৈশাখে ঘুম থেকেই উঠেই আমি ফিডব্যাকের "মেলা" গানটা শুনে নিজেকে মাতিয়ে নেই উল্লাসে)। বৈশাখের আনন্দ-উৎসবের সাথে যেতে পারে এমন চমৎকার, মানানসই, আবেদনময়ী উল্লাসের গান বোধকরি এই বাংলা মিউজিকে নেই, একমাত্র ফিডব্যাক ও মাকসুদুল হকের "মেলা" ছাড়া। আসবে সেরকমও কিছু নিশ্চিত বলা যায় না।। মাকসুদুল হক, শুধুই শিল্পী নন, একাধারে তিনি গীতিকবি, সুরকার, সঙ্গীত পরিচালক ও সর্বোপরি একজন সামাজিক যোদ্ধা।। যিনি গানের মাধ্যমে সামাজিক জাগরণের জন্য কাজ করেছেন, তুলে এনেছেন স্বদেশের কথা, তুলে ধরতে চেয়ে ধূর্ত রাজনীতিবিদতের ষড়যন্ত্রের কথা, তুলে ধরেছেন প্রিয়ার নিষ্ঠুরতাকে তাও আবার মধুর আঘাতে আঘাত করা পুরোনো ক্ষতে, গানের কথায় ফিরে এসেছে জীবন-জ্বালার কথা, স্মরণ করেছেন চিরতরে বিদায় দেওয়া বন্ধু "হ্যাপি আকন্দের কথা", কৌতুহলী হয়ে জানতে চেয়েছেন মৌসুমির কথা---কারো বুকের আলিঙ্গনে লুকিয়ে প্রিয়া আজও কি আমায় মনে করে???।। ফিডব্যাকের "মেলা" বাংলা ব্যান্ড মিউজিকের এক অনন্য সংযোজন। ১২ টি গানের প্রতিটি গানই প্রথম শ্রেণীর মিউজিক। (মাকসুদুল হক ও ফিডব্যাকের গান নিয়ে লিখতে গেলে অবশ্যই গানের লিরিকে ভিন্নতা, বাস্তবধর্মী, গানের লিরিকে চমৎকার কথার শক্তিশালী ব্যাবহার বারবার লিখতে হবে নতুন করে। আর প্রটিটি গানের কম্পোজিশান সেই আগের কথা থেকে বলতে চাইঃ যেন স্বর্গীয় কোন অনুভূতি থেকে পাওয়া। ফুয়াদ নাসের বাবু এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের ব্যান্ড মিউজিকের ইতিহাসে এক অনন্য ও অনবদ্য সঙ্গীত পরিচালক। বাংলা ব্যান্ড সঙ্গীত নিয়মিত শোনের এবং একটু খোজ খবর রাখেন যারা তারা আমার সাথে একমত পোষণ করবেন খুব সহজেই, এই আশা করা অর্বাচীন কিছু নয়।)

মেলা অ্যালবামের গানগুলো হলঃ "মেলা", “মৌসুমী পর্ব -২”, ”জীবন-জ্বালা”, ”গৌধুলী”, ”নীল-নক্সা”, ”পালকী পর্ব -১”, ”স্বদেশ”, ”জন্মেছি-এই যুগে”, ”ময়ূরী আকাশ”, ”ছোট্ট পাখি”, ”মন বুঝিয়া” ও “ফিরে এসো”। অধিকাংশ গানে কন্ঠ দিয়েছেন মাকসুদুল হক ও নিজের কন্ঠে গাওয়া প্রায় এই অ্যালবামের সব গানই উনার নিজের লেখা। জন্মেছি এই যুগে গানটিতে মাকসুদুল হক সুতীব্র চিৎকারে আর্তনাদ করে বলেছেনঃ “শুনিনা পুরোনো দিনের ঐ গান/আমি বুঝিনা তোমার রাগ-রাগিনীর গান/প্রথম যেদিন হল আর্তনাদ/আর পাগল পাগল বলে দিলে অপবাদ আমাকে/আমি জন্মেছি এই যুগে/আমার অহংকার আমি গান গাই এই যুগে”। ব্যান্ড সঙ্গীতের আধুনিকায়নে ও ব্যান্ড সঙ্গীতকে বাংলাদেশে জনপ্রিয় করার পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান যার তিনি হলেন অসামান্য প্রতিভাধর বাংলা ব্যান্ড মিউজিকের অগ্রদূত এই মাকসুদুল হক ও ফিডব্যাক। ব্যাক্তি জীবনে ব্যান্ড সঙ্গীতকেই লালন করেছিলেন দীপ্ত প্রতিভায়। ব্যান্ড সঙ্গীত আন্দোলনের প্রধান ও একমাত্র সংঘঠন বামবা (বাংলাদেশ মিউজিক্যাল ব্যান্ড অ্যাসোসিয়েশান) এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে ব্যান্ড সঙ্গীত আন্দোলনকে ত্বরাণ্বিত করেছিলেন।

১৯৯২, এইচ.এম.ভি/কলকাতা থেকে ফিডব্যাকের সর্বাধিক জনপ্রিয় গানগুলো নিয়ে প্রকাশ পায় "জোয়ার"। পুরোনো জনপ্রিয় গানগুলো যেমনঃ মৌসুমী-১, মৌসুমী-২, এই দিন চিরদিন, ঐ দূর থেকে দূরে, দিন যায় দিন চলে যায়, মাঝি তুমি, মাঝি-৯১(মাঝি তোর রেডিও নাই), চিঠি, জীবন-জ্বালা ও মেলা গানগুলো রিকম্পোজ করা হয় এই অ্যালবামে শুধুমাত্র মাঝি-৯১ ছাড়া। সবগুলো গানেই কন্ঠ দেয় মাকসুদুল হক। ফিডব্যাকই বাংলাদেশের প্রথম কোন ব্যান্ড যারা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ইন্ডিয়াতে ততকালীন সময়ে অডিও প্রকাশ করে।। কলকাতায় জোয়ার অ্যালবাম প্রকাশের পরপরই ইন্ডিয়াতে ফিডব্যাক একটি Open Air Concert এ অংশ নেয়।। হাজার হাজার উন্মত্ত শ্রোতা অংশ নেই সেই কনসার্টে। সেই সময়ে আগে ইন্ডিয়ায় এমনটি ছিল বিরল।। ঐ কনসার্টের পর জ়োয়ার অ্যালবামের কাটতি বেড়ে যায় বহুগুনে।। শ্রোতারা হুমড়ি খেয়ে পড়ে ক্যাসেটের দোকানে। কিন্তু দুঃখ ও আক্ষেপ এই যেঃ ঐ সময়ে ওপাড় বাংলার (কলকাতার) এক শিল্পীকে সুযোগ করে দিতে সমস্ত জোয়ার অ্যালবাম প্রচুর চাহিদা থাকা সত্বেও মার্কেট থেকে তুলে নেওয়া হয় এইচ.এম.ভি।।

বাংলা ব্যান্ড মিউজিকে ফিডব্যাক ও মাকসুদুল হকের করা জোয়ার অ্যালবামটি এক অনন্য সংযোজন। তখনও ফিডব্যাকের লাইন আপে ছিলঃ ফোয়াদ নাসের বাবু (কিবোর্ডিস্ট ও দলনেতা), মাকসুদুল হক (ভোকাল), পিয়ারু খান (ভোকাল ও ড্রামার), লাবু রহমান (ভোকার ও গিটারিস্ট) এবং সেকান্দর আহমেদ খোকা (বেইজ) এবং বাউলিয়ানা পর্যন্ত একই লাইন-আপ ছিল ফিডব্যাকের।। (ব্যাক্তিগত ভাবে আমি ফিডব্যাক ও মাকসুদুল হকের করা প্রতিটি অ্যালবাম শুনে মুগ্ধ হয়েছি অজস্রবার এবং প্রতিবারই নতুন নতুন করে)।

এরপর এল বঙ্গাব্দ ১৪০০ (খ্রিস্টাব্দঃ ১৯৯৪সাল)। ফিডব্যাক নিয়ে এল ফিডব্যাকের ইতিহাসের সবচেয়ে জনপ্রিয় অ্যালবাম বঙ্গাব্দ ১৪০০। গীতিকবিতার শুরু এই অ্যালবাম থেকেই। বঙ্গাব্দ ১৪০০ এর কথা আগেই উল্লেখ করেছি। (তবে কিছু কিছু ব্যাপার নতুন করে তুলে আনার একটা প্রবল আকাংখা আমার।) এই অ্যালবামের চারটি গান সচরাচর ধারাবাহিকতার বাইরে সবচেয়ে বেশী ভাললাগত। আগেই উল্লেখ করেছি মাকসুদুল হক বরাবরই সামাজিক অসংগতি তুলে ধরতে চেয়েছিলেন তার গানে। গানের মাধ্যমে করতে চেয়েছিলেন সামাজিক বিপ্লব। গান করেছেন ব্যান্ড আন্দোনল নিয়ে। বঙ্গাব্দ ১৪০০ তে করা "কোথাও রোমাঞ্চ নেই/খাঁটি করুণ বাস্তবতা/আর এই বাংলাদেশেরই কথা/ . . . দিয়ে শুরু(উচ্চ পদস্থ তদন্ত কমিটি)" ও "সামাজিক কোষ্ঠকাঠিণ্য" সামাজিক আন্দোলনের ব্যান্ড মিউজিকের ভূমিকা অনেক শক্তিশালী ও প্রশংসনীয় করে তোলে। এছাড়া একই অ্যালবামে করা "আপন দেশে চল" শিরোনামের গানটি চিরাচরিত বাংলার গরিমা গানের প্রতিনিধিত্ব করে। সেই সাথে মাকসুদুল হক-ই বাংলাদেশের প্রথম ব্যাক্তি যিনি বাংলার বাউল ও গরিমা গান গুলো ব্যান্ড সঙ্গীতের ছত্রছায়ায় নতুন প্রজন্মের হাতে তুলে দিতে চেয়েছিলেন। এছাড়াও "জীবন সুন্দর/আকাশ বাতাস-পাহাড় সমুদ্র সবুজ বনানী ঘেরা প্রকৃতি সুন্দর/আর সবচেয়ে সুন্দর এই বেঁচে থাকা/তবুও কি আজীবন বেঁচে থাকা যায়/বিদায়ের সানায় বাঁজে/নিয়ে যাবার পালকী এসে দাড়ায় দুয়ারে/সুন্দর প্রকৃতি ছেড়ে এই যে বেঁচে ছিলাম/দীর্ঘশ্বাস নিয়ে যেতে হয় সবাই কে অজানা গন্ত্যবে/হঠাৎ ডেকে উঠে নাম না জানা পাখি/অজান্তেই চমকে উঠি জীবন ফুরালো নাকি" চমৎকার আবৃতি অংশটুকু দিয়ে শুরু হয় পালকী-২। জীবনের সবচেয় নির্মম সত্য কথাটা স্মরণ করিয়ে দেয় এই গানটি। আর এই গানটির সঙ্গীত পরিবেশনাও চমৎকার। ভাল না লাগার কোনই অবকাশই নেই। আর সব কটি গানের চমৎকার পরিবেশনা ফিডব্যাকের। ফিডব্যাকের বাইরে এর কোন অস্তিত্ব নেই। এছাড়া এই অ্যালবামে লাবু রহমানে কন্ঠ গাওয়া "এখন আমি বিদ্রোহী" ও "সুখী মানুষের ভীড়ে" গান দুটি এবং পিয়ারু খানের কন্ঠ গাওয়া হাইলি মেলোডিয়াস "ও আশা" গানটা শুধুই শ্রুতি মধুর নয়, পাশাপাশি গানের সঙ্গীতায়োজন ও উপস্থাপনের ভঙ্গী পুরো ব্যাতিক্রম ও অসাধারণ। (লাবু রহমান ও পিয়ারু খানের কথা আমার এই পোষ্টে অনেক গুলো কারণেই তুলে আনিনি। অন্য কোন পোষ্টে নিয়ে আসব নাহয় ফিডব্যাক এর এই দুই যোদ্ধাকে।)



চিরাচরিত বাংলার আদি সঙ্গীতের একটা বিশাল অংশ জুড়েই রয়েছে বাউল গান ও গরিমা গান। হাছন রাজা, লালন সাঁই, সিরাজ সাঁই, বাউল আব্দুর রহমান বয়াতী এবং শাহ আব্দুল করিম সহ আরো অনেকেই সমৃদ্ধ করে গেছেন এই পুণ্যভূমি। জীবন, প্রেম, ভালবাসা, বিরহ, দেহতত্ত্ব, আলেক দর্শন সহ অনেক ক্ষেত্র সমৃদ্ধ আছে সেইসব গান দিয়ে। মাকসুদুল হক সেই দর্শন পেয়েছিলেন। বাংলাদেশর ব্যান্ড মিউজিকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে থেকে শ্রোতাপ্রিয়তা হারাতে পারে জেনেও বানিজ্যিকতার কোন মানসিকতা না রেখে শুধুমাত্র বাংলার ব্যান্ড সঙ্গীত দিয়ে নতুন প্রজন্মের কাছে বাউল গানগুলো পৌছে দিতেই ফিডব্যাক শুরু করে বাউলগান নিয়ে অ্যালবামের কাজ।। ঐ সময়ের আগে ফিডব্যাক ছাড়া বাংলার অন্য কোন ব্যান্ড এত বড় সাহসীকতার পরিচয় দিতে পারেনি।। এই প্রজেক্টের আওতায় প্রথমেই ফিডব্যাক নিয়ে আসে বাংলাদেশের মিউজিকের ইতিহাসে সিঙ্গেল ট্র্যাকের একটি পুরো অ্যালবাম যার এপিঠ-ওপিঠ দুপিঠ জুড়েই শুধু একই গান বাজতে থাকে এবং সেটি গানটি হল বিখ্যাত বাউল সঙ্গীত "মন আমার দেহঘড়ি" এর ফিউশান ভার্সন। দেহঘড়ি শিরোনামের অ্যালবামটিতে ফিডব্যাকের সাথে প্রথমবারের মত পরিবেশনা করে বিখ্যাত বাউল শিল্পী আবদুর রহমান বয়াতী এবং অ্যালবামের স্বার্থে গানের লিরিকে একটু পরিবর্তন আনা হয়।
সে-ই শুরু এরপর ১৯৯৬ সালে বাউলদের গান নিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রথমবারের মত ফিডব্যাক নিয়ে আসে একটা পুরো বাউল অ্যালবাম। এই অ্যালবামের ১০ গানের ভেতর ৯টি গান নেয়া হয় বাংলার বাউল সঙ্গীতের জনপ্রিয় গানগুলো থেকে। আর সেগুলো হলঃ করিমানা, প্রাণকান্দে, গুরুর ভাব, জনম দুঃখী, লোকসান, কেহই করে বেঁচাকেনা, দিবার কিছু নাই, শ্যাম কালিয়া এবং হাওয়া দমে শিরোনামের গানগুলো।। হাওয়াদমে গানটিতে ফিডব্যাকের সাথে পরিবেশনা করেন বাউল সাধক "হিরু-শাহ)। বাদ বাকী ১ টি গান "ধুয়ার দানা" পিয়ারু খানের লেখা গান। বাউলিয়ানা বাংলাদেশের মিউজিকের ইতিহাসের শুধুই একক ও অনবদ্য সংযোজন নয়। এই অ্যালবামটিই একমাত্র অ্যালবাম, যে অ্যালবামটি যারা বাউলগান শুনতো না কিংবা আগ্রহ বোধ করত না তাদেরকে বাউল গানে আকৃষ্ট করেছে। আমি নিজেও তাদেরই দলে পড়ি। মাকসুদুল হক ও এই ফিডব্যাক না থাকলে হয়ত আমি এই অসম্ভব চমৎকার দর্শনের মুখোমুখি হতাম না কখনোই।। এই অ্যালবামটি বাউল ধারার গানগুলোকে নতুন প্রজন্মের কাছে জনপ্রিয় করতে অসামান্য অবদান রেখেছে এবং আজও আমি তা-ই মনে করি।। এবং বর্তমান সময়ে যারা Experiment Music করছেন তাদের সবার আদিতে কিন্তু ফিডব্যাক ও এক মাকসুদুল হক-ই।
বাউলিয়ানা করার পরপরই মাকসুদুল হক করতে চেয়েছিলেন নিজের পছন্দ মত সেইসব গান, যেই গানগুলো সামাজ গঠনের আন্দোলনে ভূমিকা রাখবে, সমাজ সচেতনতায় এগিয়ে আসবে এক একটি গান, দেশ কাল উঠে আসবে প্রতিটি লিরিকে। ঝংকারে ঝরে পড়বে সমস্ত সংকীর্ণ মানসিকতা। প্রতিটি গানের কথায় থাকবে অন্যায্য ও অন্যায়ের এবং নোংরা রাজনীতির বিরুদ্ধে প্রখর প্রতিবাদ, থাকবে নিজের অক্ষমতা, থাকবে স্বদেশ প্রেমের কথা। যেই গান গুনলে সমাজ সচেতন হবে। যেই গান জাতি গঠনে উৎসাহিত করবে তরুণ সমাজকে। নিজেও সামাজিক দ্বায়বদ্ধতা থেকে মুক্ত হবেন কিছুটা। প্রতিবাদ করতে চেয়েছেন গানে গানে।। গলায় গলা মেলাতে চেয়েছিলেন লক্ষ লক্ষ তরুণের কন্ঠের সাথে।। যখন বুঝতে পারলেন ফিডব্যাকে থেকেই এই গানগুলো করার সুযোগ পাববেন না, ঠিক তখনই বাউলিয়ানা করার পরপর ১৯৯৬ সালে ফিডব্যাক ছেড়ে এসে গড়ে তোলেন "মাকসুদ ও ঢাকা" শিরোনামের একটি ব্যান্ড। ঠিক একই সময়ে মাকসুদুল হকের সাথে ফিডব্যাক ছেড়ে চলে আসে বেইজিস্ট সেকান্দর আহমেদ খোকা।। সেকান্দর আহমেদ খোকা এখন অব্দি মাকসুদ ও ঢাকা ব্যান্ডের সদস্য হিসেবে আছেন। ফোয়াদ নাসের বাবু, পিয়ারু খান ও লাবু রহমান এখনো ফিডব্যাকের সাথে জড়িত আছেন।। মাকসুদুল হক ফিডব্যাক ছেড়ে চলে আসার পর ফিডব্যাক আর কখনোই সেই আগের জনপ্রিয়তা নিয়ে দাড়াতে পারেনি। দীর্ঘ বিরতি দিয়ে করেছিলেন ফিডব্যাক ০২ নামের একটি অ্যালবাম। সেই অ্যালবামটিতে ফিচার করা হয়েছিল 'রেশাদ'কে। "আবার মেলায়" শিরোনামে একটি গানসহ সবকটি মৌলিক গান নিয়েও ফিডব্যাক আর দাড়াতে পারেনি। এখন ২০১১ সাল। সময়ের বিবর্তনে অনেকেই জনপ্রিয়তা হারিয়েছে। হারিয়েছে ব্যান্ড মিউজিকে নিজেদের বর্তমান অবস্থান। ফোয়াদ নাসের বাবুর মত শক্তিমান কম্পোজার থাকা সত্বেও লাবু ও পিয়ারু খান নিয়ে ফিডব্যাক'কে হয়ত আগের সেই স্মৃতিচারণা করেই সময় কাটাতে হয়। সেই খবর আমরা কইজনই বা রাখি। অন্যদিকে মাকসুদুল হক হয়েছে নিষিদ্ধ মাকসুদ সেই খবরই-বা কইজনের জানা।

হাসান সাইদ টিপু (অবসকিউর) ঃ


খুলনার কাছে বাংলা সংগীত অনেক অনেক ঋণী। যে খুলনা থেকে লালন এর জন্ম সেই খুলনা থেকেই যুদ্ধপরবর্তী স্বাধীন বাংলার বাংলা গানের নতুন এক যুগের সব কাণ্ডারিদের আমরা পেয়েছি। খুলনা থেকেই পেয়েছি টিপু ও অবসকিউর, মেজবাহ ও ডীফরেনট টাচ,দেশ সেরা কিবোর্ডিসট মানাম আহমেদ, গীতিকার, সুরকার ও কণ্ঠশিল্পী প্রিন্স মাহমুদ এর মতো সব সেরাদের। যারা আমাদের গুরু আজম খান, পিলু মমতাজ, ফেরদৌস ওয়াহিদ, ফিরোজ সাই ও ফকির আলমগির এর শুরু করা যুদ্ধকে এক বিশাল প্রাপ্তি তে পরিণত করেছেন। আর আমাদের বাংলা গানকে করেছেন আরও সমৃদ্ধশালী।
১৯৬৭ সালের ১৬ ই জানুয়ারী খুলনার এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম নেয় এক ছোট্ট এক শিশু। সেই ছোট্ট শিশুটি এক সময় বড় হতে থাকে আর তার দুরন্ত ডানপিটে স্বভাব বাড়তে থাকে। সাথে সবাইকে মুগ্ধ করার মতো আরও একটি চমৎকার গুন আল্লাহ তাকে জন্মের সময়ই দিয়ে দিয়েছিলেন যাকে বলে ঈশ্বরপ্রদত্ত। হ্যাঁ, সেই ঈশ্বরপ্রদত্ত সুকণ্ঠ দিয়েই ছেলেটি সবাইকে গান শুনিয়ে মুগ্ধ করতো। তা হোক স্কুলে অথবা বন্ধুদের আড্ডায় সবখানেই ছিল সেই প্রাণবন্ত কণ্ঠ। ধীরে ধীরে যে ছেলেটি একদিন হয়ে যায় বাংলাদেশের ব্যান্ড সঙ্গীতের অন্যতম যোদ্ধা ও সবার প্রিয় 'টিপু' ভাই। হ্যাঁ বন্ধুরা ! আজ আমাদের প্রিয় অবসকিউর ব্যান্ড এর প্রিয় 'টিপু' ভাইয়ের ৪৫ তম জন্মদিন। প্রিয় টিপু' ভাইকে জানাই জন্মদিনের শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা। যিনি বাংলা ব্যান্ড/পপ সঙ্গীতে অমর হয়ে থাকবেন তাঁর কালজয়ী সব গান দিয়ে।
টিপু’র ছেলেবেলাটা আর দশজনের মতোই কেটেছে। লেখাপড়ায় ভালোই ছিলেন তিনি। গান করতেন নিজের মনে। বাংলা গান খুব বেশি গাওয়া হতো না, গলা খুলে ইংরেজি গানই বেশি করতেন। স্কুল কলেজে গানের জন্য বিখ্যাতই ছিলেন টিপু। বন্ধুরা টিপুকে পেলেই জেঁকে ধরতো আর তিনিও একটার পর একটা গান গেয়েই চলতেন।
টিপু যখন কলেজে পড়তেন তখন প্রায়ই ক্লাসমেটদের সঙ্গে রিকশায় ঘুরে বেড়াতেন। তার ভাষ্যমতে, ‘তখন এটাই ছিলো আমাদের এক ধরনের আনন্দ করা উপায়। রিকশা যেমন চলতে থাকত, তেমনি চলত আমাদের পালা করে গান গাওয়া। মানাম আহমেদ আমার সহপাঠী ছিলেন। তিনি গান করতেন, সঙ্গে আমিও।’
তখন ১৯৮৪ সাল। একদিন মানাম আহমেদ টিপুকে প্রস্তাব দেন ব্যান্ডে যোগ দিতে। ব্যান্ড সংগীতের স্বর্ণযুগে নিজেকে যুক্ত করতে দ্বিধা করলেন না টিপু। তিনি যোগ দিলেন চাইমে। টিপু জানালেন, ‘১৯৮৪ সালে আমি চাইমে যোগ দিই। টিএসসিতে আমার অডিশন হয়। সেই সময় টুলু ভাই ছিলেন চাইমে। তিনি টিপুকে সিলেক্ট করেন এবং তখন টিপু চাইমে ইংরেজি গান গাইতে শুরু করেন।
তবে টিপু খুব বেশি দিন ছিলেন না চাইমে। বছর খানেক পর তিনি উপলব্ধি করলেন, তার বাংলা গান করা উচিত। নিজের একটি ব্যান্ড গড়ে তুলবেন বলেও সিদ্ধান্ত নিলেন। অনেক ভেবে-চিন্তে তিনি জন্মস্থান খুলনায় চলে গেলেন। সেখানেই কয়েকজন মিলে তৈরি করলেন একটি ব্যান্ড। নাম দিলেন অবসকিউর। এমন নামকরণের কারণ সম্পর্কে টিপু বললেন, ‘অবসকিউর মানে অস্বচ্ছ বা অস্পষ্ট। আমরা লুকিয়ে থাকা জনপ্রিয়তা অর্থে নামটি ব্যবহার করেন টিপু ও তাঁর সহযোদ্ধারা । তখন একটি হারমোনিয়াম এবং গিটার নিয়ে ব্যান্ড তৈরি করে বাড়ির নিচের একটি পরিত্যক্ত ঘরে তাঁরা প্র্যাকটিস করতেন’।
ব্যান্ড গঠনের পর গান গাওয়ার চেয়ে গান লেখা এবং সুর করার কাজটাই বেশি হতো তাদের। এভাবে তারা ৩০টি গান তৈরি করে ফেলেন। এরপর সারগাম স্টুডিওর রেকর্ডারের সঙ্গে টিপুর পরিচয় হয়। অবসকিউরের গান শুনে মুগ্ধ হয়ে যান তিনি। গান রেকর্ডিং করে ক্যাসেট বের করার কথা বলেন তিনি। এমন অসাধারণ সুযোগ হাতছাড়া করতে চাননি টিপু।
সেই সেলফ টাইটেল প্রথম 'অবসকিউর' ব্যান্ড এর অ্যালবাম বাংলা ব্যান্ড সঙ্গীতের ইতিহাসে চিরঠাই করে নেয়। যেখানে পেয়েছিলাম ' মাঝরাতে চাঁদ' ছাইড়া গেলাম মাটির পৃথিবী' 'ভণ্ড বাবা' 'মমতায় চেয়ে থাকা' মত ১২ টি সেরা গান। যা সেই ছোটবেলা থেকে আজো হৃদয়ে গেঁথে আছে এবং থাকবে চিরকাল ।
এরপর ১৯৯০ সালে বের হয় ২য় অ্যালবাম যেটিও সেলফ টাইটেলড । যার মাঝে পাই ' তুমি ছিলে কাল রাতে', খোদা 'তোমায় ডাকবো যখন' 'আধার ঘেরা স্বপ্ন ' সন্ধ্যা আকাশ' ' দৃষ্টিরই সীমানায়' এর মত চিরসবুজ ও চিরকাল মনে রাখার মত প্রিয় সব গান। এরপরে খানিক বিরতি দিয়ে ৯৩/৯৪ এর দিকে আসে অবসকিউর এর একটু অন্যরকম রকিং অ্যালবাম 'স্বপ্নচারিণী' যেখানে এতদিনের চেনা শান্ত শিষ্ট, রোমান্টিক 'টিপু' অনেক দুর্দান্ত, বুকের ভেতর জমে থাকা কোন ক্ষোভ যেন বারুদ হয়ে বিস্ফোরণ ঘটাচ্ছে সেইরকম একটি অ্যালবাম ছিল 'সপ্নচারিনি'। এই অ্যালবাম এর আগে খুলনার ২ জনপ্রিয় তারা ফ্রম ওয়েস্ট (প্রিন্স মাহমুদ) ও ডীফরেন্ট টাচ (মেজবাহ) কে নিয়ে একটি অসাধারণ ব্যান্ড মিক্সড অ্যালবাম "আবেগ' বের করে অবসকিউর । যে অ্যালবাম এর প্রতিটা গানই ছিল 'আবেগ' নিয়ে খেলা করা দুর্দান্ত সুন্দর সব গান।
'স্বপ্নচারিণী' অ্যালবাম এর 'সপ্নচারিনি' 'তুমি অকারণে ' 'আধার ঘেরা রাত' 'সেই তুমি কোথায়' 'সেই তুমি' র মত দুর্দান্ত কিছু গান। এরপর অবসকিউর কে আর পাওয়া না গেলেও শ্রোতারা প্রিয় 'টিপু' কে পেয়েছিল সবসময় বিভিন্ন মিক্সড অ্যালবাম এর চরম জনপ্রিয় ও দুর্দান্ত সব গানে। সেই মিক্সড অ্যালবাম এর যুগে শ্রোতারা পায় প্রিয় 'টিপু'র প্রথম একক অ্যালবাম 'একাকী একজন' । যা এক কথায় একটি অসাধারণ অ্যালবাম ছিল। যেখানে 'টিপু' আবার সেই পুরনো শান্ত শিষ্ট বিরহের আগুনে জ্বলা সুন্দরতম একজন মানুষ। সেই অ্যালবাম এর 'একাকী একজন' 'আমার আমি ছাড়া' 'আমার মন' গানগুলো ছিল চোখে জল আসার মত সব গান। ব্যক্তিগত জীবনে শহীদ আলতাফ মাহমুদ এর কন্যা শাওন মাহমুদ কে নিয়ে তাঁর সুখের সংসার যিনি 'টিপু'কে সর্বক্ষণ অনুপ্রেরণা দিয়ে যাচ্ছেন গান করার জন্য।
২০০৭ থেকে আবার নতুন রূপে অবসকিউর এর হাল ধরে ফিরে আসেন 'টিপু' ও অবসকিউর। বাংলা গান যতদিন বেঁচে থাকবে ততদিন সেই ইতিহাসের একটি উজ্জ্বলতম তারা হয়ে জ্বলজ্বল করে বাংলা গানের আকাশে জ্বলবে যে তারাটি তাঁর নাম 'টিপু'। যাদের অক্লান্ত পরিশ্রম, গানের প্রতি ভালোবাসা আর স্রোতাদের প্রতি দায়বদ্ধ থেকে সবসময় বাংলা গানের সম্ভারকে এক একটি ফুল দিয়ে ভরিয়ে দিয়েছেন তাদর মধ্য টিপু অন্যতম। আজকের এই ভালো ও শ্রুতিমধুর মানসম্পন্ন বাংলা গানের দুর্ভিক্ষের সময়কে যারা দূর করতে পারেন তাদেরই একজন টিপু। তাঁদের ফিরে আসাটা এবং আবার সেই কাণ্ডারির ভূমিকায় অবতীর্ণ দেখার জন্য কোটি কোটি বাংলার মানুষ আশায় বুক বেঁধে আছে। কারন তাঁদের যে আছে অনেক তারার ভিড়ে উজ্জ্বল হয়ে জ্বলতে থাকা একটি তারা যার নাম টিপু! যিনি এখনো ফুরিয়ে যাননি। তিনি যে বাংলা গানেরই এক 'যুবরাজ' ,যার কণ্ঠে সুরের মুচ্ছনায় ভাসিয়ে নিয়ে যাবে আর আমাদের মুক্তি দিবে কোটি কোটি বাংলা গান পাগল স্রোতাদের খাদের কিনারায় যাওয়া মানহীন বস্তাপচা গানের এই আকালের যুগ থেকে ।

লতিফুল ইসলাম শিবলী ঃ


পয়লা বৈশাখের এক কাকডাকা ভোরে জন্ম নিয়েই দেখে, বাংলাদেশে চলছে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি। ফুলছড়ি, বাহাদুরাবাদ ঘাটে পাকিস্তানি সেনাবাহিনির অবস্থানের ওপর যখন ইন্ডিয়ান মিগ থেকে বোমা ফেলা হচ্ছিল, তখন মুক্তিযোদ্ধা বাবার সঙ্গে বাঙ্কারে বসে শিশুটি বলছিল, 'আল্লাহ্, রক্ষা কর'—গল্পটি শিবলীর মায়ের কাছে শোনা। তখন যুদ্ধ না বুঝলেও নব্বইয়ের দশকের স্বৈরশাসনবিরোধী আন্দোলনের ভেতর দিয়েই তাঁর বেড়ে ওঠা। ইন্টারমিডিয়েটে পড়াকালেই স্বৈরশাসকের জেল জুলুম আর হুলিয়া মাথায় নিয়ে চলে আসেন নাটোর থেকে ঢাকায় । যেহেতু যুগযন্ত্রণার ক্ষ্যাপামো মজ্জাগত, তাই প্রথা ভাঙার যুদ্ধে শিবলী হয়ে ওঠেন আপাদমস্তক 'রক'।
গ্রুপথিয়েটার নাট্যচক্রের সঙ্গে মঞ্চনাটকে কাজ করতে করতেই ধীরে ধীরে বিকশিত হতে থাকেন শিল্পের অন্যান্য মাধ্যমে।

অভিভাবকদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে একদল গানপাগল তরুণ ব্যান্ড সংগীতের মাধ্যমে বাংলা গানের ধারায় যে-পরিবর্তন এনেছে, শিবলী তাদেরই অন্যতম।

আধুনিক জীবনযন্ত্রণাগ্রস্ত তারুণ্যের ভাষাকে শিবলী উপস্থাপন করেছেন অত্যন্ত সহজসরল ভাষায়। তাঁর সাফল্য এখানেই। তাই অল্প সময়ের মধ্যেই শিবলী পরিণত হয়েছেন এদেশের ব্যান্ড সংগীতজগতের কিংবদন্তি গীতিকবিতে।
আমার সমবয়সী ৯০ এর বাংলা আধুনিক ও ব্যান্ড সঙ্গীতের সকল শ্রোতা ভাই বোনদের কাছে নিশ্চয়ই লতিফুল ইসলাম শিবলি ভাইয়ের কথা মনে আছে! যিনি ছিলেন গত দশকের ব্যান্ড সঙ্গীত এর পর্দার আড়ালে থাকা একজন অতি জনপ্রিয় মানুষ। যাকে পাওয়া যেত প্রিয় আইয়ুব বাচ্চু, জেমস, মাকসুদ, মাইলস, উইনিং সহ সব জনপ্রিয় ও শীর্ষে থাকা ব্যান্ড এর নতুন অ্যালবাম এর কভারে। কারন ঐ অ্যালবাম গুলোর মাঝে যে তাঁর লিখা গান আছে। বিশেষ করে ফিলিংস( নগর বাউল), আইয়ুব বাচ্চুর অনেক অনেক জনপ্রিয় গানের গীতিকার ছিলেন তিনি। তিনি শুধু একজন গীতিকারই ছিলেন না পরবর্তীতে তাঁকে আমরা পেয়েছি “Century Tailors “ এর বিজ্ঞাপনের মডেল হিসেবে এবং তারপর পেয়েছিলাম প্যাকেজ নাটক ‘রাজকুমারী’ তে শমি কায়সার এর বিপরীতে অভিনেতা হিসেবে। ‘রাজকুমারী’ নাটক এর গল্প ও গানটাও তাঁর লিখা ছিল। পরবর্তীতে ‘রাজকুমারী’ নামে আইয়ুব বাচ্চুর সুর ও সঙ্গীতে একটি মিক্সড ব্যান্ড অ্যালবাম বের হয় যেখানে আইয়ুব বাচ্চু ‘রাজকুমারী’ গানটায় কণ্ঠ দেন। সেই প্রিয় লতিফুল ইসলাম শিবলি গত দশকের শেষ দিকে নিজের লিখা ও সুর করা একটি একক অ্যালবাম বের করেন, যার প্রত্যেকটি গানে তিনি নিজে কণ্ঠ দেন। সেই অ্যালবামটির নাম ছিল ‘নিয়ম ভাঙ্গার নিয়ম’ যা আজকের অডিও বাজারে নেই। এই দশকের নতুন শ্রোতারা হয়তো জানেও না যে লতিফুল ইসলাম শিবলি কে ছিলেন? অথচ তারাই জেমস এর জেল থেকে বলছি গানটা শুনেছে এবং নিজেরাও গাওয়ার চেষ্টা করে কিন্তু জানে না যে এই গানটি শিবলি ভাইয়ের লিখা!
'কমপ্লিট ম্যান' খ্যাত ঝুঁটিবাঁধা সেঞ্চুরি ফেব্রিকসের দুর্দান্ত সেই মডেল শিবলী ছিলেন তাঁর সময়ের ফ্যাশন-আইকন।
তিনি একজন সফল নাট্যকার। বিটিভির যুগে তাঁর লেখা প্রথম সাড়া জাগানো নাটক 'তোমার চোখে দেখি'।
নিজের লেখা নাটক 'রাজকুমারী'তে মির্জা গালিব চরিত্রে তাঁর অনবদ্য অভিনয় এখনও অনেকের মনে থাকার কথা।

শিবলীর প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ 'ইচ্ছে হলে ছুঁতে পারি তোমার অভিমান'।
দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ-- 'তুমি আমার কষ্টগুলো সবুজ করে দাও না'।

বাংলা একাডেমী প্রকাশ করেছে তাঁর 'বাংলাদেশে ব্যান্ড সংগীত আন্দোলন' নামে ব্যান্ড সংগীতের ওপর লিখিত প্রথম গবেষণাধর্মী প্রবন্ধগ্রন্থ।

নিজের লেখা, সুর ও কম্পোজিশনে এবং নিজের কণ্ঠে গাওয়া তার প্রথম অ্যালবাম-- 'নিয়ম ভাঙার নিয়ম'।
শিবলীর লেখা (প্রায় ৩০০) জনপ্রিয় গানের মধ্যে কয়েকটি:

জেল থেকে বলছি | কথা-সুর: শিবলী, ফিলিংস /নগরবাউল
তুমি আমার প্রথম সকাল | তপন চৌধুরী-শাকিলা জাফর
কষ্ট পেতে ভালবাসি | আইয়ুব বাচ্চু (এলআরবি)
কেউ সুখি নয় | আইয়ুব বাচ্চু
হাসতে দেখো, গাইতে দেখো | আইয়ুব বাচ্চ -
কত কষ্টে আছি | জেমস
পালাবে কোথায় | জেমস
মাকে বলিস | আইয়ুব বাচ্চু
কষ্ট কাকে বলে | আইয়ুব বাচ্চু
একজন বিবাগি | জেমস
রাজকুমারী | আইয়ুব বাচ্চু
আহা, জীবন! | আইয়ুব বাচ্চু
নীল বেদনা | আইয়ুব বাচ্চু
একটা চাকরি হবে, চাঁদমামা? | আইয়ুব বাচ্চু
লাশকাটা ঘর | নিলয় দাস
কার কাছে যাব | আইয়ুব বাচ্চু
কী ভাবে কাঁদাবে তুমি (যতটা মেঘ হলে বৃষ্টি নামে) | খালিদ (চাইম)
সি প্রেম | জেমস
নাটোর স্টেশন | জেমস সহ আরও অনেক অনেক অসাধারন সব গান দিয়ে আমাদের বাংলা গানকে করেছেন সমৃদ্ধ ।

*** প্রিন্স মাহমুদ ***


নব্বইয়ের শুরুর দিকে বাংলা ব্যান্ড মিউজিকে ব্যান্ড মিক্সড বা মিশ্র অ্যালবামের প্রচলন শুরু করেন আর্কের দলনেতা আশিকুজ্জামান টুলু (জনপ্রিয় ব্যান্ড চাইমেরও প্রতিষ্ঠাতা দলনেতা ছিলেন। পরবর্তীতে চাইম ছেড়ে দিয়ে গড়ে তোলেন ব্যান্ড "আর্ক" এবং পরবর্তীতে "আর্ক" চরম শ্রোতাপ্রিয়তা পায়)। আশিকুজ্জামান টুলুর সুরবিন্যাস, সঙ্গীতায়োজন ও পরিকল্পনায় প্রকাশিত হয় বাংলা ব্যান্ড Stars" এর সফল ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে আশিকুজ্জামান টুলুর সুরবিন্যাস ও সঙ্গিতায়োজনে সে-ই শুরু ব্যান্ড ও সলো অ্যালবামের পাশাপাশি জনপ্রিয় আরেক ধারার যার নাম "ব্যান্ড মিক্সড অ্যালবাম"। এরপর আর পিছনে তাকাতে হয়নি। এরপরের সময়টুকু ব্যান্ড মিক্সড অ্যালবামের জন্য শুধুই ইতিহাস। আর এই ইতিহাসের সবচেয়ে উজ্জল নক্ষত্র যুবরাজ মাহমুদ ঠিকাদার।

যুবরাজ মাহমুদ ঠিকাদার --- সঙ্গীতাঙ্গনে যার একমাত্র পরিচয় তিনি "প্রিন্স মাহমুদ"। সঙ্গীতে যার পদার্পন বন্ধুদের নিয়ে গড়া ব্যান্ড "দ্যা ব্লুজ" দিয়ে। এরপর 'দ্যা ব্লুজ' থেকে বেরিয়ে গড়ে তোলেন নিজের ব্যান্ড "ফ্রম ওয়েষ্ট"। ফ্রম ওয়েষ্ট এর পরিবেশনায় প্রকাশিত হয় আবেগ নামে একটি অ্যালবাম যেখানে আরও পারফর্ম করে অবসকিউর ও ডিফরেন্ট টাচ। আবেগ অ্যালবামে আছে প্রিন্স মাহমুদ এর চারটি চমৎকার গান। প্রিন্স তখন আমাদের কাছে " বেলা শেষে ফিরে এসে পাইনি তোমায় ' ও ''সব রাজাকার ভাইসা যাইবো বঙ্গপোসাগরে'' গানের শিল্পী। কত আড্ডায়, স্কুলের বার্ষিক অনুষ্ঠানে প্রিন্সের এই দুটি গান গেয়েছিলাম তাঁর হিসাব নেই। প্রিন্স কে এই প্রজন্মের সবাই জানে একজন গিতিকার,সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে কিন্তু প্রিন্স এর পথচলাই শুরু হয়েছিল একজন ব্যান্ড শিল্পী হিসেবেই। সেই প্রিন্স ৯৪ তে এসে পুরোদমে হয়ে যায় একজন গীতিকার, সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক।

গীতিকার ও সুরকার প্রিন্স মাহমুদঃ ব্যান্ড মিক্সড অ্যালবাম "শক্তি" দিয়ে যার শুরু। ঐ অ্যালবামের ১২ টি গানের ভেতর ৮ টি গানের কথা, সুর ও সঙ্গীতায়োজন ছিল প্রিন্স মাহমুদের। তারুণ্যের উন্মাদনাকে পুঁজি করে প্রকাশ পাওয়া "শক্তি"র শিল্পীরা ছিলেনঃ গুরু আজম খান(উচ্চারণ), এবি(এল.আর.বি), জেমস(ফিলিংস/বর্তমান নগরবাউল), পার্থ(সোলস), বাবনা(ওয়ারফেইজ), ফজল(নোভা) ও নকীব খান(রেঁনেসা)। চমৎকার সব পরিবেশনা সমস্ত অ্যালবাম জুড়ে। প্রতিটি গানের কথা সুর ও সঙ্গীতায়োজনে নান্দনিকতার ছোয়া স্পষ্ট। এরপর আর পিছনে তাকাতে হয়নি। সেই প্রথম অ্যালবাম থেকেই করেছেন নিজের মনের মত গান। গানের কথা সুর ও সঙ্গীতায়োজন ছিল বরাবরই নান্দনিকতায় ভরপুর। সেই নান্দনিকতার প্রমাণ স্বরুপ শুধুই একটি গানের কথা উল্লেখ করলাম আর সেটা এবি'র করা 'পালাতে চাই'। (বর্তমান সময়ের অনেকেই হয়ত অসাধারণ ও চমৎকার সব গানে ভরপুর এই সংকলনটি শোনেন নি। অনুরোধ রইল অন্তত একবার শুনে দেখবেন। প্রিন্স মাহমুদ এমনই এক নাম, আমার কাছে সেই নামের প্রতিশব্দ হল 'বিশ্বস্ত সৃষ্টিশীল ও নান্দনিকতার প্রতীক'।)

'শক্তি' অ্যালবাম এর জনপ্রিয়তায় আসে 'ওরা ১১ জন' নামক একটি চমৎকার ব্যান্ড মিক্সড অ্যালবাম। যেখানে এবার জেমস, বাবনা ও আজম খান নেই। অ্যালবাম এ আছে আইয়ুব বাচ্চু, ফজল, পার্থ, চন্দন,বিপ্লব, নকীব খান,খালিদ,টিপু, পলাশ ও প্রিন্স মাহমুদ প্রথম অ্যালবাম এর 'শক্তি' এর আইয়ুব বাচ্চু এবারো অ্যালবাম এর প্রথমে ''আমার দুটি আকাশ ছিল'' নামক একটি দুর্দান্ত গান দিয়ে। যেখানে আরও ছিল চন্দন '' কোন অভিযোগ মনে নেই'' টিপুর 'হাত বাড়ালেই বন্ধু' ফজল এর ''এখন তুমি সুখে নেই'', নকীব খানের ' সে তুমি' বিপ্লব এর 'ভয়' ও খালিদ এর ' কিভাবে কাঁদাবে বলো' এর মতো সুপাড় ডুপার গান।

তৃতীয় অ্যালবাম 'ঘৃণা'। আর্কের সাথে কাজ করার সুযোগ তৈরী হয় মূলত এই অ্যালবামের মাধ্যমেই। আর্কের মেইন ভোকাল হাসান ও আর্কের দলনেতা শক্তিমান গীতিকার ও সুরকার আশিকুজ্জামান টুলু এই প্রথম বারের মত কন্ঠ দেয় প্রিন্স মাহমুদের কথা ও সুরে এবং সেই সাথে বাংলা ব্যান্ড মিউজিকে সংযোজিত হয় আরেক অনবদ্য সঙ্গীতের। চমৎকার সব পরিবেশনার মধ্যে যে কয়েকটি গানের কথা উল্লেখ না করলেই নয়ঃ 'শুণ্য'-মাকসুদ, 'ভালবাসতে হবেই'-হাসান, 'নীরা'-খালিদ, 'অভিমানিনী'-টুলু, 'একা হয়ে যাই'-বাবনা, 'তুমি আর কারো নও'-চন্দন, 'অভিমানে'-পার্থ সহ সবকটি গান (অনেক চেয়েছি গানের শিরোনাম গুলো উল্লেখ না করার জন্য। কিন্তু উল্লেখ না করে তৃপ্তি পাচ্ছিলাম না। লোভ এই যে, যারা অসম্ভব সুন্দর এই গানগুলো শোনেনি তাদেরকে বলাঃ যদি এই গানগুলো অন্তত একবার না শোনেন তবে বাংলা ব্যান্ড সঙ্গীতের নান্দনিক ও চরম আবেদনময়ী একটা দিগন্ত অন্ধকারেই থেকে যাবে আপনার কাছে)

চতুর্থ অ্যালবাম 'ক্ষমা'। 'ক্ষমা' অ্যালবামের মাধ্যমেই প্রিন্স মাহমুদের কথা ও সুরে প্রথম বারের মত গান করেন মাকসুদুল হক (মাকসুদ ও ঢাকা), খালিদ(চাইম), চন্দন(উইনিং) ও টিপু(অবসকিউর)। এছাড়াও এই অ্যালবামে আরো ছিলেন গুরু আজম খান(উচ্চারণ), বাবনা(ওয়ারফেইজ), ফজল(নোভা), পলাশ(অরবিট), বগি(রেঁনেসা), পার্থ(সোলস) ও ইকবাল আসিফ। বেশ কিছু গান তুমুল শ্রোতাপ্রিয়তা পায় তারমধ্যে উল্লেখযোগ্যঃ 'অশ্রু মুছে তুমি তাকাবে/মনকে আলোকিত করবে/তোমার অশ্রু আমায় দুর্বল করে দেয়/আবার দেখা হবে/এখনি শেষ দেখা নয়/আবার কথা হবে/এখনি শেষ কথা নয়'--- আবার দেখা হবে/খালিদ(চাইম), 'কেন মন নিয়ে এত দাও যন্ত্রনা/কেন ক্ষমা দিয়ে ভুল তুমি ঢাকলে না/কেন আধাঁরে এই জীবনে কাছে আসবে না' --- ক্ষমা(মন নিয়ে যন্ত্রনা)/মাকসুদুল হক এবং টিপুর 'চাঁদ জাগা এই রাতে/দুচোখের বরষায় ভিজে/ভাবছি তোমায়/জেগে জেগে রাত/তুমিও কি ভাবছো আমায়' গানগুলো তুমুল শ্রোতাপ্রিয়তা পায়। এছাড়া চন্দনের 'ছোটো ছোটো কিছু কিছু ভুল', বাবনার 'কোথায় হারালে', ইকবাল আসিফের 'ভাঙ্গা হৃদয়' যেকোন শ্রোতা হৃদয় বিমোহিত করবে খুব সহজেই। প্রতিটি গানের কথা সুর ও সঙ্গীতায়োজনে নান্দনিক সৃষ্টিশীলতার ছোঁয়া পাবেন অজান্তে নিভৃতেই।

'জয় পরাজয় ' অ্যালবাম দিয়ে প্রিন্স শুরু করেন আধুনিক শিল্পীদের নিয়ে মিক্সড অ্যালবাম যেখানে তপন চৌধুরী, কুমার বিশ্বজিৎ, খালিদ হাসান মিলু, এরপরপরই প্রিন্স মাহমুদের সুরে বের হয় আধুনিক গানের শিল্পীদের নিয়ে অ্যালবাম 'ব্যবধান'। প্রিন্স মাহমুদ হেরে গলার ড্রামস গিটারের কিছু ব্যান্ড গানই করতে পারে --- আধুনিক গান প্রিন্স মাহমুদ'কে দিয়ে সম্ভব নয় বলে যারা প্রিন্স মাহমুদের সমালোচনায় মুখর ছিলেন, তাদের মুখ বন্ধ করতেই আসে 'ব্যবধান'। উদ্দীপ্ত প্রতিভার সৃষ্টিশীল নান্দনিকতায় প্রিন্স মাহমুদ বরাবরই ছিলেন অন্য সবার শীর্ষে। ব্যান্ড শিল্পীদের ছাড়াও করেছেন আধুনিক ও সলো শিল্পীদের গান। 'এক মুঠো জ্যোছনা' নামে পুরো একটা অ্যালবাম করেছেন জনপ্রিয় শিল্পী কুমার বিশ্বজিৎ-এর। আধুনিক গানের আরেক দিকপাল এন্ড্রু কিশোরের জন্য করেছেন 'গাঁয়েন' নামে একক অ্যালবাম। এছাড়াও করেছেন এন্ড্রু কিশোর ও আতিক হাসানকে নিয়ে ডুয়েট অ্যালবাম 'পদ্ম পাতার জল' ও 'দুই দিনের মেলা' নামে দুটি অ্যালবাম সহ আরো অনেক সলো ও মিক্সড অ্যালবাম। শুধুই ব্যান্ড মিউজিক নিয়ে আবদ্ধ হয়ে থাকেন নি তিনি। মেধা ও নান্দনিক মননশীলতার জ্যোতি ছড়িয়ে দিয়েছেন ব্যান্ড, পপ ও আধুনিক গানে। এবং প্রিন্স মাহমুদের সেই জ্যোতি শুধুই ছড়িয়ে পড়েনি চারপাশ জুড়ে, উপরন্তু সেই সাথেও আলোকিত করেছেন প্রতিটি শাখা।

ব্যবধানের পরপর প্রকাশিত হয় প্রিন্স মাহমুদের সর্বাধিক জনপ্রিয় ধারার অ্যালবাম 'শেষ দেখা'। আগের সমস্ত অ্যালবাম দিয়ে যাদের গ্রহণযোগ্যতা মিলেনি তারাও হুমড়ি খেয়ে পড়ে এই অ্যালবাম নিয়ে। শুধুই তাই নয় --- যারা বাংলা ব্যান্ড মিউজিক নিয়ে দোটানায় ছিলেনঃ ব্যান্ড সঙ্গীত শুনবেন কি শুনবেন না তারা সমস্ত দ্বিধা ছুড়ে ফেলে লুফে নেয় ব্যান্ড মিক্সড অ্যালবাম 'শেষ দেখা'। 'শেষ দেখা'-ই প্রিন্স মাহমুদের প্রথম অ্যালবামে যেখানে এবি, জেমস, হাসান, শাফিন আহমেদ, পার্থ, টুলু, খালিদ, গুরু আজম খান, ফজল, টিপু ও বিপ্লব এক সাথে একই অ্যালবামে উঠে আসে। এর আগে আর কোন অ্যালবামে এমনটি ঘটে নি। ততকালীন সময়ের মূলধারার সর্বাধিক জনপ্রিয় ব্যান্ডগুলোর শিল্পীরা এক সাথে একই অ্যালবামে গান করার সুযোগ পায়। ব্যান্ড মিক্সড অ্যালবামের শক্তি এখানেই নিহিত। সব ঘরানার শ্রোতা-ভক্তের জন্য এর চেয়ে ভাল আর কোন প্লাটফর্ম নেই একমাত্র ব্যান্ড মিক্সড অ্যালবাম ছাড়া। আর প্রিন্স মাহমুদও ঢেলে দিয়েছে দীপ্তপ্রতিভার সবটুকু নান্দনিক ছাঁপ। প্রতিটি শিল্পীর কন্ঠোপযোগী শ্রেষ্ঠ গানগুলো তৈরী করেছেন সব শ্রেণীর শ্রোতা-ভক্তকুলের জন্য। এই অ্যালবাম প্রিন্স মাহমুদের অতিতের সমস্ত অর্জন'কে ছাপিয়ে জ্যোতির দ্যুতি আরো বেশী ছড়িয়েছে আপন মহিমায়। এই অ্যালবামে ছিল তুমুল শ্রোতাপ্রিয়তা পাওয়া জনপ্রিয় গানঃ শেষ দেখা-এবি, হতেও পারে এই গান শেষ গান-জেমস, এত কষ্ট কেন ভালবাসায়-হাসান, প্রতিরাতই নির্ঘুম রাত-শাফিন, আকাশনীলা-খালিদ, জীবনের শেষ কটা দিন-গুরু আজম খান, সময় আর কাটে না-পার্থ (কথাঃ আশরাফ বাবু, সুরঃ পার্থ) সহ আরো বেশ কিছু গান।এই অ্যালবামের আগে শাফিন আহমেদ অন্য কোন মিক্সড অ্যালবামে গান করেছেন বলে আমার জানা নেই। অন্যদিকে আর্কের বাইরে হাসান'কে জনপ্রিয় করতে প্রিন্স মাহমুদের অবদান অনস্বীকার্য। হাসানের করা 'এত কষ্ট কেন ভালবাসায়' ঐ সময়ের মানুষের মুখে মুখে বেড়াতো, জেমসের 'বন্ধু ভেঙ্গে ফেলো এই কারাগার/খুলে দাও সে হৃদয়ে প্রণয়ের দ্বার/হতেও পারে এই দেখা শেষ দেখা/হতেও পারে এই গান শেষ গান' কিংবা পার্থর 'সময় আর কাটে না' এখনও গান পাগল মানুষগুলো নিয়মিত শোনেন।

শেষ দেখা'র পরপরই প্রকাশ পায় প্রিন্স মাহমুদের পরবর্তী অ্যালবাম 'এখনও দু'চোখে বন্যা'। এবি'র 'কতদিন দেখেনি দুচোখ', জেমস-এর 'মা', হাসানের 'প্রশ্ন' ও 'চলে যাও বন্ধু', শাফিন আহমেদের 'কোন এক সাঁঝে', খালিদের 'কোন কারণেই'। এই গানগুলো ঐ সময়ে শ্রোতাকুলকে কিভাবেই না আন্দোলিত করেছিল প্রতিটি গানের প্রতিটি কথা ও সুরে !!!! এই গানগুলির কথা নতুন করে বলতে চাইনা শুধুই এইটুকু ছাড়াঃ কিছু গান হয়ত শুধুই শিল্পীর কারণে অনেক বিখ্যাত। আবার কিছু কিছু গানের গীতিকারের খোজও রাখিনি অথবা জানিনা তবে এই গানগুলি যখন কোন শিল্পীর কন্ঠে Amplification এর সুযোগ পাবে তখন ঐ শিল্পীর পাশাপাশি আরও একটি নাম উচ্চারিত হবে, আর সেই নামটি হল 'প্রিন্স মাহমুদ'। এই গানগুলোর যারা শ্রোতা ছিলেন তাদের বলিঃ প্রতিটি গান শ্রোতা-হৃদয়কে এখনও আন্দোলিত করে সেই আগের মতই। আর যেই সব গানপাগল মানুষগুলো বাংলা ব্যান্ড মিউজিকের এই কালজয়ী নান্দনিক গানগুলো শুনে দেখেন নি, আপনাদের কাছে অনুরোধ থাকবে নান্দনিক সৃষ্টিশীলতায় ভরপুর এই গানগুলি একটি বারের জন্য শুনে দেখুন --- আপনার নিজের ভেতরে কেউ একজন হয়ত বহুকাল ধরেই অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় আছে এই গানগুলোর জন্য। যেন কত আপন, কত চেনা, কত প্রিয় এই গানগুলো অভিমানে এতদিন আপনার থেকে অনেক অনেক দূরে ছিল। আর আজ কাছে পাওয়াতেই অশ্রুর বাধ ভেঙ্গে গেছে . . .
'এখনও দু'চোখে বন্যা'র পর শতাব্দী পরিবর্তনের আগে ১৯৯৯ এ প্রিন্স মাহমুদের দুটি অ্যালবাম প্রকাশিত হয়। একটি হল 'দাগ থেকে যায়/৯৯ এর শুরুর দিকে' আর অন্যটি হল 'স্রোত/৯৯ এর শেষের দিকে'। শেষ দেখা এবং এখনও দু'চোখে বন্যার সফল ধারাবাহিকতার সরব উপস্থিতি মেলে 'দাগ থেকে যায়' অ্যালবামে। সেই সৃষ্টিশীল নান্দনিকতার পুরোটায় উঠে আসে এই অ্যালবাম জুড়ে। শাফিন আহমেদের গাওয়া 'আজ জন্মদিন তোমার' গানটি অ্যালবাম প্রকাশের সাথে সাথেই সারা বাংলাদেশ কাঁপায়। যেখানেই যাই সেখানেই বাজে শাফিন আহমদের 'আজ জন্মদিন তোমার', জেমসের 'কিছু ভুল ছিল তোমার', এবি'র 'বেলা শেষ ফিরে এসে', জুয়েলের তুমুল শ্রোতাপ্রিয়তা পাওয়া 'তুমি বোঝনি বন্ধুত্ব কি',খালিদের 'হয়নি যাবার বেলা' সহ এই অ্যালবামের বাকী গানগুলো। বাংলা মিউজিকে জন্মদিন উৎসব নিয়ে এর চেয়ে কোন ভাল গান নেই, আসবে সেই আশা ক্ষীণ। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্মদিনের উৎসব পালনে এই গানটি জন্মদিন-সঙ্গীত হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। এই অ্যালবামের রেশ কাটতে না কাটতেই আসে ৯০ দশকের প্রিন্স মাহমুদের শেষ অ্যালবাম 'স্রোত'। সবকটি গানই শ্রুতিমধুর। স্পষ্ট এবং নান্দনিক কথামালায় গাঁথা গানগুলোর উল্লেখযোগ্য কয়েকটিঃ এবি'র 'অভিমান নিয়ে', জেমসের 'পাপী', জুয়েলের তুমুল শ্রোতাপ্রিয়তা পাওয়া 'যদি কখনো অসহায়', টিপুর 'একদি কাদঁবে', পিয়াসের 'মন শত পাহারায়', মিজানের 'কাল যে আপন ছিল আজ হল পর' এবং শাফিন আহমেদের 'দুঃখ স্রোত'।

ফিরে যাই এক অবাক কন্ঠে --- জেমস। এখনও দু'চোখে বন্যা অ্যালবামের সবচেয়ে শ্রোতাপ্রিয় ও বিখ্যাত গান হল জেমস-এর 'মা'। এই গানটি প্রথমবার শুনেছিলাম দানাবাকৃতির একটি সিডি প্লেয়ারে (শুরুতেই যেই সিডি প্লেয়ারের গল্প করলাম)। তাও আজ ১ যুগেরও কিছু বেশী সময় পেরিয়ে গেছে। কালের স্রোতে যতদিন বাংলা ব্যান্ড মিউজিক টিকে থাকবে ঠিক ততদিন ঠিক আগের মতই আবেদন থাকবে প্রিন্স মাহমুদের কিছু গানের যেই গানগুলোতে কন্ঠ দিয়েছেন বাংলা ব্যান্ড মিউজিকের শক্তিমান শিল্পীরা। তবে এখনও দু'চোখে বন্যা অ্যালবামে করা জেমসের 'মা' তার অন্যতম। একটি গানই যথেষ্ঠ জেমস-কে এই বাংলা মিউজিকে অনন্তকাল শ্রোতাকুলের অন্তরে গেঁথে রাখার জন্য। এই একটি গান শ্রোতা শ্রেণীর সমস্ত প্রাচীর ভেঙ্গে পৌছে গেছে সর্বস্তরে এবং সেই সাথে পৌছে দিয়েছে তারুণ্যদীপ্ত ব্যান্ড সঙ্গীতের বারতা। যে গান শুধুই কানে কানে বলে যায়নি; কাঁদিয়েছে অজস্র শ্রোতা হৃদয়কে, সৃষ্টি করেছে বড় ধরণের দাগ। শত চেষ্টাতেও সেই দাগ মুছে ফেলা যায়। বরং থেকে যায়। যিনি একটি বারের জন্য জেমসের 'মা' গানটা শুনেছেন তার যে অনুভূতি শত শত শ্রোতা হৃদয়েরও অনুভূতিও তেমন-ই এক ও অভিন্ন। প্রিন্স মাহমুদ এমন অভিন্ন অনুভূতির জন্ম দিয়েছেন অসংখ্যবার। হয়ত তিনি নিজেও জানেন না। আমার মনে আছে আমি যখন মা গানটা হাই-ভলিউমে শুনতাম তখন লক্ষ্য করতাম আশেপাশে যতদূর পর্যন্ত গানের শব্দ স্পষ্ট শোনা যেত তার ভেতরের সমস্ত মানুষ যখন জেমসের কন্ঠে 'দশ-মাস দশ-দিন ধরে গর্ভে ধারণ/কষ্টের তীব্রতায় করেছে আমায় লালন' বাক্যটা শুনত তখন পুরো গানটা শোনার জন্য উদ্গ্রীব থাকত। হোক সে আবাল, বৃদ্ধ কিংবা বনিতা।

প্রিন্স মাহমুদ মানেই তুমুল শ্রোতা নন্দিত সারা বাংলাদেশ কাপাঁনো চমৎকার চমৎকার সব অ্যালবাম। প্রতিটি অ্যালবামের সর্বাধিক গানই নান্দনিক, তারুণ্যদীপ্ত কথামালায় গাঁথা ও অপূর্ব সুরের মূর্ছনায় গড়া অনন্যসব সংকলন। শক্তি, ক্ষমা, ঘৃণা, শেষ দেখা, এখনও দু'চোখে বন্যা, দাগ থেকে যায়, স্রোত এই অ্যালবামগুলি ব্যান্ড সঙ্গীতে অনন্য সংযোজন হিসেবে টিকে থাকবে বাংলা ব্যান্ড মিউজিকের ইতিহাসের পাতায়। সেই ইতিহাস প্রিন্স মাহমুদের ইতিহাস। সেই ইতিহাস বাংলা ব্যান্ড সঙ্গীতের এক যুবরাজের ইতিহাস।
*** প্রিন্স মাহমুদের প্রকাশিত অ্যালবামসমূহ।



০১. শক্তি

০২. ওরা এগার জন

০৩. ক্ষমা

০৪. ঘৃণা
৫. জয় পরাজয় - তপন চৌধুরী, কুমার বিশ্বজিৎ, খালিদ হাসান মিলু,

০৬. ব্যবধান

০৭. দূর থেকে ভালবেসে যাব - কামাল আহমেদ (ঠিক মনে নেই)

০৮. শেষ দেখা

০৯. এখনও দু'চোখে বন্যা

১০. দাগ থেকে যায়

১১. স্রোত

১২. দেয়াল দুই হৃদয়ের মাঝে

১৩. প্রিয় বন্ধুকে - ভেলেন্টাইন স্পেশাল

১৪. হারজিৎ

১৫. পিয়ানো

১৬. চিঠির উত্তর দিও

১৭. তাল - হাসান

১৮. মেহেদী রাঙ্গা হাত

১৯. ছুটি - এবি, হাসান, জেমস

২০. হীরা চুনি পান্না - আসিফ, সুমন, আতাহার টিটু

২১. এক মুঠো জোছনা - কুমার বিশ্বজিৎ

২২ . কিশোর কিশোরী - বাপ্পা, কানিজ সুবর্না

২৩. দুই দিনের মেলা -এন্ড্রু কিশোর (আর কে যে ছিল ঠিক মনে নেই)

২৪. ১২ মাস - এবি, হাসান, জেমস, মাকসুদ

২৫. এক টুকরো চাঁদ - খালিদ

২৬. গায়েঁন – এন্ড্রো কিশোর

২৭. ও পুতুল আমার পুতুল - আরিফ

২৮. দহন শুধু তোমার জন্য - এবি, হাসান, জেমস, বিল্পব

২৯. সারেগামা - হাসান, জেমস

৩০. পদ্ম পাতার জল - এন্ড্রু কিশোর, আতিক হাসান

৩১. দেশে ভালবাসা নাই - এবি, জেমস

৩২. যন্ত্রনা - এবি, জেমস

৩৩. হ্যালো কষ্ট - হাসান

৩৪. প্রতারণা - এবি, জেমস

৩৫. মাটি - এবি, জেমস

৩৬. দেনা পাওনা - এবি, জেমস, হাসান

৩৭. বাজনা - এবি, জেমস, বিল্পব

৩৮. ভালবাসা মানে দুঃখ - হাসান

৩৯. আড্ডা - মেহরাব, রুমী

৪০. দেবী

৪১. বন্দনা - মাহাদী

৪২. হাটি - কুমার বিশ্বজিৎ, ফাহমিদা নবী

৪৩. ঘুমাও - খালিদ

৪৪. বোকা - ক্লোজাআপ ওয়ান তারাকাদের নিয়ে

৪৫. প্রিন্স মাহমুদের গান - প্রিন্স মাহমুদ, পলাশ, মেহরাব, ফাহমিদা নবী

৪৬. নির্বাচিতা (প্রিন্স মাহমুদের সর্বশেষ প্রকাশিত অ্যালবাম)

** এখানে উল্লেখ্য যে সবাই প্রিয় আইয়ুব বাচ্চুর কণ্ঠে ''বেলা শেষে'' গানটি শুনেন সেটি হলো প্রিন্স মাহমুদ এর 'ফ্রম ওয়েস্ট' ব্যান্ড এর 'সে কেমন মেয়ে' অ্যালবাম এর 'বেলা শেষে' গানটির ২য় পর্ব। ১ম পর্বে প্রিন্স নিজেই গানটি গেয়েছিলেন যা বহু শ্রোতার অজানা। এই ব্যাপারে আমি এর আগে আমার একটি পোস্টে বিস্তারিত বলেছিলাম যে গানটি আমি ও আমার সমবয়সীরা পেয়েছিলাম ১৯৯১ তে। ***

*** হ্যাপি আখন্দ, জেমস, সোলস , ওয়ারফেইজ, লতিফুল ইসলাম শিবলি , টিপু’র গল্পগুলো লিখেছেন ব্লগার কবি ও কাব্য ।
আইয়ুব বাচ্চু, মাকসুদ , মাইলস ও প্রিন্স মাহমুদ এর গল্পগুলো লিখেছেন মুখলেসুর রহমান সজল ( কম্পিউটার সায়েন্স , শাবিপ্রবি , সিলেট )
সংকলন সম্পাদনা ঃ কবি ও কাব্য *****
***আগামীতে বাংলা ব্যান্ড সংগীত এর ইতিহাসে চিরস্মরণীয় ব্যান্ড রেনেসাঁ, নোভা , আর্ক, উইনিং ও চাইম, বাপ্পি খান (গীতিকার), শহীদ মোহাম্মদ জঙ্গি (গীতিকার) , নিয়াজ আহমেদ অংশু (গীতিকার) জুয়েল বাবু ( সুরকার) নিয়ে ধারাবাহিক গল্পের মাধ্যমে আপনাদের বাংলা ব্যান্ড ইতিহাসের সর্বকালের সেরাদের সম্পর্কে জানানোর সামান্য চেষ্টার সমাপ্তি টানবো । ***






৩২টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

লালনের বাংলাদেশ থেকে শফি হুজুরের বাংলাদেশ : কোথায় যাচ্ছি আমরা?

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:১৪



মেটাল গান আমার নিত্যসঙ্গী। সস্তা, ভ্যাপিড পপ মিউজিক কখনোই আমার কাপ অফ টি না। ক্রিয়েটর, ক্যানিবল কর্পস, ব্লাডবাথ, ডাইং ফিটাস, ভাইটাল রিমেইনস, ইনফ্যান্ট এনাইহিলেটর এর গানে তারা মৃত্যু, রাজনীতি,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমেরিকার গ্র্যান্ড কেনিয়ন পৃথিবীর বুকে এক বিস্ময়

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৪১


প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে হাতে গাছের ডাল আর পরনে সাধা পোশাক পরিহিত এক মহিলার ভাটাকতে হুয়ে আতমা গ্র্যান্ড কেনিয়নের নীচে ঘুরে বেড়ায়। লোকমুখে প্রচলিত এই কেনিয়নের গভীরেই মহিলাটি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি! চুরি! সুপারি চুরি। স্মৃতি থেকে(১০)

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৪


সে অনেকদিন আগের কথা, আমি তখন প্রাইমারি স্কুলে পড়ি। স্কুলে যাওয়ার সময় আব্বা ৩ টাকা দিতো। আসলে দিতো ৫ টাকা, আমরা ভাই বোন দুইজনে মিলে স্কুলে যেতাম। আপা আব্বার... ...বাকিটুকু পড়ুন

যেকোন বাংগালীর ইন্টারভিউর সময়, 'লাই-ডিটেক্টটর' যোগ করে ইন্টারভিউ নেয়ার দরকার।

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৫ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:০৭



আপনার এনলাকার এমপি, প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী কামাল সাহেব, যেকোন সেক্রেটারী, যেকোন মেয়র, বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান, বিএনপি'র রিজভী, আওয়ামী লীগের ওয়ায়দুল কাদের, আপনার থানার ওসি, সীমান্তের একজন বিজিবি সদস্য, ঢাকার... ...বাকিটুকু পড়ুন

তাবলীগ এর ভয়ে ফরজ নামাজ পড়ে দৌড় দিয়েছেন কখনো?

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:২৬


আমাদের দেশের অনেক মসজিদে তাবলীগ এর ভাইরা দ্বীন ইসলামের দাওয়াত দিয়ে থাকেন। তাবলীগ এর সাদামাটাভাবে জীবনযাপন খারাপ কিছু মনে হয়না। জামাত শেষ হলে তাদের একজন দাঁড়িয়ে বলেন - °নামাজের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×