Rag কথাটা প্রথম শুনি যখন আমি বুয়েটের প্রথম বর্ষে, আশির দশকে। অবশ্য এটা সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের জন্য ছিল না, শুধু স্থাপত্যের চতুর্থ বর্ষের ছাত্ররা নবাগত প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের rag দিত। Rag এর দিন বিকালে স্থাপত্য ভবন আর লাইব্রেরীর মাঝের মাঠে স্থাপত্যের সব শিক্ষার্থীরা জড়ো হতো rag দেখার জন্য আর চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থীরা প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের নানা রকম কাজ করতে বলতো যেমন কাউকে বেসুরো গলায় গান গাইতে হবে, কেউ একপা তুলে দাঁড়িয়ে থাকবে এতক্ষণ না অনুমতি দেয়া হয় ইত্যাদি। শুরুতে বলা হতো নিজের নাম আর জেলার নাম বলতে হবে, কিন্তু নোয়াখালী বললেই প্রবল আপত্তি শুরু হতো সিনিয়রদের, নোয়াখালী বলা চলবে না... পুরো জিনিসটাই ছিল হাসি আর আনন্দের।
আমি বুয়েটের ছাত্র রাজনীতিও দেখেছি, ইউকসু নির্বাচন দেখেছি। ছাত্র ইউনিয়ন আর (নাম মনে নেই) কোন ছাত্র সংগঠনের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হত। প্রধানত ক্লাসে যারা ভালো ছাত্র কিংবা টেলিভিশনে বিতর্ক প্রতিযোগিতায় কৃতী বিতার্কিক কিংবা খেলোয়াড় হিসেবে পরিচিত তাদের এই নির্বাচনে দাঁড় করানো হতো যেন তাদের পরিচিতির কারণে ভোট বেশি পায়! নির্বাচনের আগে সকল প্রার্থীরাই শিক্ষার্থীদের সাথে দেখা করে ভোট চাইতেন, শুনেছি প্রতিদ্বন্দ্বীরা একসাথে ক্যাফেটেরিয়ায় বসে আড্ডাও দিতেন। দুই দলের সভাপতি প্রার্থী ছিলেন সহপাঠী, একজন ইলেকট্রিকালের ফার্স্ট বয়। তিনি হেরে গেলেন। রায় ঘোষণার পর দুই দলের পদ প্রার্থীরা একসাথে হলে হলে গিয়ে ছাত্রদের ধন্যবাদ জানালেন ভোট দেবার জন্য। যদিও হেরে যাওয়ার দলকে সবাই হারু পার্টি বলছিল, কিন্তু নির্বাচন প্রত্যাখ্যান বা মারামারি দূরে থাক, সামান্য মনোমালিন্যও হতো না। যারা নির্বাচিত হতেন, তাদের কাজ ছিল প্রধানত ছাত্রদের জন্য নানা সুবিধা আদায় করা, হলের নানা সমস্যার সমাধান করা এবং প্রধান কাজ ছিল পরীক্ষা আসলে পরীক্ষা পেছানোর জন্য আন্দোলন করা। চাঁদাবাজি খুনখারাবি এগুলো বুয়েটে তখন ছিল না।
বুয়েটে Ragging শব্দটা নতুন করে শুনলাম এই শতাব্দীতে, ২০১২ তে। সেসময় মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এর এক নবাগত ছাত্র, যার নাম ছিল সম্রাট, সে আজিমপুর বাসস্ট্যান্ডে বাস চাপা পড়ে মারা যায়। তারপর শোনা গেল আগের রাতে তাকে rag এর নামে হলে প্রচন্ড অত্যাচার করা হয় এবং সকালে সে এতটাই বিপর্যস্ত ছিল যে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় বাস চাপা পড়ে। এভাবেই আমার জানা হল এই যুগে র্যাগ কাকে বলে।
আমার ছেলে যখন বুয়েটে ভর্তি হলো, তখন সে যেহেতু হলে থাকতো না তাই তার rag কতটা কঠিন হয়েছিল জানিনা, কিন্তু সে কয়েকদিন কিছুটা বিপর্যস্ত ছিল। তারপর সে বুঝে গেল নিজেকে কীভাবে আক্রমণ থেকে বাঁচাতে হবে... সে ছাত্রলীগের কর্মী দু তিনজন ছেলের সাথে ভালো সম্পর্ক রেখে চলল, তাঁদের পড়াশোনায় সাহায্য করে।
কিন্তু তবু সমস্যা হল। ছেলের ক্লাসের সময় আমাদের গাড়ি পার্ক করে রাখা থাকতো। একদিন ড্রাইভার ফোনে জানালো, একটা ছেলে হেলমেট দিয়ে গাড়ির উইন্ডশিল্ড ভেঙ্গে দিয়েছে। সিকিউরিটি গার্ডের সাথে ফোনে কথা বলে জানলাম, সে অকারণে এটা ভেঙেছে এবং সিসি ক্যামেরায় তার ভাঙচুরের ছবি আছে। আমি ছাত্র কল্যাণ পরিচালকের সাথে গিয়ে দেখা করলাম, যিনি আমারও শিক্ষক ছিলেন। তিনি ফোন করে সিকিউরিটি গার্ডের থেকে ছাত্রের নাম জানলেন, চিনতে পারলেন ছাত্রলীগের এক পাতি নেতা বলে। আমার খুব জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করছিল, আমাদের বুয়েটে যেখানে কেবলই জ্ঞানের চর্চা হতো তার আজ এই অবস্থা হল কেন!! সেটা না জিজ্ঞেস করে আমি জিজ্ঞেস করলাম, ছেলেটা আমার গাড়ি ভাঙল কেন? তিনি দুই হাত দিয়ে মাথা চেপে বসে থাকলেন, তারপর বললেন,
- শক্তি প্রদর্শন করার জন্য...
সাধারণ ছাত্রদের উপর ছাত্রলীগের শক্তি প্রদর্শন চলতেই থাকলো, কিন্তু সেই খবর বাইরে আসতো না। আবরারের মৃত্যুর পর যখন বুয়েটের ছাত্রলীগ শক্তিহীন, তখন অনেক ঘটনা প্রকাশিত হতে লাগলো। তখন জানা গেল, অনেক ছাত্র অত্যাচারিত হয়ে বুয়েটে ছেড়ে গিয়েছে।
আবরারকে ঠান্ডা মাথায় কয়েক ঘন্টা ধরে ২৫/ ৩০ জন ছাত্রলীগ পিটিয়েছে, উল্লাস করেছে। কেন মেরেছে? আবরার ফেসবুকে একটা পোস্ট দিয়েছিল, যেখানে বলেছিল ভারতকে নিঃস্বার্থভাবে বাংলাদেশ সাহায্য করছে অনেকভাবে, অথচ ভারত তিস্তার পানি আটকে রেখেছে। এই পোস্ট পড়ার পর ছাত্রলীগ সিদ্ধান্ত নিল এমন পোস্ট দাতা শিবির না হয়েই যায় না, অতএব তাকে মারতে হবে। আবরারকে মেরে ফেলে লাশ শেরে বাংলা হলের সিঁড়ির কাছে রেখে তারা বিরিয়ানি খেতে গিয়েছে, ফিরে এসে টিভিতে ফুটবল খেলা দেখে মদ খেয়ে উল্লাস করেছে।
যখন তারা টিভি দেখছে, সেই সময় সাধারণ ছাত্ররা সিঁড়ির পাশের সিসিটিভির ফুটেজ খুলে নেয়, যেখানে দেখা যায় হেলমেট বাহিনী লাশ ধরাধরি করে এনে শুইয়ে রাখছে। এরপর সকালে বাহিনী বুয়েট মেডিকেল সেন্টারের এম্বুলেন্স নিয়ে আসে, আবরার অসুস্থ হয়ে পড়েছে তাই তাকে মেডিকেল সেন্টারে নিয়ে যাবে বলে। সেই সময় সাধারণ ছাত্রদের কেউ সাংবাদিকদের খবর দেয় এবং সিসিটিভির ফুটেজ তাদের হাতে তুলে দেয়। এই সাধারণ ছাত্রদের শিবির জঙ্গি ইত্যাদি বলে হত্যাকান্ড ধামাচাপা দেয়া গেল না, কারণ এই ফুটেজে সত্যি ঘটনা প্রকাশ পাবার পর কেবল বুয়েটের সাধারণ ছাত্ররা নয়, বুয়েটের অ্যালামনাইরাও ক্ষোভে ফেটে পড়েন। সে সময় বুয়েট এলামনাই এসোসিয়েশনের সভাপতি ছিলেন ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী, যিনি একজন সুপরিচিত ব্যক্তি ছিলেন। তিনি এবং অন্য এলামনাইরা একত্রিত হয়ে প্রতিবাদ এবং দোষীদের শাস্তি দাবি করতে লাগলেন। একজন এলামনাই ছিলেন অভিনেতা আবুল হায়াত। সাধারণ ছাত্রদের যেমন দেয়া যায়, এই এলামনাইদের কাউকে শিবির বা জঙ্গি তকমা দেয়া গেল না, কারণ অনেকেই জানে তাঁরা তা নন। এদের প্রতিবাদের মুখে বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ হয়, যাতে আর কোন ছাত্র এভাবে খুন না হয়। ফলে বন্ধ হয়ে গেল বুয়েটে ছাত্রলীগের কার্যক্রম।
তারপর চার বছর ধরে দেখা গেল ছাত্রলীগবিহীন বুয়েট ঝামেলাবিহীন ভাবে চলছে। অনেকবার ছাত্রলীগ ফেরার চেষ্টা করে ফিরতে পারেনি বুয়েটে। তাই শেষ পর্যন্ত মোক্ষম উপায় বেছে নিল, বলল বুয়েট শিবির জঙ্গি হিজবুত তাহরীরে ভরে গেছে, এদেরকে প্রতিহত করার জন্য ছাত্রলীগের প্রয়োজন!! শয়তানের ছলের অভাব হয় না কার্যোদ্ধারের জন্য। একটা ছল হচ্ছে গোয়েবলীয় মিথ্যা প্রচারণা, সাধারণ ছাত্রদের ট্যাগায়িত করা।
বুয়েট নাকি হিজবুত তাহরীরের আস্তানা, বুয়েট নাকি ছাত্রলীগের অভাবে মাদ্রাসা হয়ে গেছে!! অথচ এরা বোমা ফাটায়নি, কারোর রগ কাটেনি, অমুসলিম ভিসিকে চার বছরেও সরিয়ে দেয় নি!!...
আবরারের হত্যাকান্ডকে পাশবিক বলা যায় না, কারণ পশুও কখনো স্বজাতির একজনকে মেরে ফেলে না। একে বলা যায় নারকীয়। এই নারকীয় হত্যাযজ্ঞকে জায়েজ করার জন্য যারা নানা মিথ্যা ফাঁদছেন, তাদের জন্য অনিঃশেষ ঘৃণা!!
দুমড়ে মুচড়ে স্বপ্নের মালা আকাশ ছোঁয়ার সাধ
প্রিয় বাবা তুমি প্রস্তুত করো তোমার চওড়া কাঁধ।
আগে চড়েছিল ছোট্ট আমিটা, এবারে আমার লাশ
মুখোশে মুখোশ মানুষের সাথে শুয়োরের বসবাস।
সূত্রঃ আবরারের ছবি অন্তর্জাল থেকে, ছড়ার লেখক রোমেন রায়হান।
আবরারের মৃত্যুর পর লিখেছিলাম: হায় বুয়েট!
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:৩২