somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ছায়া দেখলেও মনে হয়, এই বুঝি কেউ...

১১ ই মার্চ, ২০১৩ দুপুর ২:৩০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সব দূরে সরে গেছে। সব দূরের মনে হয়। সরকার, রাষ্ট্র, রাজনীতি। তাদের কাছে তো আর আমার আতঙ্কের কথা বলতে পারি না। শুধু আছে কিছু প্রিয়জন, যেমন বাবা। তার কাছেই না হয় বলি আমার নিরাপত্তাহীনতার কথা, দেশের কথা, রাজনীতির কথা।


প্রিয় বাবা,
কেমন আছো? জানি খুব উৎকণ্ঠা নিয়ে তোমার দিন কাটে। হয়তো কাটেও না। ফোন দাও, ফোন রিসিভ করতে পারি না। বিরক্ত নিয়ে লাইনটা কেটে দিই। কখনো কখনো হয়তো রিসিভ করলেও তোমাকে বকা দিয়ে রেখে দিই, বলি ব্যস্ত আছি, তুমি বুঝো না!

আমার এই উচ্চস্বরে, বিরক্তিমাখা কথা শুনেও তুমি ক্ষান্ত দেও না। আবার ফোন দাও। বলো, বাবা তুই ভালো আছিস? টিভিতে দেখলাম ঢাকায় খুব গণ্ডগোল হচ্ছে। ঢাকার বাইরেও। তুই ভালো আছিস? নিরাপদে আছিস তো? তোরা সাংবাদিকতা করিস, রাত-বিরাতে বাসায় ফিরিস। সব ঠিক আছে তো? সমস্যা হলে বাসায় চলে আয়, চাকরির দরকার নাই। আমার যা আছে তা দিয়ে ভালোই কেটে যাবে।

বাবা, তোমার এইসব আবেগময় কথাকে কখনো পাত্তা দিইনি। সন্তানের জন্য তোমার দুশ্চিন্তা এতটুকো মূল্য পায়নি আমার কাছে। আজ খুব অসহায় হয়ে তোমার কাছে লিখছি। ফোন দিতে পারতাম। তবে কথাগুলো হয়তো গুছিয়ে বলতে পারবো না, বা আবেগের কারণে থেমে যাবে, তাই লিখে পাঠালাম।

তুমি আমার মতো বিরক্ত হচ্ছো না তো। জানি, হবে না। কারণ তুমি আমার বাবা, সন্তান নও! সন্তানরাই বরং বিরক্ত হয়।

ভালো নেই বাবা। আমি ভালো নেই! অনিরাপদ আর নিরাপত্তাহীনতায় কাটে আমার প্রতিটি মুহূর্ত। কখন কী যে হয়ে যায়, কে জানে! জানোই তো দেশের কী অবস্থা। জীবনের ন্যূনতম নিরাপত্তা নেই। মাঝ রাতে যখন বাসায় ফিরি প্রচণ্ড ভয় হয়। ছায়া দেখলেও মনে হয়, এই বুঝি কেউ...।

খুব মনে আছে, ছোটবেলায় ভয়ের কোনো স্বপ্ন দেখে যখন ঘুম ভাঙতো, তুমি আগলে রাখতে আমায়। বুকের মধ্যে চেপে ধরে বলতে কোনো ভয় নেই, আমি আছি। সেই ছোট্ট আমিটি গুটিসুঁটি মেরে তোমার বুকের মাঝে নিরাপত্তার চাদরে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে থাকতাম।

জান বাবা, আজ আমি সেই নিরাপত্তার চাদরটা খুব মিস করি। খুব ইচ্ছে হয়, সব ছেড়েছুড়ে তোমার বুকের মাঝে হারিয়ে যাই। মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলির কথা তোমার কাছ থেকেই আমার জানা। তোমার চোখেই আমি দেখেছিলাম প্রথম মুক্তিযুদ্ধ। পাকিস্তানিদের সেই বর্বরতা, সাহসী মুক্তিবাহিনীর এক একটা অপারেশনের বর্ণনা যখন তুমি দিতে, অদ্ভূতরকমের জ্বলজ্বল করতো তোমার চোখ। আমি সেই চোখে স্বাধীনতাকে অনুভব করতে শিখেছিলাম। কী ভীতিকর সময়ের মধ্য দিয়ে না তোমরা এক-একটা দিন পার করেছো, আজ ২০১৩ সালে এসে আমি ঠিক উপলব্ধি করতে পারি।

ভাবছো, ৭১’র সঙ্গে কী আর ২০১৩ এর তুলনা চলে! চলে বাবা, চলে। ৭১’এ মুক্তির যুদ্ধ হয়েছিল। দেশের জন্য, মায়ের জন্য, সম্মানের জন্য, সম্ভ্রমের জন্য। এখনো তাই হচ্ছে। তবে ৭১’এ দেশপ্রেম ছিল, রাজনীতি ছিল দেশের জন্য। এখন মোটাদাগে সেটা দেখি না।

টেলিভিশনের কল্যাণে হয়তো এতক্ষণে জেনে গেছ, গতরাতে সুরকার আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের ছোটভাই খুন হয়েছেন। কেন তাকে হত্যা করা হয়েছে জানো বাবা? তাকে মারা হয়েছে কারণ, সুরকার বুলবুল যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের বিরুদ্ধে সাক্ষী দিয়েছিলেন। যে লোকটি একটি ন্যায় বিচারের জন্য গত সাত মাস ধরে গৃহবন্দি জীবন-যাপন করছেন, তোমাদের সরকার তাকে নিয়ে এতটুকু ভাবলো না, নিরাপত্তার কথা চিন্তা করলো না! এই হলো তোমাদের স্বাধীন দেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক-বাহক একটি দলের চরিত্র। ভাবছো বাকিদের কথা কেন বলছি না! কারণ ওরা তো নষ্টের চেয়েও নষ্ট, পচে যাওয়া, দুর্গন্ধময়। ওদের নিয়ে ভাবতেও ঘেণ্না হয়।

ছোটবেলা থেকে তুমি শিখিয়েছো, রাজনীতি হবে জনগণের জন্য। রাজনীতি হবে দেশের জন্য। রাজনীতি হবে সার্বভৌমত্বের জন্য। এখন আর আমি রাজনীতির মাঝে জনগণ, দেশ, সার্বভৌমত্ব খুঁজে পাই না। আমার কাছে মনে হয় আপোষ আর ক্ষমতার অপর নাম রাজনীতি। আমার কাছে মনে হয়, চেতনা নিয়ে ব্যবসার অপর নাম রাজনীতি।

যদি তাই না হবে তাহলে কেন তোমাদের সরকার নিরাপত্তা দিতে পারছে না? কেন সহিংসতাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারছে না? কেন ওইসব নরপশুরা আমাদের মনে উল্টো ভয় ঢুকিয়ে দিতে পারছে? তোমার কী মনে হয় না বাবা, এখন রাজনীতির গুণগত পরিবর্তনের আরেকটা সংষ্করণ হলো এই ‘ভয়’ নিয়ে রাজনীতি? সবপক্ষই আমাদের মনে ভয় ঢুকিয়ে দিতে চাইছে? আমাদেরকে ভীত-সন্ত্রস্ত করে পক্ষে নিতে চাইছে? তুমি বলতে- মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রশ্নে নিরপেক্ষ থাকার কোনো অর্থ নেই। কোন পক্ষে যাবো বাবা? একপক্ষে তো পচে যাওয়া ভ্রষ্ট দুর্গন্ধ ছড়ানো দেশবিরোধী গোষ্ঠী, আর অন্যপক্ষে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক-বাহক অথচ ব্যবসায়ী দৃষ্টি।

সাংবাদিকতার এক দশকেও আমি পক্ষ খুঁজে পাইনি- এটাই কী ব্যর্থতা নয়?

জান বাবা, রাজনীতির গুঁটি হয়ে আমাদের নিয়ে ওরা চালাচালি করে, আর আমরা মৃত বা জীবিত গুঁটি হয়েই চলতে থাকি। আর তাই ইদানিং প্রচণ্ড পরাধীন মনে হয় নিজেকে। স্বাধীন কবে হবো জানি না। তবে মনের পরাধিনতা কাটাতে সময় লেগে যাবে। আমার মন অবরুদ্ধ হয়ে গেছে। মুক্তির জন্য আবার তোমারই স্মরণ নিলাম। এর চেয়ে আপন আর কে বাবা। আমাদের সরকারগুলো যদি একটু আপন হতো, একটু দরদ দিয়ে আমাদের কথা চিন্তা করতো। এতটুকু।

অনেক কথাই লিখে ফেললাম বাবা। জানি তুমি কাঁদছো। কাঁদছো তোমার সন্তানের জন্য। কিন্তু কারো কী এভাবে মন কাঁদে এই আমাদের জন্য? এই দেশটাকে এত ভালোবাসি, এতো প্রেম, তবুও কেন মনে হয়- দেশই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে! যদি কিছু হয়ে যায় আমাদের গ্রামের বাড়ির দীঘিরপাড়ে যে ছাতিম গাছটা আছে তার নিচে আমাকে আশ্রয় দিও। ছোটবেলা সেটা আমার অনেক প্রিয় ছিল, শুনেছি তোমারও।

ইতি,
তোমার সন্তান, একজন বাঙালি
৩টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

×