নিজের পেশাটাকে মনে মনে অভিশাপ দিতে দিতে জিসান ট্রেনের টিকেট কিনতে গেল। আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই। ঈদের আগের দিন ও ডিউটি করতে হয়। এখন যদি ট্রেনের টিকেট না পায়! মা সারা বছর ঈদের জন্য ওয়েট করে। এই সময়টাতেই ও বাসায় যায়। আর ও কিনা বাড়ি যাচ্ছে ঈদের আগের দিনে। তাড়াহুড়া করে ব্ল্যাকে দ্বিগুণ দামে একটা টিকেট ম্যানেজ করল। ট্রেন ছেড়ে দিচ্ছিল। কোন মতে দৌড়ে উঠলো সে।
ধ্যাত! সিট এক মহিলার পাশে। বোরখাওয়ালি যাই হোক, সিট তো একটা পেয়েছি। দাঁড়িয়ে যেতে হচ্ছে না, এই ভাবতে ভাবতে বসে পড়ল ও।জিনিসপত্র ঠিকমত রাখতে না রাখতেই মায়ের ফোন ।- হ্যাঁ মা, ট্রেনে উঠলাম। বাসায় পৌঁছুতে দেরি হতে পারে।
একটু স্থির হয়ে বসতে না বসতেই আবার ফোন! ঘুম ঘুম চোখে আবার পকেট থেকে ফোন বের করে দেখে কোন কল নেই। আর তখন পাশের মহিলাটা পার্স খুলে তার ফোন রিসিভ করল। রিংটোন একই! জিসান একটু অবাক হল। আর যাই হোক মহিলার কণ্ঠস্বর ভালই। কোথায় যেন শুনেছি শুনেছি মনে হচ্ছে! যাই হোক ক্লান্তিতে ঘুম নেমে আসছিল ওর। ঘুম আসতে না আসতেই আবার ঘুম ভেঙ্গে গেল। এবার পাশের মহিলার ডাকে। মহিলা হকারকে ডাকছে। একটা পানির বোতল কিনে পানি খাওয়া শুরু করল। অদ্ভুত! এই মহিলাকি রোজা ও রাখে নি! ও আচ্ছা অনেকেরই তো মেয়েলি সমস্যা থাকতে পারে। আশ্চর্য! আমি এই মহিলাকে নিয়ে এত ভাবছি কেন? জিসান মনে মনে বলতে লাগলো।
একটু পরে আবার ঘুম ভেঙ্গে গেল। কি ব্যাপার ট্রেন থেমে গেল কেন? পাশের এক লোক বলে উঠলো, আরে বলবেন না ভাই। ইঞ্জিন খারাপ হয়ে গেছে। পথে কোথায় জানি আরেকটা বগিচ্যুত ও হয়েছে। কখন যে ঠিক হবে তার কোন গ্যারান্টি নাই। বাংলাদেশের রেলওয়ে বলে কথা! জিসান নেমে গিয়ে খবর নিয়ে আসলো। আসলেই কবে ঠিক হবে তার কোন ঠিকানা নাই। ট্রেন এখন খেতের মাঝখানে। দুপাশে বিস্তীর্ণ সবুজের সমারোহ। আরেক লোক খবর দিল , মাইল পাঁচেকে হাঁটলে ছোটখাটো একটা বাজার পড়বে। সেখান থেকে ভ্যানে করে বাস স্ট্যান্ডে যাওয়া যাবে। সন্ধ্যা নামার আগে আগে বাজারে পৌঁছাতে হলে এখনই রওনা দেয়া দরকার।
ক্লান্ত শরীরে এত পথ হাঁটতে ইচ্ছা করছিল না। কিন্তু যাবে না যাবে না এটা ঠিক করতে করতেই দেখা গেল বগি প্রায় খালি। ঈদের দিনটাও যদি মায়ের সাথে কাটাতে না পারে মা অনেক মন খারাপ করবে। তাই জিসান হেঁটে যাবার সিদ্ধান্ত নিল। ব্যাগটা হাতে নিয়ে নামার প্রস্তুতি নিতেই খেয়াল হল আরে বগিতে শুধু পাশের ঐ মহিলা একা বসে! মহিলার দিকে ফিরে কিছু বলার আগেই মহিলাই বলে উঠলো, চলুন আমি আপনার সাথে যাব। একদম সোজাসুজিই ! অপরিচিত এক ব্যাক্তির সাথে যেতে একটু বিব্রত ও হলনা! যেন পরিচিত কারো সাথে কথা বলছে।জিসান মনে মনে অবাক হল।
******************
অনেকদিন পর এমন খোলা মাঠে হাঁটছিল। ফুরফুরে বাতাস । নানা কথা ভাবতে ভাবতে নিজের মাঝেই হারিয়ে গেল জিসান। ভুলেই গেল পাশের মহিলার কথা। হটাত পাশের মহিলার কথায় আবার ভাবনার জাল ছিন্ন হল। - আমার একটু পানি খাওয়া দরকার।পানি শেষ। একটু দূরেই একটা বাড়ি দেখা যাচ্ছিল মাঠের মাঝে। গিয়ে এক কৃষাণীকে পানির কথা বলতেই অবাক চোখে এক জগ পানি এনে দিল। মহিলাটি নিজের বোতল পুরিয়ে নিল। আর উঠানের এক কোণায় গিয়ে মুখের নেকাব খুলে মুখ ধুয়ে নিল। কিন্তু মুখটা দেখার সুযোগ হল না জিসানের । ছি , আমি কি করছি! জিসান মনে মনে লজ্জা পেলো।
ওরা আবার হাঁটতে লাগলো । অল্প কিছুদূর যেতে না যেতেই পেছন থেকে ডাক। ও ভাই, ও লিলা কোর্তাওয়ালা ভাই। একটা ছোট্ট কিশোরী দৌড়ে আসছে। জিসান একটু এগিয়ে গেল মেয়েটার দিকে। মেয়েটার হাতে কলাপাতায় মোড়া কিছু চিড়া আর দুইটুকরা গুড়। আপনের বউএর লাইগা মায় দিছে। কইসে পোয়াতি কালে খালিপেটে থাকতে নাই। বলেই ফুড়ুৎ করে চলে গেল চড়ই পাখির মত।
ও মাই গড! মহিলা প্রেগন্যান্ট! ছি , আমি এতক্ষন ধরে আছি আর বুঝতেই পারি নি। আর ঐ কৃষাণী বুঝে ফেলেছে। এই অবস্থায় মহিলা এতক্ষণ ধরে হাঁটছে। হাতে একটা ব্যাগ। নিজের উপর নিজেরই লজ্জা আর রাগ হতে লাগলো জিসানের। মহিলার কাছে গিয়ে ও বলল, ঐ কৃষাণী আপনার জন্য এই খাবার পাঠিয়েছে। এই সময় বেশিক্ষন নাকি খালি পেটে থাকতে নেই। নিন আর দিন ব্যাগটা আমাকে দিন। মহিলা প্রথমে একটু ইতস্তত করলেও পরে ব্যাগটা দিল।
আশেপাশে আস্তে আস্তে ঘর বাড়ি দেখা যেতে লাগলো। একটু পরেই ওরা ছোট বাজারটায় পৌঁছুলো। ভ্যান নিয়ে বাসস্ট্যান্ডে যেতে যেতে সন্ধ্যা। দুজনে একসাথেই টিকেট কাটল। আজানের পর বাস ছাড়বে। কিছু খাবার কিনে এক চায়ের দোকনে বসল। ইফতার করতে করতে জিসানই কথা তুলল। আপনি কোথায় যাবেন?_বাঁকখালি।কে
থাকে ওখনে?আপনার স্বামী?- আমার বাবার বাড়ি। জিসানের একটু খটকা লাগলো। বাঁকখালি কার বাড়ি? - হাজি বাড়ি।
কথাটা শোনার পরে জিসানের পৃথিবী নড়ে উঠলো। সামনের দুনিয়াটা ঝাপসা হয়ে উঠলো। শ্রুতি!! হাজিবাড়ীর একমাত্র মেয়ে, জিসানের জীবনের একমাত্র ভালোলাগা । ধাক্কাটা সামলাতে অনেকটা সময় লাগলো। তাই বাসে উঠেও অনেকক্ষণ কথা হল না। পরে সেই শুরু করল। তুমি একা একা ! হাজবেন্ড আসতে দিল এই অবস্থায়?
- হাজবেন্ড আর নেই। শ্রুতি নির্লিপ্ত কণ্ঠে জবাব দিল।
জিসান আরেকটা ধাক্কা খেল। কিভাবে?
- আমি ওকে খুন করেছি। মুখের নেকাবটা খুলত খুলতে আস্তে আস্তে জবাব দিল। ওই মুখের অর্ধেকটা এসিডে ঝলসানো। - ও একটা পশু ছিল। আমার সন্তানের এমন বাবা থাকার চেয়ে বাবা না থাকাই ভাল। আমি ওকে বড় করব এক আদর্শ , ভালো মানুষ বাবার গল্প শুনিয়ে। যাতে ও গর্ব করতে পারে।
*******************************************************************
ঈদের দিন সকালে জিসান এসে পৌছুলো। রান্না ঘরে গিয়ে দেখে মা সেমাই জর্দা রান্না করে চুপি চুপি আঁচলে চোখ মুছছে। অর্ধেক পথে ফোনের চার্জও শেষ। তাই আর খবর ও দেয়া হয়নি। ও পেছন থেকে মাকে জড়িয়ে ধরে বলল, মা তাড়িতাড়ি সেমাই খেতে দাও।নামাজের দেরি হয়ে গেল। তুমি না বলতে ,ঈদের নামাজের আগে মিষ্টি কিছু খাওয়া সুন্নত !
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে জুন, ২০১৫ বিকাল ৩:১৬