-আম্মা গরু নিতেন না? কাইল তো কুরবান! রাস্তাত কত মানুষেরে দেখছি কত্ত বড় বড় গরু কিইন্না লইয়া যায়।
-কুরবানের আনন্দ কি আর সবার লাইগ্যা আহে বাপজান!?
-ক্যান?!আমরা কুরবান দিতাম না? গোস্ত খাইতাম না?
-খাইতি না কিল্লাইগা! আমি কাইল সক্কাল সক্কাল ঘুম থেইক্যা উইঠাই বাইরে যাইয়্যাম গোস্ত আইনতে।
হালিমা আমাদের সমাজের একজন ভিখারিনী। পনেরো বছর পাড় হতে না হতেই মধ্যবয়স্ক ঠেলাগাড়ি চালক করিমের সাথে বিয়ে হয়।বিয়ের এক বছরের মাথায় করিম দুনিয়া ছাড়ে। তার বিদায়ের পর পরই উত্তরাধিকার আসে পৃথিবীতে। কিভাবে
ছেলেটা মানুষ করবে তা নিয়ে খুব চিন্তায় পড়ে গেলো হালিমা। এক ধনীর বাড়িতে যায় কাজের সন্ধানে।বাড়ির মালিক মধ্যবয়স্ক।
সেও একদিন সুযোগ খুঁজে নিলো। তারপর আর কি!আত্মহত্যার কথা ভাবে হালিমা। যতবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে ততবারই বাবুর
কথা মনে পড়ে। বেঁচে থাকাটা দরকার ছিলো স্বামীর দেয়া প্রদীপের জন্য।এই প্রদীপ কখনো নিভে যেতে দিবে না সে। তাই
সমাজের মানুষগুলোর প্রতি মাথা নত করে ভিক্ষার পথ বেছে নেয়। বাবু বড় হতে থাকে হালিমার ভিক্ষার উপার্জনে।
ছয় বছরের ছেলেটা বুঝতে শিখেছে কোরবান কি জিনিস! তাই আজ মাকে অভিমান নিয়ে ধরেছে গরু কিনতে। হালিমা সকালে গোস্ত নিয়ে আসবে বললে বাবু কোনোভাবেই তা মানতে রাজি নয়। তার
আজই একটা বিরাট গরু লাগবে।অন্য বাচ্চাদের মতো গরু নিয়ে খেলবে।গরুর মুখে খড়কুটা তুলে দিবে। রাত এগারোটা পাড় হয়েছে। ছেলেটার আব্দার বেড়েই চলছে। তার চোখে মুখে পানি। বড় রাস্তার পাশের ডাস্টবিন থেকে কুড়িয়ে আনা ভারি বিছানাটা তার চোখের
পানিতে ভিজে যাচ্ছে।
-আম্মা তুমি যাও না ক্যান? গরু আনো না ক্যান?
-বাপজান আমার কাছে ত ট্যাকা নাই। গরু কি দিয়া কিইন্নাম।
হালিমা নিজেও তার চোখের পানি আটকাতে পারলো না। ছেলের কান্নায় তার বুক ফেটে যাচ্ছে।হালিমা ছেলেকে আঁকড়ে
ধরে কান্নার মাত্রা আরো বাড়িয়ে দেয়। এই পরিস্থিতিতে ছেলেকে না সামলে নিজেই মরা কান্না জুড়ে দেয়।
আসলে মায়েদের অন্তর যতটা নরম হয় ততটাই সস্তা হয় তাদের চোখের পানি। সন্তানের কষ্টে খরচ করার জন্য সৃষ্টিকর্তা নিজেই
হয়তো আলাদাভাবে তাদের চোখের নিভৃতে একটা নলকূপ বসিয়েছেন। আর সেই নলকূপের পানি হালিমার চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে।
রাত্রির গভীরতা বাড়ছে। হালিমা ছেলেকে নিয়ে শুয়ে আছে। বাবু গভীর নিদ্রায় তলিয়ে। চারদিক নিশ্চুপ। সকাল হলেই কোরবানের
আমেজ ছড়িয়ে পড়বে চারদিকে।। এই ছোট্ট বাবুর চোখটাই শুধু কান্নায় ভিজবে।
সকাল আটটা। শয়ে শয়ে মুসল্লি ঈদের নামাজ আদায় করে ফিরছে। সবার মধ্যেই খুব তাড়াহুড়োর একটা ভাব। কিছুটা সময় পর
একটা গরু চুরি যাওয়ার আনাগোনা শুরু হয়। চারদিকে খুব চেঁচামেচি হচ্ছে।। লোকজন গরু খোঁজতল্লাশিতে বেড়িয়ে পড়ে।
বাবু একটা লাল গরু নিয়ে আনন্দমেলা জমিয়েছে। শেষরাত থেকেই এই আনন্দ বিরতিহীনভাবে চলছে। মাঝেমাঝে গরুর মুখে
খড়কুটা তুলে দেয়। পাশেই হালিমা বসা। সন্তানকে চোখের আড়াল করছে না। বাবু জানে না অল্প সময় পর তাদের সাথে কি
হতে যাচ্ছে।! হালিমার চোখ বড় রাস্তার দিকে। বিরাট মাত্রার ঝড়ের জন্য অপেক্ষায় আছে তার দেহ-মন।
#সাড়ে_পাঁচ_ঘন্টা_পূর্বে
______________
এই রাতে এইটুকুন একটা ছেলেকে একলা রেখে বের হওয়াটা ঠিক হচ্ছে না। কিন্ত ঘুুমন্ত ছেলের মুখে কান্নার শুকনো দাগ
হালিমাকে আর থামাতে পারলো না। বেরিয়ে পরলো রাতের অন্ধকারে। বড় রাস্তার দুপাশে বিশাল বিশাল দালান। দারোয়ানের চোখ ফাঁকি দিয়ে একটা দালানের দেয়াল টপকে ভিতরে প্রবেশ করলো। দারোয়ানের মুখে রোমাল ছুঁইয়ে পা
টিপতে টিপতে ভিতরে এগুতে থাকে। রোমালে কি ছিলো আমার জানা নেই। তা শুধু হালিমাই জানে। এইবার একটা লাল গরু
বাঁধন থেকে খুলে গেইটের দিকে আগায়। গরুটা হালিমার কষ্টের পরিমাণ অনুভব করতে পারছে। হয়তো সে কারণেই শান্ত থেকে
হালিমাকে সহযোগীতা করছে। তা না হলে একটা গরু এতটা শান্ত থাকার কথা নয়। নিরবে গেইট খুলে গরু নিয়ে সোজা ঘরমুখো হয়
হালিমা।
#বর্তমান
__________
হালিমার দৃষ্টি এখনো বড় রাস্তার দিকে। লোকজন ছুটে আসছে। সবার হাতে ছোট-বড় লাঠি।হালিমা ছেলেকে টান দিয়ে কোলে
তুলে নিলো।এবার যৌবনকালের সমস্ত শক্তি ঢেলে দিলো দৌঁড়ের মধ্যে। কিন্তু কতদূরই বা যাওয়া যায়। খানিক সময়ের মধ্যেই ধরা
দিতে হয়। খুব মারধোর চলতে থাকে। হালিমার কান্নায় আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামে।
কান্নার স্বরে মিনতি করে যাচ্ছে সে । তার মিনতি বা কান্না কোনটাই লোকজনের দৃষ্টি কাড়ে না। লাঠির একটা আঘাত লাগে তার
মাথার ঠিক মাঝখানে। ছেলেটাকে একপাশে জোরপূর্বক আটকে রাখা হয়। তার চোখের পানিও যেন থামতে চায় না।
হালিমার ভিক্ষুক প্রতিবেশীরা পুরো ঘটনাটা খুব আমেজ নিয়ে উপভোগ করে। কিছুক্ষণ মধ্যে জায়গাটা জনশূন্য হয়ে যায়।
বৃষ্টির মাত্রা কমে আসছে। হালিমা মাটিতে পরে আছে। তার দেহ থেকে গড়িয়ে পড়া রক্ত বৃষ্টির পানিতে ধুইয়ে গেছে। বাবু তার
দেহের পাশে বসে মা মা করে কাঁদছে আর গাল টিপে দিচ্ছে।মাঝেমাঝে কপালে চুমুও খাচ্ছে।
কি ভাবছেন? হালিমা জীবিত আছে কি না? নাহ! হালিমা আর জীবিত নেই। সে দুনিয়াকে বিদায় জানায় নি। দুনিয়া তাকে বিদায় করে
দিয়েছে। তাও আবার জোরজবরদস্তি করে। আমি জানি না বাবু নামের ছয় বছরের বাচ্চাটার ভবিষ্যৎ কি! অন্যকেউ জানে কি
না সেও আমার অজানা।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৪:৫১