"আমার বিশ্বাস আমরা কেউ অভিনয় করিনি। যদি করেও থাকি, কখনো কেউ জানতেই
পারবো না কেউ একজন অভিনয় করেছিলাম।" কথাটা আমার নয়। কথাটা বলেছিল আতিক। বেশ কয়েকদিন আগে।ধরুন ৫-৬ বছর তো হবেই। এই দুইটা বাক্যই বোধয় আমাদের বন্ধুত্বটা এখনো বাঁচিয়ে রেখেছে। আমরা '০৯ সালের এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিলাম। আতিক আর আমার সিট পড়েছিল ক্লাসের লাস্ট দুটো বেঞ্চে। একটা হাসির কথা বলি, তার সাথে সেই ক্লাসরুমেই আমার প্রথম আলাপ। প্রায় তিন বছর একই স্কুলের ক্লাসমেট থাকা সত্ত্বেও স্কুলজীবনের শেষ মুহূর্তে আলাপ হওয়াটা সত্যিই হাস্যকর।
অল্পেই তাকে বন্ধু ভাবতে শুরু করলাম।সেও শুরু করলো। পরে অবশ্য বুঝতে পেরেছিলাম ওসব বন্ধু টন্ধু কিচ্ছু না। সব তার দেখার ধান্দা ছিলো। আমি এমনটা কেনো বলছি শুনুন। বাংলা দ্বিতীয় পরীক্ষার দিন সে বললো,
- দোস্ত, তোর মত বন্ধু হয়না।
-কি যে বলস!
- হ্যা দোস্ত সত্যি। দোস্ত তুই কি অনুবাদটা লিখছোস? আমারে দেখা।
-হ্যা লিখছি,ওয়েইট!
ম্যাথ পরীক্ষার দিন তো ক্লাসে ব্যোম ফাটাইতেছিলো। কি বলেছিলো শুনুন,
- দোস্ত পরীক্ষা শেষ হইলে তোরে আমাদের গ্রামে নিয়ে যাবো।গ্রামে অনেক সুন্দর সুন্দর মেয়ে আছে।তোর পাশে হ্যাব্বি লাগবে।
- আরে দোস্ত এইভাবে বলস কেন! আমার মত ছেলের সাথে কাউরে মানাবে না যে আমি জানি।
- না দোস্ত তোর ফেইসটা পুরা রানবীর কাপুরের মত। দোস্ত আমারে আট নাম্বার অংকটা দেখাইস।
এইবার বুঝেন!
এনিওয়ে পরীক্ষার পাশাপাশি
হাসি ঠাট্টা চলতে থাকে। কয়েকবার আমাদের খাতার উপর স্যারদের হামলা হয়েছিলো। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কানের লতি টেনে অন্যান্য পরীক্ষার্থীদের বিনোদন দেয়ার মত সুবর্ণ সুযোগও হয়েছিলো একবার। যাকগে স্যাররা কত সুযোগই করে দেয়।থাক সেসব। পরীক্ষার কক্ষেই আতিক তার জীবনের প্রথম ক্রাশের আপাদমস্তক আমার মস্তকে গেঁথে দিলো। আপাদমস্তক শুনে আমাদের ব্যাপারে মনে কোনো কুচিন্তা প্রবেশ করাবেন না। আপাদমস্তক দিয়ে মেয়েটার ফার্স্ট টু লাস্ট সব ইতিহাস বুঝানো হয়েছে। মেয়েটা বেচারার
নাওয়াখাওয়ার সর্বনাশ করে ছেড়েছিলো। মেয়েটা কি তার শুধুই ক্রাশ ছিলো! নাকি
অন্যকিছু? এসএসসি পরীক্ষা শেষ। পরীক্ষা শেষ হতে না হতেই আমাদের কুঁচোচিংড়ি ক্রাশকে পটানোর মিশনে নেমে পড়লো। অহ একটা কথা বলা হয়নি।আমার বন্ধুটা খুবই চিকনা। কুঁচোচিংড়ি নামটা পারফেক্ট তো? নামটা আগে মাথায় আসেনি।এখনই আসলো। ক্রাশকে একনজর দেখার জন্য সকাল-দুপুর-বিকেল তারই বাসার সামনে-পিছনে কখনো রিকশায় কখনো দাঁড়িয়ে থেকে অপেক্ষার শেষ মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করতো। কি ভাবছেন? সে একা একা অপেক্ষা করতো কিনা? না ভাই, তার সাথে আমি হাসান চিকনাইয়্যাও অপেক্ষায় থাকতাম। আর মনে মনে কুঁচোচিংড়ির চৌদ্দগুষ্ঠিরে ধুইতাম। অজাতে আমার নাওয়াখাওয়াও বন্ধ করে দিয়েছিলো। অপেক্ষায় বিরক্ত হয়ে তাকে
কত যে খেঁচকা টান দিয়েছিলাম লিখে প্রকাশ করা যাবে না। সে সবকিছুই পারতো। ভালো লিখতে পারা, গাইতে পারা এই সব কিছুই তার কাছে ওয়ান-টুর ব্যাপার ছিলো। শুধু ব্যোমযানের মত উড়ে মেয়েটার কাছে গিয়ে মনের কথা জানিয়ে দেয়ার মত
সাহসিকতার কমতি ছিলো। খোন্তা দিয়ে তার বুকটা খুঁড়ে দিলে হয়তো দেখা যেত কতটা ভালোবাসা পুষে রেখেছিলো মেয়েটার জন্য।
মেয়েটার ব্যাপারে বলি, মেয়েটার নাম মেঘনা। খুবই শান্তশিষ্ট মেয়ে। হিজাব ব্যবহার মুসলিম মেয়েদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এই নিয়মটা সে সর্বদা মেনে চলে। গায়ের রং শ্যামলা। চোখ চারটা। অবাক হওয়ার কিছু নেই,মেয়েটা চশমা পড়ে। সুস্বাস্থ্যের অধিকারী। যার পাশে আমার কুঁচোচিংড়ি বন্ধুকে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। আর সবচাইতে বড় কথা হলো মেঘনা তার চেয়ে এক বছরের বড়।
এসএসসি'র পর কুচোচিংড়ি টানা দুই বছর মেঘনার বাসার সামনে দাঁড়িয়ে তার ঘরের বন্ধ কালো গ্লাসটার দিকে তাকিয়ে থাকতো। কোনোদিন তার প্রিয় মুখটার দেখা মিলে নি। তারপর হঠাৎ একদিন খবর পাওয়া গেলো মেঘনারা স্বপরিবারে কলকাতা চলে গেছে। এরপর আমরাও এইচএসসি শেষ করে ভার্সিটি এডমিশন টেস্ট দিলাম। দু'জনেই ঢাকা ভার্সিটিতে চান্স পেলাম। পরিবারকে চিটাগং রেখে দু'জনেই ভার্সিটির হোস্টেলে উঠলাম।
মেঘনা চলে যাওয়ার পর কুচোচিংড়ি খুবই ভেঙে পড়েছিলো। ঠিকমত খাওয়াদাওয়া করতো না। তাকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে কতটা কষ্ট হয়েছিলো তা শুধু আমিই জানি। তবে এখনো তাকে মেঘনা মেঘনা করে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে দেখা যায়।
ভার্সিটিতে প্রায় দুই বছর পার করেছি। পড়াশুনা নিয়ে খুব ব্যস্ত সবাই। ক্লাসের সবচে বয়স্ক ছাত্র আজিম ভাই। গত তিন বছর এই ক্লাসেই পড়ে আছেন। আজিম ভাইয়ের একটা ভালো গুণ হলো জুনিয়র কারো সাথে কখনো খারাপ আচরণ করেন না। তাই ক্লাসে যথেষ্ট সম্মান পান এবং সবাই তাকে আপনি করে সম্বোধন করে।
আজ ভার্সিটি না গিয়ে কুচোচিংড়িকে নিয়ে সাভারে যাওয়ার জন্যে বের হলাম। রিকশায় উঠলাম। কুচোচিংড়ি বললো,
- দোস্ত চল চিটাগং যাই। আম্মারে মনে পড়তেছে খুব।
- গত মাসেই তো গেলি! আচ্ছা ঠিকাসে যাবোনে!
এক সপ্তাহ পর চিটাগং আসলাম। দুই দিন কাটিয়ে আবার ভার্সিটি ফিরতে হবে। ইম্পরট্যান্ট ক্লাস আছে। বাবামা আর রুবাকে নিয়ে বান্দরবন ঘুরতে গেলাম। সঙ্গে আতিক আর তার ফ্যামিলিও গেলো।খুব মজায় কাটলো। যে কয়দিন চিটাগং ছিলাম,একটা সকাল কিংবা বিকাল মেঘনার বাসার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বাদ যায় নি। একইভাবে আতিকের সেই কালো গ্লাসটার দিকে তাকিয়ে থাকা। যেমনভাবে টানা দুইটা বছর তাকিয়ে ছিলো। যতবার চিটাগং আসি ততবারই এইখানে এসে দুজনে সময় কাটাই। মেঘনার দেখা মিলেনি কোনোবারই। এবারো মিললো না। দুইদিন থাকার জন্যে এসে আট দিন বেড়িয়ে তবেই ঢাকা ফিরলাম।
সকাল দশটা হয়ে গেলো। ঘুম থেকে উঠে ক্যান্টিনে গেলাম নাস্তা আনতে। আতিক ঘুম। কাল মাঝরাতেও মেঘনার জন্যে খুব কেঁদেছিলো। তাই এখনো ঘুম ভাঙ্গছে না। আজিম ভাই ক্যান্টিনে বসে সিগারেট টানছেন।
-কি খবর হাসান? চিটাগং থেকে কবে ফিরলি?
-জ্বী গতকাল দুপুরে আজিম ভাই।
নাস্তা নিয়ে ফিরছি। খেয়াল করলাম হোস্টেলের বাইরে একটা বোরখা পরা মেয়ে দাঁড়িয়ে। অবাক হলাম। বয়েজ হোস্টেলের বাইরে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে থাকা অবশ্যই ভাবনার বিষয়। মনে হচ্ছে কাউকে খুঁজছে। মেয়েটার কাছে গেলাম।
- কাউকে খুঁজছেন?
- জ্বী আমার নাম মেঘনা। আতিকের খোঁজে আসছি।
আমার চোখ কপাল ছুঁই ছুঁই অবস্থা।বলে কি! এটা স্বপ্ন? আবার ভাবলাম নাহ স্বপ্ন কেন হবে! ভাবনা কমিয়ে বললাম,
-হ্যা আতিক এখানেই থাকে। আপনি এখানেই দাঁড়ান। এক্ষুনি ডেকে আনছি। মেয়েটা কাল্পনিক পরীর চেয়েও সুন্দর। মেয়েটার ব্যাপারে আতিকের কাছে শোনা একটা কথা মিথ্যা প্রমাণিত হলো। এই কয়বছরে তার অনেক পরিবর্তন হয়েছে মনে হচ্ছে। খুবই হালকা পাতলা গড়নের। আতিক বলেছিলো সুস্বাস্থ্যের অধিকারী।
আতিককে ঘুম থেকে ডেকে তুলতে গেলাম।
-আতিক!আতিক উঠ!
কোনো সাড়া নেই।এবার আমার দেয়া নামটাতে ডাকতে লাগলাম,
-ওই কুচোচিংড়ি! শালা জলদি উঠ!
গভীর ঘুম ভেঙ্গে উঠেই আমার মাথায় চড় কষে দিলো।
-ওই ষাড়ের মত চেঁচাস কেন?
- শালা জলদি বাইরে আয়। বলেই টানতে টানতে বাইরে নিয়ে গেলাম।
- দেখ ওটা কে?
আতিক মেয়েটার দিকে তাকিয়ে এক মুহূর্তের জন্যও চোখ সরাতে পারছে না। সেই চোখ! সেই ঠোট! সেই হাসি! যা ৫ - ৬ বছর আগে দেখেছিলো। আতিক আগে সাহস করে মেঘনার সামনে যেতে পারতো না। আর এখন মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। চোখ সরাতেই পারছেনা। মেয়েটা কাছে এলো।
- আমাকে প্রথম কোথায় দেখেছিলে?
আতিক থমকে উঠলো।
- জ্বী... ইয়ে মানে আপনাদের বাসার সামনেই।
- আমার ব্যাপারে খবরাখবর কোথায় পেয়েছিলে? যেমন ধরো, আমার নাম। কিভাবে জানতে পারলে?
- পাড়ার ছেলেদের থেকে খবর নিছি।
- প্রতিদিন আমার বাসার সামনে দাঁড়াই থাকতে কেন?
- আপনি কি করে জানলেন?
- আমি দেখেছি।
- কি করে?
- জানালার যে কালো গ্লাসটাতে তাকাই থাকতা, সেই গ্লাসের আড়ালে বসে থাকতাম।
- তাহলে জানালা খোলেননি কেন?
- এমনি।
- আপনি না কলকাতা চলে গেছিলেন? কবে ফিরলেন?
- কলকাতা থেকে এক বছরের মধ্যেই ফিরে আসছি।
- কেন?
- কলকাতা ভালোলাগে না।
- কেন?
- এমনি। যতবার চিটাগং গেছো ততবারই আমার বাসার সামনে গিয়ে বসে ছিলে?
- হু
- কেনো?
- এতো কিছু জিজ্ঞেস করছেন কেন?
মেঘনা জবাব দিলো না। দুজনে কিছুক্ষণ নিরবতা পালন করলো। তারপর মেয়েটা বয়েজ হোস্টেল পরোয়া না করে আতিককে জড়িয়ে ধরলো। আতিক হতভম্ব হয়ে গেলো। তবে বাঁধা দিলো না। এই দিনটার জন্যেই বোধয় দুজনের বেঁচে থাকা। মেয়েটা খুব কাঁদছে।
- জানালার আড়ালে বসে দেখাতাম তুমি কিভাবে ছটফট করতে। এইভাবে ছটফট না করে কোনো একদিন রাস্তায় ডেকে বলে দিলেই তো পারতে।
- সাহস পাইনাই।
- জানালার আড়ালে বসে প্রতিটা মুহূর্ত তোমার জন্যে অপেক্ষা করেছি! বাবা গত দুই বছর আগেই বিয়ে ঠিক করেছিলো। বিয়ে করিনি।
- কেনো করনি?
- মন চাইছে তাই করিনি। মেয়েটা অভিমানের কণ্ঠে বললো।
আবার করুণ কণ্ঠে বলে উঠলো,
- আমি তোমাকে ভালবাসি। আমি আর পারছিনা, তোমার বাসায় গিয়ে ঠিকানা নিয়ে চলে আসছি।
আতিকের চোখেও জল। তার কাছে সব স্বপ্ন মনে হচ্ছে। বুক থেকে মেঘনার মাথা তুলে চোখ থেকে গড়ানো দু'গালের পানি হাত দিয়ে মুছে দিচ্ছে। আর তার কানের লতিতে ঠোঁট লাগিয়ে বলছে,
-আমি তোমাকেই ভালোবাসি।শুধুই তোমাকে।
দুজনে খুব হ্যাপী। আতিক এইবার ফাইজলামি শুরু করলো,
-আচ্ছা তুমি আরেকটু মোটা ছিলা না?এতো চিকনা হইলা কেমনে?
আমি এতক্ষণ দূর থেকে দাঁড়িয়ে তাদের ভালোবাসার মিলন দেখছিলাম। এবার কাছে এসে বললান,
- শালা তোর মতো কুচোচিংড়িরে বিয়া করতে হবে জানে তাই চিকনা হওয়ার অষুধ খাইছে।
দুইজনই খুব শব্দ করে হেসে উঠলো। তাদের হাসি দেখে নিজেকে খুব অসহায় মনে হলো। তাই আমিও আমার বিখ্যাত দাঁত দেখিয়ে দিলাম। আতিক আমায় জড়িয়ে ধরলো।
আজ সেই দুইটা বাক্য খুব মনে পড়ছে, "আমার বিশ্বাস আমরা কেউ অভিনয় করিনি।যদি করেও থাকি, কখনো কেউ জানতেই পারবোনা কেউ একজন অভিনয় করেছিলাম।"
ভালোবাসার এই বাক্য দুটি আজ দুইটা সম্পর্কেই মানানসই। বন্ধুত্ব আর প্রেম।
_______________
মেহেদী
০১/১১/১৫
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০১৫ সকাল ১১:৩৮