(পূর্বাপর)
হাদিছে বর্ণিত মে’রাজের তাৎপর্য, বিষয়বস্তু ও ফলাফল ৫ ওয়াক্ত নামাজ যা অনায়াসেই সাধারণ অহি করা সম্ভব ছিল! মে’রাজ পূর্ব ছুরাগুলিতে আলবৎ অহি করাও আছে। আর শিক্ষার মধ্যে উল্লিখিত বেহেস্তে দর্শনীয় বিবরণগুলি আরব্য গাঁজাখোরী উপন্যাসের মতই কৌতুককর।।
মে’রাজের একই বিষয়বস্তু সংবলিত গদ বাঁধা রচনা সম্ভার নির্দিষ্ট মওসুমে চৌদ্দ শত বৎসর যাবৎ কত কোটিবার যে পত্র-পত্রিকায়, বিভিন্ন বই-পুস্তকে ছাপা হয়েছে এবং হবে তার হিসাব নেই। কিন্তু শরিয়তের তিল পরিমাণ জ্ঞানের মে’রাজ (উর্দ্ধগতি) হয়েছে বলে কোন প্রমাণ নেই। একটি মাত্র মোসলমানের মে’রাজ হয়েছে বলে কোন ইতিহাস নেই। পক্ষান্তরে ‘আচ্ছালাতু মে’রাজুল মোমেনীন’ অর্থ: নামাজে মোমীনদের মে’রাজ হয়।
মুমিনের নামাজেই যদি মে’রাজ হয় তবে স্বীকার করতেই হবে যে মে’রাজ নবির জীবনের অতি তুচ্ছ বিষয়; কিন্তু আপত্তিকর স্বার্থে বিশ্বময় শ্রেষ্ঠ মোজেজা বলে কোরানের বিপরিতে আজব কল্প-কাহিনী রচনা করে জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করেছে। 'মক্বা-মদিনা, বাঘের ছবিসহ আজমিরের আকাশে খাজাবাবার আবির্ভাব' নামে অনুরূপ প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছে খাজা বাবার মাজারের কতিপয় ধুরন্দর অর্থ লোভী খাদেম পরিবার।
জনৈক সাধকের অভিমত:
'বোরাক' অর্থ বিদ্যুত, বিদ্যুতের বিদ্যুত অর্থাৎ নূর; গাধা-খচ্চর বা ঘোটকী নয়। মানুষের কাল্ব বা হৃদয় একটি আনবিক চুল্লি, মহা বিদ্যুতাগার; যে বিদ্যুতের পরশেই সুই থেকে রকেট, এ্যাটম বোমসহ বিশ্বের সকল কিছু আবিস্কার হচ্ছে। স্রষ্টা সৃষ্টের প্রেরণা সংঘর্ষে, অর্থাৎ ছালাত ও একনিষ্ঠ গবেষণা, সাধনার মাধ্যমে হৃদয়ে বিদ্যুত বা নূর সঞ্চারিত ও প্রসারিত হ’তে থাকে। ধর্ম-কর্ম করে যার যতটুকু নূরের সঞ্চার হয়েছে তার ততটুকু আল্লাহবোধ অনুভুত হয়েছে, অর্থাৎ ছোয়াব হয়েছে। এই নূর সঞ্চার হ’তে হ’তে যখন সমস্ত দেহ বিদ্যুতায়ন হয় তখন তার আমিত্ব সত্ত্বা, দেহ ও জীবন আলাদা করে দেখতে পারে। তখন দৃশ্য থেকে অদৃশ্য হ’তে পারে, এরেদা বা ইচ্ছা করা মাত্রই মূহুর্তের মধ্যেই একই সঙ্গে একাধিক স্থানে প্রকাশ হ’তে পারে; এর নামই চৈতন্য বা রাব্বানী (আল্লাহময়) হওয়া [দ্র: ৩: ৭৯]। আর তখনই দৃশ্য-অদৃশ্য, দূর-নিকট, অতীত-ভবিষ্যৎ সবই একাকার হয়ে কালের উর্দ্ধে বর্তমান হয়। এমন অবস্থা মানুষের পক্ষে বা স্থুল দেহে সকল সময় ধরে রাখা সম্ভব নয়; যেমন সম্ভব নয় স্বপ্ন ক্ষণটি ধরে রাখা।
হযরত মুহাম্মদ এই অবস্থায় উপনীত হয়েছিলেন এবং এর নামই মে’রাজ বা জ্ঞানের পরিপূর্ণতা। এজন্যই তাঁকে ‘নূর মুহাম্মদ’ বলা হয়; অর্থাৎ জ্যোতিদেহধারী মানব। তিনি যেখানে ছিলেন, ঠিক সেখানেই দৃশ্যও ছিলেন, অদৃশ্য ছিলেন। জীব যেমন জীবনকে দেখতে পায় না, দেখতে পায় তার দেহটি মাত্র; কিন্তু হযরত মুহাম্মদ স্থুল দেহকে আলাদা করে জ্যোতি জীবন দেহের মধ্যে বিলীণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ইহারই সাক্ষ্য প্রমান দেয় ৫৩: নজম এর ২-১১ নং আয়াত, যা একটু পরেই আলোচিত হবে।
শুন্যাকাশে তিনি গাধা অপেক্ষা বড়, খচ্চর অপেক্ষা ছোট সাদা পশু, মতান্তরে: ঘোটকীর অনুরূপ, লেজটি ময়ুর পুচ্ছসদৃশ, মাথাটি নারীর [ দ্র: টি. ডব্লিউ আরনোল্ড এর পেইন্টিং ইন ইসলাম (অক্সফোর্ড,১৯২৮), পু:১১৭-১২২ এবং ৫৩-৫৬ ছবির প্লেট চতুষ্টয়; তথ্যসুত্র: সংক্ষিপ্ত ইসলামী বিশ্বকোষ,২য় খ.) কল্পিত ঐ অদ্ভূত নারী পশুর পিঠে চড়ে তিনি উড়ে বেড়াননি। শরিয়তের এই অপপ্রচার মহানবিকে কলঙ্কিত করেছে, ইসলামকে হেয় প্রতিপন্ন করেছে।
তিনি যে সত্যসত্যই পশুর পিঠে ঘুরে বেড়াননি তা’ তাদের হাদিছেই ধরা পড়ে। কথিত হয় যে, খুনি খুন করে, ধরা পড়ার ভয়ে যাবতিয় আলামত নষ্ট করে যায়; কিন্তু কর্ম দোষে মনের অলক্ষ্যে এমন কোন না কোন আলামত রেখেই যায়, যার সুত্র ধরে প্রকৃত খুনিকে ধরতে সক্ষম হয়।
কথিত হয় যে, ঘটনা শুনে আবুযেহেলগণ মহানবিকে চ্যালেঞ্জ করে বলেছিল যে, সত্যিই যদি তিনি দীর্ঘ ১ মাসের পথ রাতের ১ মিনিটেরও কম সময়ের মধ্যে বায়তুল মোকাদ্দাছ গিয়ে, আবার ফিরে এসে থাকেন তবে উহার দরজা কয়টি ইত্যাদি বলে দিতে। তখন নাকি রাছুল বিভ্রাটে পড়ে যান! হঠাৎ আল্লাহর মেহেরবানীতে বায়তুল মোতাদ্দাছ মসজিদটি নবির সম্মুখে হাজির হয়! তৎপর তিনি উহা দেখে দেখে প্রশ্নের সঠিক উত্তর বলে দেন। [ দ্র: বোখারী, ৫ম খ. ৫ম সংস্করণ, আ. হক, পৃ: ৩৫৮]
হাদিছটি কথিত মে’রাজের যাবতিয় বয়ান এক্ষণে সন্দেহজনক করে, পরিবর্তে বায়তুল মোকাদ্দাছ মসজিদটির মে’রাজ হয়েছিল বলে সাক্ষ্য-প্রমান দিচ্ছে! যা বড়ই কৌতুককর।
আবু যেহেলের প্রশ্ন ছিল মুহুর্তে বায়তুল মোকাদ্দাস আসা-যাওয়া সম্পর্কে। কিন্তু সেখান থেকে ৭ম আসমানের বিষয়াদি সম্পর্কে একটিও প্রশ্ন করেননি! এর অর্থই প্রচলিত ৭ম আসমান ভ্রমণ কাহিনী স্বয়ং রাছুল কখনও বলেননি; বললে অবশ্য অবশ্যই বুদ্ধিমান নেতা আবু যেহেল ক্ষুদ্র প্রশ্নটি না করে বরং চর্ম চক্ষু দেখা মটকীর মত বরইর ২/১টি বিচি বা বেহেস্তের কস্তুরী গন্ধযুক্ত দু’এক গ্রাম মাটি আনলেন না কেন? এই প্রশ্নেই রাছুলকে হ্যস্ত-ন্যস্ত করে ফেলতেন! যা থেকে উদ্ধার পাওয়ার কোনই পথ থাকতো না। সুতরাং এখানেই প্রকৃত ধার্মীকদের বোঝা উচিৎ যে, কল্পিত হাদিছগুলি রচিত হয়েছে মুসলিমবেসী ইসলামের ঘোর শত্রু কর্তৃক।
প্রকাশ থাকে যে, কতিপয় আলেম-আল্লামাগণ ছুরা নজম ও তকবীরের কতিপয় আয়াত উত্থাপণ করে হযরত মোহাম্মদের দ্বিতীয় মে’রাজ প্রমাণের ব্যর্থ চেষ্টা করেন। সে সম্বন্ধে পরবর্তিতে বিশদভাবে বর্ণিত হয়েছে।
স্মরণীয় যে, উল্লিখিত বিষয়বস্তু সাধারণতঃ সাক্ষি, যুক্তি বা বিকল্প ধারায় প্রমান প্রতিষ্ঠা করা কিছুতেই সম্ভব নয়; ইহা স্বপ্ন জগতের মতই স্ব স্ব এবং চুড়ান্ত ধ্যান-সাধনায় প্রাপ্ত স্বতন্ত্র উপলব্দির বিশ্বাস মাত্র।
বাস্তবতার নিরীক্ষে:
‘আকসা’ অর্থ দূরবর্তি স্থান, ‘আসরা’ অর্থ রাতে ভ্রমণ। অর্থাৎ রাতে দূরবর্তি স্থানে ভ্রমণ! কোথায়! মসজিদুল আকসায়। কিন্তু তৎকালে ‘আকসা’ নামে কোন মসজিদ ছিল না; -উমাইয়া খলিফা আব্দুল মালিক বিন মারওয়ান রাছুলের মৃত্যুর প্রায় ৬০ বছর পরে ৭২ হি: ৬৯১ খৃ: আকসা মসজিদটি নির্মান করেন-। -এজন্য কেহ ‘আকসা’ অর্থে আকাশের কোন স্থানকে অনুমান করেন, পক্ষান্তরে জনাব বোখারীর অনুমান ‘বায়তুল মোকাদ্দাস’ -। [দ্র: সং. ই. বিশ্বকোষ, ২য় খ. ২য় সংস্করণ, পৃ: ১৮১, ১৮২]
রাছুলের জীবনে রাতের অন্ধকারে দূরবর্তি স্থান ভ্রমণ ছিল শত্র“ ভয়ে মক্বা থেকে মদিনায় পলায়ণ (হিযরত)। এই ভ্রমণ রাছালের জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ; যেমন ছিল জীবন তথা ইসলামের ঝুকি তেমনই ছিল রহমতপূর্ণ। কারণ ঐ রাতে তিনি পালিয়ে না গেলে ভোরেই তাঁর মৃত্যু ছিল অনিবার্য; আর তাঁর মৃত্যু মানে তৎক্ষণাত ইসলামের যবনিকাপাত!
চারিদিক জীবন হরণকারী সশস্র শত্র“ বেষ্ঠিত বুহ্য ভেদ করে রাতের অন্ধকারে নিরস্র মোহাম্মদ ৩শ মাইল ভ্রমণ করে নিরাপদে গন্তব্য স্থলে পৌঁছে যাওয়া ছিল ইসলামের জন্য এক বিশাল রহমত। পূর্ব থেকেই মদিনায় তাঁর জন্য সীমাহীণ রহমত অপেক্ষা করছিল; মান-সন্মান ও জীবনের ভয়-ভীতিবিহীণ সংরক্ষিত একটি পূর্ণ নিরাপদ স্থান; ঐ বিশাল রহমতের বদৌলতেই অশান্ত, উশৃংখ্যল-বিশৃংখ্যল আরব জাতিকে অতি অল্প সময়ের মধ্যেই আপন দর্শন প্রতিষ্ঠাকল্পে একটি শান্তিপূর্ণ দেশে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। অর্থাৎ তাঁর জীবনের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য বাস্তবায়ণে ঐ ভ্রমণ ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও শ্রেষ্ঠ রহমতপূর্ণ, যা ৭০ হাজারবার কল্পিত পশুর পিঠে ৭ম আসমান ভ্রমণের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান। এই বাস্তবতাটাই আয়াতে সংক্ষেপে বর্ণিত হয়েছে।
‘মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসা’ বাক্যটি রুপক, কারণ আরব জয় করার আগ পর্যন্ত ৩৬০টি মূর্তির বাস ঘর কাবাকে কেহ মসজিদ বলতো না, আর আকসা সম্বন্ধে একটু আগেই বর্ণিত হয়েছে। ঐতিহাসিকগণ এমনকি প্রচলিত হাদিছও স্বীকার করে যে রাছুলের ভ্রমণ শুরু হয়েছিল মতান্তরে কাবার হাতিম/উম্মে হানির ঘর থেকে! ‘আকসা মসজিদ’ বলতে কোন ঘরই ছিল না। মূলতঃ ‘এক উপাসনালায় থেকে দূরবর্তি উপাসনালয় অর্থাৎ মক্বা থেকে মদিনা ভ্রমনের কথাই উল্লিখিত আয়াতে বর্ণিত হয়েছে মাত্র।
প্রধানতঃ কোরান পরিপূর্ণভাবেই বাস্তববাদী দর্শন অর্থাৎ প্রধানতঃ ইহকাল এবং দ্বিতীয়তঃ পরকালের জন্য; আর পরকাল বলতে ‘এখন’ এর পর থেকেই শুরু। কিন্তু জ্ঞানের অভাবে, বাপ=দাদার অনুসরণে ‘পরকাল’ বলতেই প্রশ্নবোধক স্বার্থে মৃত্যুর পরের কালকে বুঝানো হয়েছে:
অ ইজ কিলা-ইয়াহতাদুন[ [ ২: ১৭০] অর্থ: যখন তাদেরকে বলা হয়, ‘আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তা তোমরা অনুসরণ কর’, তারা বলে, ‘ না না! বরং আমরা আমাদের পিতৃপুরূষদেরকে যাতে পেয়েছি তারই অনুসরণ করবো।’ এমন কি, তাদের পিতৃপুরুষগণ যদিও কিছুই বোঝে না বরং তারা সৎ পথেও ছিল না, তবুও?
(চলবে-৫/৬)