(পূর্বাপর)
নিম্ন বর্ণিত আয়াতগুলি আলোকে রাছুলের ২য় বার ৭ম আসমানের উর্দ্ধে ভ্রমণ (মে'রাজ) হয়েছিল বলে দাবি করা হয়।
১. মা দাল্লা-মা রাআ। [৫৩: ২-১১] অর্থ: তোমাদের সাথী বিভ্রান্ত নন, বিপথগামীও নন; এবং সে মনগড়া কথাও বলেন না; ইহা তো অহি, যা তার প্রতি প্রত্যাদেশ হয়; তাকে শিক্ষা দেয় শক্তিশালী, প্রজ্ঞাসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব, সে (আপন জ্যোতিদেহটি) নিজ (দেহের) আকৃতিতে স্থির হয়েছিল, তখন সে উর্দ্ধদিগন্তে, অতঃপর সে তার নিকটবর্তী হলো, অতি নিকটে, ফলে তাদের মধ্যে দুই ধনুকের ব্যবধান ছিল অথবা উহারও কম। তখন তার বান্দার প্রতি যা অহি করার তা অহি করা হ’লো। যা সে দেখেছে তার অন্তকরণ তা অবিশ্বাস করেনি।
২. আফাতুমারুনাহু-মাইআরা [৫৩: ১২] অর্থ: সে যা দেখেছে তোমরা কি সে বিষয়ে তার সংগে বিতর্ক করবে?
৩. অ লাকাদ্ব রায়াহু- জান্নাতুল মাওয়া-মা ইয়াগশা। [৫৩: ১৩-১৮] অর্থ: নিশ্চয়ই ‘সে তাকে’ আরেকবার দেখেছিল; প্রান্তবর্তি বরই গাছের কাছে (ছেদ্রাতুল মোনতাহা); যার নিকট অবস্থিত বাসোদ্যান; যখন বরই গাছটি যদ্বারা আচ্ছাদিত হবার তদ্বারা আচছাদিত ছিল। তার দৃষ্টি বিভ্রম হয়নি, লক্ষচ্যুতও নয়। সে তো তার প্রতিপালকের নিদর্শনাবলী দেখেছিল।
৪. ইন্নাহু-ইয়াস্তাক্বিম। [৮১: ১৯-২৮] অর্থ: নিশ্চয়ই এই কোরান সন্মানিত বার্তাবাহকের (আনীত) বাণী; যে সামর্থশালী আরশের মালিকের নিকট মর্যাদাসম্পন্ন; যাকে সেথায় মান্য করা হয় এবং বিশ্বাসভাজন। এবং তোমাদের সাথী পাগল নয়, সে তো তাকে স্পষ্ট দিগন্তে দেখেছে, সে অদৃশ্য বিষয় (জ্ঞান) সম্পর্কে কৃপণ নয়। এবং ইহা অভিশপ্ত শয়তানের বাক্য নয়। সুতরাং তোমরা কোথায় চলেছো? ইহা তো শুধু বিশ্ব জগতের জন্য উপদেশ. তোমাদের মধ্যে যারা সরল পথে চলতে চায় তাদের জন্য।
৫. ইন্নহু-মুত্তাক্বীন [৬৯: ৩৮-৪৮] অর্থ:- নিশ্চয়ই এই কোরান এক সন্মানিত রাছুলের বাহিত বার্তা। ইহা কোন কবির রচনা নয়; তোমরা অল্পই বিশ্বাস কর, ইহা কোন গণকের কথা নয়, তোমরা অল্পই অনুধাবন কর। ইহা জগতসমুহের প্রতিপালকের নিকট থেকে অবতীর্ণ। সে যদি আমার নামে কিছু রচনা করতো আমি অবশ্যই তার ডান হাত ধরে জীবন ধমনী কেটে ফেলতাম; অতঃপর তোমাদের সাধ্য ছিল না তাঁকে রক্ষা করার। অবশ্যই ইহা মুত্তকীনদের জন্য উপদেশ।
পর্যালোচনা:
ক. ১ নং ধারাটি হাজার বছরের অধিককাল থেকে অদ্ব্যাবধি যে মে’রাজ নিয়ে তর্ক-বিতর্ক চলছে তার ইংগিত এখানেই তবে কল্পিত মে’রাজের সঙ্গে ইহার কোনই সম্পর্ক নেই!
আয়াতে বলা হয়েছে যে, সাথী (সাহেব) বা লোকটির সামনে নিজ আকৃতি বা স্ব-রূপ অর্থাৎ আপন জ্যোতিদেহটি কাছে, আরো কাছে অর্থাৎ ধীরে ধীরে প্রকাশ হয়, যখন পূর্ণভাবেই প্রকাশ হলো, তখন তিনি দেখতে পেলেন যে, আপন দেহের সঙ্গেই ইহার সংযোগ। অর্থাৎ সেটি আপন দেহ থেকেই ধীরে ধীরে প্রকাশ হয়ে অর্ধবৃত্ত বা ধনুকের ন্যায় তাঁর সামনে স্থীর ও স্পষ্ট হয়; যেমন সম উচ্চতা বিশিষ্ট দুই ব্যক্তি সামনা সামনি বসে পা যুগলদ্বয়ের তালু পরস্পর সংযুক্ত করলে যে ধনুক আকার অঙ্কিত হয়; অতঃপর কথাবার্তা হয়।
আয়াতে ব্যবহৃত ‘কাওছাইন’ দ্বি বচনে সাধারণতঃ ২ ধনুক বুঝায় বটে! কিন্তু দু’টি ধনুক পরস্পর সামনা সামনি যুক্ত করলে ধনুকাকৃতি বিলুপ্ত হয়ে পূর্ণ বৃত্ত বা ‘০’ শুণ্যাকার ধারণ করতঃ উভয়ের অস্তিত্ত্ব বিলুপ্ত হয়ে একাকার বা '০' হয়ে যায়; আর এ অবস্থায় ‘বাক্য বিনিময়’ বা (উভয়) কথোপকথন বাক্যটিই মিথ্যা হয়ে যায়; আর মাঝে ফাঁক থাকলে প্রথম দুই ব্রাকেট যেমন ‘( )’ এমন চিত্র অঙ্কিত হয়, কিন্তু মানুষ ও তার জ্যোতিদেহের আকৃতি ধনুকের মত নয় হেতু দু’জন সামনা সামটি দাঁড়ালে এমন চিত্র অঙ্কিত হয় না। তা’ছাড়া ২ ধনুকের ব্যবধান বলতে লম্বালম্বি কি পাশাপাশি/উল্টা-উল্টি ব্যবধান ছিল! এসম্বন্ধে সংশয় বা বিতর্কের সুযোগ থাকে; যার সমাধান অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। ফানাফিল্লাহ হোক কি বাকাবিল্লাহই হোক! স্রষ্টার একাকার/অখন্ড অবয়ব খন্ডিত মানুষের পক্ষে কস্মিণকালেও দর্শন সম্ভব নয়; প্রকৃতি তো দূরের কথা! যে কোন বস্তু বা মানুষের দেহ, এমনকি একটি বলেরও পূর্ণ অবয়ব (৩৬০ ডিগ্রী) এক সঙ্গে দর্শন সম্ভব নয়। খন্ডিত দেহ বা নির্দিষ্ট আকৃতির ভিন্ন ভিন্ন মানুষ স্রষ্টার অখন্ডিত একাকার রূপ বা অবয়ব স্ব স্ব খন্ডাকৃতি রূপেই দর্শিত হয়। আল্লাহ নামে বহুবচন ‘নাহনু’ বা আমরা ব্যবহার অন্যতম কারণ।
হযরত মুছা অখন্ড অবয়ব দেখতে চাইলে এক সেকেন্ডর কয়েক শ’ ভাগের একভাগ সময়ের জন্য নিজের অস্তিত্বই হারিয়ে ফেলেছিলেন। [৭: ১৪৩]
আলোচ্য বর্ণনার আলোকে বহুবচন ‘কাওছাইন’ ২ ধনুক অর্থে একটি ধনুকের ২ প্রান্ত অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে এবং ইহাই সহজ, সরল এবং যুক্তিসঙ্গত; যেমন সিজার্স (একটি কেচির দু’টি প্রান্ত/অংশ), আই গ্লাসেস (একটি চশমার দু’টি চোখ); তা’ছাড়া অনুরূপ বাস্তব দর্শনপ্রাপ্ত অন্তত দু’ একজন লোক সমাজে থাকেই। কিন্তু প্রকাশ করা তাদের ইচ্ছাধীন নয়। ( ১৪: ১০, ১১)।
মাথা উঁচিয়ে তাকানোই উর্দ্ধ দিগন্ত নয়। মাটির উপরই উর্দ্ধ দিগন্ত; আর্দ্ব (দৃশ্য/বস্তু) এবঙ ছামা (অদৃশ্য/অবস্তু/আকাশ) পরস্পর মিলিত। দেহ বা বস্তুর আশেপাশের শুণ্যস্থানই উর্দ্ধ দিগন্ত; হাতের পাঁচ আংগুলের ফাঁকে যে শুণ্য বা গ্যাপ উহাই আকাশ। ইহার বিবরণ মে’রাজ-১ এ বর্ণিত হয়েছে। মাথার উপর বা কল্পিত উর্দ্ধাকাশ থেকে একটি ছবি ধীরে ধীরে ভাসতে ভাসতে কাছে, আরো আরো কাছে আসলে ধনুক বা অর্ধ বৃত্তে অবস্থান অঙ্কিত হয় না, বরং সমান্তরাল খাড়া রেখা (!!) বা দু’টি স্তম্ভের রূপ নেয়; কিন্তু অনুরূপ বর্ণনা উল্লিখিত আয়াতে নেই।
রাছুল তখন কি অবস্থায় ছিলেন:
তিনি তখন শুয়ে ছিলেন কি দাঁড়িয়ে বা বসে ছিলেন! এমন বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হলেও এ নিয়ে আজ পর্যন্ত কেহ বিতর্কে আসেন নি; আস্লে ৬/৭ আসমানের সন্দেহ/কল্পনাগুলি বহু পূর্বেই সমাধা হয়ে যেত। তিনি যে পা’দ্বয় সামনে প্রশস্ত করে ৯০ ডিগ্রী কোণ করে বসে ছিলেন তাতে কোনই সন্দেহ নেই এবং তাই বলেই জ্যোতিদেহের ৯০ ডিগ্রী যুক্ত হয়ে ১৮০ ডিগ্রীতে অর্ধ চন্দ্র বা ধনুক চিত্র ধারণ করে। গোল অর্থাৎ ‘০’ শুণ্যের পরিধি ৩৬০ ডিগ্রী এমন অবস্থায় অর্ধ বৃত্ত এমনকি দ্বিতীয়ের কোনই অস্তিতই থাকে না।
খ. ২ নং আয়াতে বলা হযেছে যে, ১ নং ধারায় বর্ণিত ঘটনায় তিনি যা দেখলেন, শুনলেন তা বাস্তব সত্য; তিনি পাগল নন, বিভ্রান্ত নন এবং মনগড়া কথাও বলেন না। সুতরাং ঐ সম্বন্ধে সন্দেহ, অবিশ্বাস বা তর্ক-বিতর্ক করা সঙ্গত নয়। যেহেতু ইহা নতুন কিছু নয়, কারণ পূর্বাপর কেহ না কেহ অনুরূপ দেখেছেন এবং দেখে থাকেন (সকল রাছুর-নবিগণ) এবং তার প্রমান স্বরূপ হাজির করা হয়েছে ৩ নং আয়াত।
গ. ৩ নং আয়াতটির শুরুতে ‘সে তাকে আবার দেখলেন,’ বাক্যে কর্তা ও কর্ম দু’টো সর্বনাম ব্যবহৃত হলেও মূল আরবিতে একটি মাত্র কর্ম কারক সর্বনাম আছে, তা হলো ‘হু’ অর্থাৎ ‘তাকে;’ উহাই আলোচ্য বাক্যের উদ্দেশ্য বা সাবজেক্ট। অর্থাৎ তাকে (জ্যোতিদেহকে) অনুরূপ (আরেকবার) দেখেন।’ ‘আবার দেখেন বা আর একবার দেখেছেন’ বাক্যদ্বয়ে অর্থ দাঁড়ায় ‘কর্তা একাধিকবার দেখেছেন’ মূলতঃ তা নয়, আর কর্তাও সেখানে উহ্য; বরং তাকে (জ্যোতিদেহকে ) অন্য কেহ অনুরূপ (আবার) দেখেছেন।
অ লাকাদ রাআহু নাজলাতান উখরা (৫৩: ১৩) আয়াতটির শব্দার্থগুলি বিশেষভাবে লক্ষনীয়:
অ=এবং; লাকাদ= ঘটমান অতীত চিহ্ন; রাআ= দেখে, দেখেছিল, ধারণ, লক্ষ্র, বিজ্ঞাপন, সতর্কীকরণ, ইন্দ্রিয়দ্বারা জ্ঞানার্জন করা, মনোযোগ, চিন্তা-ভাবনা, মতামত; হু-তাকে, তার; নাজলাত-অবতরণ, উদয়, প্রকাশ; উখরা- ভবিষ্যতে, পরবতির্তে, পরকাল; ইয়াগশা= আচ্ছাদিত থাকা/থাকবে, ঘিরে ফেলা/ফেলবে, ছেয়ে থাকা/থাকবে।
উল্লিখিত শব্দগুলির অর্থ দেয়া হলো এজন্য যে, প্রচলিত অনুবাদে কালের ব্যবহারসহ বেশি-কম হেরফের আছে [বিশেষ করে ‘উখরা (৫৩: ১৩) ও ইয়াগশা’ (৫৩: ১৬) শব্দদ্বয়] বিধায় প্রচলিত অনুবাদ শতভাগ নির্ভুল দাবি করার যুক্তি কেহ খুঁজে পাবেন না এবং প্রকৃত ভাবুকদের ভাববার সুযোগ হবে।
লক্ষনীয় যে, ১নং ও ৩নং আয়াতে বর্ণিত অনুরূপ দুই ঘটনার বিবরণে একক কর্তাকে (জ্যোতিদেহকে) ভিন্ন ২ জন (ব্যক্তি) কর্ম কারক দেখেছেন; মাঝখানে ২নং আয়াতটি উভয় উভযের সাক্ষিরূপে দাঁড় করা হয়েছে। কিন্তু সে ব্যক্তিটি কে! তা আয়াতটির নীচেই ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে মাত্র। সাধারণ শিক্ষিত লোকও মনোযোগ দিয়ে মাত্র ২/১ বার পড়লেই স্থানের ছবিসহ সহজ সরল কিন্তু অবিশ্বাস্য আর এক জ্যোতিদেহধারীর ঠিকানা পাওয়া যায়, তা হলো:
(চলবে-৬/৬)
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে আগস্ট, ২০১০ সকাল ৭:৪৫