গল্পঃ সড়ক ব্যবস্থা।
আমাদের দুজনের চুমু খাওয়া দেখে নগরী সমস্ত মানুষজন সন্ধ্যা নামতেই হাতে হারিকেন নিয়ে হাটে!! আশ্চর্য নগরীর সব আশ্চর্য মানুষ। চুমোই তো খেয়েছি। তাছাড়া তার ঠোঁটের কোণে সদ্য ওঠা বাদামী রঙের তিলটা দেখে শহরের যে কোন লাল গাড়িওয়ালা কিছুক্ষণের জন্য দাঁড়িয়ে যাবে। আমি তো কেবল শুধুই মানুষ! আমার দোষ কীসে।
দাড়িমোচ কাটিনা মাস তিনেক হবে। স্নান করি মাঝেসাজে। যদি চুমু খাবার সময় সেজুঁতি বমি করে দেয় তাহলে বুঝি গা দিয়ে তীব্র গন্ধ। তখন বাজার থেকে কসকো সাবান কিনে নিয়ে এসে আচ্ছামতো গায়ে মাখি। এমন বাউন্ডুলকে এত ভালবাসে কেন সে! মাঝে মধ্যে নিজের উপরেই হিংসে হয়। আবার ভয় হয়। বোকা শহর কে বিশ্বাস করতে ভয় করে! নগরীর গণতন্ত্র খুবই ভয়ংকর!!
সেজুঁতি দামী ঘরের মেয়ে। হাসিটা শেষ বিকেলের গোধূলি লগ্নের মতো। হাসলে গালে টোল পড়ে। প্রথম বেঞ্চের ছাত্রী সে। প্রথম পরিচয় হয় নীলক্ষেতে। সে বই কিনতে এসেছিল। সাহিত্য খুব ভালোবাসে।আমি ছোটখাটো এক কবি ও গল্পকার। আমার লেখার প্রেমে পড়েই আমার প্রথম সন্তান(উপন্যাস) কিনতে এসেছিল। তার মুখে নিজের প্রশংসা শুনে মনখুশিতে সুনীলের একটা কবিতা আবৃতি করে শুনিয়েছিলাম। তাতেই সে আমার লেখা ফেলে আমার প্রেমে পড়ে গেল! এক দাড়িমোচ না কামানো ও স্নান না করা অভ্যেস পুরুষকে না বুঝেই ভালোবেসে ফেলল। তখন আমার কলম, খাতার পাশাপাশি ছোট্ট একটা প্রেম খুব দরকার ছিল। এই যুগে জেনেবুঝে বাউন্ডুলকে ভালবাসতে যাবে কোন মেয়ে। দুজনেই সাহিত্যপ্রেমী। ভালোবাসা হলো মন গহীনের এক অলৌকিক অনুভূতি। ভাললাগার শেষ নেই, ভালোবাসার শেষ আছে।
এখন কলম,খাতায় দম দেবার সাহস পাই, অনুপ্রেরণা পাই। এখন আমার সেঁজুতি আছে। যে কিনা বাবার চার চাকাওয়ালা সবুজ গাড়ি ফেলে রেখে পায়ে হেঁটে আসে আমার কাছে। একটুখানি আমার মুখে কবিতা আবৃতি শুনবে বলে। আবৃতি খুব বেশি ভাল লাগলে, নগরীর সমস্ত কিছুকে নিস্তব্ধ করে দিয়ে পা উঁচু করে আমাকে চুমু খায়। মিনিট দুয়েক পরে আবার সবকিছু নিজের গতিতে চলতে শুরু করে। আমি প্রতিদিন কায়দা করে একটা করে কবিতা শিখে আসি তার চুমু পাবার আশায়।
শ্রাবণ মাসের মাঝামাঝি তিরিক চাঁদের আলো গায়ে মেখে দুজন সংসদ ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। আচমকা আকাশটা তোর জোর করে আওয়াজ তোলা শুরু করে। সবাইকে ফাকি দিয়ে বৃষ্টির প্রথম ফোটা এসে পড়ে সেঁজুতির কপালের মাঝ বরাবর। আমি তার কোমরে হাত রেখে বুড়ো আঙুল দিয়ে কপালের পানি মুছতেই সেজুঁতি শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আমাকে। যেনো এক আকাশ হারানোর ভয়। কায়দা করে মেঘ বৃষ্টি হয়ে ভিজিয়ে দেয় আমাদের। সে আমার পায়ে পা রেখে, নাকে নাক রেখে আমার বুকের মধ্যে ঢুকে যেতে চায়। পাশ দিয়ে যাওয়া পথচারীরা ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে থাকে দুজন সাহিত্যপ্রেমীর প্রেম। যাকে বলা যায় সাহিত্যিক প্রেম।
তাকে লাল বেনারসি শাড়ি পড়ে আসতে বলেছি দেখে, সে আমাকে পরপর তিনটে রবীন্দ্রনাথের কবিতা আবৃত্তি করিয়ে শোনাবার আবদার করে। তাতেও আমি রাজি হই। সন্দেশের মত দেখতে সুন্দরীকে লাল বেনারসি শাড়িতে না জানি কত ভালো লাগবে! এমনিতেও বাঙালি নারীদের শাড়িতে বেশি ভালো লাগে।
আমি রবীন্দ্রনাথের মনকে খুব সুন্দর করে পাঠ করছি গুনগুন করে বকুলতলার নিচে বসে। আবৃতি খারাপ হলে নাকি নাক টেনে দিবে। চেনা এক গন্ধ আশেপাশে ভিড় জমিয়েছে বুঝতে পেরে সামনে তাকাতেই দেখি, লাল বেনারসি শাড়িতে দেবী পূর্ণিমা মতো দেখতে এক মানবী রাস্তার ওপারে দাঁড়িয়ে আছে। শাড়িতে তাকে ভাল লাগবে এটা স্বাভাবিক। কিন্তু এখন যা দেখছি তা অস্বাভাবিক।
তাকে দেখে শহরের যে কোনো প্রতিষ্ঠিত টোকাই দাঁড়িয়ে যাবে। আমি অজগর সাপের মতো 'হা' করে তাকিয়ে রয়েছি তার দিকে। সমস্ত নগরীতে যেন দিনের বেলায় চাঁদের আলো উপচে পড়ছে! নগরীর সমস্ত ধূলিকণা থেকে শুরু করে বাসের হেলপার অব্দি নিস্তব্ধ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে।
তার কায়দা করে শাড়ি পরা আর নূপুরের শব্দে বাসের ড্রাইভার বেহুঁশ হয়ে খুব সহজেই তার উপর দিয়ে চলে যায়। চোখের সামনে একজন লেখকের প্রাণকে মেরে দিয়ে যায়। নগরীর অসচেতন ড্রাইভার আর কত মানুষের পাওয়া স্বপ্নকে চার চাকার তলে ফেলে মিশিয়ে দিবে কালো ইট-পাথরের মাঝপথে। শহরের আট-দশটা ছোটখাটো ভুলের মধ্যে আমার ভালবাসাও একটি ছোট্ট দুর্ঘটনা। পুলিশ এসে নিয়ে যায়। পরদিন পত্রিকার ভিতরে না দেখা পৃষ্টার ছোট কলামে ছোট আকারে প্রকাশ করে এক বাউন্ডুলের সাজানো গোছানো ভালোবাসার মানুষটির নাম।
"এটি সড়ক দুর্ঘটনা নয়, আমাদের সড়ক ব্যবস্থা।" নগরীর গণতন্ত্র খুব বেশী ভয়ংকর।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই আগস্ট, ২০১৮ রাত ৯:৪২