সবুজ ঘাসে ভরা সুবিশাল মাঠের একপাশে একটা দোতলা নতুন দালান আর জরা-জীর্ন একটা লম্বা টিনের ঘর নিয়ে রতনপুর উচ্চ বিদ্যালয়। জরা-জীর্ন স্কুল ঘরের একটি কক্ষে অষ্টম শ্রেনীর ক্লাস হয়। ক্লাসে স্যার নেই। তাই যথারীতি ছাত্ররা সবাই আড্ডা, দুষ্টুমিতে ব্যস্ত। হঠাৎ পিয়ন এসে জানালো আজ কোন ক্লাস হবে না। স্কুল অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ।
এ কথা শুনে সবাই খুশিতে চিৎকার করে উঠলো। বাকি সবার মতো মানিকও ক্লাস থেকে বের হয়ে গেলো মনের আনন্দে বাড়ির পথে রওনা হলো।
বাড়ি ফিরে দেখে মা উঠোনের একপাশে ছোট্ট চুলায় রান্না করছে। সে পিছন থেকে মাকে জড়িয়ে ধরে বললো, “মা, স্কুল বন্ধ দিয়া দিছে”।মানিকের মা আমেনা বেগম ঘুরে মানিকের দিকে তাকিয়ে বললো, “কিসের বন্ধ”? “জানি না” বলে মানিক উঠে ঘরে চলে গেলো বই-খাতা রাখতে। তারপর আবার মায়ের কাছে এসে বললো “মা, খুব ক্ষুধা লাগছে, খাইতে দাও”।
মানিককে খেতে দিয়ে আবার রান্নায় ব্যস্ত হয়ে পড়লো আমেনা বেগম। হঠাৎ মানিকের বাবা আবুল মিয়া এসে হাজির হলো। আবুল মিয়া একজন সামান্য কৃষক, পরের জমিতে চাষ করে সংসার চালায়। সারাদিন রোদের মাঝে কাজ করে ঘেমে শরীর ভিজে গেছে। তাই বাড়ির পাশের পুকুর থেকে হাত-মুখ ধুয়ে ছেলের পাশে এসে বসলো।গামছা দিয়ে হাত-মুখ মুছতে মুছতে স্ত্রীকে বললো “ভাত দাও”।
আমেনা বেগম ভাতের থালাটা এগিয়ে দিলো স্বামীর দিকে। ততক্ষনে মানিকের খাওয়া শেষ, সে হাত ধুয়ে উঠোনের একপাশে থাকা ফুটবলটা নিয়ে মাঠের দিকে রওনা হতেই মানিকের বাবা জানতে চাইলো “কই যাস? আজ স্কুল নাই?”।মানিক বাবার কথার উত্তর দিয়ে চলে গেলো মাঠের দিকে।
আবুল মিয়াকে চিন্তিত দেখে আমেনা বেগম জিজ্ঞেস করলো “কি হইছে তোমার? কি চিন্তা করতাছো?” ক্ষেতে কাম করতে গিয়া করিম ভাইয়ের কাছে শুনলাম দেশের অবস্থা নাকি ভালা না। দেশে নাকি যুদ্ধ লাগছে। শহর থাইকা দলে দলে মানুষ গেরামে আইতাছে লুকায়া থাকনের লাইগা”। আমেনা বেগম সব শুনে অবাক হয়ে জানতে চাইলো “কিসের যুদ্ধ”? আবুল ভাত খেতে খেতে বললো “জানি না, তয় আমার খুব ডর লাগতাছে মানিকের লাইগা। ওরে একটু সাবধানে থাকতে কইও”।আমেনা বেগম মাথা নেড়ে জবাব দিলো “জি আইচ্ছা”।
রাতের বেলা খাওয়া শেষে যখন সবাই ঘুমাতে যাবে তখন পাশের বাড়ির মজিদ মিয়া, রমিজ মিয়া এসে আবুলকে ডাকতে লাগলো। আবুল ঘর থেকে বের হতেই তারা করিম মিয়ার বাড়িতে রেডিও শুনতে যাওয়ার প্রস্তাব দিলো। আবুল রাজি হয়ে চলে গেলো তাদের সাথে।
জ্যোৎস্না রাতে চাদের আলোয় ঘরের বাইরে পাটি পেতে মায়ের কোলে মাথা রেখে মানিক বায়না ধরলো গল্প বলার জন্য। আমেনা বেগম ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে গল্প শুরু করলো, “এক দেশে এক রাজা আছিলো, তার দুই রানী। সুয়োরানী, দুয়োরানী………”।গল্প শুনতে শুনতে মানিক কখন যে ঘুমিয়ে পড়লো টের পেলো না।
কিছুদিন পর গ্রামে পাক বাহিনী হানা দিতে শুরু করলো। গ্রামের অনেকেই মুক্তি বাহিনীতে যোগ দিলো। কিন্তু বউ আর ছেলের কথা ভেবে আবুল গেলো না।এই অবস্থার মাঝেও রোজকার মতো আবুল মাঠে গেলো কাজ করতে। মানিক তার জন্য দুপুরের খাবার নিয়ে গেলো। আবুল মানিককে খাবার রেখে বাড়ি যেতে বললো। মানিক বাবার কথা মতো বাড়ি চলে গেলো।
হঠাৎ কোথা থেকে একদল পাক সেনা এসে হাজির হলো আবুলের সামনে। ভাতের থালাটা লাথি দিয়ে ফেলে দিয়ে জিজ্ঞেস করলো “বোল, মুক্তি কিধার হ্যায়”? আবুল ভয়ে ভয়ে বললো “আমি জানি না হুজুর,আমারে ছাইড়া দ্যান”।
পাকবাহিনীর একজন “শালা, ঝুটা কাহিকে” বলে আবুলের বুকে লাথি মেরে দিলো। কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে একের পর এক আবুলের বুকে গুলি করে চলে গেলো।
এদিকে বাবার দেরি দেখে মানিক বাবার খোঁজে মাঠে এসে দেখে বাবার রক্তাক্ত নিথর শরীরটা মাটির উপর পড়ে আছে। পাশেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ভাত কাক গুলো পরম আনন্দে খেয়ে যাচ্ছে। মানিক বুঝতে পারলো না সে কি করবে। আসতে আসতে বাবার মৃতদেহের পাশে বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো। হঠাৎ মায়ের কথা মনে হতেই সে বাড়ির দিকে দৌড় দিলো। বাড়িতে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে মাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে বললো “মা, বাজানরে ওরা মাইরা ফালাইছে। আমি ওগো ছাড়ুম না, আমি যুদ্ধে যামু”।
আমেনা বেগম যেন কিছুই বুঝতে পারলো না। শোকে পাথর হয়ে গেলো।
পরদিন মাকে অনেক বুঝিয়ে মায়ের কাছ থেকে দোয়া চেয়ে বললো “মা, তুমি চিন্তা কইরো না। আমি যুদ্ধ শেষ হইলে ফিরা আসুম। তুমি সাবধানে থাইকো”।আমেনা বেগম কাঁদতে কাঁদতে মানিকের কপালে আলতো চুমু দিয়ে বললো “যা বাজান, সাবধানে থাকিস। খবর দিস।“
মায়ের কাছে থেকে বিদায় নিয়ে মানিক পাশের গ্রামে মুক্তিবাহিনী ক্যাম্পে চলে গেলো। ছোট বলে কেউ প্রথমে নিতে চাইলো না। শেষে ওর আগ্রহ দেখে রাজি হলো সবাই। কিছুদিনের মধ্যেই ট্রেনিং নিয়ে সব শিখে ফেললো। কয়েকটা ছোট খাটো অপারেশনে যোগ দিতে লাগলো। যুদ্ধশেষে ক্যাম্পে যখন সবাই জয়ের আনন্দ করতো ও তখন বসে বসে মায়ের কথা ভাবতো।
সেদিন একটা বড় অপারেশনে গেলো ওরা। যুদ্ধ করতে করতে হঠাৎ কেমন করে যেন একটা গুলি এসে লাগলো মানিকের বুকে। মানিকের মনে হলো ও পড়ে যাচ্ছে। ধরার কেউ নেই। ছোটবেলায় হাটতে হাটতে যখন পড়ে যেত তখন মা এসে ওকে ধরতো। আজ মা কোথায়? ওর যে খুব ঘুম পাচ্ছে। মা কি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দেবে। গল্প শোনাবে? মা এখন কেমন আছে? বেঁচে আছে তো? ও যে মাকে কথা দিয়েছিলো ফিরবে বলে। মা কি ওর ফেরার জন্য অপেক্ষা করছে? এসব ভাবতে ভাবতেই মানিক চিরকালের মতো ঘুমিয়ে পড়লো।
যুদ্ধ শেষ। দেশ স্বাধীন হয়েছে। সবাই ফিরেছে কিন্তু মানিক ফেরেনি। আমেনা বেগম ঘরের দুয়ারে বসে ছেলের জন্য পথ চেয়ে বসে আছে। তার বিশ্বাস মানিক ফিরবে। কারন, তার ছেলে যে তাকে কথা দিয়েছে।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ রাত ১০:৪১