somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অনেক দিন আগের কথা।

০৭ ই আগস্ট, ২০১৬ দুপুর ১:০৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :





৩রা মে, ২০১৪।

অন্যান্য দিনের মতনই সাধারণ একটা দিন। একদম সাধারণও অবশ্য বলা যাচ্ছে না। একটু আগেই শুনলাম এহার মা-কে বলতে, „তোমার বাবাকে বল কাপড় নাড়তে যেতে।“ এহা এবং এহার বাবা একই রুমে আছে। আমাকে সরাসরি না বলে এহাকে দিয়ে বলা মানে হচ্ছে ঘরের আবহাওয়া ভাল না। যেকোনো মুহূর্তে ঝড়ের পূর্বাভাস। এই ঝড় শেষ হতে কয়েকটা দিন লেগে যাবে। এই কয়েকদিন এহা এবং রিহাকে দিয়ে আমার সাথে কথা বার্তা চলবে। খুব সম্ভবত বাসায় রান্নাবান্নাও বন্ধ থাকবে দুই দিন। বাইরে চমৎকার রোদেলা আবহাওয়া, তবুও শনিবারটা ভাল কাটবে বলে মনে হচ্ছে না।

কাপড় নেড়ে বাসায় ফিরেই শুনলাম, „তোমার বাবাকে বলতে পার না, সব সময় সব কিছু আমাকে কেন করতে হবে!“ এহার মুখ শুকনো, শনিবারের ছুটির দিনে তার বিশেষ কিছু করার নেই। আমার উপরের ঝাড়ি আপাতত তাকে খেতে হচ্ছে। বেচারা।কে যেন ফোন করছে, একবার বাজার পর ধরি নি। নাছোড় বান্দার মতন রিং বাজিয়েই চলেছে। রিফাত ভাই ফোন করেছেন, না ধরলেই না।

„কি খবর, আদনান, আজকে শনিবার ফ্রি আছ নাকি? তোমার সাথে দেখা করব করব বলছিলাম অনেকদিন ধরে, তোমার সময় থাকলে আজকে …“ গত এক বছর ধরে উনার আমার বাসায় আসার কথা, এর আগেও ফোন করে বলেছেন, চলে আসছি। শেষ মুহূর্তে অন্য কাজে আটকা পড়ে গেছেন বলে আসতে পারেন নি। আজকের ঝড়ের দিনেই উনার আসার কি দরকার!

„চলে আসেন রিফাত ভাই, আমি বাসাতেই আছি। বাচ্চাদের সাথে একটু সময় কাটাচ্ছি, ফ্রি আছি।“

„কোন ঝামেলা করবা না আদনান। আমরা জাস্ট আসব আর দেখা করেই ফুট মারব। রান্না বান্নার কোন ঝামেলা করবা না।

“ খাইসে, এমনিতেই বাসার আবহাওয়া ভাল না, এর মধ্যে গেস্ট আসলে কি হবে কে জানে। উনি আবার আরেকজনকে সাথে নিয়ে আসছেন। রান্নার মানুষ এই ঘটনা শুনলে আমাকেই রান্না করে ফেলতে পারে।

ভয়ে ভয়ে বললাম „কে আসছে সাথে?“

„আমাদের এক কলিগ, অনেকদিন পর স্টুটগার্টে এসেছে ঘুরতে। আজকে আমাদের কোন নির্দিষ্ট কোন গন্তব্য নেই, ভাবলাম তোমার সাথে দেখা করি।“

„চলে আসেন ভাই, ভালই হবে আপনার কলিগের সাথে পরিচিত হয়ে।“

ভালই হবে বৈকি, আজকে শনিবার কপালে কি শনি আছে কে জানে।

এহা জানতে চায়, „কেউ কি আসবে আজকে আমাদের বাসায়, বাবা?“

„হু।“

এহা রিহা দুইজন চিৎকার করতে করতে মা-র কাছে গিয়ে খবর দিয়ে আসল।

„আজকে বাবার বন্ধুরা আসবে।“

„তোমার বাবাকে বল আজকে রান্না করতে।“

গত ১০ বছর নিজে রান্না করি নি, আপাতত শেষ অস্র প্রয়োগ চলছে। রিফাত ভাই প্রথম বাসায় আসছেন, তাও আবার কলিগ নিয়ে। বেচারাদের চা বিস্কুট খাইয়ে বিদায় করে দিতে হবে ভেবে একটু টেনশনে পড়ে গেলাম। এবারও রিফাত ভাই শেষ মুহূর্তে প্ল্যান বদলে ফেললে কেমন হয়!



জার্মানিতে এক যুগের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, বাংলাদেশীরা তিনটেয় আসার কথা থাকলে চারটের দিকে ফোন দিয়ে বলে, ভাই ট্রেনটা একটুর জন্য মিস করে ফেলেছি, পাঁচটার মধ্যেই চলে আসব। তারপর ছয়টায় এসে হাসিমুখে বলবে, একটু দেরী করে ফেললাম ভাই।

রিফাত ভাই আর্মিতে ছিলেন এই তথ্যটা জানা ছিল না। চারটের সময় আসার কথা বলে কাঁটায় কাঁটায় চারটের সময় দরজা খুলে অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। তখনো শর্মির সাথে অচল অবস্থাটা কিভাবে মিটিয়ে ফেলা যায়, সেটার প্ল্যান করা শেষ করে উঠতে পারি নি। অনেক বছর ধরে ফেসবুকের মাধ্যমে পরিচয়, তবে রিফাত ভাইয়ের সাথে এই প্রথম দেখা। উনি মাই ডিয়ার টাইপের মানুষ, দেখা হবার সাথে সাথে দরজাতেই আপন মানুষের মতন আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। তার আলিঙ্গনের উষ্ণতায় আলোকিত দিনটা আরও আলোকিত হয়ে উঠল।

রিফাত ভাইয়ের সাথে অসম্ভব সুদর্শন লম্বা করে একটা ছেলে। ছেলেটা আমাকে দেখে সুন্দর করে হেসে সালাম দিল। আমি আপনি করে বলতেই বলল, „আমাকে তুমি করে বলবেন“।

ছেলেটা আমাদের বয়েসি হবে হয়তো। পেছনে উঁকি দেয়া কৌতূহলী বাচ্চাদের সারি এবং বাচ্চাদের বাবার মাথার ফর্সা টাক দেখে আমাকে একটু বয়স্কই ভেবেছে হয়তো। ছেলেটার হাসি কেমন চেনা চেনা, মনে হয় যেন খুব আপন কেউ।



আমরা সামনের ঘরে বসলাম। শর্মির ঘর ভেতর থেকে বন্ধ। আমার বন্ধুদের সে দেখা করবে – এমন সম্ভাবনা খুব কম। কথা বলার মাঝে রিফাত ভাইয়ের সাথে আসা ছেলেটা বার বার গলা ছেড়ে হাসছিল। ছেলেটা চমৎকার গুছিয়ে গল্প বলে, হাসিটা যেন কোথাও শুনেছি, এমন মনে হয়।

রিফাত ভাই কথায় কথায় বললেন, „রাজি কিন্তু তোমাদের নটরডেম কলেজে ছিল!“

„নটরডেম, তাই নাকি? কোন ব্যাচ?“

„৯৫।“

আমার তখন অবাক হবার পালা। আমি নিজেও ৯৫ ব্যাচ ছিলাম নটরডেম কলেজে। হয়তো কলেজে দেখেছি, এইজন্যই এত চেনা চেনা মনে হচ্ছে? অবশ্য নটরডেম অনেক বড় কলেজ, প্রতি ব্যাচে হাজার খানেক ছেলে। এক গ্রুপের ছেলেরা অন্য গ্রুপের ছেলেদের খুব কমই চেনে।

„কোন গ্রুপ?“

„গ্রুপ সেভেন।“

„গ্রুপ সেভেনের ক্যাপ্টেন ছিল যেই ছেলেটা মনে আছে ওঁর কথা?“

„আদনান? হ্যাঁ, ওঁকে অংক স্যার ক্যাপ্টেন বানালেন। খুব মজার একটা ঘটনা। স্যার একদিন ক্লাসে এসে বললেন, কে কে ক্যাপ্টেন হতে চাও। সাতজন দাঁড়ালো। স্যার বললেন, সাতজন থেকে বাছাই করা তো সমস্যা। দুই জন করে প্রতি সপ্তাহে আমরা ছয়জনকে দায়িত্ব দিয়ে দেখব। এর মধ্যে যারা ভাল কাজ করবে, তাদেরকে স্থায়ী ভাবে ক্যাপ্টেন নির্বাচিত করা হবে। সাতজন থেকে একজন বসে যাও, তাহলে ছয়জন নিয়ে কাজ করতে সুবিধে হবে। সাতজনের একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকায়। কেউ নিজে থেকে বসতে চায় না। শেষমেশ আদনান বসে পড়ল। বাকি ছয়জন স্বস্তির হাসি হাসল। স্যার অবশ্য ছয়জনের সবাইকে বসিয়ে দিয়ে ঘোষণা দিলেন, আদনানই ক্যাপ্টেন হবে। যেই ছেলে অন্যদের জন্য নিজের পজিশন সেক্রিফাইস করতে পারে সেই ক্যাপ্টেন হবার যোগ্য…“

রাজির সাথে আমার পরিচয় এসএসসি দেবার আগে কলাবাগানের ই-হক কোচিং সেন্টারে ১৯৯২ সালে। রাজি আমাকে দেখে চিনতে পারে নি। গ্রুপ সেভেনের ক্যাপ্টেন হবার গল্পটা ১৯৯৩ সালের ঘটনা সে ২১ বছর পরেও ঠিক মনে রেখেছে। বাইলজি নেবার জন্য গ্রুপ সেভেনে কয়েক মাস থেকেই সেই ছেলেটা অন্য গ্রুপ চলে গিয়েছিল। নটরডেম থেকে পাস করে রাজি সামরিক বাহিনীতে যোগ দিয়েছিল, গ্রুপ সেভেন মাত্র কয়েকটা মাস একসাথে থেকে আলাদা হবার পর আর যোগাযোগ ছিল না। সেই রাজি আজকে ২১ বছর পর জার্মানিতে আমার বাসায় বসে আমাকেই আমার কলেজ জীবনের গল্প শোনাচ্ছে!

শর্মির সাথে ঝগড়া টগড়া ভুলে গিয়ে দৌড়ে গিয়ে ওকে ডেকে আনলাম জোর করে। অলৌকিক ঘটনা প্রতিদিন ঘটে না, আজকে রাগ করে থাকার দিন না।



রিফাত ভাই একটু বসেই চলে যেতে পারলে না। আমার মায়াবতী স্ত্রী রাগ ভুলে গিয়ে রকমারি রান্না করতে বসে গেল। রাজি দুইদিন আমাদের বাসায় থেকে গেল, সারা রাত ধরে আমাদের গল্প গুজব চলল। কত বছর আগেকার ছেলেমানুষি কথা স্মরণ করে হাসাহাসি করলাম। রাজির জীবন, ক্যারিয়ার অত্যন্ত রাজকীয়। সামরিক বাহিনী থেকে মেজর হিসেবে স্বেচ্ছা অবসর নিয়ে বছর তিনেক আগে সুইজারল্যান্ডে চলে এসেছে স্থায়ীভাবে তার সুইস স্ত্রীর কাছে। রাজি পৃথিবীর ৬৪টি দেশে ঘুরেছে, তার অভিজ্ঞতার অসামান্য সব গল্প আর জীবন কাহিনী শুনলাম মন্ত্রমুগ্ধের মতন।

রাজিকে দুইদিন পর বিদায় দেবার মুহুর্তে।
রাজিকে দুইদিন পর বিদায় দেবার আগ মুহুর্তে।
রাজি বার বার বলছিল, „সেই ২০ বছর আগে যদি কেউ আমাদের বলত, পরের বার আবার ২০ বছর পরে দেশ থেকে বহু যোজন দূরে জার্মানির একটি শহরে আমাদের দেখা হবে, বিশ্বাস করা যায়!“। নাহ, বিশ্বাস করা তো দূরে থাক, এমন ভাবনাও মনে আসতো না কখনও। ঠিক যেমন আজকে ভাবতেও পারছি না, আরও ২০ বছর পর জীবন কি রহস্য নিয়ে হাজির হবে, পৃথিবীর অন্য কোন এক প্রান্তে!

আমাদের জীবনের সুন্দরতম এবং আনন্দময় সময় আমাদের শৈশব এবং কৈশোরকাল। জীবন বড় কঠিন, সে তার স্বাভাবিক নিয়মে এইসময়ের বন্ধু প্রিয়জনদের দূরে সরিয়ে দেয়। তারপর কখনও কখনও জীবন আবার গভীর মমতায় অনেক বছর আগের প্রিয় মুখগুলিকে সামনে নিয়ে আসে। হারিয়ে যাওয়া দিনের সকল অস্পষ্ট হয়ে আসতে থাকা ছবিগুলো আবার ফিরে ফিরে আসে। অতীতের স্মৃতি চারণ আর নস্টালজিয়াতে চারদিক ভরে ওঠে। সেই তুলনাহীন আনন্দে ভাসতে ভাসতে হারিয়ে যাওয়া সব স্কুল কলেজের অসংখ্য প্রিয় মুখের কথা মনে পড়ে। মনে মনে অপেক্ষায় থাকি, একদিন আবার সেই সুর বাজবে। হঠাত অচেনা পথে দেখা হয়ে যাবে পুরনো কোন চেনা মুখের সাথে। বুকে জড়িয়ে ধরে বলব, „বন্ধু, কি খবর বল।“১

৩রা মে, ২০১৪।

অন্যান্য দিনের মতনই সাধারণ একটা দিন। একদম সাধারণও অবশ্য বলা যাচ্ছে না। একটু আগেই শুনলাম এহার মা-কে বলতে, „তোমার বাবাকে বল কাপড় নাড়তে যেতে।“ এহা এবং এহার বাবা একই রুমে আছে। আমাকে সরাসরি না বলে এহাকে দিয়ে বলা মানে হচ্ছে ঘরের আবহাওয়া ভাল না। যেকোনো মুহূর্তে ঝড়ের পূর্বাভাস। এই ঝড় শেষ হতে কয়েকটা দিন লেগে যাবে। এই কয়েকদিন এহা এবং রিহাকে দিয়ে আমার সাথে কথা বার্তা চলবে। খুব সম্ভবত বাসায় রান্নাবান্নাও বন্ধ থাকবে দুই দিন। বাইরে চমৎকার রোদেলা আবহাওয়া, তবুও শনিবারটা ভাল কাটবে বলে মনে হচ্ছে না।

কাপড় নেড়ে বাসায় ফিরেই শুনলাম, „তোমার বাবাকে বলতে পার না, সব সময় সব কিছু আমাকে কেন করতে হবে!“ এহার মুখ শুকনো, শনিবারের ছুটির দিনে তার বিশেষ কিছু করার নেই। আমার উপরের ঝাড়ি আপাতত তাকে খেতে হচ্ছে। বেচারা।কে যেন ফোন করছে, একবার বাজার পর ধরি নি। নাছোড় বান্দার মতন রিং বাজিয়েই চলেছে। রিফাত ভাই ফোন করেছেন, না ধরলেই না।

„কি খবর, আদনান, আজকে শনিবার ফ্রি আছ নাকি? তোমার সাথে দেখা করব করব বলছিলাম অনেকদিন ধরে, তোমার সময় থাকলে আজকে …“ গত এক বছর ধরে উনার আমার বাসায় আসার কথা, এর আগেও ফোন করে বলেছেন, চলে আসছি। শেষ মুহূর্তে অন্য কাজে আটকা পড়ে গেছেন বলে আসতে পারেন নি। আজকের ঝড়ের দিনেই উনার আসার কি দরকার!

„চলে আসেন রিফাত ভাই, আমি বাসাতেই আছি। বাচ্চাদের সাথে একটু সময় কাটাচ্ছি, ফ্রি আছি।“

„কোন ঝামেলা করবা না আদনান। আমরা জাস্ট আসব আর দেখা করেই ফুট মারব। রান্না বান্নার কোন ঝামেলা করবা না।

“ খাইসে, এমনিতেই বাসার আবহাওয়া ভাল না, এর মধ্যে গেস্ট আসলে কি হবে কে জানে। উনি আবার আরেকজনকে সাথে নিয়ে আসছেন। রান্নার মানুষ এই ঘটনা শুনলে আমাকেই রান্না করে ফেলতে পারে।

ভয়ে ভয়ে বললাম „কে আসছে সাথে?“

„আমাদের এক কলিগ, অনেকদিন পর স্টুটগার্টে এসেছে ঘুরতে। আজকে আমাদের কোন নির্দিষ্ট কোন গন্তব্য নেই, ভাবলাম তোমার সাথে দেখা করি।“

„চলে আসেন ভাই, ভালই হবে আপনার কলিগের সাথে পরিচিত হয়ে।“

ভালই হবে বৈকি, আজকে শনিবার কপালে কি শনি আছে কে জানে।

এহা জানতে চায়, „কেউ কি আসবে আজকে আমাদের বাসায়, বাবা?“

„হু।“

এহা রিহা দুইজন চিৎকার করতে করতে মা-র কাছে গিয়ে খবর দিয়ে আসল।

„আজকে বাবার বন্ধুরা আসবে।“

„তোমার বাবাকে বল আজকে রান্না করতে।“

গত ১০ বছর নিজে রান্না করি নি, আপাতত শেষ অস্র প্রয়োগ চলছে। রিফাত ভাই প্রথম বাসায় আসছেন, তাও আবার কলিগ নিয়ে। বেচারাদের চা বিস্কুট খাইয়ে বিদায় করে দিতে হবে ভেবে একটু টেনশনে পড়ে গেলাম। এবারও রিফাত ভাই শেষ মুহূর্তে প্ল্যান বদলে ফেললে কেমন হয়!



জার্মানিতে এক যুগের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, বাংলাদেশীরা তিনটেয় আসার কথা থাকলে চারটের দিকে ফোন দিয়ে বলে, ভাই ট্রেনটা একটুর জন্য মিস করে ফেলেছি, পাঁচটার মধ্যেই চলে আসব। তারপর ছয়টায় এসে হাসিমুখে বলবে, একটু দেরী করে ফেললাম ভাই।

রিফাত ভাই আর্মিতে ছিলেন এই তথ্যটা জানা ছিল না। চারটের সময় আসার কথা বলে কাঁটায় কাঁটায় চারটের সময় দরজা খুলে অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। তখনো শর্মির সাথে অচল অবস্থাটা কিভাবে মিটিয়ে ফেলা যায়, সেটার প্ল্যান করা শেষ করে উঠতে পারি নি। অনেক বছর ধরে ফেসবুকের মাধ্যমে পরিচয়, তবে রিফাত ভাইয়ের সাথে এই প্রথম দেখা। উনি মাই ডিয়ার টাইপের মানুষ, দেখা হবার সাথে সাথে দরজাতেই আপন মানুষের মতন আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। তার আলিঙ্গনের উষ্ণতায় আলোকিত দিনটা আরও আলোকিত হয়ে উঠল।

রিফাত ভাইয়ের সাথে অসম্ভব সুদর্শন লম্বা করে একটা ছেলে। ছেলেটা আমাকে দেখে সুন্দর করে হেসে সালাম দিল। আমি আপনি করে বলতেই বলল, „আমাকে তুমি করে বলবেন“।

ছেলেটা আমাদের বয়েসি হবে হয়তো। পেছনে উঁকি দেয়া কৌতূহলী বাচ্চাদের সারি এবং বাচ্চাদের বাবার মাথার ফর্সা টাক দেখে আমাকে একটু বয়স্কই ভেবেছে হয়তো। ছেলেটার হাসি কেমন চেনা চেনা, মনে হয় যেন খুব আপন কেউ।



আমরা সামনের ঘরে বসলাম। শর্মির ঘর ভেতর থেকে বন্ধ। আমার বন্ধুদের সে দেখা করবে – এমন সম্ভাবনা খুব কম। কথা বলার মাঝে রিফাত ভাইয়ের সাথে আসা ছেলেটা বার বার গলা ছেড়ে হাসছিল। ছেলেটা চমৎকার গুছিয়ে গল্প বলে, হাসিটা যেন কোথাও শুনেছি, এমন মনে হয়।

রিফাত ভাই কথায় কথায় বললেন, „রাজি কিন্তু তোমাদের নটরডেম কলেজে ছিল!“

„নটরডেম, তাই নাকি? কোন ব্যাচ?“

„৯৫।“

আমার তখন অবাক হবার পালা। আমি নিজেও ৯৫ ব্যাচ ছিলাম নটরডেম কলেজে। হয়তো কলেজে দেখেছি, এইজন্যই এত চেনা চেনা মনে হচ্ছে? অবশ্য নটরডেম অনেক বড় কলেজ, প্রতি ব্যাচে হাজার খানেক ছেলে। এক গ্রুপের ছেলেরা অন্য গ্রুপের ছেলেদের খুব কমই চেনে।

„কোন গ্রুপ?“

„গ্রুপ সেভেন।“

„গ্রুপ সেভেনের ক্যাপ্টেন ছিল যেই ছেলেটা মনে আছে ওঁর কথা?“

„আদনান? হ্যাঁ, ওঁকে অংক স্যার ক্যাপ্টেন বানালেন। খুব মজার একটা ঘটনা। স্যার একদিন ক্লাসে এসে বললেন, কে কে ক্যাপ্টেন হতে চাও। সাতজন দাঁড়ালো। স্যার বললেন, সাতজন থেকে বাছাই করা তো সমস্যা। দুই জন করে প্রতি সপ্তাহে আমরা ছয়জনকে দায়িত্ব দিয়ে দেখব। এর মধ্যে যারা ভাল কাজ করবে, তাদেরকে স্থায়ী ভাবে ক্যাপ্টেন নির্বাচিত করা হবে। সাতজন থেকে একজন বসে যাও, তাহলে ছয়জন নিয়ে কাজ করতে সুবিধে হবে। সাতজনের একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকায়। কেউ নিজে থেকে বসতে চায় না। শেষমেশ আদনান বসে পড়ল। বাকি ছয়জন স্বস্তির হাসি হাসল। স্যার অবশ্য ছয়জনের সবাইকে বসিয়ে দিয়ে ঘোষণা দিলেন, আদনানই ক্যাপ্টেন হবে। যেই ছেলে অন্যদের জন্য নিজের পজিশন সেক্রিফাইস করতে পারে সেই ক্যাপ্টেন হবার যোগ্য…“

রাজির সাথে আমার পরিচয় এসএসসি দেবার আগে কলাবাগানের ই-হক কোচিং সেন্টারে ১৯৯২ সালে। রাজি আমাকে দেখে চিনতে পারে নি। গ্রুপ সেভেনের ক্যাপ্টেন হবার গল্পটা ১৯৯৩ সালের ঘটনা সে ২১ বছর পরেও ঠিক মনে রেখেছে। বাইলজি নেবার জন্য গ্রুপ সেভেনে কয়েক মাস থেকেই সেই ছেলেটা অন্য গ্রুপ চলে গিয়েছিল। নটরডেম থেকে পাস করে রাজি সামরিক বাহিনীতে যোগ দিয়েছিল, গ্রুপ সেভেন মাত্র কয়েকটা মাস একসাথে থেকে আলাদা হবার পর আর যোগাযোগ ছিল না। সেই রাজি আজকে ২১ বছর পর জার্মানিতে আমার বাসায় বসে আমাকেই আমার কলেজ জীবনের গল্প শোনাচ্ছে!

শর্মির সাথে ঝগড়া টগড়া ভুলে গিয়ে দৌড়ে গিয়ে ওকে ডেকে আনলাম জোর করে। অলৌকিক ঘটনা প্রতিদিন ঘটে না, আজকে রাগ করে থাকার দিন না।



রিফাত ভাই একটু বসেই চলে যেতে পারলে না। আমার মায়াবতী স্ত্রী রাগ ভুলে গিয়ে রকমারি রান্না করতে বসে গেল। রাজি দুইদিন আমাদের বাসায় থেকে গেল, সারা রাত ধরে আমাদের গল্প গুজব চলল। কত বছর আগেকার ছেলেমানুষি কথা স্মরণ করে হাসাহাসি করলাম। রাজির জীবন, ক্যারিয়ার অত্যন্ত রাজকীয়। সামরিক বাহিনী থেকে মেজর হিসেবে স্বেচ্ছা অবসর নিয়ে বছর তিনেক আগে সুইজারল্যান্ডে চলে এসেছে স্থায়ীভাবে তার সুইস স্ত্রীর কাছে। রাজি পৃথিবীর ৬৪টি দেশে ঘুরেছে, তার অভিজ্ঞতার অসামান্য সব গল্প আর জীবন কাহিনী শুনলাম মন্ত্রমুগ্ধের মতন।

রাজিকে দুইদিন পর বিদায় দেবার মুহুর্তে।
রাজিকে দুইদিন পর বিদায় দেবার আগ মুহুর্তে।
রাজি বার বার বলছিল, „সেই ২০ বছর আগে যদি কেউ আমাদের বলত, পরের বার আবার ২০ বছর পরে দেশ থেকে বহু যোজন দূরে জার্মানির একটি শহরে আমাদের দেখা হবে, বিশ্বাস করা যায়!“। নাহ, বিশ্বাস করা তো দূরে থাক, এমন ভাবনাও মনে আসতো না কখনও। ঠিক যেমন আজকে ভাবতেও পারছি না, আরও ২০ বছর পর জীবন কি রহস্য নিয়ে হাজির হবে, পৃথিবীর অন্য কোন এক প্রান্তে!

আমাদের জীবনের সুন্দরতম এবং আনন্দময় সময় আমাদের শৈশব এবং কৈশোরকাল। জীবন বড় কঠিন, সে তার স্বাভাবিক নিয়মে এইসময়ের বন্ধু প্রিয়জনদের দূরে সরিয়ে দেয়। তারপর কখনও কখনও জীবন আবার গভীর মমতায় অনেক বছর আগের প্রিয় মুখগুলিকে সামনে নিয়ে আসে। হারিয়ে যাওয়া দিনের সকল অস্পষ্ট হয়ে আসতে থাকা ছবিগুলো আবার ফিরে ফিরে আসে। অতীতের স্মৃতি চারণ আর নস্টালজিয়াতে চারদিক ভরে ওঠে। সেই তুলনাহীন আনন্দে ভাসতে ভাসতে হারিয়ে যাওয়া সব স্কুল কলেজের অসংখ্য প্রিয় মুখের কথা মনে পড়ে। মনে মনে অপেক্ষায় থাকি, একদিন আবার সেই সুর বাজবে। হঠাত অচেনা পথে দেখা হয়ে যাবে পুরনো কোন চেনা মুখের সাথে। বুকে জড়িয়ে ধরে বলব, „বন্ধু, কি খবর বল।“
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই আগস্ট, ২০১৬ দুপুর ১:০৪
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

লালনের বাংলাদেশ থেকে শফি হুজুরের বাংলাদেশ : কোথায় যাচ্ছি আমরা?

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:১৪



মেটাল গান আমার নিত্যসঙ্গী। সস্তা, ভ্যাপিড পপ মিউজিক কখনোই আমার কাপ অফ টি না। ক্রিয়েটর, ক্যানিবল কর্পস, ব্লাডবাথ, ডাইং ফিটাস, ভাইটাল রিমেইনস, ইনফ্যান্ট এনাইহিলেটর এর গানে তারা মৃত্যু, রাজনীতি,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমেরিকার গ্র্যান্ড কেনিয়ন পৃথিবীর বুকে এক বিস্ময়

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৪১


প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে হাতে গাছের ডাল আর পরনে সাধা পোশাক পরিহিত এক মহিলার ভাটাকতে হুয়ে আতমা গ্র্যান্ড কেনিয়নের নীচে ঘুরে বেড়ায়। লোকমুখে প্রচলিত এই কেনিয়নের গভীরেই মহিলাটি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি! চুরি! সুপারি চুরি। স্মৃতি থেকে(১০)

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৪


সে অনেকদিন আগের কথা, আমি তখন প্রাইমারি স্কুলে পড়ি। স্কুলে যাওয়ার সময় আব্বা ৩ টাকা দিতো। আসলে দিতো ৫ টাকা, আমরা ভাই বোন দুইজনে মিলে স্কুলে যেতাম। আপা আব্বার... ...বাকিটুকু পড়ুন

যেকোন বাংগালীর ইন্টারভিউর সময়, 'লাই-ডিটেক্টটর' যোগ করে ইন্টারভিউ নেয়ার দরকার।

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৫ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:০৭



আপনার এনলাকার এমপি, প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী কামাল সাহেব, যেকোন সেক্রেটারী, যেকোন মেয়র, বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান, বিএনপি'র রিজভী, আওয়ামী লীগের ওয়ায়দুল কাদের, আপনার থানার ওসি, সীমান্তের একজন বিজিবি সদস্য, ঢাকার... ...বাকিটুকু পড়ুন

তাবলীগ এর ভয়ে ফরজ নামাজ পড়ে দৌড় দিয়েছেন কখনো?

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:২৬


আমাদের দেশের অনেক মসজিদে তাবলীগ এর ভাইরা দ্বীন ইসলামের দাওয়াত দিয়ে থাকেন। তাবলীগ এর সাদামাটাভাবে জীবনযাপন খারাপ কিছু মনে হয়না। জামাত শেষ হলে তাদের একজন দাঁড়িয়ে বলেন - °নামাজের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×