সরকারি দল মনে করছে বিরোধীদল বাংলাদেশকে পাকিস্তান বানাতে চায়। আবার বিরোধীদলের দাবী সরকার বাংলাদেশকে সিকিম বানাতে চায়। পাকিস্তান বানাতে চাওয়া হল, দেশ পাকিস্তানের মতো তালেবানী রাষ্ট্র হবে। পাকিস্তান বাংলাদেশের চেয়ে এক ধাপ উপরের রাষ্ট্র। তারা উন্নয়নশীল দেশ আর আমরা স্বল্প উন্নত। পাকিস্তানের জনগণের মাথাপিছু আয় বাংলাদেশের জনগণের দ্বিগুণেরও বেশি। শিক্ষার হার প্রায় সমান তবে মানে তারা এগিয়ে। প্রাইমারি ও মাধ্যমিক পরীক্ষায় শিক্ষকদের ৬০% বলে দেয়ার নীতি অন্তত ওখানে নেই। ওদের বিচার বিভাগ যে কতটা শক্তিশালী তা আমরা টের পেলাম ক্ষমতাসীন রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দেখে। আমরা কি এটা ভাবতে পারি? ওদের পত্রিকা ডন এর মানের সাথে আমাদের কোন পত্রিকাটির তুলনা করা যায় না। এর মধ্যেও উগ্র মৌলবাদ পাকিস্তানে একটি বড় সমস্যা। ওখানকার পাহাড়ী ও আফগান সীমান্তবর্তী এলাকাতে তালেবান সমস্যা রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে পাকিস্তান অনেক স্থিতিশীল বলেই মনে হচ্ছে। একাত্তর পর্যন্ত আমাদের সম্পদ শোষণ করেই তারা সম্পদ বানিয়েছে। পাকিস্তানকে আমরা ঘৃণা করি একাত্তরে তাদের হত্যা, ধর্ষণ ইত্যাদি কারণে। কিন্তু আমরা তাদের যতই ঘৃণা করি না কেন, তারা আমাদের ছেড়ে অনেকটা পথ এগিয়েছে ইতোমধ্যে। আর আমরা তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে ৩ বছরে দুই ফুট উঠলে পরের দুই বছরে পৌনে দুই ফুট নামি। এই হিসাবে পাকিস্তান হওয়াটা যতটা ঘৃণা-লজ্জার ততটা ক্ষতির নয়।
সিকিম হওয়াটা একেবারে আলাদা বিষয়। একদা সিকিম স্বাধীন রাষ্ট্র ছিল। ভারত ও চীনের মাঝখানে অতিগুরুত্বপূর্ণ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। প্রথমে জাতিসংঘে এর সদস্যপদে বাঁধ সাথে সোভিয়েত ইউনিয়ন। কারণ ছিল ভারতের আবদার। ভারত চেয়েছিল সিকিমকে গ্রাস করতে। এজন্য প্রথমে তারা রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে। বলা হয় এজন্য ভারত তার বিপুল পরিমাণ সৈন্যকে সিভিল ড্রেসে সিকিমে পাঠিয়ে আন্দোলন করায়। সেই আন্দোলনে রাজতন্ত্রের পতন হয়। জবরদস্তিমূলক এক গণভোট কেড়ে নেয় সিকিমের স্বাধীনতা। সিকিম ভারতের রাজ্য হয়ে যায়। তার মানে আমাদের সিকিম হয়ে যাওয়া মানে আমাদের স্বাধীনতা হারানো। ফাউ কিছু লাভও হবে, ভারত যেতে ভিসা লাগবে না। বাংলাদেশকে সিকিম বানানোর প্রধান অন্তরায় এদেশের জনগণ। দেশের প্রায় ৯০ ভাগ মানুষ মুসলমান। তারা এটা কোনভাবেই মেনে নেবে না। কেউ কেউ বলতে পারেন সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান নিয়েতো কাস্মিরও ভারতের সাথে থাকছে। আন্দোলন করে তো স্বাধীনতা পায়নি। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একজন অধ্যাপক বললেন, বাংলাদেশের সিকিমে পরিনত হওয়া সম্ভব এবং এটা হলে ৪শ বছরেও আন্দোলন করে স্বাধীনতা পুনরোদ্ধার করতে পারবে না। কারণ টোটাল ভারতে মুসলমান হয়ে পড়বে সংখ্যা লঘু। তার মানে আমাদের জন্য সিকিম হওয়া বড় কঠিন।
সাম্প্রতিক বাংলাদেশ নিয়ে ভারত মরিয়া হয়ে উঠেছে। অনেকের ধারণা বাংলাদেশে এক তরফা নির্বাচন অনুষ্ঠানে ভারতের ভূমিকা বিপুল। সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার অজুহাতে সদ্য অনুষ্ঠিত নির্বাচনকে ভারতই পৃথিবীতে একমাত্র বৈধতাদানকারী রাষ্ট্র হয়েছে। এর আগে ভারত বিদ্বেষ থেকে হিন্দু বিদ্বেষ শীর্ষক একটি কলামে বলেছিলাম, ভারতের এসব ভূমিকায় মানুষ প্রথমে ভারত বিদ্বেষি হবে এবং পরবর্তীতে হিন্দু বিদ্বেষী হবে। অত্যন্ত দুর্ভাগ্য যে সেটাই হয়েছে। দেশের শত শত হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের বাড়িঘর ও তাদের উপর নেক্কারজনক হামলা চালানো হয়েছে। তাদের মন্দির ভাঙ্গচুর করা হয়েছে, প্রতিমা ভাঙা হয়েছে। এদেশ হতে প্রায় দুই তৃতীয়াংশ হিন্দু ইতোমধ্যে দেশ ছেড়ে চলে গেছে। এর ক্ষতি শুধু রাষ্ট্রই বহন করছে না সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে নির্যাতিতরাসহ সকল হিন্দুরা। তাদের মুসলমানদের উপর হতে বিশ্বাস সম্পূর্ণ উঠে যাচ্ছে। এসব হামলা বন্ধে রাষ্ট্র প্রায় নির্বিকার। হামলার অভিযোগ উঠেছে সরকারবিরোধীদের উপর। যদিও বিরোধীরা দেখাতে চাচ্ছে, যে কয়েকজন ধরা পড়েছে তারা সরকারি দলের লোক। সরকারের উচিৎ সংখ্যালঘুদের উপর হামলাকে অতিগুরুত্ব দিয়ে হামলাকারীদের দমন করা। বাংলাদেশের মতো নির্বাচন নিয়ে ঝামেলা হয়েছিল জিম্বাবুয়েতে। ওখানে বিরোধীদল অবশ্য অংশ নিয়েছিল কিন্তু বশংবদ নির্বাচন কমিশনার রেজাল্ট উল্টে দেয়। এর পরিনতিতে জাতির জনক রবার্ট মুগাবে বিশ্বব্যাপী নিন্দিত ও ঘৃণিত হচ্ছেন। নিজ দেশেতো জনপ্রিয়তা হারিয়ে নির্লজ্জের মতো ক্ষমতা দখল করে আছে। ওখানে মুগাবের পেছনে ভূমিকা রেখেছে দক্ষিণ আফ্রিকা। এতে দক্ষিণ আফ্রিকার স্বার্থ রয়েছে, যেমন এখানে ভারতের দুটি স্বার্থ রয়েছে। তাদের প্রধান স্বার্থ হল- ব্যবসায়িক স্বার্থ দ্বিতীয় স্বার্থ হল সন্ত্রাস। তারা বাংলাদেশে উগ্রপন্থীদের উত্থান চায় না। এ ভূখণ্ড ব্যবহার করে ভারতের সন্ত্রাসবাদে যাতে কোনরূপ সহযোগিতা না হয় সেই নিশ্চয়তা তাদের শুধু বর্তমান সরকারই দিতে পেরেছে। এ সরকারের আমলেই বিনা অর্থে আমাদের ভূখণ্ড সড়ক ভারত ব্যবহার করতে পেরেছে। অথচ বিনিময়ে ভারত আমাদের কিছুই দেয়নি এবং ওদের দেশেই মৌলবাদের উত্থান ঘটেছে।
দেশে অর্ধেকের বেশি আসনে ভোটারদের ভোটদানের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হল আবার অবশিষ্ট ভোটার এলাকায় বিরোধীদলবিহীন নির্বাচনে সীমাহীন কারচুপি করা হল। ব্যাপক জাল ভোট ও সিল মারা ভোট সচেতন মানুষ মেনে নেয়নি। সবচেয়ে চাপে পড়েছেন আওয়ামীলীগের সমর্থকগণ, তারা লজ্জায় মুখ লোকানোর চেষ্টা করছেন। তাদের গর্বের যায়গায় এবার তীব্র আঘাত লেগেছে। নির্বাচনী দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা কমবেশি নাজেহাল হয়েছেন। তারা সম্মান ও দায়িত্ব বিসর্জন দিয়ে, ঝুঁকির মধ্যে থেকেই ব্যালট দিতে বাধ্য হয়েছেন অবৈধভাবে সীল মারার জন্য। অনেক এমপিই সাহস করেননি সুষ্ঠু ভোট করার। ফরিদপুর-৪, ঢাকা-১ ও ঢাকা-৭ আসনে অনেকাংশে সুষ্ঠুভোট সরকারদলীয় প্রার্থীকে পরাজয়ের সাদ দিয়েছে। দেশি-বিদেশি প্রায় সবমহলের কাছে এই অগ্রহণযোগ্য নির্বাচন মানুষকে আতঙ্কিত করছে। তারা জানেনা কি হতে যাচ্ছে। সংবিধান লংঘন করে ২৪ জানুয়ারির আগে এমপিদের শপথ গ্রহণ হল তাড়াহুড়ো করে। মানুষ হিসাব মেলাতে পারছে না, কি হতে যাচ্ছে। এভাবে সরকার কত বছর থাকবে? একুশ সাল না একচল্লিশ সাল তা মানুষ বুঝতে পারছে না। কেউ ভাবছে ৬ মাসের মধ্যে আবারো গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হবে, কেউ ভাবছে ৩ বছরের আগে নয়। আবার কেউ ভাবছে তিন বছর পার করতে পারলে তারা ৫ বছরের আগে নির্বাচন কেন দিবে? যদি নির্বাচন ৫ বছর পরেই দেয় তাহলে এভাবেই নির্বাচন করে ক্ষমতায় তারা অবশ্যই থেকে যেতে চাইবে ৪১ সাল পর্যন্ত।
এখন দেশ যাদের হাতে তারা দেশকে অন্তত পাকিস্তান হতে দিবে না এটা নিশ্চিত। তাদের অধিনে থাকলে তালেবানী রাষ্ট্র হবে না আবার পাকিস্তানের সাথে মিশে যাওয়ার কোন সম্ভাবনাও থাকবে না। তবে সিকিম বানানোর ক্ষমতা তাদের আছে, কিন্তু তাদের সেই ইচ্ছা অবশ্যই নাই। তবে আমাদের দ্ইু নেত্রীর মধ্যেকার যে সম্পর্ক তাতে একজন নিজের নাক কেটে আরেকজনের যাত্রা ভঙ্গ করতে পিছপা হবেন না- এটা হলফ করে বলা যায়। প্রধান দুই নেত্রীর মধ্যেকার ঘৃণাবোধ তাদের শিক্ষারই বহিপ্রকাশ। কোন সুশিক্ষিত মানুষ এভাবে কথা বলে না, এভাবে ঘৃণা করে না, এভাবে দেশকে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেয় না। কত অবলীলায় নেতা-নেত্রীরা দাবী করছেন, জনগণ অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচনে ভোট দিয়েছে। এরা সম্ভবত এতে লজ্জা পায় না। এই যে শতশত মানুষের মৃত্যু হচ্ছে, এই যে সংখ্যালঘুদের উপর নির্মম নির্যাতন হচ্ছে এতে তাদের কোন বিকার নেই। তাদের রয়েছে অসংখ্য ঘৃণাসেল, তারা পরস্পরের উপর এই ঘৃণাসেল নিক্ষেপ করেন। বিভিন্ন অজুহাত দিয়ে জাতিকে ধ্বংস করে দিচ্ছেন। আমাদের ভাবতে অবাক লাগে এদের একটি দল নাকি একাত্তরে দেশ স্বাধীন করেছিল। আরেকটি দলের প্রতিষ্ঠাতা সেক্টর কমাণ্ডার ও একটি ফোর্সের প্রধান ছিলেন। এগুলো যদি সত্যি হবে তাহলে এই দুই দলের লোকেরা দেশকে ধ্বংসের দিকে কেন নিয়ে যাচ্ছে? সরকারি দল বলছে, বিরোধীদলকে জামাত ছাড়তে হবে। আচ্ছা যদি দেশবাসী জামাতকে না চায় তাহলে বিএনপি তাদের জোটে রাখলে তাদেরই বিপদ। যদি জামাতের কারণে বিএনপির ক্ষতি হয় তাহলে আওয়ামীলীগের অসুবিধা কোথায়? জনগণের নিকটই আপনারা বিচার দিন, তারাই বিচার করুক। আজ অনেক কিছুকেই বিতর্কিত করে ফেলা হয়েছে ক্ষমতায় থাকতে গিয়ে। দেশের বেশিরভাগ মানুষই একসময় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চেয়েছে। সম্প্রতি একজন সাবেক ছাত্রলীগ নেতাই দাবী করলেন, এখন মানুষের মনোভাব বদলে গেছে। যদি তাই হয় তাহলে এই বিচারকে কে বা কারা বিতর্কিত করলো? কারা বিচারকার্য মানসম্মতভাবে না করে রাজনৈতিক বিবেচনায় করল। কেন অধিকাংশ মানুষ মনে করছে এখানে গলদ হয়েছে। কেউ কেউ ভারতের মতো নির্বাচনের সাংবিধানিক প্রয়োজনীয়তার কথা বলছেন। তাহলে অন্তত নির্বাচনটিতো সুষ্ঠু করা যেত। কিন্তু মানুষ নির্বাচন দেখে ফেলেছে। তারা দেখেছে জাল ও সিলমারা ভোট। এদের কিভাবে বিশ্বাস করাবেন- নির্বাচন হয়েছে প্রয়োজনীয়তার কারণে।
বাংলাদেশ সিকিম বা পাকিস্তান না হলেও আজ জিম্বাবুয়ের মতো অবস্থায় পড়ে গেছে। এখন আসবে বিভিন্ন দেশ ও জাতিসংঘের বিভিন্ন চাপ। এর থেকে উদ্ধারের একটিই পথ- অতিদ্রুত একটি সুষ্ঠু নির্বাচন করা।