ভয়াঙ্কর Ewing's Sarcoma ক্যান্সারে আক্রান্ত কিশোর রাতুল।
মানুষের কষ্ট আমার সহ্য হয় না। কষ্টে কাউকে দেখলে হৃদয়টা কেঁপে ওঠে-কেঁদে ওঠে। রাতুলের বাবাকে দেখেও আমার চোখ অশ্রুসজল হয়েছিল। গুরুতর অসুস্থ নিষ্পাপ এক কিশোর সন্তানের ছবি হাতে বাবা। ছলছল চোখ। বিষন্ন, স্থির দৃষ্টি। দেখেই বুঝা যায়, কত দিন না জানি ঘুম নেই ও চোখে। বিপদাপন্ন স্থবির অচল যেন তার পৃথিবীটা। পৃথিবীতে কত মানুষ! কত আনন্দ-গান, হাসি-খেলা এই পৃথিবীতে! অথচ তার পৃথিবীটা কেমন গুমোট! অজানা শঙ্কায় কম্পমান তার বুক! অমোচনীয় পিপাসায় কাতর তার শুকনো কাষ্ঠ অধর! কন্ঠ ভাষাহীন! তিনি কিছু বলতে পারছেন না যেন! কী করবেন তিনি? কোথায় যাবেন? কার কাছে আশ্রয় চাবেন? কাকে শুধাবেন মনের ব্যথা? কার কাছে পাবেন হৃদয়ের শান্তনা? কে দেবে তাকে অভয়? জীবনের এই কঠিনতম পরীক্ষায় তিনি কি উত্তীর্ন হতে পারবেন? তিনি কি ভেঙ্গে পড়বেন? নি:শেষ হয়ে যাবেন?
আসলেই তিনি আজ নিরুপায়। জানেন না, কী করবেন, কোথায় যাবেন, কার দ্বারে হাত বাড়াবেন। সহানুভূতিশীল কোন্ মানুষটির কাছে তিনি একটু আশ্রয় পাবেন, বুঝতে পারছেন না। প্রানের স্পন্দন সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে, তার জীবন রক্ষার্থে সঞ্চিত যা কিছু ছিল, নগদ অর্থসহ সবই হারিয়েছেন। এমনকি জমিজমা যা ছিল তাও বিক্রি করেছেন। সর্বস্ব হারিয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় তিনি। বাবার হাতে সন্তানের এই ছবিটির বুঝি খুব ওজন। লাশের খাটিয়া বহন করা যেমন কষ্টের। ফুলের মত এই নিষ্পাপ শিশু সন্তানের ছবির ওজনও বুঝি, না জানি কতই না বেশি - বাবার জন্য, মায়ের জন্য! আমি রাতুলের বাবাকে দু'চারটি কথার বেশি বলিনি। 'বলিনি', বলাটা বোধ হয় ঠিক না, আসলে বলতে পারিনি। রাতুলের ছবিটির দিকে তাকিয়ে, তার বাবার অশ্রুসজল চোখ দেখে আমার চোখও অশ্রুসজল হয়ে উঠছিল। একজন বিপন্ন অসহায় মানুষের সামনে নিজের আবেগকে ধরে রাখতে না পারা পীড়াদায়ক। এই পীড়াদায়ক ঘটনাটিই ঘটতে চলেছিল রাতুলের বাবার নিদ্রাহীন ক্লান্ত শ্রান্ত মুখাবয়ব দর্শনে। তার সীমাহীন উদ্বিগ্নতা দেখে, তার বিধ্বস্ত চেহারার দিকে তাকিয়ে থাকার সাহস আমার ছিল না। আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাই আমার অপারগতার জন্য। তাঁর কাছে মিনতি জানাই, তিনি যেন কোনো বাবা-মাকে এই ধরনের কঠিন পরীক্ষায় নিপতিত না করেন। সন্তান দিলেন, সন্তানের মুখের পানে তাকিয়ে মায়ের তাপিত প্রান শীতল হলো, বাবার হৃদয় জুড়ালো। গভীর মমতায়, অপরিসীম ভালবাসায় বুকে আগলে রেখে মানুষ করার স্বপ্ন দেখলেন নাড়ী ছেঁড়া সেই ধনকে। অত:পর কঠিন থেকে কঠিনতম পরীক্ষা দিলেন তিনি। বাবা-মায়ের যা ছিল, যা কিছু ছিল, সহায় সম্বল টাকা পয়সা সব কিছু ব্যয় করেও শেষ হলো না। সন্তানের অসুখ ছাড়ছে না। রোাগ ভাল হচ্ছে না। আজ রিক্তহস্ত বাবা-মা আকাশের মালিকের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলছেন। মহান মালিকের দিকে ফরিয়াদের হাত উঁচু করছেন। আহ! প্রিয়তম মালিক! আপনি কি একটু দয়া করবেন না, বিপন্নপ্রায় বিধ্বস্ত এই পরিবারটির প্রতি!
২০১৬ ইং সালে রাতুলের মারাত্মক Ewing's Sarcoma ক্যান্সার ধরা পড়ে। প্রাথমিক পর্যায়ে দেশের ডাক্তারদের দেখিয়ে তাদের পরামর্শে চিকিৎসা চালানো হয়। তাকে বাংলাদেশের ডাক্তারগন ৭ টি কেমো দেন। প্রতিটি কেমো দিতে সময় লাগে ৫ দিন। ১ টি কেমো দেয়ার পরে পরবর্তী কেমো দেয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয় ২১ দিন। প্রতিটি কেমোর জন্য বাংলাদেশে খরচ পড়ে প্রায় ৩৫,০০০/- টাকা থেকে ৪০,০০০/- টাকার মত। এছাড়া প্রতিটি কেমো দেয়ার পরে আবার নিয়মিত দিয়ে যেতে হয় রেডিয়েশন বা রেডিওথেরাপি। একপর্যায়ে দেশের চিকিতসায় আশাব্যঞ্জক উন্নতি লক্ষনীয় হয়ে না ওঠায় তাকে নিয়ে যাওয়া হয় ভেলোরের বিখ্যাত Christian Medical Callage -এ। সেখানে আবার নতুন করে সকল কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরে দীর্ঘ দিন (৫ মাসের বেশি সময়) অবস্থান করে চিকিৎসা গ্রহন করাতে হয়। এই হাসপাতালেও তাকে আবার দেয়া হয় একে একে ৭ টি কেমো। প্রতিটি কেমোর জন্য এখানে খরচ পড়ে প্রায় ৬০,০০০/- রুপি, বাংলাদেশী টাকায় প্রায় ৯০,০০০/- টাকার মত। সাথে প্রতিটি কেমোর পরপরই রেডিয়েশন বা রেডিওথেরাপী তো রয়েছেই।
সবগুলো কেমো সফলতার সাথে সম্পন্ন হলে রাতুলের সুস্থতা কিছুটা ফিরে আসে। ডাক্তারগন তাকে নিরাপদ ঘোষনা করে দেশে ফেরত পাঠান, তবে শর্ত দিয়ে দেন, প্রতি তিন মাস পরপর যেন তাদের কাছে নিয়ে চেকআপ করিয়ে আনা হয় রাতুলকে। সেই চেকআপের ধারাবাহিকতায় গত ৩০ জুন ২০১৮ ইং তারিখ তাকে আবার নেয়া ভেলোরের সেই মেডিকেলে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে ডাক্তারগন এবারের পরীক্ষার পরে নতুন সমস্যার কথা জানান। তারা জানান, নতুন করে রাতুলকে আবারও ৬ টি কেমো দিতে হবে। সাথে রেডিওথেরাপীও। ডাক্তার বলেছেন, রাতুলের মাথায় টিউমার ধরা পড়েছে সেটির অপসারনেও প্রয়োজন হবে জটিল একটি অপারেশনের। বর্তমান পরিস্থিতিতে রাতুলের বাবার চোখে পৃথিবীটা বুঝি খুবই ছোট হয়ে আসছে।
রাতুলেরা দুই ভাই। রাতুল ছোট। প্রাথমিক সমাপনি পরীক্ষায় এ প্লাস পেয়ে ২০১৬ সালে ক্লাশ সিক্স এ ভর্তি হয় রাতুল। কিন্তু পড়ালেখায় ছেদ পড়ে। হঠাত জীবন বিধ্বংসী ক্যান্সার ধরা পড়ে রাতুলের। বড় ভাই পুলক এইচএসসির ছাত্র। এ যাত্রায় (৩০ জুন ২০১৮ ইং) রাতুলের সাথে ভেলোরে যান তার মা এবং বড় ভাই পুলক। বাবা থেকে যান বাড়িতে। বাবার সংসার পরিচালনার ক্ষেত্রে উপার্জনের একমাত্র মাধ্যম ছিল ছোট্ট একটি দোকান। সেই দোকানটিও বন্ধ ছিল দীর্ঘ দিন। রাতুলের চিকিৎসা চলাকালীন প্রায় বছরাধিককাল ধরে বন্ধ থাকা দোকানটি খোলা রাখার চিন্তা থেকেই হয়তো তিনি থেকে যান দেশে। কিন্তু চেকআপের পরে ভেলোর থেকে সংবাদ আসে নতুন করে রাতুলকে ভর্তি করাতে হবে সেখানে। কেমো, থেরাপীসহ সকল চিকিৎসা চালাতে হবে পূর্ববত। আর তার জন্য আবারো প্রয়োজন বৃহত অংকের অর্থের। ইতোপূর্বেকার চিকিতসা বাবদ রাতুলের বাবার সার্বিক খরচের পরিমান প্রায় ১৪-১৫ (চৌদ্দ লক্ষ) টাকার মত। বিশাল এই অর্থের যোগান দিতে গিয়ে ইতোমধ্যেই একপ্রকার নি:স্ব হয়ে গেছেন তিনি। সহায় সম্পদ, ধার-দেনা, শেষে জমি-জমা বিক্রি করেছেন সন্তানের জীবন বাঁচানোর চেষ্টায়। এরপরেও যখন কুলোতে পারেননি, দ্বারস্থ হয়েছেন নানান জনের কাছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে তার মত অসহায় বাবার পৃথিবীটা আজ বড় ছোট। বড় সংকুচিত। বড় কঠিন। কী করবেন তিনি? তাকে যুঁতসই কোনো আশ্বাসের বানী শোনাতে পারিনি। শুধু বলেছি, তিনি যেন মহান আল্লাহ পাকের উপর ভরসা রাখেন। ভেঙ্গে না পড়েন। কারন, তিনিই উত্তম অভিভাবক। তিনিই সর্বোত্তম আশ্রয়দাতা। তাঁর কাছেই যেন নিবেদন করেন হৃদয়ের সকল আঁকুতি। সব মিনতি।
রাতুলের বাবার পার্সোনাল মোবাইল নম্বর, ব্যাংক একাউন্ট এবং বিকাশ নম্বর এই পোস্টের শেষের দিকে সংযুক্ত করে দেয়া হবে। হৃদয়বান কারও মমতার পরশে রাতুল অাবার সুস্থ হয়ে উঠবে, এটা ভাবতেই মনে প্রশান্তি অনুভব করি।
গত ১৬ জুলাই বাসায় গিয়ে স্ত্রীকে রাতুলের কথা বলেছিলাম। তিনি তার ভ্যানিটিব্যাগ খুলে নগদ ৫০০ টাকা রাতুলের জন্য আমাকে দিলেন। দেখলাম, রাতুলের ছবিটি দেখে তিনিও অশ্রুসজল, অন্যরকম হয়ে গেলেন। আমার কলিজার টুকরো আম্মু এসে বলল, আব্বু, আমার স্কলারশীপের টাকাটা পেয়েছি। ওখান থেকে কিছু টাকা রাতুলকে দিয়ে দিব। আহ! প্রানের জন্য প্রানের কি টান! আল্লাহ পাক আপনার দরবারে সিজদাবনত ফরিয়াদ, রাতুলের মত নিষ্পাপ এই ফুলের কলিটাকে আপনি সুস্থ করে দিন। আবার সে যেন ফিরে আসতে পারে তার পড়ার টেবিলে। দূরন্ত খেলার সাথীদের সাথে সবুজের মাঠে। রাতুলের জন্য যাদের প্রান কাঁদে তাদের প্রতি রহমতের বৃষ্টি বর্ষন করুন। রাতুলের বাবা-মায়ের চোখের অশ্রু মুছে যাক, রাতুলের প্রতি বিশ্ববাসী সকলের আদরে ভালবাসায় স্নেহ মমতায়।
দেশে এবং ভারতের ডাক্তারদে সকল পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাগজপত্র চেয়েছিলাম রাতুলের বাবার কাছে। তিনি জানিয়েছেন, সকল কাগজ পত্র জড়ো করলে ফাইলে ধরানো মুশকিল। বই হয়ে যাবে। এখানে উল্লেখযোগ্য মাত্র কয়েকটি ডকুমেন্ট - যা তিনি আমাকে দেখিয়েছেন, তা আপনাদের বুঝার সুবিধার্থে উপস্থাপন করা হল -
আপডেট ৩০.০৭.২০১৮: গতকাল ২৯.০৭.২০১৮ ইং তারিখ রাতুলের বাবা জানিয়েছেন, এ যাত্রায় রাতুলের প্রথম কেমোটি সম্পন্ন হয়েছে। রাতুল বর্তমানে ভারতের ভেলোরের বিখ্যাত Christian Medical Callage -এ আছে। রাতুলের বাবা আরও জানিয়েছেন, ছেলের কাছে তার যাওয়ার কথা থাকলেও প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহ করতে না পারায় তিনি এখনও যেতে পারেননি। আমরা আল্লাহ পাকের নিকট বাচ্চাটির সুস্থতা দান এবং পরিবারটির আর্থিক দৈন্য ও দুরবস্থা দূরীকরনের বিনীত প্রার্থনা জানাচ্ছি।
এই পোস্টের প্রেক্ষিতে দু'একজন সহায়তা প্রদানের আশ্বাস দিলেও এযাবত কেউ রাতুলের বাবার সাথে কোনো প্রকার যোগাযোগ করেননি জানিয়েছেন তিনি। অহেতুক মনে করে রাতুলের বাবার ফোন নম্বর এবং ব্যাংক একাউন্ট ডিটেইলস এখান থেকে সরিয়ে দিলাম। ভাবছি, পোস্টটিও সরিয়ে দেব। রাতুল ভাল থাকুক। আল্লাহ পাক সকলের মঙ্গল করুন।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা মার্চ, ২০১৯ সকাল ৯:১৫