ফ্রান্স দেশের এক রূপকথা। একদা এক দেবী প্রেমে পড়লো পেলিমন নামের মর্ত্যলোকের নশ্বর যুবকের। প্রতিদিন তার আসা-যাওয়ার পথে নজর রাখতো সেই জলের দেবী। একদিন পেলিমনেরও দৃষ্টি আটকালো সেই দেবী পানে। দেবী প্রেক্ষণে বিস্ময়াবিভূত পেলিমন রূপের আতিশয্যে হতবাক হয়ে গেলো। এ যে স্বচ্ছ জলের মাঝে ফুটে থাকা এক কান্তিমান সৌকর্য। কামুক কায়ার শিলীন্ধ্রার চোখে ধরা দিলো পূর্ণিমার শশাঙ্কের উদ্ভাসিত শশিকর। রিপু দুর্বল মানবের জৈবিকতার তাড়নার কাছে হার মানলো তার নিভৃতচারী প্রচ্ছন্ন বিবেক। রক্ত-মাংসের যুবক পেলিমন তাই ছেড়ে চলে গেলো তার বাগদত্তাকে। অথচ সম্ভ্রান্তবংশীয় ঘরের মেয়ে ছিল পেলিমনের বাগদত্তা হবু স্ত্রী বার্থা। রূপের বীণার তারে বেজে উঠলো ভাঙনের করুণ রাগিণী। দেবীসকাশে পাণিবদ্ধ হল পেলিমন। পরিণয়কালে পেলিমন এই বলে শপথ নিলো যে, “প্রতিটি জাগ্রত নিঃশ্বাস তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা আর বিশ্বস্ততায় হয়ে রবে পরিকীর্ণ।” কিন্তু বাস্তবতার অমোঘ নিষ্ঠুরতা মানবের মনকে করলো বিক্ষিপ্ত, বিচ্যুত। বছর ঘুরতেই তাদের ঘরে আসলো এক ফুটফুটে শিশু। ছেলের জন্মের পর থেকেই দেবীর রূপ-মাধুর্যে ভাঁটার টান আসতে লাগলো। বয়সের ভার বলিরেখায় প্রতীয়মান হতে থাকলো। এককালের চোখধাঁধানো সৌন্দর্যের অকাল অবনমন পেলিমনের মনকে অন্যদিকে আকৃষ্ট করলো। সে আবার ফিরে গেলো তার প্রয়াত বাগদত্তার সমীপে। বিষয়টা দেবী বধূর অক্ষির অগোচরে থেকে গেলো; কিন্তু তা স্বল্প সময়ের জন্য। একদিন বিষয়টা ধরা পড়ে গেলো তার কাছে। পেলিমনের বাহুবন্ধনে বার্থাকে দেখে দুঃখে ও ক্রোধে দিশেহারা হয়ে গেলো এককালের সৌন্দর্যের অধিষ্ঠাত্রী দেবী । যার জন্য সে তার অমরত্বকে বিসর্জন দিয়ে মর্ত্যলোকে নেমে সংসার পেতেছে, যে অনিত্য আত্মার প্রতি প্রেমাসক্ত হয়ে সে হারিয়েছিল তার চিরকৌমার্যকে, আজ সে কিসের লোভে সেই পবিত্র বিশ্বাসে আঘাত করলো, অটুট বন্ধনে চির ধরালো! অভিশাপ দিয়ে বসলো দেবী। “তুমিই তো প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিলে আমাকে তোমার প্রতিটি জাগ্রত নিঃশ্বাসে ভালোবাসার কথায়, তবে তথাস্তু। যতক্ষণ তুমি জাগবে নিঃশ্বাস তোমার সঙ্গী থাকবে। কিন্তু যেই মাত্র তুমি ঘুমিয়ে পড়বে, তোমা থেকে সে বিদায় নেবে।” রূপকথা মতে, সেই দেবীর অভিশাপে নাকি পেলিমন কখনোই আর ঘুমাতে পারেনি। ফরাসী রূপকথার এই জলদেবীর নাম ছিল ওন্ডিন। আর তার সেই অভিশাপকে বলা হয় ওনডিন্স কার্স।
ফ্রেডেরিক ডে লার লেখা এই রূপকথায় এক লোভাতুর, বিশ্বাসঘাতক প্রেমিকের উপর দেবী ওন্ডিনের অভিশাপ পড়লেও চিকিৎসা বিজ্ঞান যাকে ওনডিন্স কার্স বলে অভিহিত করে থাকে তার সিংহভাগ ভুক্তভোগীই কিন্তু নিষ্পাপ শিশু। এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি ঘুমের ভিতর নিঃশ্বাস নিতে ভুলে যায়। পরিণতিতে ঘুম ভেঙে যায় অসময়ে। ওনডিন্স কার্সকে বলা হয় কনজেনিটাল সেন্ট্রাল হাইপোভেনটিলেশন সিনড্রোম অথবা প্রাইমারী অ্যালভিওলার হাইপোভেনটিলেশন। খুবই দুর্লভ মাত্রার এই রোগটি প্রতি দুই লাখ শিশুর মধ্যে মাত্র একজনের হয়। এই রোগটি মূলত কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের যে অংশটি স্বয়ংক্রিয় নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে সেখানে সৃষ্ট ঝামেলার কারণে তৈরি হয়। ঘুমের মধ্যে অ্যাপনিয়া (Apnea) দেখা দেয়। অ্যাপনিয়া হলে বহিঃশ্বসন প্রক্রিয়ায় বাধাগ্রস্ততা আসে। শ্বসনতন্ত্রের পেশিকলার নড়াচড়া থেমে যায়। ফলে ফুসফুস তার স্বাভাবিক প্রক্রিয়া আর চালু রাখতে পারে না। ওনডিন্স কার্স ছেলে বা মেয়ে যে কারো ক্ষেত্রেই হতে পারে।
ওনডিন্স কার্সে নিপতিত জন নানা রকম সমস্যায় ভোগে; একটা তো বললামই। এছাড়া তার ডিসফ্যাগিয়া (Dysphagia) দেখা দেয় যার ফলে তার খাবার গিলতে কষ্ট হয়। দেখা দিতে পারে হির্শপ্রুংস রোগ (Hirschsprung's disease) যার ফলে পরিপাকতন্ত্রের বিশেষত বৃহদান্ত্রের বিশাল অংশ জুড়ে কোন স্নায়ুবিক সংযোগ থাকে না। এর ফলে শরীরে তৈরি হওয়া স্টুল বের হবার জন্য যে দু’টি প্লেক্সাস (Plexus) এর প্রয়োজন তারা ঠিকমতো কাজ করতে পারে না। পরিপাকতন্ত্রের স্নায়ুতন্ত্রে এই দুই রকমের প্লেক্সাসের একটি হল আউরবাখ্স প্লেক্সাস (Auerbach's plexus); আরেকটা মেইসনার্স প্লেক্সাস (Meissner's plexus) নামে পরিচিত। কিছু ক্ষেত্রে সিমপ্যাথেটিক গ্যাংলিয়াতে টিউমার দেখা দিতে পারে যাকে নিউরোব্লাস্টোমা বলে। শরীরে স্বল্প মাত্রায় অক্সিজেন যাওয়ার কারণে ত্বক বিবর্ণ হয়ে যায়। এছাড়া মাথাব্যথা, ঝিমানি ভাব ও উচ্চ রক্তচাপ দেখা দিতে পারে।
ঠিক কি কারণে এই রোগটা হয় তা সম্পূর্ণরূপে বের করা যায়নি এখনো। তবে পিএইচওএক্স২বি (PHOX2B) নামক একটা ট্রান্সক্রিপশন ফ্যাক্টরের এক্ষেত্রে জড়িত থাকার বিষয়টি কিছুটা প্রমাণ করা গেছে। এই ফ্যাক্টরটি অটোনমিক নার্ভাস সিস্টেমের ডেভেলপমেন্টের সাথে বিশেষভাবে জড়িত। এখানে মিউটেশন হলে প্রায় ৯১% কেসেই এই রোগটি হয়ে থাকে দেখা গেছে। এই রোগের রোগীদের বেঁচে থাকার জন্য সারাজীবন যান্ত্রিক ভেন্টিলেশন প্রক্রিয়া অবলম্বন করে থাকতে হয়। তবে এটার একটা সমস্যাও আছে। এই পদ্ধতিতে ট্রাকিয়োটমি (Tracheotomy) করতে হয়। এটি এক ধরণের সার্জিক্যাল প্রক্রিয়া। তবে অধুনা বাইফেসিক কুইরাস ভেন্টিলেশন (Biphasic Cuirass Ventilation) নামে আরেকটি পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়েছে যেখানে এই ট্রাকিয়োটমি করতে হয় না। এছাড়া ফ্রেনিক নার্ভ পেসিং (Phrenic Nerve Pacing) নামেও আরেকটি পদ্ধতি আছে। তবে এই সব প্রক্রিয়াই অনেক ব্যয়বহুল যা বহু সাধারণ্যের নাগালের বাইরে থেকে যায়। ফলে অনেক শিশুই হয় ঘুমের মধ্যেই কিংবা না ঘুমাতে না ঘুমাতে নানাবিধ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে অকালেই চলে যায় চির ঘুমের দেশে।
একদম উপরের ছবিটা একটা থাই আর্টিকেল থেকে নেওয়া। আর শিরোনামে ইংরেজিতে কি লেখা দেখেছেন? My daughter will die, if she sleeps. বাক্যটার বঙ্গানুবাদ দরকার? মনে হয় দরকার নেই।
-----
লেশ-নাইহান সিনড্রোম: একটি আত্মবিধ্বংসী রোগের নাম
-----
Genetic Engineering and Biotechnology Club - GEBC- সমাজের সকল স্তরে জিন প্রকৌশল ও জীবপ্রযুক্তির ব্যাপক পরিচিতিকরণ ও প্রচলন এবং এ সংক্রান্ত সকল বিষয় নিয়ে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিন প্রকৌশল ও জীবপ্রযুক্তি বিভাগের একমাত্র পেইজ।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




