somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ওনডিন্স কার্সঃ রূপকথার আদলে নামাঙ্কিত এক ভয়ংকর রোগ

০৬ ই এপ্রিল, ২০১৪ বিকাল ৫:২৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


ফ্রান্স দেশের এক রূপকথা। একদা এক দেবী প্রেমে পড়লো পেলিমন নামের মর্ত্যলোকের নশ্বর যুবকের। প্রতিদিন তার আসা-যাওয়ার পথে নজর রাখতো সেই জলের দেবী। একদিন পেলিমনেরও দৃষ্টি আটকালো সেই দেবী পানে। দেবী প্রেক্ষণে বিস্ময়াবিভূত পেলিমন রূপের আতিশয্যে হতবাক হয়ে গেলো। এ যে স্বচ্ছ জলের মাঝে ফুটে থাকা এক কান্তিমান সৌকর্য। কামুক কায়ার শিলীন্ধ্রার চোখে ধরা দিলো পূর্ণিমার শশাঙ্কের উদ্ভাসিত শশিকর। রিপু দুর্বল মানবের জৈবিকতার তাড়নার কাছে হার মানলো তার নিভৃতচারী প্রচ্ছন্ন বিবেক। রক্ত-মাংসের যুবক পেলিমন তাই ছেড়ে চলে গেলো তার বাগদত্তাকে। অথচ সম্ভ্রান্তবংশীয় ঘরের মেয়ে ছিল পেলিমনের বাগদত্তা হবু স্ত্রী বার্থা। রূপের বীণার তারে বেজে উঠলো ভাঙনের করুণ রাগিণী। দেবীসকাশে পাণিবদ্ধ হল পেলিমন। পরিণয়কালে পেলিমন এই বলে শপথ নিলো যে, “প্রতিটি জাগ্রত নিঃশ্বাস তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা আর বিশ্বস্ততায় হয়ে রবে পরিকীর্ণ।” কিন্তু বাস্তবতার অমোঘ নিষ্ঠুরতা মানবের মনকে করলো বিক্ষিপ্ত, বিচ্যুত। বছর ঘুরতেই তাদের ঘরে আসলো এক ফুটফুটে শিশু। ছেলের জন্মের পর থেকেই দেবীর রূপ-মাধুর্যে ভাঁটার টান আসতে লাগলো। বয়সের ভার বলিরেখায় প্রতীয়মান হতে থাকলো। এককালের চোখধাঁধানো সৌন্দর্যের অকাল অবনমন পেলিমনের মনকে অন্যদিকে আকৃষ্ট করলো। সে আবার ফিরে গেলো তার প্রয়াত বাগদত্তার সমীপে। বিষয়টা দেবী বধূর অক্ষির অগোচরে থেকে গেলো; কিন্তু তা স্বল্প সময়ের জন্য। একদিন বিষয়টা ধরা পড়ে গেলো তার কাছে। পেলিমনের বাহুবন্ধনে বার্থাকে দেখে দুঃখে ও ক্রোধে দিশেহারা হয়ে গেলো এককালের সৌন্দর্যের অধিষ্ঠাত্রী দেবী । যার জন্য সে তার অমরত্বকে বিসর্জন দিয়ে মর্ত্যলোকে নেমে সংসার পেতেছে, যে অনিত্য আত্মার প্রতি প্রেমাসক্ত হয়ে সে হারিয়েছিল তার চিরকৌমার্যকে, আজ সে কিসের লোভে সেই পবিত্র বিশ্বাসে আঘাত করলো, অটুট বন্ধনে চির ধরালো! অভিশাপ দিয়ে বসলো দেবী। “তুমিই তো প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিলে আমাকে তোমার প্রতিটি জাগ্রত নিঃশ্বাসে ভালোবাসার কথায়, তবে তথাস্তু। যতক্ষণ তুমি জাগবে নিঃশ্বাস তোমার সঙ্গী থাকবে। কিন্তু যেই মাত্র তুমি ঘুমিয়ে পড়বে, তোমা থেকে সে বিদায় নেবে।” রূপকথা মতে, সেই দেবীর অভিশাপে নাকি পেলিমন কখনোই আর ঘুমাতে পারেনি। ফরাসী রূপকথার এই জলদেবীর নাম ছিল ওন্ডিন। আর তার সেই অভিশাপকে বলা হয় ওনডিন্স কার্স।



ফ্রেডেরিক ডে লার লেখা এই রূপকথায় এক লোভাতুর, বিশ্বাসঘাতক প্রেমিকের উপর দেবী ওন্ডিনের অভিশাপ পড়লেও চিকিৎসা বিজ্ঞান যাকে ওনডিন্স কার্স বলে অভিহিত করে থাকে তার সিংহভাগ ভুক্তভোগীই কিন্তু নিষ্পাপ শিশু। এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি ঘুমের ভিতর নিঃশ্বাস নিতে ভুলে যায়। পরিণতিতে ঘুম ভেঙে যায় অসময়ে। ওনডিন্স কার্সকে বলা হয় কনজেনিটাল সেন্ট্রাল হাইপোভেনটিলেশন সিনড্রোম অথবা প্রাইমারী অ্যালভিওলার হাইপোভেনটিলেশন। খুবই দুর্লভ মাত্রার এই রোগটি প্রতি দুই লাখ শিশুর মধ্যে মাত্র একজনের হয়। এই রোগটি মূলত কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের যে অংশটি স্বয়ংক্রিয় নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে সেখানে সৃষ্ট ঝামেলার কারণে তৈরি হয়। ঘুমের মধ্যে অ্যাপনিয়া (Apnea) দেখা দেয়। অ্যাপনিয়া হলে বহিঃশ্বসন প্রক্রিয়ায় বাধাগ্রস্ততা আসে। শ্বসনতন্ত্রের পেশিকলার নড়াচড়া থেমে যায়। ফলে ফুসফুস তার স্বাভাবিক প্রক্রিয়া আর চালু রাখতে পারে না। ওনডিন্স কার্স ছেলে বা মেয়ে যে কারো ক্ষেত্রেই হতে পারে।

ওনডিন্স কার্সে নিপতিত জন নানা রকম সমস্যায় ভোগে; একটা তো বললামই। এছাড়া তার ডিসফ্যাগিয়া (Dysphagia) দেখা দেয় যার ফলে তার খাবার গিলতে কষ্ট হয়। দেখা দিতে পারে হির্শপ্রুংস রোগ (Hirschsprung's disease) যার ফলে পরিপাকতন্ত্রের বিশেষত বৃহদান্ত্রের বিশাল অংশ জুড়ে কোন স্নায়ুবিক সংযোগ থাকে না। এর ফলে শরীরে তৈরি হওয়া স্টুল বের হবার জন্য যে দু’টি প্লেক্সাস (Plexus) এর প্রয়োজন তারা ঠিকমতো কাজ করতে পারে না। পরিপাকতন্ত্রের স্নায়ুতন্ত্রে এই দুই রকমের প্লেক্সাসের একটি হল আউরবাখ্স প্লেক্সাস (Auerbach's plexus); আরেকটা মেইসনার্স প্লেক্সাস (Meissner's plexus) নামে পরিচিত। কিছু ক্ষেত্রে সিমপ্যাথেটিক গ্যাংলিয়াতে টিউমার দেখা দিতে পারে যাকে নিউরোব্লাস্টোমা বলে। শরীরে স্বল্প মাত্রায় অক্সিজেন যাওয়ার কারণে ত্বক বিবর্ণ হয়ে যায়। এছাড়া মাথাব্যথা, ঝিমানি ভাব ও উচ্চ রক্তচাপ দেখা দিতে পারে।

ঠিক কি কারণে এই রোগটা হয় তা সম্পূর্ণরূপে বের করা যায়নি এখনো। তবে পিএইচওএক্স২বি (PHOX2B) নামক একটা ট্রান্সক্রিপশন ফ্যাক্টরের এক্ষেত্রে জড়িত থাকার বিষয়টি কিছুটা প্রমাণ করা গেছে। এই ফ্যাক্টরটি অটোনমিক নার্ভাস সিস্টেমের ডেভেলপমেন্টের সাথে বিশেষভাবে জড়িত। এখানে মিউটেশন হলে প্রায় ৯১% কেসেই এই রোগটি হয়ে থাকে দেখা গেছে। এই রোগের রোগীদের বেঁচে থাকার জন্য সারাজীবন যান্ত্রিক ভেন্টিলেশন প্রক্রিয়া অবলম্বন করে থাকতে হয়। তবে এটার একটা সমস্যাও আছে। এই পদ্ধতিতে ট্রাকিয়োটমি (Tracheotomy) করতে হয়। এটি এক ধরণের সার্জিক্যাল প্রক্রিয়া। তবে অধুনা বাইফেসিক কুইরাস ভেন্টিলেশন (Biphasic Cuirass Ventilation) নামে আরেকটি পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়েছে যেখানে এই ট্রাকিয়োটমি করতে হয় না। এছাড়া ফ্রেনিক নার্ভ পেসিং (Phrenic Nerve Pacing) নামেও আরেকটি পদ্ধতি আছে। তবে এই সব প্রক্রিয়াই অনেক ব্যয়বহুল যা বহু সাধারণ্যের নাগালের বাইরে থেকে যায়। ফলে অনেক শিশুই হয় ঘুমের মধ্যেই কিংবা না ঘুমাতে না ঘুমাতে নানাবিধ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে অকালেই চলে যায় চির ঘুমের দেশে।



একদম উপরের ছবিটা একটা থাই আর্টিকেল থেকে নেওয়া। আর শিরোনামে ইংরেজিতে কি লেখা দেখেছেন? My daughter will die, if she sleeps. বাক্যটার বঙ্গানুবাদ দরকার? মনে হয় দরকার নেই।

-----
লেশ-নাইহান সিনড্রোম: একটি আত্মবিধ্বংসী রোগের নাম
-----
Genetic Engineering and Biotechnology Club - GEBC- সমাজের সকল স্তরে জিন প্রকৌশল ও জীবপ্রযুক্তির ব্যাপক পরিচিতিকরণ ও প্রচলন এবং এ সংক্রান্ত সকল বিষয় নিয়ে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিন প্রকৌশল ও জীবপ্রযুক্তি বিভাগের একমাত্র পেইজ।
১৫টি মন্তব্য ১৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বিজয়ের আগে রাজাকারের গুলিতে নিহত আফজাল

লিখেছেন প্রামানিক, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:১৩


ঘটনা স্থল গাইবান্ধা জেলার ফুলছড়ি থানার উড়িয়া ইউনিয়নের গুণভরি ওয়াপদা বাঁধ।

১৯৭১সালের ১৬ই ডিসেম্বরের কয়েক দিন আগের ঘটনা। আফজাল নামের ভদ্রলোক এসেছিলেন শ্বশুর বাড়ি বেড়াতে। আমাদের পাশের গ্রামেই তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

৫৫ বছর আগে কি ঘটেছে, উহা কি ইডিয়টদের মনে থাকে?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:৫৮




ব্লগের অনেক প্রশ্নফাঁস ( Gen-F ) ১ দিন আগে পড়া নিউটনের ২য় সুত্রের প্রমাণ মনে করতে পারে না বলেই ফাঁসকরা প্রশ্নপত্র কিনে, বইয়ের পাতা কেটে পরীক্ষার হলে নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

নিজামী, মুজাহিদ, বেগম জিয়াও বিজয় দিবস পালন করেছিলো!!

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৭:২০



মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বেগম জিয়ার মুরগী মগজে এই যুদ্ধ সম্পর্কে কোন ধারণা ছিলো না; বেগম জিয়া বিশ্বাস করতো না যে, বাংগালীরা পাকীদের মতো শক্তিশালী সেনাবাহিনীকে পরাজিত করতে পারে;... ...বাকিটুকু পড়ুন

১৯৭১ সালে পাক ভারত যুদ্ধে ভারত বিজয়ী!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯


দীর্ঘ ২৫ বছরের নানা লাঞ্ছনা গঞ্জনা বঞ্চনা সহ্য করে যখন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বীর বাঙালী অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে বীরবিক্রমে যুদ্ধ করে দেশ প্রায় স্বাধীন করে ফেলবে এমন সময় বাংলাদেশী ভারতীয়... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইন্দিরা গান্ধীর চোখে মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক: ওরিয়ানা ফলাচির সাক্ষাৎকার থেকে

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:৫৫


১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইতালীয় সাংবাদিক ওরিয়ানা ফলাচি ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাক্ষাৎকার নেন। এই সাক্ষাৎকারে মুক্তিযুদ্ধ, শরনার্থী সমস্যা, ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক, আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী পররাষ্ট্রনীতি এবং পাকিস্তানে তাদের সামরিক... ...বাকিটুকু পড়ুন

×