বিয়াত্রিস,
মধু ডাঙ্গার রাস্তার উপর তখন শুধু ভ্যান গাড়ি চলত আর ৬ টিপে বাস চলত, রিকশার প্রচলন তখন নিতান্তই ঘোমটা পরা নতুন বউ এর মত। আর ব্যাটরী চালিত গাড়ি এল তারও অনেক পরে পোড়া ডিজেলের মাথা ধরা গন্ধওয়ালা টেম্পুকে স্থানান্তরিত করে। যাই হোক তখন শুধু ভ্যান গাড়ি চলত, রাজনীতি আর অর্থনীতির সূত্র মেনে রাত বাড়লে চাহিদার সাথে যোগান না থাকায় ভাড়া হয়ে যেত দ্বিগুন। তখন আমরা বাপের হোটেলের খেয়ে বনের মোষ তাড়াই আর রাতের ফোন কোম্পানির কিন্নর কন্ঠি যেন দুঃখিত বলতে না পারে, এই সম্মান বাচাঁতে ফোন কোম্পানির মুনাফা বাড়াই।
এমনি এক পরিস্থিতে বিরাম পুর ষ্টেশনে যখন ট্রেন থামল তখন সন্ধ্যাতারা প্রায় মাঝ আকাশে আর তখন চাঁদটা সন্ধ্যা তারার সঙ্গে লুকোচুরি খেলছে, মাঝে মাঝে মেঘের ঘোমটার আড়ালে উকিঝুকি মেরে। আমরা ছয়জন, শীলা, সনেট, বায়জিদ, মহিলা কলেজের ইংলিশ টিচার যিনি আমার আর সনেটের প্রাইভেট টিচার, আর তার বন্ধুর মেয়ে- বাইজিদের হাই স্কুল মেট রঙ্গণী আর এই আমি। নামার পরেই “রাস্তা ও যানবাহন” শিরোনাম করে গবেষণা প্রস্তাব যখন দেওয়া শুরু হয়ে গেল; বেচারা চাঁদ তখন ঘোমটা মেরে আমাদের গবেষণা থেকে পালিয়ে বাঁচল।
এই অন্ধকারে শীলার ব্যাগের দায়িত্ব জুটল সদ্য অবাল থেকে সাবালকের খাতায় নাম লেখা আমার ঘাড়ে, তাই রমনীর ইত্যাদি ইত্যাদি ও ইত্যাদি ভর্তি ১ মন ওজনের ব্যাগ টানার প্রস্তাব উপেক্ষ করা সম্ভব হল না। ভাগ্য সুপ্রসন্ন হল তাঁর কৃপায় ;যেহেতু আমার এক হাতে আমার নিজের সবেধন নীলমণি ব্যাগখান আছে সেহেতু শীলার প্রস্তাব হল তার ব্যাগের এক অংশের ভার সে বহন করতে ইচ্ছুক। মনে কচকচনি নিয়ে না, না, বলেও রাজি হয়ে গেলাম, আর তখনি ঘটল সেই বজ্রঘাত, বিদ্যুতের চমক না অন্য কিছু নাকি আমার আবাল্য সাধনার কারনে এমন ঘটল, কয়েকটি মূহূর্ত মন হল যেন আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্বকে প্রামণ করার চেষ্টায় মত্ত্ব হয়ে উঠল যখন শীলার হাতের উপর আমার হাত পড়ল, বেরসিক চাঁদ ঠিক তখনই ঘোমটা খুলে ৩২ পাটি দাঁত বের করে মেজাজ সপ্তমে উঠিয়ে খিল খিল করে হাসতে শুরু করল... শালার বদমাস চাঁদ!
অগ্যতা সকলের দৃষ্টি আড়লে বুকের উপড় বিশাল পাথর ফেলে হাত ছেড়ে দিতে হল । এদিকে সকলের গবেষণা প্রস্তাব বিবেচনা করে আমাদের শিক্ষক মহদয় সিদ্ধান্ত দিলেন আমাদের ভ্যান যোগেই মধুডাঙ্গা যেতে হবে। তাই যার যা কিছু ছিল তাই সঙ্গে নিয়া আমরা ভ্যান স্ট্যান্ড অভিমুখে রওনা হলাম, আর আমার বুকে তখন নিউটনের প্রত্যেক ক্রিয়ারই সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে এই সূত্র অনুসরণ করে জেগে রইল। বুঝতে পারলাম না আমার এ কি হল, সামন্য একটু ছোঁয়া, আমার চেতনাকে হঠাৎ প্লাবনের মত ডুবিয়ে রাখল সারাটা পথ। কেন জানি শীলার সঙ্গে স্বাভাবিক কথাগুলোও বড় মধুর মনে হতে লাগল। আর স্যার হচ্ছেন গান পাগল মানুষ, তার কলেজের ছাত্রীদের জোর করে গান শেখানোর দ্বায়িত্বটা তিনি স্বেচ্চায় নিজের কাঁধে বয়ে বেড়ান । আর পরিবার ছেড়ে এই মফস্বল শহরে আছেন দীর্ঘদিন যাবৎ এমন বৈরাগ্য মনের মানুষ কি এমন জোস্না রাতে বাঁধ ধরে রাখতে পারেন, তাই সকল বাঁধ ভেঙ্গে স্যারের গলায় তখন “আজ জোস্নারাতে সাবাই গেছে বনে”। আমার মনে পুলকের ঝর্ণা ধারা আর শীলার মনে কি হতে পারে তা ভেবে মনে মনে পুলকের স্রোত দ্বিগুন থেকে দ্বিগুনতর বা তারো বেশী হচ্ছিল। এ দিকে স্যার গেয়ে চলেছেন আর স্যারের সঙ্গে জোগ দিয়েছে শীলা বাইজিদ সাবাই। আজ জোস্না রাতে সবাই গেছে বনে আজ/বসন্তের এই মাতাল সমীরণে, /আজ জোস্না রাতে সবাই গেছে বনে আজ /যাবনা যাবনা গো যাবনা যে, /রইনু পরে ঘরের মাঝে এই নিরালায় | /এই নিরালায় র'ব আপন করে |/যাবনা এই মাতাল সমীরণে, /আজ জোস্না রাতে সবাই গেছে বনে আজ |/আমার এ ঘর বহু যতন করে, /ধুতে হবে মুছতে হবে মোরে |/আমারে যে জাগতে হবে | /কি জানি সে আসবে কবে ? /যদি আমায়, যদি আমায় পরে তাহার মনে |/বসন্তের এই মাতাল সমীরণে, /আজ জোস্না রাতে সবাই গেছে বনে আজ |/বসন্তের এই মাতাল সমীরণে/আজ জোস্না রাতে সবাই গেছে বনে আজ |
শীতের রাতে এই কোরাসে রুবাহুত গাছের পাখিরা মাঝে মাঝে নিজেদের প্রতিদ্বন্দী ভেবে তাদের অবস্থান জানান দিচ্ছিল আর চাঁদ তার স্তুতি শুনে তো লজ্জায় কুয়াশার মুসলিন শার্শী দিয়ে তাকায়। হালকা কুয়াশার ছাঁট মেখে এবরোথেবরো কংক্রিটের প্লাটফরম আর পাথরের রেল লাইন পেরিয়ে আমরা যখন ঘাসের মখমলে পা রাখলাম, শিশিরের শিহরণ ছড়িয়ে গেল মাংসপেশী ভেদ করে অস্থি মজ্জায়, শীত শীত ভাব যেন হৃদয় নামক বস্তুটাকেও সংক্রমিত করল । মন তখন একটু ছোঁয়ার অপেক্ষায় চাতক পাখি হয়ে ফটিক জল ফটিক জল বলে ব্যাকুলতায় চন্ডীদাসের মত মন সাগরে বড়শী বাইছে । মাঠ পেরিয়ে একটা ছোট গলি, তারপর আমরা অর্ধ তীর্থযাত্রীরা প্রত্যাশার যাত্রা সাঙ্গ করলাম কু্যাশাভেজা ভ্যান স্ট্যান্ডে এসে।
শীতের রাতে মফস্বলের ভ্যান স্ট্যান্ড, যতটা না ফাঁকা থাকার কথা তার চেয়েও শুণ্য আর নিশ্চুপ যেন আমরা ইংলিশ হরর সিনেমার মত ভৌতিক জঙ্গলে এসে পরেছি............... (চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে নভেম্বর, ২০১৫ রাত ১১:১৬