somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অনুবাদ গল্পঃ লা মিজারেবল- ভিক্টর হুগো -০২

২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৭ রাত ১:৫৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
পর্ব-০২

লা মিজারেবলঃ পর্ব-০১
প্রথম পর্বের পরঃ 



১৮১৫ সালের অক্টোবর মাসের একটি দিন । সূর্য তখন ডুবু-ডুবু করছে। ফ্রান্সের ছোট একটি শহর 'ডি'র একটি পথ দিয়ে ধীর গতিতে এগিয়ে চলেছে একটি লোক। মনে হয় ভীষন পরিশ্রান্ত। লোকটির মজবুত বাঁধুনির শরীর। বয়সে প্রৌঢ়। জীর্ণ মলিন বিচিত্র রঙের তালিযুক্ত তার পরনের পোশাক। পায়ে ছেঁড়া জুতা, হাতে একটি প্রকান্ড লাঠি। লোকটির সারা গায়ে ভল্লুকের মত ঘিচঘিচে লোম। থ্যাবরা নাক। চ্যাপ্টা মুখে একবোঝা দাড়ি। মাথার চুলগুলো কদম ফুলের মত ছাঁটা। সবমিলিয়ে অদ্ভুত। লোকটির পিঠে একটি মাঝারি ধরনের পোটলা।

পথ চলতে-চলতে একটি হোটেল দেখে দাঁড়ালো সে। কি যেন ভাবলো কিছুক্ষণ। তারপর দরোজা ঠেলে হোটেলের ভিতরে ঢুকে পড়ল। যে ঘরে প্রবেশ করলো, সেটাই হোটেলের খাবার ঘর, হোটেলওয়ালা ক্যাশবাক্স নিয়ে এই ঘরে বসে সব জিনিসের তদারকী করে। ঘরটির একপাশে চুলো। গনগনে আগুন জলছে, পাশের আরেকটি ঘর থেকে কিছু লোকের সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে।

বিচিত্র এক আগন্তুককে দেখে হোটেলওয়ালা ভ্রূ কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো, ---কি চাই তোমার?

--আজ রাতের মতো আপনার হোটেলে থাকার ও খাবার মতো কোন ব্যবস্থা হবে? আগন্তুক জানতে চায়।

সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকায় হোটেলওয়ালা। বলে, --হুঁ! ট্যাঁকে কিছু আছে তো?

--হ্যাঁ, তা হবে, নইলে কি আর এমনি-এমনি এসেছি---

আগন্তুকটি পকেট থেকে একটি চামড়ার থলি বের করে টাকা দেখায়। তখন হোটেলওয়ালা বলে, --আচ্ছা বেশ, ওই টুলটায় বসো, রান্না এখনো শেষ হয়নি।

আগন্তুকটিও যেন খানিকটা আশ্বস্ত হয়। দরোজার পাশে টুলটা টেনে বসে হাতের লাঠির উপর থুতনিতে ভর দিয়ে সে জিজ্ঞেস করে, --খাবার তৈরি হতে কি বেশি দেরি হবে ভাই?

--না না, বেশি দেরি হবে না। একটু অপেক্ষা করো বাপু। হোটেলওয়ালা জবাব দেয়।

তারপর হোটেলওয়ালা পুরোনো একটি খবরের কাগজের পাশ থেকে এক চিলতে  কাগজ ছিড়ে পেন্সিল দিয়ে কিন যেন লিখল। লেখা শেষ হলে হোটেলের একটি বেয়ারার হাতে কাগজটি দিয়ে হোটেলওয়ালা তাকে ফিস-ফিস করে কি যেন বলে। বেয়ারা সেই কাগজ নিয়ে তাড়াতাড়ি করে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।

কিছুক্ষন পর বেয়ারাটি ফিরে আসে। হোটেলওয়ালার হাতে সে ছোট্ট একটি চিরকুট এগিয়ে দেয়, আর সেটা পড়ে হোটেলওয়ালার চোখমুখ কুঁচকে উঠলো। আগন্তুকটি কোণের টুলে বসে তখন ঢুলছে, হোটেলওয়ালা এগিয়ে গিয়ে তার ঘার ধরে নাড়া দেয়, আগন্তুকটির তন্দ্রা ভেঙ্গে যায় এবং ধড়মড় করে উঠে বসে।

হোটেলওয়ালা বলে, -- কিহে! বসে-বসে ঘুমাচ্ছিলে নাকি? উঠ, কথা আছে।

আগন্তুকটি বলে, -- খাবার তৈরি হয়ে গেছে? এই আসছি।

-- শোন। তুমি খাবার পাবে না। কঠিন কন্ঠে বলে হোটেলোয়ালা।

-- খাবার পাব না! কেন? কি হয়েছে? আমি কি পয়সা দিব না নাকি?

-- না, সে জন্যে নয়। পয়সা দিলেও আমি তোমায় খাবার দিচ্ছি না।

-- কেন? আমি কি অন্যায় করেছি? আগন্তুকটি টুল ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়, ঘরের এককোণে টেবিলের উপর সাজানো ছিল সার-সার পাত্র, সেদিকে এগিয়ে যায় সে, পাত্রের ঢাকনাগুলো উঠিয়ে ফেলে। সে ক্ষিপ্তকণ্ঠে জিজ্ঞেস করে, -- এই এতগুলো খাবার দিয়ে তুমি কি করবে? এগুলো কার জন্য? আমি কেন খাবার পাব না?

হোটেলওয়ালা বলে, --তুমি ছাড়া আরো অনেক লোক রয়েছে, আর তা ছাড়া খাবার থাকলেও আমি তোমাকে দিতে পারব না।

এবার আকুল্ভাবে হাত জোর করে আগন্তুক বলে উঠল-- সাহেব, আমি ভীষণ পরিশ্রান্ত, আমি আজ প্রায় ১২মাইল পথ হেঁটেছি। সারাদিন কিছু খাইনি। খাবার না দিন, আপনার আস্তাবলের কোণে আজকের রাতে থাকবার মতো একটু জায়গা দিন। বাইরে দারুন শীত। এখানে আমি কাওকে চিনি না। এই রাতে কোথায় যাব। আপনি ভেবেছেন, আমার টাকা নেই? এই নিন টাকা, আমি আপনাকে এগুলো আগাম দিয়ে দিচ্ছি।

হোটেলওয়ালা এবার বলে, -- দেখো বাপু, কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। আমি লোকটি নেহাতই ভালো মানুষ। ওসব ঝামেলা পচ্ছন্দ করি না। প্রথমেই আমার সন্দেহ হচ্ছিল। ফাঁড়িতে খবর নিয় জানলাম, আমার অনুমান সত্যি। বুকে হাত দিয়ে বলো দেখি, তুমি সে দাগী আসামী জাঁ ভালজাঁ নও?

আগন্তুকের মুখ করুন হয়ে উঠে, মাথা নেড়ে সে জবাব দেয়, --হ্যাঁ, আমিই জাঁ ভালজাঁ।

--  ব্যাস, হয়ে গেল। শোন দাগী আসামীদের আমি হোটেলে জায়গা দিই না। যাও

হোটেল ছেড়ে বাইরে এসে দাঁড়ালো ভালজাঁ। কি যেন ভাবলো সে, তারপর আবার পথ চলতে শুরু করলো। কিন্তু তার পা যে আর চলতে চায় না।

চলতে-চলতে পথের ধারে ছোট একটি হোটেলে গিয়ে উঠলো ভালজাঁ। সেখানেও তার জায়গা হলো না। পরিশ্রান্ত শরীর নিয়ে আবার শুরু হলো তার পথ চলা। পথ চলতে-চলতে সে একসময় শহরের কারাগারের কাছে এসে দাঁড়ালো। কারাগারের প্রকান্ড ফটকের গায়ে একটি লোহার শিকল লাগানো। জোরে-জোরে শেকলটা টানতে লাগলো ভালজাঁ। ফটকের ওপাশে শিকলের মাথায় বাঁধা ঘন্টার ঠন-ঠন করে শব্দ হলো।

ঘন্টার শব্দ শুনে কারাগারের এক রক্ষী বেড়িয়ে এলো। জিজ্ঞেস করলো, --কি ব্যাপার! শিকল টেনেছো কেন?

-- জ্বী, আমার নাম জাঁ ভালজাঁ। দাগী আসামী। খুবই অসহায় অবস্থায় পড়েছি, থাকা-খাওয়ার কোন ব্যবস্থা নেই। আপনাদের কারাগারে আজ রাতের জন্য আমাকে একটু জায়গা দেবেন?

অবাক হয়ে রক্ষীটি ভালজাঁর দিকে তাকিয়ে থাকলো। লোকটি পাগল নাকি?

সে বললো, --যাও এখান থেকে, পাগল কোথাকার, কারাগার তোমার শ্বশুরবাড়ি নাকি, যে ইচ্ছে হলেই থাকতে পারবে। যদি থাকবার শখ হয় ত যাও --গিয়ে একটা চুরি-ডাকাতি করো। বলে রক্ষীটি চলে গেল।

আবার সেই পথ চলা শুরু হলো ভালজাঁর। এই গলি সেই গলি চলতে চলতে লাগলো সে। পথের দু'পাশে কি সুন্দর সাজানো বাগান। দু'পাশে সুন্দর ছোট-বড় ছিম-ছাম স্বপ্নপুরীর মতো বাড়ি।

এমনি একটি বাড়ির সামনে এসে থমকে দাঁড়ালো ভালজাঁ। একতলা সে বাড়ি। ছবির মতো। সাজানো ফুলের বাগান। জানালার দামী পর্দা। ঘরের ভিতর থেকে ভেসে আসছে কথাবার্তা। জানালার পর্দা একপাশে গুটানো। ভালজাঁ দেখতে পেল, একজন ভদ্রলোক এক শিশুকে আদর করছেন। পাশে এক যুবতী মহিলা। শিশুটি তার কচি-কচি হাত-পা নেড়ে খিল-খিল করে হাসছে। মহিলার কোলেও একটি শিশু। সেই শিশুটিও মিট-মিট করে হাসছে। ভালজাঁ ভাবলো, ভদ্রলোকটি নিশ্চয়ই ছেলেটির বাবা আর মহিলাটি তার মা। এত সুখ এত আনান্দ যেখানে, সেখানে নিশ্চয় তার মতো হতভাগ্যের আশ্রয় মিললেও মিলতে পারে। বাড়ির দড়জার দিকে এগিয়ে যায় ভালজাঁ। খট-খট করে কড়া নাড়ে।

--কে? ভেতর থেকে রাশভারী এক কন্ঠস্বর ভেসে এল।

-- আমি একজন অসহায়, দয়া করে দরজাটা খুলুন।

দড়জা খুলে ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করেন, --কি ব্যপার, আপনি কোথা থেকে এসেছেন?

--আমি একজন বিদেশি আগন্তুক। আজকে ১২ মাইল পথ হেঁটে এই শহরে এসে পৌঁছেছি, খুবই ক্লান্ত। তাছাড়া বাইরে দারুন বরফ পড়ছে। আমাকে আজকে রাতের জন্য একটু আশ্রয় দিন। এজন্য আপনাকে যদি টাকা-পয়সা দিতে হয়, আমি তাও দিতে রাজি আছি।

ভালজাঁর আপাদমস্তক জরিপ করে ভদ্রলোক কৌতূহলের সুরে বললেন, --কোন হোটেলে যাচ্ছেন না কেন? পয়সা যখন খরচ করবেন, তখন...

--স্থানীয় কোন হোটেলেই আমার জায়গা পেলাম না। ভালজাঁ জবাব দেয়।

--কোন হোটেলেই জায়গা পেলেন না? বলেন কি! ওই যে কি নাম ওই আস্তাবলওয়ালা বড় হোটেলটায় গিয়েছিলেন?

--হ্যাঁ, গিয়েছিলাম। কিন্তু তারা আমাকে খেতে দিল না। আশ্রয় চাইলাম, তার তাতেও রাজী হলো না।

লোকটির মনে এবার পুরোপুরি ভাবে সন্দেহ জেগে উঠলো। তিনি জিজ্ঞেস করেন, --দেবে না কেন? আপনার পরিচয় কি? কোথা থেকে এসেছেন?

হাতের হারিক্যান ভালজাঁর মুখের কাছে তুলে ধরে কুঞ্চিত চোখে তাকালেন ভদ্রলোক।

ভালজাঁ ততক্ষন দরজার সামনে বসে পরেছে। খানিক্ষন চুপ থেকে সে বললো,--ভীষণ ক্ষুধার্ত আমি। দয়া করে আমায় কিছু খেতে দিন। আমি আপনার কাছে সব খুলে বলবো। আমার বুক জ্বালা করছে। আমার হাত-পা কাঁপছে। আমাকে একটু দয়া করুন।

টেনে-টেনে চিবিয়ে-চিবিয়ে ভদ্রলোক বললেন, --ব্যাস, হয়েছে। তোমায় আমি ঠিক চিনতে পেরেছি। প্রথম থেকেই আমার সন্দেহ হচ্ছিল, অনেক দিন আগে এক রাজকীয় প্রচার পত্রে তোমার ছবি দেখেছিলাম। তুমিই সেই জাঁ ভালজাঁ?

ভালজাঁ লোকটির পা জরিয়ে ধরতে চাইলো। ভদ্রলোক যেন আঁতকে উঠলেন। ঘরের মধ্যে ঢুকে দেয়ালে লটকানো বন্দুকটি টেনে নিয়ে বেরিয়ে এলেন। ভালজাঁর দিকে বন্ধুক উঁচিয়ে চিৎকার করে বলে উঠলেন, --খবরদার বলছি, আর এক পাও এগিয়ো না। গুলী মেরে তোমার মাথার খুলি উড়িয়ে দেবো বদমাশ কোথাকার!

ভদ্রমহিলার হাঁক-ডাক শুনে ভদ্রমহিলাও ভয়ে চিৎকার দিয়ে উঠলেন। বাচ্চা দুটোও আর্তনাদ করে উঠলো, মুহূর্তের মধ্যে ঘরের আবহাওয়া বদলে গেল। ভালজাঁ তখোনো বলে চলেছে, --আমাকে দয়া করুন হুজুর। কিছু অন্ততঃ খেতে দিন। আমি আর সইতে পারছি না। আমায় এক গ্লাস পানি খাওয়াবেন? আমার কন্ঠনালী শুকিয়ে আসছে।

--পানি খাওয়াবো না ছাই। বন্দুক উঁচিয়ে হুঙ্কার দিয়ে ওঠেন ভদ্রলোক। --যাও বলছি এখান থেকে।

ক্লান্ত পায়ে টলতে-টলতে বেরিয়ে যায় ভালজাঁ। দরোজা এটেঁ দেন ভদ্রলোক। জানালাগুলোর পর্দা পর্যন্ত এটেঁ দেন তিনি।

ধীর পায়ে এগুচ্ছে ভালজাঁ। শীতের হিমেল হাওয়া বইছে হু-হু করে। খানিক দূর এগিয়ে ভালজাঁ রাস্তার পাশে একটি ছোট তিরপাল ঢাকা জায়গা দেখতে পেল। রাস্তা মেরামতের কাজ হয়েছে ওখানে দিনের বেলায়। জায়গাটির এপাশে-ওপাশে ইট-সুরকি বালি ছড়ানো।

মনে-মনে খুশি হয় ভালজাঁ। তিরপালের নিচে হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকে যায়। খানিকটা খরও বিছানো রয়েছে। ঝোলাটা নামিয়ে রাখে সে। তারপর ধীরে-ধীরে হাত-পা গুটিয়ে শুয়ে পড়ার আয়োজন করে। আর অমনি ঘেউ-ঘেউ করে তেড়ে আসে বড় একটি বাঘা কুকুর। কুকুরটি গর্তের এক পাশে খড়ের গাদায় শুয়ে আয়েশ করছিল-- ভালজাঁর অনাধিকার প্রবেশে সে বিরক্ত হয়ে উঠেছে হয়তো।

সামান্য পথের কুকুরও তাকে দয়া করলো না। দুর্বল হাতে একবার লাঠি উঁচিয়ে তেরে গিয়েছিল ভালজাঁ। কিন্তু কুকুরটি তাকে কামড়াতে আসে। ভয়ে বেরিয়ে আসে ভালজাঁ।

পথ চলতে-চলতে সে শহরের বাইরে চলে এলো। শীতের হিমেল হাওয়ায় যেন হাত-পা জমে যাচ্ছে। শহরের বাইরে খোলামেলা জায়গায় শীত যেন আরও বেশি জেকে বসেছে। হিমেল হাওয়ার কাঁপনে অস্থির অবস্থা ভালজাঁর।

ঘুরতে-ঘুরতে সে একটি গীর্জা দেখতে পেল। গীর্জার আশে-পাশে ছোট-ছোট কয়েকটি বাড়ি। আকাশ থেকে চাঁদের আলো ছড়িয়ে রয়েছে। ফিঁকে আলোয় একটি বাড়ির সামনে একটি পাথরের বেদী দেখতে পেল সে। সেই বেদীর উপর হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়লো ভালজাঁ। কয়েক মিনিট হয়তো পেরিয়ে গেছে। ক্লান্তির অবসদে সে তখন ঘুমে অচেতন।

দূর থেকে কে যেন জিজ্ঞেস করলো, --তুমি কে হে, ওখানটায় শুয়ে আছো?

ধীরে ধীরে তন্দ্রার মোড় কেটে যায়। বাড়ির ব্যালকনি থেকে কে যেন তাকে দেখছে। ভালজাঁ দেখল একজন অভিজাত পৌর ভদ্রলোক, পরনে বিশাল আলখাল্লা, গলায় ক্রূশ, আর তার ডান কাঁধে একটি সুন্দর শাল বিশেষ ভাবে ঝোলানো রয়েছে। পরনের পোশাক আর বেশভূষা দেখেই ভালজাঁ বুঝে গেল যে, ইনি গীর্জার বিশপ। আর এটি তারই বাড়ি।

ভালজাঁ ধরফর করে উঠে দাঁড়ালো। বিশপ আবার জিজ্ঞেস করলেন, -- এই শীতের রাতে তুমি ওখানটায় কি করছিলে হে?

ভালজাঁ বলতে শুরু করলো, জনাব, আমি ভীষণ ক্লান্ত। অনেক দূর থেকে হেঁটে এসেছি। আজ চারদিন থেকে না খেয়ে আছি। আমি ক্ষুদার্ত। এই শহরে কেও আমাকে খেতে দেয় নি, কোন থাকার জায়গা হয় নি। দয়া করে আমায় তাড়িয়ে দিবেন না। একটু দয়া করুন। আজ রাতটা এখানে কাটাতে দিন। কথা দিচ্ছি, কাল ভোর হওয়ার আগেই আমি এখান ছেড়ে চলে যাব।

ভালজাঁ কাঁদতে আরাম্ভ করলো এবং জোর হাত করে বসে পড়ল। বিরবির করে বলতে থাকলো, দয়া করুন জনাব, দয়া করুন। আমি আর পারছি না।

--বাইরে প্রচন্ড শীত। ভিতরে আসো। এসে বলো কি হয়েছে তোমার? এই বলে বিশপ ভিতরে চলে গেলেন।

বিশপের কথা শুনে ভালজাঁ একেবারে থ হয়ে গেল। তার শুনতে ভুল হয় নি তো, সে যেন নিজের কান কেও বিশ্বাস করতে পারছে না। তারপর কিছুটা ইতস্ততঃ বোধ করে সে এগিয়ে গেল দরজার দিকে। দরজাটি ভিতর থেকে বন্ধ। তাই সে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো।

রাত তখন সাড়ে আটটা। রাতের খাবারের সময় হয়ে এসেছে। বিশপের খাবার টেবিলে খাবারের আয়োজন করা হচ্ছিল। টেবিলের একপাশের চেয়ারে বিশপের বোন বসেছিলেন। বিশপ একটি চেয়ার টেনে তার বোনের পাশই বোসলেন। বুড়ী ঝি টেবিলে খাবার সাজাচ্ছে। এমনি সময় দরোজায় শব্দ হলো ঠক-ঠক করে।

--ভেতরে আসুন-- বিশপ বললেন।

বুড়ী ঝি দরোজা খুলতেই ভালজাঁ ঘরে ঢুকে পড়লো। ঝি আগুন্তুককে দেখে, তার দিকে ফ্যাল-ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। আগন্তুকের বেশভূষা দেখে আর ধরণ-ধারণ দেখে বিশপের বোনও কম অবাক হননি। কিন্তু বিশপ খুব শান্তভাবেই বসে ছিলেন। তাকে দেখেই ভালজাঁ বলতে আরাম্ভ করলো-- জনাব, আপনার বহুত দয়া। আমার নাম জাঁ ভালজা। আমি একজন দাগী আসামী-কয়েদী। উনিশ বছর জেল খেটেছি। কিন্তু আমিও আর সবার মতো একটি মানুষ। আমারো ক্ষুধা আছে, তৃষ্ণা আছে। মাথা গুঁজাবার মতো ঠাঁই-এর দরকার রয়েছে। চার দিন হলো আমি জেল থেকে ছাড়া পেয়েছি। আরপর থেকে আমার স্বস্তি নেই। সমাজের চোখে আজ আমি অবহেলার বস্তু। পোড় খাওয়া কুকুরের মতো এই চারদিন আমি এখান থেকে সেখানে ছুটে বেরাচ্ছি। বার-তের মাইল পথ হেঁটে আজ আমি এই শহরে এসেছি। কিন্তু কোন হোটেলে জাইগা পেলাম না, কোথাও কিছু খেতে পেলাম না। কোথাও জায়গা পেলাম না। পয়সা দিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু কেও আমকে পয়সা দিয়েও আশ্রয় দিতে চায় না। সবখান থেকে ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসেছি। তারপর আপনার বাড়ির সামনের বেদির উপর এসে শুয়ে ছিলাম। একটু আগে আপনি ভিতরে ডাকলেন তাই আপনার সামনে চলে এলাম।

--ভালো করেছেন। বিশপের জবাব। তারপর তিনি ঝিকে বললেন, --টেবিলে আরো একজনের জন্য প্লেট, কাঁটা-চামুচ সাজাও। আজকে আমাদের সাথে এই নতুন অতিথিও আহার করবেন।

ভালজাঁ হতবাক। তার সাথে আবার তামাশা করা হচ্ছে না তো। ঝি আরেক প্রস্থ প্লেট, কাঁটা-চামচ আনার জন্য আলমারীর দিকে যাচ্ছিল। ভালজাঁ বাধা দিয়ে বললো, দাঁড়াও।

তারপর বিশপকে বললো, --জনাব, আমি সত্যি খুব সাংঘাতিক লোক। কয়েদী। উনিশ বছর জেল খেটেছি। চারবার জেল থেকে পালাবার চেষ্টা করেছি। এই দেখুন, আমার ছাড়পত্র। ভালজাঁ তার ঝোলা থেকে একটি হলুদ কাগজ বের করে দেখালো।

তারপর বিশপকে বললো, --এবার বলুন, ঠিক করে বলুন --আপনি আমাকে খেতে দেবেন নাকি তাড়িয়ে দেবেন?

--আপনি অনেক ক্লান্ত। চুলোর পাশে ঐ চেয়ারটার পাশে বসে গা গরম করে নিন। বাইরে দারুন শীত পরেছে।

এরপর ঝিকে উদ্দেশ্য করে বিশপ বললেন, --বুঝলে, আমাদের খেতে দিয়ে তুমি মেহমানের বিছানাটা ঠিক করে দিও।

ঝি টেবিলে আরেকপ্রস্থ কাঁটা-চামচ রেখে গেলো। বিশপ ভালজাঁকে বললেন,-- আজকে দারুন শীত, তাই না? ঘরে আগুনের পাশে বসে রয়েছি, তবু মনে হচ্ছে, হাত বুঝি সিঁটিয়ে যাচ্ছে।......একি আপনি এখনো দাঁড়িয়ে রয়েছেন। আরে বসুনতো, জামা-কাপর বদলাবেন না?

না, না, আর তো অবিশ্বাস নয়। তাহলে সে সত্যি-সত্যি খেতে পাচ্ছে। শোবার জায়গা পাচ্ছে। ভালজাঁ বিশপের কাছে এসে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো। আর বলতে থাকলো --আপনি বড্ড দয়ালু। আপনার তুলনা হয় না।

বিশপ বললেন --একি করছেন আপনি? আমাকে অযথা লজ্জা দিচ্ছেন। উঠুন দেখি। আমি এই গির্জার বিশপ। আমার নাম বিশপ মিরিয়েল। এটা আমার কর্তব্য। আপনি কয়েদী ছিলেন, উনিশ বছর জেল খেটেছেন, তাতে কি হল? আপনিও তো একটা মানুষ? চলুন, চুলোর কাছটায় বসা যাক।

ভালজাঁ বিশপকে বললো, -- দয়া করে আমাকে আর আপনি ডাকবেন না। আমি পাপী-তাপী মানুষ। কিন্ত আপনার কথা শুনে আমি এখন আর কোন অনুতাপ অনুভব করছি না। সবাই আমাকে দূর-দুর করে তাড়িয়ে দিয়েছে। ছেলেবেলা থেকে দারুন কষ্ট ভোগ করে চলেছি। বিধবা বোনের সাত ক্ষুধার্ত সন্তানের জন্য একটুকরা রুটি জোগার করতে গিয়ে উনিশ বছর জেল খাটলাম। আমার চাইতে একটা জানোয়ারের জীবনো ঢের ভাল। আপনি অনেক দয়ালু বিশপ, - বলতে বলতে টেবিলের উপর মাথা গুঁজে ভালজা ঁ ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো।

বিশপ ভালজার পিঠে হাত রাখলেন। বললেন, শন্ত হও। এত বিচলিত হয়ে পড়ছো কেন? ঈশ্বরকে স্মরণ করো।

টেবিলে আলো হচ্ছে না বলে ঝি অন্য ঘর থেকে রুপার দু'টো বাতিদান এনে তাতে মোম জ্বালিয়ে রেখে গেল।

বিশপ বললেন,-- এসো ভাই, শুরু করা যাক আমাদের খাবার।

অনেকদিন পর পরম তৃপ্তির সাথে খাওয়া শেষ করলো ভালজাঁ। এবার একটু ঘুম। বড্ড ক্লান্ত সে। দু'চোখে তার নেমে আসছে ঘুম।

ভালজাঁর শোবার ব্যবস্থা হয়েছে বিশপের ঘরের ঠিক পাশের ঘরে। আসলে এটা একটা প্রার্থনা ঘর। ঘরের এককোণে পর্দার দেওয়াল দেয়া একটি কামরা। সেই ঘরটিই দেয়া হলো ভালজাঁকে। ঘরের একপাশে ছোট একটা খাট। তার উপর ধবধবে বিছানা। খাটের কোণে একটা টেবিল। টেবিলের উপর রুপোর বাতিদানে মোমবাতি। ঘরে ঢুকে ভালজাঁ চারদিকে অবাক চোখে তাকাতে লাগলো। এতো সুন্দর একটা ঘরে তাকে ঘুমুতে দেয়া হয়েছে।

বিশপও ভালজাঁর সাথে এ-ঘরে এসেছিলেন। ভালজাঁকে তিনি বললেন, -- তোমাকে নিয়ে আর পারা গেল না! তুমি বড্ড ক্লান্ত। তোমাকে এবার বিশ্রাম নিতে হবে। এবার শুয়ে পড়ো দেখি।

বিশপ চলে যাচ্ছিলেন, তারপর থেমে আবার ভালজাঁকে বললেন, --আর হ্যা, শোন, কাল ভোরে এখান থেকে যাবার আগে কিছু না খেয়ে চলে যেও না...। টাটকা দুধ থাকবে ঘরে। আমার নিজের গাই-গরু রয়েছে। যাও এখন ঘুমিয়ে পড়ো। এই বলে বিশপ চলে গেলেন।

বিশপ চলে যেতেই ভালজাঁ পরম নিশ্চিন্তে চোখ বুজলো।

(চলবে)

লা মিজারেবলঃ পর্ব-০৩
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা অক্টোবর, ২০১৭ দুপুর ২:০৭
১২টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সবুজের মাঝে বড় হলেন, বাচ্চার জন্যে সবুজ রাখবেন না?

লিখেছেন অপলক , ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:১৮

যাদের বয়স ৩০এর বেশি, তারা যতনা সবুজ গাছপালা দেখেছে শৈশবে, তার ৫ বছরের কম বয়সী শিশুও ১০% সবুজ দেখেনা। এটা বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা।



নব্বয়ের দশকে দেশের বনভূমি ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×