somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অনুবাদ গল্পঃ লা মিজারেবল- ভিক্টর হুগো -০৩

০১ লা অক্টোবর, ২০১৭ রাত ১২:০৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
পর্ব-০৩

লা মিজারেবলঃ পর্ব-০১
লা মিজারেবলঃ পর্ব-০২

২য় পর্বের পরঃ


রাত তখন দুটো। গীর্জার ঘড়িতে ঢং-ঢং করে ঘন্টা বাজতেই ভালজাঁর ঘুম ভেঙ্গে গেল। বিছানা থেকে উঠে ভালজাঁ চারদিকে তাকাতে লাগলো। ঘুমোবার আগে সে বাতিটি নিভিয়ে রেখেছিল। বাইরে হাল্কা জ্যোছনা। নরম আলো ওপাশের জানালা দিয়ে আসছে। ঘরে আর কোন আলো নেই। মাত্র চার ঘন্টা ঘুমিয়েছে ভালজাঁ। তার মনে হলো আরো খানিকটা ঘুমিয়ে নিলে বেশ হয়। এতদিনের ক্লান্তি আবসাদ এখনো পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারেনি সে। কিন্তু আর ঘুম হলো না ভালজাঁর।

 পাশেই বিশপ মারিয়েলের শোবার ঘর। ভালজাঁর মনে পড়লো- রাতে ঘরের ভেতর গিয়ে আসবার সময় বিশপের ঝিকে রুপার থালা-বাসন, কাঁটা-চামচ সহ আরও কিছু জিনিশ আলমারির মধ্য সাজিয়ে রাখতে দেখেছে। চোখ দুটো জ্বলে উঠলো ভালজাঁর। আবছা আঁধারে ঘরের সবখানেই সে যেন রুপার থালা-বাসন কাঁটা-চামচ দেখতে পাচ্ছে।

ঘরের মধ্যে অস্থির পায়চারী করতে লাগলো ভালজাঁ। ঘরের মধ্যখানে দরজা। দরজাটা ভিজানো রয়েছে। ভালজাঁ আস্তে আস্তে দরজাটি ঠেলতে লাগলো। দরজা খুলে সে পাশের একটি জানালার ধারে এগিয়ে গেল। গলা সমান উঁচু জালালা, গরাদ নেই। জানালা থেকে বাইরে তাকালো ভালজাঁ। চাঁদের আলোয় বিশপের বাগানটা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে সে। ওপাশেই বাগান ঘিরে দেওয়াল। তাও বেশি উঁচু নয়। ভালজাঁ ভাবলো, এই দেয়াল টপকাতে তার কোন অসুবিধায় হবে না।

ঘন-ঘন শ্বাস পড়ছে ভালজাঁর। দারুন শীতেও কপালে কিছু ঘাম জমেছে। ভালো-মন্দ, দ্বিধা-ভয়, সন্দেহ-সংঘাতে ভালজাঁর মন দো-দোলামান। ভালজাঁ তার ঝোলার মধ্য থেকে লম্বা সূঁচালো একটা লোহা বের করলো। দখতে অনেকটা সিঁদকাঠির মতো। জানালার কাছে গিয়ে আলোতে লোহাটা পরিক্ষা করে নিলো ভালজাঁ। হ্যাঁ, এটা দিয়েই তালা খোলা যেতে পারে।

পায়ের জুতাজোড়া খুলে ঝোলার মধ্যে রাখলো ভালজাঁ। হাতের লাঠিটি রাখলো জানালার কাছে, ঝোলাটা আর একবার নেড়েচেড়ে দেখলো। তারপর সে দরজা খুলে পা টিপে-টিপে বিশপের ঘরের দিকে এগুতে লাগলো। বিশপের ঘর পেরুলেই খাবার ঘর। ভালজাঁ এগুতে থাকলো। ঘরে ঢুকেই ভালজাঁ দেখলো বিশপ গভীর ঘুমে অচেতন। কাঁচের জানালার পর্দার কিছু অংশ ফাঁক হয়ে রয়েছে। সেই ফাঁক থেকে কিছু চাঁদের আলো বিশপের মুখে এসে পরেছে। চাঁদের আলোয় ভারী মায়াময় মনে হলো বিশপকে। শান্ত, সৌম্য মুখ। খাবার ঘরের দরজাটা সোজাসুজি বিশপের পায়ের দিকে। ভালজাঁ অতি সাবধানে সেখানে গিয়ে দাঁড়ালো। তারপর ধীরে-ধীরে কপাটটা একটুখানি ঠেলে দিল। সামান্য পরিমান জায়গা ফাঁক হয়েছে, এর মধ্যে দিয়ে ঘরে ঢোকা অসম্ভব। দড়জাটা খুব শক্ত ভাবে এঁটে রয়েছে তাই বেশ জোরেই কপাটটা ঠেলতে লাগলো সে। কিন্তু জোরে ঠেলা দিতেই কপাটে মড়-মড় করে শব্দ হলো। ভালজাঁ ভয়ে একেবারে কাঠ হয়ে গেল। বুকটা হাপরের মতো উঠা-নামা করছে। কপাটের মরচে পড়া কব্জার শব্দে সবাই বুঝি জেগে উঠেছে। এই বুঝি সবাই 'চোর-চোর' বলে তাড়া করে তাকে ধরে ফেলবে। কিন্তু না ঠিক আগের মতই নিস্তব্দতা বিরাজ করছে। চারদিক সব নিঝুম, ঘরের মধ্যে আধোজ্যোছনার আলো। বিশপও গভীর ঘুমে অচেতন।

ভালজাঁ ঘরের মধ্যে প্রবেশ করলো। ঘরে জ্যোছনার হালকা আলো, কিন্তু ঘরের জিনিসপত্র তেমন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। ভালজাঁ চারদিকে ভাল করে তাকিয়ে নিল। তারপর বাসন-কোসন রাখবার আলমারিটার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। আলমারিটা তালবদ্ধ। সে তালা খোলার জন্য সিঁদকাঠিটি বের করলো। কিন্তু একি! আলমারিটির তালার সাথে চাবিটাও যে ঝুলছে। রাতে বিশপের ঝিঁ তালা দিয়ে ভুল করে চাবিটি না নিয়েই চলে গেছে। ভালজাঁর কাজ অনেকটা সহজ হয়ে গেল, তালা ভাঙ্গার জন্য সিঁদকাঠির আর দরকার হলো না। আলমারির পাল্লা দুটো খুলে ফেললো ভালজাঁ। একপাশে তাক করে রুপার বাসন-কোসনগুলো সাজানো রয়েছে। লোভে চক-চক করে উঠলো ভালজাঁর চোখ।

জীবনে অনেক দুঃখ-কষ্ট সয়েছে ভালজাঁ। কষ্টে তার জীবন ভারাক্রান্ত। জেল থেকে বেরুনোর পর সারা পৃথিবীর উপরে তার মনে একটা ক্ষোভ জমে গেছে। প্রতি পদে ঠোকর খেতে-খেতে তার সে ক্ষোভ আরো গভীর হয়ে উঠছে। কিন্তু সাথে-সাথে ভালজাঁ এও চেয়েছিল, সে বেঁচে থাকবে। নিষ্পাপ, নির্বিকার, শান্ত-সুন্দর একটি জীবনের সে অধিকারী হবে। অনুতাপ করার মতো কোন কাজ সে করেছিল বলে মনেও করেনি। তার বোনের কথা, বোনের ছোট-ছোট ছেলেমেয়েদের কথা সে কখনো ভুলতে পারিনি। তাদের কারনে অতীতের কয়েকটি বছর তার ঘুমকে কেড়ে নিয়েছে। বিশাল এক শুন্যতা আর হতাশা তাকে ঘিরে ধরে।

বাসন-কোসনের আলমারির উপরেই যীশুর একটি ছবি। হাত বাড়িয়ে ছবিটি কি যেন বলতে চাইছে। জ্যোছনার অস্পষ্ট আলোতে ছবিটি দেখে ভালজাঁ চমকে উঠলো। বিশপ নিশ্চন্তে ঘুমোচ্ছেন। ভালজাঁর মনে হলো, ছবিটি বিশপকে আশীর্বাদ করছে। আবার মনে হলো না না, ছবিটি ভালজাঁকে তিরস্কার করছে। ভালজাঁর মনে হলো তার প্রভু যেন তাকে বলছে-- যে তোমাকে খাবার দিল, আশ্রয় দিল-- তুমি তারই সর্বনাশ করছো ভালজাঁ?

আবার সেই চিন্তায় পেয়ে বসলো ভালজাঁকে। তার চারপাশে পৃথিবী যেন টলছে; বিশপকে ঘুম থেকে জাগিয়ে সে কি তার পা ধরে ক্ষমা চাইবে? খানিক্ষণ কেটে গেল। ভালজাঁর বুকের ঝড় শান্ত হয়ে গেছে। কিছুক্ষণ নিশ্চল দাঁড়িয়ে সে কী ভাবলো কে জানে? হঠাৎ সে তার থলেটা খুলে ফেললো। বাসন-কোসনগুলোকে পাঁজা করে সে থলির মধ্যে পুরে নিল। তারপর দ্রুত নিজের ঘরে এসে জানালা গলিয়ে সে বাগানে প্রবেশ করলো। চারদিকে ভালো করে তাকিয়ে নিলো ভালজাঁ। না কেউ তাকে দেখছে না। সে বাগানের পাঁচিল টপকে বাইরে চলে গেল।

পরদিন ভোর হতেই বিশপের বাড়িতে হৈ-চৈ পড়ে গেল। ব্যাপারটা প্রথমে নজরে পড়ে ঝি'র চোখে।

বুড়ি ঝি বিশপকে বললো, --হুজুর! আমাদের সর্বনাশ হয়ে গেছে। আমাদের দামি রুপোর বাসন-কোসন গুলো চুরি হয়ে গেছে। কালকেই বুঝতে পেরেছিলাম, লোকটি সুবিধের নয়! খুনে ডাকাত-ডাকাত ভাব।

বিশপ চুপ করে ছিলেন। ঝি'র কথা শুনে তিনি বললেন, -- আহা বেচারা। এমনটা না করলেই পারত। আমাকে বললেই আমি তাকে ওগুলো দিয়ে দিতাম। তবে নিয়েছে যখন ভালই করেছে। বড্ড গরিব বেচারা, ভীষণ গরীব। ওগুলো বিক্রি করে সে যা টাকা পাবে, তা দিয়ে বেশ কিছুদিন সুখেই খেয়ে-পড়ে বাঁচতে পারবে সে। বেচারা ১৯ বছর অনেক কষ্ট সহ্য করেছে। এখন একটু সুখ করুক। প্রভু যেন তার মঙ্গল করেন।

বিশপের বোনো এর মধ্যে বিশপের কাছে এসে দাঁড়িয়েছেন। বিশপের কথা শুনে তিনি আর কিছু বলতে ভরসা পেলেন না।

ভালজাঁ কিন্তু পালিয়ে যেতে পারেনি। পাঁচিল টপকিয়ে দুমদাম করে ছুটে পালাচ্ছিল ভালজাঁ। রাত তখন সাড়ে তিনটা। পাহারাদার পুলিশের চৌকি দেয়া তখনও শেষ হয়নি। ভালজাঁ একদল পাহারাদার পুলিশের সামনে পড়ে গেল। নাক পর্যন্ত বানর টুপি দিয়ে ঢাকা বোচকাসহ একটা লোককে পালিয়ে যেতে দেখে তাদের সন্দেহ হলো। ভালজাঁ পুলিশের হাতে ধরা পড়লো।

ভালজাঁ বলল, -- জিনিশগুলো তার চুরি করা নয়। বড় গীর্জার পাদ্রীসাহেব তাকে এগুলো দিয়েছেন।

পুলিশ বললো, --তাই সই। চল বিশপের কাছে। ভালজাঁকে নিয়ে পাহারাদার পুলিশ এসে হাজির হলো বিশপের বাড়ি।

বিশপ ভালজাঁকে দেখতে পেয়ে বললেন,-- ভোরবেলা কিছু না খেয়েই চলে গেলে তুমি! আমি বুড়ি ঝিকে কালরাতেই বলে রেখেছিলাম যে, খুব ভোরেই তোমাকে যেন এক গ্লাস দুধ দেওয়া হয়। আর হ্যাঁ, তোমাকে কালকে বাসন-কোসনের সাথে দুটো রূপোর বাতিদানও তো দিয়েছিলাম। সে দুটি তুমি বোধহয় ভুলে রেখে গেছো। নিয়ে যাওনি কেন? নিয়ে যাও।

ভালজাঁ পাথরের মূর্তির মতো করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। কি জবাব দেবে সে! বিশপ তাকে কেন বকলেন না। কেন তাকে ধরে বেঁধে প্রহর করলেন না। তা'হলেই তো তার ঠিক শাস্তি হতো। ভালজাঁ অস্বস্তির হাত থেকে বেচেঁ যেত।

পুলিশের দারগা বিশপকে বললেন, -- আচ্ছা, তাহলে আপনি সত্যি-সত্যি তাকে ওগুলো দিয়েছেন? আমারা তো ভেবেছিলাম চুরি-- ছিঃ ছিঃ খুব অন্যায় হয়ে গেল। দারগা ভালজাঁর হাতকড়া খুলে দিতে বললেন।

ভালজাঁর চোখ দপ করে জ্বলে উঠলো। সে তাহলে ছাড়া পেয়ে গেল। তার আর জেল হবে না? কিন্তু তারপরেই সে আবার চুপসে গেল। ম্লান হয়ে গেন তার দু'চোখের দীপ্তি। তার পায়ের কাছে রুপার বাসন-কোসনে ভরা থলিটি পড়ে রয়েছে। অন্ততঃ কম করে হলেও আট থেকে নয়শো টাকা দাম হবে সেগুলোর। ভালজাঁ একবার মনে হলো সে অন্যায় করেছে। দীর্ঘ উনিশ বছরের কারাবাসের পর তার মনের মধ্য জমে উঠেছিল ক্ষোভ আর ক্রধের আগুন। এবার তার যেন অনুতাপ হলো। কারণ, ভালজাঁর মন তখনো নানা ভাবের আনাগোনায় দুলছে। এক দিকে পৃথিবীর প্রতি চরম ঘৃণা, অপরদিকে অন্যায় বোধ। ভালজাঁর সে সময়ের মনের অবস্থা আমরা শুধু অনুমানই করতে পারি, তার সঠিক বিবরণ দেওয়া সম্ভব নয়।

দারগা, পুলিশ চলে গেল। বিশপ ভালজাঁকে বললেন, -- জাঁ ভালাজাঁ! তুমি একটু অপেক্ষা করো। আমি ওঘর থেকে তোমার জন্য রুপোর বাতিদান দু'টো নিয়ে আসছি। দেখো, এবারও না নিয়ে চলে যেও না যেন।

বিশপ খানিক পরেই রুপোর বাতিদান দু'টো নিয়ে এলেন। ভালজাঁকে বললেন,--এই নাও, এ দু'টো বিক্রি করলেও তুমি কম করে একশ টাকা পাবে, নাও। লজ্জ্বা করো না ভালাজাঁ। আমি কিছু মনে করিনি। প্রভু তোমার কৃপা করুন। এখন থেকে পরম সৃষ্টিকর্তার সুন্দর দৃষ্টি তোমার উপরেই থাকবে, তুমি ভালো থাকবে ভালজাঁ। ভালো হয়ে বেঁচে থাকবে। আর হ্যাঁ, যদি কোনদিন এ শহরে আবার আস, তাহলে আমার বাড়িতে এসো। কোন লজ্জ্বা করো না। তুই আমার প্রিয় ভাই হয়ে থাকবে ভালাজাঁ। ভালো থেকো।

বিশপ ভালজাঁর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। এরপর বাতিদান দু'টো তার হাতে দিয়ে তিনি নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ালেন। বিশপ চলে যেতেই ভালজাঁর চোখ থেকে অঝোর ধারায় টপ-টপ করে অশ্রু গড়িয়ে পরতে লাগল। ভালজাঁ কাঁদছে। এ কান্না তার পরিতাপের কান্না।

কাঁদতে-কাঁদতে বিশপের বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে এলো ভালজাঁ। সাথে তার সেই থলি আর হাতে রুপোর বাতিদানগুলো। ভালজাঁ ছুটে পালাতে চায়। অস্বস্তির দারুন দহনে সে ছটফট করছে। তার মনে নানা ভাবানার ঝর বয়ে চলেছে। খোলা স্থান চাই। শহর থেকে দূরে, অনেক দূরে-- যেখানে কেও তাকে চিনবে না, জানবে না-- এমনি এক জায়গায় ছুটে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে তার।

সারাদিন এখানে-সেখানে ঘুরে বেড়ালো ভালজাঁ। তখন বিকেল। ভালজাঁ ঘুরতে-ঘুরতে হাজির হলো শহরের এক কোণে একটা মাঠে। বিরাট বড়, তেপান্তরের মত একটি মাঠ। মাঠের ওপারে গড়ে উঠেছে নতুন বসতি, নতুন লোকালয়। 'ডি' শহরের সাথে ওপাশের লোকালয়ের যোগাযোগ সাধন করেছে এই মাঠটি।

ভালজাঁ সারাদিন ঘুরে-ঘুরে খুবি ক্লান্ত হয়ে পরেছিল। মনের মধ্যে তার সে ঝড় এখনো আছে কিনা কে জানে।

ভালজাঁ মাঠের মধ্যে একটি ঢিবির মতো জায়গা বেছে নিয়ে তার পাশে বসে পড়লো। বসে-বসে সে আকাশ-পাতাল ভাবতে লাগলো। এমনি করে কতক্ষন সে চুপ করে বসেছিল তা তার মনে নেই। হঠাৎ, একটি সঙ্গিতের আওয়াজে তার ঘোর কেটে গেল। কান পেতে ভালজাঁ গানটি শুনবার চেষ্টা করলো। শব্দটি ক্রমশই কাছে এগিয়ে আসছে। খানিক পর ভালজাঁ দেখলো, এগারো-বারো বছরের একটি ছেলে গান গাইতে-গাইতে যাচ্ছে। খুব হাসিখুশী ভাব। ছেলেটির পিঠে একটি বাক্স ঝুলান, হাতে বেহালার মত একটি যন্ত্র।

ভালজাঁ যে ঢিবির কাছে বসে ছিল, ওটার পাশেই ছিল ছোট একটি ঝোপ। ছেলেটি গান গাইতে-গাইতে এসে একটু জিরিয়ে নেবার জন্যে ঝোপের ওপাশে বসে পড়ল।ভালজাঁকে সে দেখতে পায়নি। তখন পরন্ত বিকেল।

হঠাৎ কি জানি খেয়াল হলো ছেলেটির। পিঠের ছোট বাক্সটি সে খুলে ফেললো। বাক্সের মধ্যে আনি, দু'আনি, সিকি, আধুলিতে মিলে বেশ কয়েকটি খুচরা পয়সা। পয়সাগুলো নেড়েচেড়ে দেখতে লাগলো ছেলেটি। তারপর তার মধ্য থেকে একটি চকচকে আধুলি বের করে নিয়ে সে বাক্সটি বন্ধ করলো। তারপর আবার গুন-গুন করে গান গাইতে-গাইতে আধুলিটাকে হাতের বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে টোকা মেরে শূন্যে ছুঁড়ে সে খেলা করতে লাগলো।

ঝোপের আড়াল থেকে ভালাজাঁ সবকিছুই লক্ষ করে চলেছে। সে কি ভাবছে কে জানে! কিন্তু আস্তে-আস্তে তার কপালের বলিরেখাগুলো কঠিন হয়ে উঠলো। চোখের দু'কোণ গেল কুঁচকে। ভালজাঁর চোখে কেমন যেন এক বন্য দৃষ্টি বিরাজ করতে লাগলো।

আধুলিটি নিয়ে খেলা করতে-করতে একবার আধুলিটি ছেলেটার হাত থেকে ফসকে মাটিতে পড়ে গেল। পড়েই ঢিবির উপর দিয়ে গড়িয়ে-গড়িয়ে ঠিক ভালজাঁর পায়ের কাছে এসে সেটা থেমে গেল। ভালজাঁ চট করে পা দিয়ে আধুলিটি চেপে রাখলো।

আধুলিটি হাত থেকে ফসকে যেতেই ছেলেটি চটপট উঠে দাঁড়িয়েছে।  আধুলিটি কোথায় গেল, তা তার নজর এড়ায়নি। সে সটান হয়ে ভালাজাঁর কাছে এসে হাজির হলো। ভালজাঁ সব টের পেয়ে গেল। কিন্তু নির্বিকার বসে রইলো -যেন কিছুই টের পায়নি। ছেলেটি ভালজাঁ মুখোমুখি দাঁড়াতেই ভালজাঁ তার দিকে কটমট করে তাকাল। জিজ্ঞেস করলো,-- কি চাস তুই?

--জ্বি, আমার আধুলিটি...ছেলেটি বললো।

--আধুলি! কিসের আধুলি রে? ভালজাঁ বেশ রেগে জিজ্ঞেস করলো।

ছেলেটি ভ্যাবচাকা খেয়ে গেছে। লোকটি এরকম খুনে দৃষ্টি নিয়ে তার দিকে তাকাচ্ছে কেন? না, তবুও সে আধুলিটি না নিয়ে যাবে না। সারা দিন এখানে-সেখানে ঘুরে গান গাইতে কি রকম কষ্ট হয়। সেখান থেকেই এই রুজি তার।

ছেলেটি মাঠের এদিক-সেদিক তাকালো। ধারে কাছে কাউকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। ক্রমে-ক্রমে চারধার আঁধার হয়ে আসছে। সে ভালজাঁর কাছে আর একটু সরে এলো। বললো, -- ও সাহেব, দিন না আমার আধুলিটা। ঐ তো আপনি পা দিয়ে চেপে রেখেছেন। দয়া করে আপনার পা টা একটু তুলুন। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। আমাকে অনেক দূর যেতে হবে।

এবার ছেলেটির দিকে ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো ভালজাঁ। শেষ বিকেলের ছায়া এসে পরেছে তার চোখে। একদৃষ্টিতে সে ছেলেটির দিকে তাকিয়ে রইলো। ভ্রূ কুঁচকে এসেছে ভালজাঁর। ধীরে-ধীরে তার চোখে বুনো আক্রোশ জমা হতে লাগলো। দু'চোখে যেন কেমন চুরমার করে দেওয়া দৃষ্টি।

ছেলেটি ভালাজাঁর বুনো চাউনি দেখে ভয় পেল। খানিকটা পিছনে সরে দাঁড়ালো সে। ভালজাঁ জিজ্ঞেস করলো, -- কি নাম তোর?

-- আমার নাম জেয়োভে। আমার আধুলিটি দিয়ে দিন সাহেব। আমাকে অনেক দূরে যেতে হবে। হুঁই শহরের সেই কোণায়-- ছেলেটির কণ্ঠ ভেজা। সন্ধ্যা নেমে এসেছে।

ভালজাঁ রাগে খপ করে জেয়েভের হাত ধরে ফেলল। আর্তনাদ করে উঠলো জেয়োভে। হঠাৎ কি ভেবে হাত ছেড়ে দিল ভালজাঁ। জেয়োভে ততক্ষনে কান্না শুরু করে দিয়েছে। কিছুক্ষন কাঁদার পর সে বুঝতে পারলো, তার আধুলিটি সে আর কখনই ফেরত পাবে না । তাই ভালজাঁর শারীরিক শক্তি আর তার বুনো দৃষ্টির কাছে নিজে থেকেই হার মেনে নিলো। খানিক্ষন শূন্য দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে রইলো ভালজাঁর দিকে। তারপর নিজের জিনিশপত্র গুটিয়ে নিয়ে পা বাড়ালো তার গন্তব্যের দিকে। মুহুর্তেই যেন অন্ধকারে মিশে গেল সে।

সন্ধ্যা তখন রাতের মাঝে মিশে যাচ্ছে। কাজ জ্যোছনা। শীতের বাতাস বইছে। জোয়েভে চলে যাওয়ার পর ভালজাঁ কতক্ষন ওখানে বসে ছিল তার মনে নেই। শীতের হাওয়া তার নাকে মুখে হু-হু করে লাগতেই সে উঠে দাঁড়ালো। ধীরে-ধীরে সে তার ডান পা উঠালো। আধুলিটি মাটির সাথে সাপটে রয়েছে। জেয়োভের মুখটি তার চোখের সম্মুখে ভেসে উঠলো। এক দৃষ্টিতে আধুলিটির দিকে তাকিয়ে রইলো ভালজাঁ। তারপর একসময় হু-হু করে কেঁদে উঠলো। সে চিৎকার দিয়ে বলে উঠলো,-- জেয়োভে! ও জেয়োভে! তুমি কোথায়। ফিরে এসো, তোমার জিনিশটি নিয়ে আমি অন্যায় করে ফেলেছি। এসো, তোমার আধুলি তুমি নিয়ে যাও।

কেউ সারা দিল না তার ডাকে। জেয়োভে যে পথ ধরে চলে গিয়েছিল সে দিকে হাঁটতে লাগলো ভালজাঁ। তখন হিমেল হাওয়া বইতে শুরু করেছে। মাঝে-মাঝে জেয়োভের নাম ধরে চিৎকার দিয়ে সে ডাকতে লাগলো। মাঝে-মাঝে সে থেমে এদিক-ওদিক ভাল করে নিরীক্ষন করতে লাগলো। দূর থেকে কোন জিনিশকে দেখে সে ছুটে গেল জেয়োভে মনে করে। কিন্তু নাহ, কেউ কোথাও নেই, কেউ তার ডাকে সারা দিল না। তাছাড়া এই প্রচন্ড ঠান্ডার রাতে কেই বা বাইরে থাকবে?

ভালজাঁ পাগলের মত পায়চারি করতে লাগলো। আর অস্পষ্ট স্বরে বিড়বিড় করে বলতে লাগলো, -- আমি পাপ করছি। দশ-বারো বছরের একটি বাচ্চা ছেলের রোজাগারের টাকা আমি কেড়ে নিয়েছি। আমি অমানুষ। আমি পাপী। জেয়োভে, ফিরে আয়; নিয়ে যা তোর জিনিশ। আমাকে পাপমুক্ত কর। আমি যে পাপ করেছি তা ক্ষমার অযোগ্য। ইশ্বর কনোদিনই আমকে ক্ষমা করবেন না। ফিরে আয়, পাপমুক্ত কর আমাকে। এইসব বলতে-বলতে ভালজাঁ আবার ডুকরে কেঁদে উঠলো। তার বুকে আবার ঝড় বইতে শুরু করেছে।

এভাবে কতক্ষন বসেছিল ভালজাঁ মনে নেই। হিমেল হাওয়া যখন চরম পর্যায়ে পৌছালো, তখন বাধ্য হয়েই উঠে দাঁড়ালো সে। একটু দূরে তার বাসন-কোসনের থলেটা পড়ে রয়েছে। থলেটা কাঁধে নিয়ে টলতে-টলতে সে পথ চলতে লাগলো। হাঁটতে-হাঁটতে সে একটা তে-মাথা রাস্তার কাছে পৌছালো। ঘোলাটে দৃষ্টিতে সে তিনটি পথের দিকে তাকাতে লাগলো, কোন পথে যাবে সে? ক্লান্তিতে সারা শরীর যেন জরিয়ে রয়েছে। তে-মাথার কাছে একটি পাথরের উপর বসে পড়লো ভালজাঁ।

খানিক পর আবার সে হাঁটতে শুরু করলো। ভালো-মন্দ, পাপ-পুণ্যের নানা ভাবনায় তার মনে ঝড় বয়েই চলেছে। বিশপের কথা মনে হলো, --তুমি এবার থেকে ভালো হয়ে চলবে ভালজাঁ। প্রভু তোমার মঙ্গল করুন। ভালজাঁ ভাবছিলো, সে কি ভালোভাবে জীবন-যাপন করতে পারবে? সাথে-সাথে তার মনে জাগলো জিঘাংসা। আবার হঠাৎ করে জেয়োভের কথা মনে হলো। আবার কান্নায় ভেঙ্গে পরলো সে। এই কান্নার যেন শেষ নেই। পাপ-পুণ্যের দোদুল দোলার আন্দোলিত একটি ঝড়ের পাখির মতো ভালজাঁ পথ চলতে লাগলো। চলতে-চলতে সে চলে গেল দূরের কোন এক অজানা গন্তব্যে।

সে কোথায় গেল, কেউ তার খোজ করলো না। উনিশ বছরের কয়েদ খাটা একটি লোককে এ শহরের ক'জনই বা চেনে, আর চিনলেও কেই-বা তার খবর নেবে। বিশপ ছাড়া সবাই তো তাকে তাড়িয়ে দিয়েছে। ভালজাঁ কতক্ষন কেঁদেছিল, তারপর সে যে কোথায় চলে গেল; আমরা কেউ তা জানি না।

(চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা অক্টোবর, ২০১৭ রাত ১২:৫৮
৫টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ


২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

লিখেছেন এস.এম. আজাদ রহমান, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:৪৪



বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

কেন বিএনপি–জামায়াত–তুরস্ক প্রসঙ্গ এখন এত তপ্ত?
বাংলাদেশের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে একটি পরিচিত ভয়–সংস্কৃতি কাজ করেছে—
“র”—ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা নিয়ে রাজনীতিতে গুজব,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×