পবিত্র ধর্মগ্রন্থ আল কোরআনসহ ইসলাম ধর্মবিষয়ক প্রায় ৪২টি বইয়ের অনুবাদক এবং রচক ভাই গিরিশচন্দ্র সেন।
কোরআন শরিফের প্রথম বাংলা অনুবাদক গিরিশচন্দ্র সেন ১৮৩৫ খ্রিষ্টাব্দে নরসিংদী জেলার পাঁচদোনা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯১০ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ আগস্ট ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। প্রতিবছর প্রায় নীরবেই তার মৃত্যুবার্ষিকী অতিক্রান্ত হয়। এবছরও তা-ই হয়েছে। কেউ মনে করেনি, স্মরণ করার চেষ্টাও ‘না’। নতুন প্রজন্মের অনেকে হয়তো জানেও না এই সাধকের কথা। ২০১০ সালের ১৫ আগস্ট ছিল গিরিশচন্দ্র সেনের শততম মৃত্যুবার্ষিকী।
অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, গিরিশচন্দ্র সেন একজন ব্রাহ্মধর্মাবলম্বী হয়েও কেন পবিত্র কোরআন শরিফ অনুবাদ করতে গেলেন? তার আত্মজীবনী থেকে জানা যায়, ব্রাহ্মধর্মের নববিধান মণ্ডলীর প্রতিষ্ঠাতা কেশবচন্দ্র সেনের উৎসাহ এবং অনুরোধে তিনি এ কাজ শুরু করেন। কেশবচন্দ্র সেন সকল ধর্মের মধ্যে একটা সমন্বয় আনতে চেয়েছিলেন। সেই সংকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে তিনি বোধ করেন সমন্বয়সাধন করতে হলে সব ধর্ম সম্পর্কে সাধারণ জ্ঞান থাকতে হবে। আর তাই প্রধান ধর্মগুলোর সারকথা জানার জন্য তিনি ইসলাম, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান ধর্মের মূলগ্রন্থগুলো বাংলায় অনুবাদের উদ্যোগ নেন। চার ধর্মের মূলধর্মগ্রন্থ অনুবাদের জন্য চারজন পণ্ডিত ব্যক্তিকে দায়িত্ব প্রদান করেন। উর্দু, ফার্সি এবং সংস্কৃত ভাষায় দখল থাকার কারণে কোরআন শরিফ অনুবাদের দায়িত্ব দেয়া হয় গিরিশচন্দ্র সেনের ওপর। কিন্তু অনুবাদ করার মতো আরবি জ্ঞান ছিল না গিরিশচন্দ্র সেনের। তিনি তখন আরবি ভাষা শিক্ষার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ১৮৭৬ সালে ভারতের লখনৌ শহরে পাড়ি জমান আরবি ব্যাকরণ শেখার জন্য। ৪২ বছর বয়সের গিরিশচন্দ্র সেন সেখানের একজন মৌলবির কাছে আরব্য ভাষার তালিম নিতে শুরু করেন। আরবি ব্যাকরণে বিজ্ঞ পঁচাত্তর বছর বয়সের মৌলবি এহসান আলী তাকে যতেœর সঙ্গে আরবি ভাষা শিক্ষা দেন। এরপর কলকাতার একজন মৌলবির কাছে কিছুদিন আরবি ভাষার শিক্ষা নিয়ে ঢাকায় চলে আসেন গিরিশচন্দ্র সেন। নলগোলার মৌলবি আলীমুদ্দিনের কাছে আরবি ইতিহাস ও সাহিত্য চর্চা শুরু করেন। এ সময় তিনি কোরআন পাঠ আরম্ভ করতে গিয়ে বুঝতে পারেন, কোনো মুসলমান কোরআন বিক্রেতা তার কাছে পবিত্র কোরআন শরিফ বিক্রি করবে না। তখন তিনি তার একজন মুসলমান বন্ধু মিয়া জামাল উদ্দিনের মাধ্যমে একটা কোরআন শরিফ সংগ্রহ করেন। নিজের আত্মজীবনীতে গিরিশচন্দ্র সেন লেখেন, ‘আমি তফসির ও অনুবাদের সাহায্যে পড়িতে আরম্ভ করি। যখন তফসিরাদির সাহায্যে আয়াত সকলের প্রকৃত অর্থ কিছু বুঝিতে পারিলাম, তখন তাহা অনুবাদ করিতে প্রবৃত্ত হইলাম।’ উর্দু ভাষায় ভালো দখল থাকার কারণে তিনি এ সময় শাহ রফিউদ্দিন ও শাহ আবদুল কাদেরের উর্দু অনূদিত কোরআন থেকে সাহায্য নেন। অনুবাদ করতে গিয়ে তিনি যশোরের মৌলবি আলতাফ উদ্দিনের কাছ থেকেও পরামর্শ গ্রহণ করেন।
১৮৮০ সালে গিরিশচন্দ্র সেন সর্বপ্রথম কোরআন শরিফের ক্ষুদ্র একটি সংকলন প্রকাশ করেন। এর পর তিনি পূর্ণাঙ্গ অনুবাদের কাজে হাত দেন এবং ১৮৮১ সালে ময়মনসিংহে অবস্থানকালে কোরআন শরিফের ছোট ছোট অংশের অনুবাদ প্রকাশ করতে শুরু করেন। একই বছরের শেষ দিকে তিনি শেরপুরের চারুযন্ত্র প্রেস থেকে তার অনুবাদের প্রথম খণ্ড প্রকাশ করেন। প্রথম সংস্করণে তা মাত্র এক হাজার কপি ছাপা হয়েছিল। তখন গিরিশচন্দ্র সেনের অনুবাদিত কোরআন শরিফ নিয়ে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়েছিল মুসলমানদের মধ্যে। পক্ষে-বিপক্ষে নানা রকমের বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছিল। গিরিশচন্দ্র তার আত্মজীবনীতে লেখেন, মুসলমান বন্ধুদের মধ্যে একজন বন্ধু ক্রুদ্ধ হয়ে বলেছিলেন, ‘আমাদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থের অনুবাদ একজন কাফের করেছেন, তাকে পাইলে তার শিরñেদ করব।’
১৮৮২ সালে দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশ হলে দৃশ্যপট বদলাতে থাকে। কয়েকজন আলেম গিরিশচন্দ্র সেনকে অভিনন্দন জানান এবং জমিদার, ধনাঢ্য মুসলমানরা তার অনূদিত কোরআন শরিফ কেনার জন্য অগ্রিম মূল্য পরিশোধ করতে শুরু করেন। এর ফলে পরবর্তী খণ্ডগুলো তিনি অতি সহজে প্রকাশ করতে সক্ষম হন। কলকাতার বিধানযন্ত্র ছাপাখানা থেকে খণ্ডে খণ্ডে প্রকাশ হতে থাকে কোরআন শরিফের বাংলা অনুবাদ। প্রায় ছয় বছর সময় লাগে সম্পূর্ণ কোরআনের অনুবাদ এবং মুদ্রণ শেষ করতে। অবশেষে ১২ খণ্ডের পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ বাঁধাই করে বাজারে ছাড়া হয় এবং দাম ধরা হয় মাত্র আড়াই টাকা, যা ওই সময়ের একজন প্রাথমিক স্কুল শিক্ষকের মাসিক বেতনের সমান।
১৮৯৮ সালে বাংলায় অনূদিত কোরআন শরিফের দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয় কলকাতার দেবযন্ত্র প্রেস থেকে। কলকাতার মহালগঙ্গা মিশন প্রেস থেকে তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৯০৮ সালে এবং বাংলাদেশ থেকে পূর্ণাঙ্গ অনুবাদের প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৯৭৭ সালে ঢাকার ঝিনুক পুস্তিকা থেকে।
১৮৭৬ সালে আরবি শিক্ষা শুরু করে মাত্র পাঁচ বছরের মাথায় ১৮৮১ সাল থেকে গিরিশচন্দ্র সেন কোরআন শরিফের বাংলা অনুবাদ শুরু করেন এবং ছয় বছরের মাথায় ১৮৮৬ সালে ১২ খণ্ডের পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ শেষ করেন, যা অনেকের কাছেই অলৌকিক বা বিস্ময়কর বলে মনে হয়েছে। প্রায় বিতর্কহীনভাবেই গিরিশচন্দ্র সেনের বাংলা অনুবাদ সে সময়ের মুসলিম সমাজ এবং আলেমগণ গ্রহণ করেন। তখন অনেক বিজ্ঞ আলেম গিরিশচন্দ্রের প্রশংসা করে পত্র লেখেন। যারা পত্র লিখেছিলেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা হলেন, মওলানা আকরাম খাঁ, ইসলামি চিন্তাবিদ মজফর আবদুল্লাহ, কলকাতা মাদ্রাসার আরবি শিক্ষক আহমদ উল্লাহ প্রমুখ। মুসলমান সমাজ তখন গিরিশচন্দ্র সেনকে ‘ভাই’ বলে সম্বোধন করতে শুরু করে এবং কোনো কোনো ব্যক্তি তাকে ‘মৌলবি গিরিশ’ বলে উপাধি দেন। মওলানা আকরাম খাঁ তার অনুবাদকর্মটিকে পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য বিষয় বলে উল্লেখ করেছিলেন।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, খ্রিষ্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীর আগে থেকেই ভারত উপমহাদেশের বাংলাভাষী অঞ্চলে মুসলমানদের আগমন ঘটে। ব্যবসায়ী এবং ধর্মপ্রচারকদের আগমন হয় তারও অনেক আগে। সে সময়ে প্রায় সাত কোটি মানুষের ভাষা ছিল বাংলা। অনেক সমৃদ্ধ সাহিত্যও ছিল বাংলা ভাষায়। আরবি, ফার্সি, উর্দু ভাষায় পারদর্শী অনেক আলেম ছিলেন যারা বাংলা সাহিত্যেও পারদর্শী ছিলেন। কিন্তু তাদের কেউ ১৮৭৬ সাল পর্যন্ত কোরআন শরিফের পূর্ণাঙ্গ অনুবাদের কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেননি। টাঙ্গাইলের মাওলানা আমির উদ্দিন বসুনিয়া আমপারার কিছু অংশ কাব্যাকারে অনুবাদ করেছিলেন, যা কলকাতার বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের গ্রন্থগারে সংরক্ষিত আছে বলে জানা যায়।
গিরিশচন্দ্র সেন শুধু কোরআন শরিফের অনুবাদ করেই তার কাজ শেষ করেননি। তিনি হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রথম বাঙালি জীবনীকার। তিনি ১৯০৫ সালে মুসলমানদের কল্যাণে বঙ্গভঙ্গকে সমর্থন জানিয়ে বক্তৃতা এবং পুস্তক রচনা করেছিলেন। তিনি ইমাম হাসান এবং হোসেনের জীবনীসহ মিশকাত শরিফের অর্ধেকটা বাংলায় অনুবাদ করেছেন। এছাড়াও ইসলাম ধর্মবিষয়ক প্রায় ৪২টি বই রচনা এবং অনুবাদ করেছেন গিরিশচন্দ্র সেন। তার অনূদিত গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, শেখ ফরিদুদ্দিন আত্তারের ‘তাজকেরাতুল আউলিয়া’ অবলম্বনে ‘তাপসমালা’, (এ বইটিতে ৯৬ জন প্রখ্যাত মুসলিম মনীষীর জীবনীর বর্ণনা রয়েছে), মাওলানা জালালুদ্দিন রুমির ‘মসনবি শরিফ’ ও শেখ আত্তারের ‘মানতেকুহতায়ের’ অবলম্বনে ‘তত্ত্ব-রতœমালা’, শেখ সাদির ‘গুলিস্তাঁ’ ও ‘বুস্তাঁ’ অবলম্বনে ‘হিতোপাখ্যান মালা’ ইত্যাদি। টীকাসহ কোরআন শরিফ অনুবাদের সময় গিরিশচন্দ্র সেন তাফসিরুল হোসাইন, শাহ আবদুল কাদিরের ফায়িদা এবং তাফসিরুল জালালাইন অনুসরণ করেন।
http://www.shaptahik.com/v2/?DetailsId=9504