somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অপুনর্ভব

২২ শে ডিসেম্বর, ২০১১ সকাল ৯:৩৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

-চাঁদের আলোয় বিভ্রম সম্পর্কিত আপনার আর্টিকেলটা এডিটর খুব পছন্দ করেছেন। আপনার খান তিনেক বকেয়া সম্মানী ক্যাশিয়ারের কাছ থেকে নিয়ে নেবেন।
-ধন্যবাদ স্যার!
-আমার ভিজিটিং কার্ডটা রাখুন। প্রয়োজন পড়লে ফোন দিবেন।
-মাই প্লেজার স্যার!
কচকচে টাকা এবং ভিজিটিং কার্ড সাথে নিয়ে তৃপ্তির হাসি হেসে ববি বের হয় অফিস থেকে।

*
এই মুহূর্তে ববি একটা কঠিন পরিস্থিতিতে পড়েছে। জরুরী কাজে মতিঝিল যেতে হয়েছিলো তাকে। বাসায় ফেরার পথে আজিমপুর থেকে নীলক্ষেতের বিশাল জ্যাম দেখে সে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো এই জ্যামে ঘন্টাখানেক আটকে থাকার চেয়ে নেমে গিয়ে সায়েন্সল্যাব পর্যন্ত হেঁটে যাওয়াই ভালো। ভীড়বাস থেকে তড়িঘড়ি করে অসতর্কতায় নেমে পড়াটাই কাল হল। সিগারেটের দোকান থেকে একটা বেনসন নিয়ে মূল্য পরিশোধ করার সময় বুঝলো যে তার পকেটটা হালকা ঠেকছে। মানিব্যাগটা পিকপকেট হয়ে গেলো নাকি! কী যন্ত্রণা! ফ্রিল্যান্স সাংবাদিকতা করে বিল আদায় করাটা যে কত কঠিন সে হাড়ে হাড়ে জানে। আজকেই বিলটা পেল, তাও আবার বেশ কয়েকটা লেখার বিল একসাথে! যদিও তাকে বাসায় টাকা দিতে হয় না, প্রেমিকাও নেই যে ডেটিংয়ে প্রেমের বকেয়া সুদে-আসলে আদায় করে নেবে কেউ! তবে কয়েকটা দিনতো মৌজ করে কাটাতে পারতো! হোটেল নীরবে বন্ধুদের সাথে ভোজনাড্ডার শেষে দরাজ কন্ঠে বলতে পারতো "বিলটা আমিই দিচ্ছি!"। তা আর হবার জো নেই, অন্তত এই মাসে।
"ধুস শালা, পকেটমারের মায়েরে বাপ!"
খিস্তি করে উঠলো সে।
"মাম্মা টেকাটা দিয়ালান"
দোকানদারের তগাদায় সংবিৎ ফেরে তার। সিগারেটটা হয়তোবা অক্ষম ক্ষোভের জ্বালানীতে পরিণত হওয়ায় দু মিনিটেই শেষ হয়ে গেছে। এখন পকেট হাঁচড়ে পিচড়ে যদি ভাঙতি টাকা পাওয়া যায়! তার সময়ক্ষেপণ দেখে দোকানদার অধৈর্য্য হয়।
-দিতাছি খাড়াও!
এরকম পীড়নের মধ্যেও সে গলার ভারিক্কি ভাবটা ধরে রেখে কোনমতে একটা পাঁচটাকার আর একটা দুই টাকার কয়েন খুঁজে পেয়ে মনে মনে উল্লসিত হয়ে বিরক্ত ভঙ্গিতে সিগারেটের দাম পরিশোধ করে।
টি স্টলটা পার হবার পর আরো কিছু প্রাপ্তিযোগের আশায় সে পকেট হাতড়ানোর চেষ্টা করে। অন্তত বাসায় ফেরার ভাড়াটা তো দরকার! এই মানবঅধ্যুষিত ফুটপাথ বা প্রস্রাবের দুর্গন্ধে আমোদিত রাস্তা কোনটাই তাকে স্থির হয়ে দাঁড়াবার অবকাশ দেয় না। চলন্ত অবস্থায় পকেট হাতড়ানো যথেষ্ঠ জটিল একটা ব্যাপার। এরজন্যে দীর্ঘদিনের কসরৎ প্রয়োজন। ক্ষণিকের জন্যে তার মাথায় খেলে গেলো, অন্য কারো পকেট হাতড়ালে কেমন হয়! এই ভীড়ের মধ্যে তারই মত বেকুব কোন অসতর্কের পকেট থেকে স্ফীতউদরের মোটা মানিব্যাগ ছো মেরে নেয়াটা কী খুব কঠিন কিছু? ছি! এসব কী ভাবছে সে! নিজের সংকীর্ণতাকে ছাপার অযোগ্য ভাষায় গালিগালাজ করে সে। শহরভর্তি ক্ষ্যাপা মানুষ তাকে পিটিয়ে ছাতু বানানোর জন্যে তৈরী! সবাই ক্ষেপে আছে সবসময়ই। কেন এত শীত, কেন এত গরম, কেন এত জ্যাম, উপলক্ষ্য পেলেই হল! ঝাল মিটিয়ে ছাড়বে যে কারুর ওপর যেকোন এক দল! হয়তোবা তারা ভীড়ের মধ্যে বিচ্ছিন্ন অবয়ব, হয়তোবা পর্ণো সিডির দোকানের সামনে ভীত, কুন্ঠিত,লালসান্বিত মুখে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা তরুণ, কিন্তু সংঘবদ্ধ হতে এক মিনিটও সময় লাগবে না। তবে...
"আমি তো কারো ক্ষতি করি নি। কে আমার মানিব্যাগ মেরে দিয়েছে সেটাও জানি না।"
এই ভাবনার ফলশ্রূতিতে সে এমন একটা উপসিদ্ধান্তে উপনীত হয়, যেহেতু তার ক্ষতি করেছে যে, সে অজ্ঞাত,তাই সেও অজ্ঞাত কারো ক্ষতি করতেই পারে! এই যে সামনে ঢিলেঢালা ভঙ্গীতে জ্যাকেট দরদাম করছে লোকটি, সেই যে তার পকেট কাটেনি কে বলতে পারে?
"হাউয়ার পুলা আমার কষ্টের টাকায় তুই জ্যাকেট কিনোস? খাড়া দেখাইতেছি!"
তবে দেখার, ভাবার এবং সেটাকে একটা সফল চৌর্যবৃত্তিক ক্রীয়াকলাপে পরিণত করার জন্যে যথেষ্ঠ রিফ্লেক্স এ্যাকশন না থাকার কারণে তাকে ভীড়ের প্রাবল্যে সামনে এগিয়ে গিয়ে অন্য শিকারের কথা ভাবতে হয়।

ঢাকা কলেজের সামনে আসার পর তার বেপরোয়া চিন্তাধারা কিছুটা স্থিত হয়। এই কলেজ থেকে মাত্র বছরখানেক হল সে পাস করে বেরিয়েছে। চেনাজানা ছোটভাই বা শিক্ষক বা হোস্টেলকে নিজের জমিদারবাড়িতে পরিণত করা বড়ভাইয়ের দেখা মিলে যাওয়া অসম্ভব না। এই ক্ষেত্রে অবশ্য সুবিধা বা অসুবিধা দুই দিকই আছে। ক্ষতির ঘাটতি মেটাতে গিয়ে বিশৃঙ্খল কার্যকালাপ করতে গিয়ে ধরা খেলে জবরদস্ত পরিচিতজনেরা আক্রমনাত্নক জনতার প্রতি তেড়েফুড়ে অভিগমন করবে নিশ্চিত, যেমনটা হয়েছিলো থার্ড ইয়ারে থাকতে, যখন চপল ভাই চাঁদনীচক মার্কেটে চাঁদা আদায় করতে গিয়ে বিপত্তিতে পড়েছিলো...

চপল ভাইকে ববির কখনই পছন্দ ছিলো না। ববি সবসময়ই রাজনৈতিক সংস্পর্শ এড়িয়ে চলেছে। তারপরেও নিজ জেলার অধিবাসী হবার কারনেই হয়তো চপল ভাই ববিকে স্নেহের দৃষ্টিতে দেখতো। মিছিলে যাবার সময় যখন ফার্স্ট ইয়ারের বোকাসোকা ছেলেগুলোকে ঝেটিয়ে রুম থেকে ধরে নিয়ে আসা হত, তখন "প্রচন্ড মাথা ব্যাথা" অথবা "দুইদিন ধরে জ্বর" এইসব ঠুনকো অজুহাত মেনে নিয়ে চপল ভাই ববিকে নিস্তার দিতো। সেই চপল ভাই একবার মহাবিপদে পড়ে গেলো চাঁদাবাজী করতে গিয়ে। হকাররা পেয়ে বসেছিলো ঘা কতক দিয়েও ছিলো বাঁশ দিয়ে। ঘটনাস্থলে ববিও ছিলো, সে তখন ছাত্ররাজনীতির ক্ষমতার দম্ভজনিত অধঃপতন দেখে সুশীল আত্মপ্রসাদ ভোগ করছিলো। তবে কিছুক্ষণের মধ্যে আর্মস নিয়ে চপল ভাইয়ের দলবল চলে এসে দোকানদারদের পাল্টা ঠ্যাঙানি দেয়ায় তার আত্মপ্রসাদ নিস্ক্রিয় গ্যাসের মত অকেজো হয়ে গিয়ে তাকে প্রস্থানে উদ্বুদ্ধ করে। সে অবশ্য ভেবেছিলো একবার, চপল ভাইয়ের রক্ষাকর্তাদের দলে ভীড়ে গিয়ে আলগা ভাব নেবে কী না, কিন্তু নৈতিকতা না ভীরুতা কোনটার প্রভাবে অথবা সংমিশ্রণে সে হলের রুমে ফিরে গিয়ে সুবোধ ছেলের মত লেখাপড়া করতে বসেছিলো সেটা এক অমীমাংসিত মানসিক আচরণ হয়েই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে আছে এখনও। চপল ভাইয়ের সাথে এখন দেখা হলে সে কী তাকে আগের মত সমাদর করবে? কোন বিড়ম্বনায় পড়লে পকেট থেকে এইট মিমি বের করে ত্রাস সৃষ্টি করে আগলে রাখবে নিরাপদ আশ্রয়ে?

নাহ, এরকম ভাবাটা মোটেই উচিৎ হচ্ছে না। সে এমন কোন দূরবস্থায় পড়েনি যে আর্মড ক্যাডারের আশ্রয় নিতে হবে। তার শুধু দরকার বাসায় যাবার বাস ভাড়া। এতটা পথ হেঁটে যাওটা কষ্টকর হবে। সে বড়ই ক্লান্ত। ভাবতে ভাবতে সে আনমনে পকেটে হাত দেয় আরেকটা সিগারেট কেনার জন্যে, এবং খেয়াল করে যে সে কপর্দকশূন্য এবং ক্ষুধার্ত। বাসায় কী না কী রান্না করেছে কে জানে, হয়তোবা বরবটিভাজি আর বাতাসীমাছ! পকেটে আজকে টাকা ছিলো, চাইলেই নীলক্ষেত থেকে দু প্যাকেট বিরানি গোগ্রাসে গিলে ধীরেসুস্থে এক গেলাস লাচ্ছির অর্ডার দিতে পারতো, বখশিশ দিতো দরাজ হাতে। কিন্তু হল কই! খানকির ছেলে পকেটমার! ববি'র এবার মনে হয় তার প্রতিশোধস্পৃহা নেহায়েৎ অমূলক না। যে পকেট কেটেছে, তাকে তো দেখেনি, কিন্তু কে অপরাধী না তাই বা নিশ্চিত হবে কী করে! টিচার্স ট্রেইনিং কলেজের সামনের ফুটপাথে দাঁড়িয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে মানুষের আসা যাওয়া দেখতে দেখতে সে সম্ভাব্য অপরাধীদের তালিকা করে। মহিলা এবং শিশুদের প্রথমেই তালিকা থেকে বাদ দেয়, চিরায়ত পুরুষতান্ত্রিক মহানুভবতায়। কিন্তু সাম্প্রতিককালে পঠিত অপরাধসংক্রান্ত ঘটনাবলী, যেমন ট্যাবলয়েডগুলোয় প্রকাশিত "ঢাকা শহরে বোরখাঅলীদের ছিনতাইকার্যে অংশগ্রহণ" অথবা "ছিন্নমূল শিশুদের নতুন নেশা, বেলুনের মধ্যে বিবিধ মিশ্রণ থেকে শ্বাস নেয়া" তাকে পরাক্রম পুরুষে বানিয়ে সবার প্রতি সমান আক্রোশ প্রকাশে সহায়তা করে। এই শহরে যে কেউ খুনী, যে কেউ পকেটমার হতে পারে।

"শুধুমাত্র আমি কেন মারা খামু! হালায় ক্ষিদায় পেট জ্বলতাছে, শইল চলে না, এহন কী সাইন্সল্যাব পর্যন্ত যামু বাসের খোঁজে? নাকি নীলক্ষেতে যায়া তেহারি খামু? বাসায় তো বুয়া বালের আঁটি ভাজি করছে!"

যা আছে কপালে, এই ভেবে নীলক্ষেতের দিকে যাবার পথে ঢাকা কলেজের সামনে এসে ববি আবারও দ্বিধাগ্রস্থ হয়ে দাঁড়ায়। তার পিকপকেটিংয়ের পরিকল্পনাটা সফল হবার সম্ভাবনা খুবই কম, অনভ্যস্ততার কারণে। কিন্তু যদি প্রিয় ছোটভাই সুবাইল দেখে ফেলে! সুবাইলের সঙ্গে তার খুবই অন্তরঙ্গ সম্পর্ক ছিলো। ছেলেটা সারাক্ষণ ক্রিকেট খেলা নিয়ে বকবক করত। ববি অবশ্য ক্রিকেট তেমন পছন্দ করতো না। তার একটাই বাজে নেশা ছিলো, পয়সা দিয়ে জুয়া খেলা, এবং চুরি করা। আর এক্ষেত্রে অনুগত ছোটভাই সুবাইলকে ব্যবহার করে সে চুরি করে অনেক টাকা জিতেছে। অবশ্য এই টাকা দিয়ে সে তাকে খাইয়ে দিয়েছে পরে। সুবাইলের এখনও হলে থাকার কথা। তার কাছ থেকে কিছু টাকা ধার নেয়া যায় না? কিন্তু ববির ভয় হয়, থ্রি কার্ডের জোচ্চুরির কথা যদি সে ইতিমধ্যে জেনে ফেলে! মুখ দেখাতে পারবে সে? জানাটা অস্বাভাবিক কিছু না, কারণ শেষের দিকে তার একটা বাজে নিকনেম জুটে গিয়েছিলো, যা সে আর স্মরণ করতে চায় না। বর্তমান অবস্থায় এটা অবশ্য একদিক দিয়ে তার উপকারই করে!
"থ্রি কার্ডে চুরি করছি যখন তাইলে মাইনষের পকেট মারলেই বা দোষ কী! একই তো কথা! মাইনষে আমার পকেট কাইটা সাফা কইরা দিবো, আর আমি করলেই দোষ? বাসায় যাওয়ার ভাড়া নাই, ভালমন্দ খাওয়ার ইচ্ছা ছিলো বাসার বালছাল বাদ দিয়া সেইটারও উপায় নাই!"
সেইসাথে ববির মনে পড়ে তার বিকল হয়ে যাওয়া সেলফোনটা ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে একটা মোটামুটি মানের, কিন্তু চটকদার চাইনিজ মোবাইল ফোন কিনতে পারতো আজকের অর্জিত টাকা দিয়ে। চন্দ্রিমা সুপারমার্কেটে থরে থরে সাজানো ফোনগুলো দেখে সে রীতিমত ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে।
"নাহ, আইজ একটা এসপার ওসপার কইরাই ছাড়ুম! পুরা শহর প্রস্তুত হইয়া আছে আমারে স্ক্রু আপ করার লিগা, আইজকা এর বিহিত না কইরা কুনো বাসায় যাওয়াযাওয়ি নাই!"

ববির ভাগ্য অভাবনীয় রকম সুপ্রসন্ন বলা যায়! ইডেন কলেজের সামনে সে যখন সতর্ক মনে উদাস দৃষ্টিতে গাছপালা, সন্ধ্যা এবং অসংলগ্ন অবস্থায় বসে থাকা জুটিদের দেখছিলো, এবং সারাদিন অভুক্ত অবস্থায় থাকার কারণে নির্গত অম্লের প্রদাহে উদরপীড়ায় ভুগছিলো ঠিক তখন সে খেয়াল করল, ফুচকার বিল মিটাতে গিয়ে অতি আবেগী এক নতুন জুটির প্রেমাতাল মুহূর্তের ফাঁক গলে বেখেয়াল পুরুষটির মানিব্যাগ থেকে একটা কড়কড়ে এক হাজার টাকার নোট; নাকি পাঁচশ টাকার নোট, সুন্দরভাবে অবতরণ করল রাস্তার কংক্রিট বুকে সন্তর্পণে, লুকিয়ে থেকে চোখ মটকালো ববির দিকে তাকিয়ে, আশ্বস্ত করল, "আর কেউ দেখে নি, আমাকে নাও!"
ববি গুটিগুটি পায়ে অগ্রসর হল ফুচকাঅলার দিকে।
"মামা, ফুচকা কত কইরা?"
ববি পা দিয়ে ঢেকে রাখলো তার মুফতে পাওয়া সম্পদ। মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে। ভীড় একটু কমলে তারপর কুড়িয়ে নেবে। নইলে কেউ সন্দেহ করতে পারে। আর একজন সন্দেহ করে একটা হাঙ্গামা বাঁধানোর প্রচেষ্টা করলেই হয়েছে! মব সাইকোলজি বড়ই ভয়ানক।
"ত্রিশ টেকা পেলেট"
"কী বল ত্রিশ টাকা! সেদিনই খেলাম বিশ টাকা দিয়ে"
"কবে খাইছেন? অন্যকোথাউ খাইছেন তাইলে। এইখানে একদাম"
"ওহ আচ্ছা!"
ববি অপেক্ষা করে আরো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে সুযোগ পেলে পায়ের তলা থেকে শাঁই করে পকেটে ভরবে নোটটা। হাজার টাকার নোট না হলেও পাঁচশ টাকার তো বটেই! কীসের নীলক্ষেতের তেহারি! আজকে সে কেএফসিতে গিয়ে চিকেন ফ্রাই আর... আরো কী কী ভালো জিনিস পাওয়া যায়, ওগুলো খাবে। পাঁচ হাজার টাকার শোকটা অবশ্য ভুলবার নয়! এই মাসটাও যাবে সেলফোনবিহীন। তবে ভাগ্য যখন নিজ থেকেই এভাবে অকাতরে বিলিবন্টন শুরু করেছে, নিজ থেকে একটু চেষ্টা করলে ভাগ্যের সাথে যৌথ উদ্যোগে সমঝোতাস্মারকপুস্তক প্রকাশ করাটা দূরুহ হবে না!
"ভাইয়া একটু সাইড দিবেন? কাস্টমার আইতাছে"
"কে সুবাইল নাকি?"
ভাবনায় অকস্মাৎ ছেদ পড়ায় তালগোল পাকিয়ে বেফাঁস কথা বলে ফেলায় ববি বড়ই লজ্জিত হয়। সুবাইলের কাছ থেকে থ্রি কার্ডস এ চুরি করা+ খাইয়ে দেয়া মিলিয়েও হাজারখানেক টাকা অন্তত দেনা আছে এখনও। সুবাইল যতই প্রিয় ছোটভাই হোক, এই একহাজার টাকার নোটটা দাবী করলে ববি নির্ঘাৎ খুনী হয়ে যাবে! অবশ্য এত হাজার মানুষের মাঝে সুবাইলের এখানেই, আজকেই, এই মুহূর্তেই আসার সম্ভাবনা দশমিকের ভগ্নাংশেরও কম।
"সুবাইল কেডা"
দোকানদারের প্রশ্নের জবাবে কিছু না বলে সেও মাথা ঝাঁকায়, হ্যাঁ, সুবাইল কে! সে কী করতে এখানে আসবে? এখান থেকে সটকে পড়ে টাকাটা পকেটস্থ করা ব্যাস! সুবাইল বা চপল ভাই কারো তোয়াক্কা না করলেও চলবে। টাকাটা পকেটস্থ করার প্রক্রিয়াটা এখনও যথেষ্ঠ জটিল, ববি পায়ের নীচে নোটটা রেখে ধীরে, ছেঁচড়ে হাঁটতে থাকে, চকচকে নতুন নোট, ছিড়ে যাবার ভয় নেই। আর অল্পবিস্তর ছিড়ে গেলেও গুলিস্তানের টাকা ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে বদলে নেয়া যাবে, কিছু টাকা কেটে রাখবে, কিন্তু কথা হল কত রাত পর্যন্ত ওরা পসরা সাজিয়ে রাখে?
"ভাইজানের কি পায়ে ডিফেক্ট?"
উৎসুক পথচারীর জিজ্ঞাসায় হতচকিত হয়ে সে নীচে তাকিয়ে দেখে টাকাটা পায়ের ফাঁক গলে দেখা যাচ্ছে কী না! সুরক্ষা নিশ্চিত হবার পর সে হাসিমুখে জবাব দেয়,
"হ্যাঁ, ভাই একটু আর কী... বাস থেকে নামতে গিয়ে..."
"সাবধানে চইলেন। এমনে কইরা বিরাট এ্যাক্সিডেন হইতে পারে"
ববি সাবধানেই চলে। সাবধানতা একান্তই প্রয়োজন এখন। আরেকটু সামনে এগুলেই একটা নির্জন জায়গা পাওয়া যাবে। তখন আয়েশে তুলে নিতে পারবে টাকাটা।

হঠাৎ হট্টগোল! একটা বেয়াদব পুলিস এসে হুমকি দিচ্ছে ফুচকঅলাকে।
"ঐ, তোরে না কইছি এইখানে আর দোকান বওয়াইবি না! এইডা দোকানের জায়গা? সরা, শীগগির সরা, নাইলে দিমু বাড়ি!"
ববি'র সময় নেই আর, টাকাটা এক্ষুণি পদতল থেকে নিয়ে পকেটে ভরতে হবে। "খানকির ছেলে পুলিসগুলা আর আওনের টাইম পাইলো না! পুলিসের চৌদ্দগুষ্টির মায়েরে বাপ!"
মনে মনে খিস্তি করতে গিয়ে অধিক উত্তেজনা আর অনভ্যস্ততায় এবং পলায়নরত ফুচকঅলা এবং অন্যান্য হকার, দোকানদারদের ঠেলাঠেলিতে পা হড়কে পড়ে যায় ববি। পায়ের তলা থেকে টাকাটা গলে কোথায় গেছে কে জানে! সারাদিনের ধকল এবং এসিডিটি যোগসাজসে আক্রমণ করায় ববি উগড়ে দেয় তার অম্লীয় তরল এবং পাকস্থলীতে বিদ্যমান যৎসামান্য খাদ্য।

কিছুক্ষণ নিথর হয়ে থাকার পরে, জায়গাটা আরো নির্জন এবং অন্ধকার হয়ে এলে চাঁদের আলোয় সে দেখে তার বমির মধ্যে চাঁদমুখ করে হাসছে একটা চকচকে হাজার টাকার নোট। লোভে চকচক করে ওঠে তার চোখ। কিন্তু বমি ঘাঁটতে গিয়ে প্রবল দুর্গন্ধে আরো একবার বমি করে নেতিয়ে পড়ে সে।

পরবর্তী প্রচেষ্টা করতে গিয়ে দ্বিধান্বিত হয়, এটা কী আসলেই ভাঁজ হয়ে থাকা টাকা নাকি ভিজিটিং কার্ড? ববির ক্লান্ত চোখ পার্থক্য ঠাহর করতে পারে না। যদি ভিজিটিং কার্ডই হয়ে থাকে, তাহলে এত কষ্ট করার কোন মানে হয়? কিন্তু যদি টাকা হয়? হাজার টাকার নোট?

চাঁদের আলো বড়ই বিভ্রমময়!





১১৮টি মন্তব্য ১১৮টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমাদের হাদিকে গুলি করা, আর আওয়ামী শুয়োরদের উল্লাস। আমাদের ভুল কোথায়?

লিখেছেন তানভির জুমার, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৫৩



৩০ জনের একটা হিটলিস্ট দেখলাম। সেখানে আমার ও আমার স্নেহের-পরিচিত অনেকের নাম আছে। খুব বিশ্বাস করেছি তা না, আবার খুব অবিশ্বাস করারও সুযোগ নাই। এটাই আমার প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

এ যুগের বুদ্ধিজীবীরা !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১:৪০


ডিসেম্বর মাসের চৌদ্দ তারিখ বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করা হয়। পাকিস্তান মিলিটারী ও তাদের সহযোগীরা মিলে ঘর থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করেন লেখক, ডাক্তার, চিকিৎসক সহ নানান পেশার বাংলাদেশপন্থী বুদ্ধিজীবীদের!... ...বাকিটুকু পড়ুন

মায়াময় স্মৃতি, পবিত্র হজ্জ্ব- ২০২৫….(৭)

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৭

ষষ্ঠ পর্বের লিঙ্কঃ মায়াময় স্মৃতি, পবিত্র হজ্জ্ব- ২০২৫-….(৬)

০৬ জুন ২০২৫ তারিখে সূর্যোদয়ের পরে পরেই আমাদেরকে বাসে করে আরাফাতের ময়দানে নিয়ে আসা হলো। এই দিনটি বছরের পবিত্রতম দিন।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আধা রাজাকারি পোষ্ট ......

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:৫৬


আমি স্বাধীন বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেছি। আমার কাছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, বা পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে আজকের বাংলাদেশের তুলনা—এসব নিয়ে কোনো আবেগ বা নস্টালজিয়া নেই। আমি জন্মগতভাবেই স্বাধীন দেশের নাগরিক, কিন্তু... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইন্দিরা কেন ভারতীয় বাহিনীকে বাংলাদেশে দীর্ঘদিন রাখেনি?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:২০



কারণ, কোল্ডওয়ারের সেই যুগে (১৯৭১সাল ), আমেরিকা ও চীন পাকিস্তানের পক্ষে ছিলো; ইন্দিরা বাংলাদেশে সৈন্য রেখে বিশ্বের বড় শক্তিগুলোর সাথে বিতন্ডায় জড়াতে চাহেনি।

ব্লগে নতুন পাগলের উদ্ভব ঘটেছে;... ...বাকিটুকু পড়ুন

×