আমি দু কামরার যে ফ্ল্যাটটায় ভাড়া থাকি, তাতেএকজন নতুন সদস্য এসেছে। সে গভীর রাত পর্যন্ত উচ্চ ভলিউমে টিভি দেখে। মাঝেমাঝে মনে হয় পাশের ঘরে গিয়ে বলে আসি শব্দটা একটু কমিয়ে দিতে। তবে তার কোন প্রয়োজন নেই। কারণ আমি জেগে থাকি অনেক রাত পর্যন্ত। উচ্চস্তরের কোন চিন্তাভাবনা করিনা, কাউকে নিয়ে ভাবিনা, স্বপ্ন দেখার বিলাসিতাও নেই, তাই তার এহেন আচরণে আমার রাত্রিযাপনের ক্ষেত্রে কোন ব্যাঘাৎ ঘটেনা। আমি ঘুমোনোর অনেক আগেই সে টিভি বন্ধ করে দেয়। এভাবে সময়ের কুশলতায় তুচ্ছ সংঘাত সহজেই এড়াতে পারি আমরা। পাশের ঘরের নতুন বাসিন্দার সাথে দেখা সাক্ষাৎ তেমন একটা হয়ে ওঠেনা। সে নানা কাজকর্মে ব্যস্ত থাকে। বাসায় ফেরে রাত করে। আমার কাজ মূলত ঘুমানো। অন্য অনেক পিতৃপালিত ধেড়ে আলসে বেকার খোকার মত আমিও ভবিষ্যতের চিন্তা বা পরিকল্পনা আপাতত মূলতবী করে রেখেছি। তবে অন্যদের সাথে আমার পার্থক্য এই, তারা কেউ তারুণ্যের স্বাভাবিক প্রগলভ চিন্তাভাবনাকে মূলতবী করে রাখেনি, যা আমার ক্ষেত্রে ঘটেছে। অবশ্য এমন ব্যাপার শুধুমাত্র আমার ক্ষেত্রেই ঘটছে বলে নিজেকে অন্যরকম ভেবে আত্মপ্রসাদ লাভ করার কোন কারণ নেই! হৃদয়ঘটিত বিড়ম্বনার আফটারশকে কারো কারো মধ্যে এমন অনুভূতিহীনতার সাময়িক বা স্থায়ী পর্যায় আসতেই পারে! আমি বেশ অভ্যস্ত হয়ে গেছি এতে। উচ্চশব্দময় টেলিভিশিক রাত ঘুমহীনতার অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ হিসেবে জুড়ে গেছে। আমার ভালোই লাগে এই সঙ্গ।
পাশের ঘরের বাসিন্দা বেশ বিনোদনপিয়াসী। মূলত সিনেমা, নাটক আর বাহারী বিজ্ঞাপনের দিকেই তার মনোযোগ। যৌনাবেদনময়ী তরুণী কন্ঠের অভিমানী অনুযোগ, বা প্রেমাতুর হৃদয়ের আর্তি শুনে ছন্নছাড়া স্মৃতিরা আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে চায় নিঝুম টানেলের একদম শেষপ্রান্তে। নচ্ছার স্মৃতিদল নাছোড় হয়ে শক্তি প্রদর্শন করতে চাইলে বাধ্য হয়ে আমাকে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে অন্য কাজে ব্যস্ত হতে হয়। দীর্ঘ স্বমেহনদৃশ্য অবলোকন করতে গিয়ে তারা ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। জেগে থাকি আমি। খুব দুর্বল আর অশক্ত তারা। কতক্ষণ আর পারবে আমার সাথে!
পাশের ঘরের বাসিন্দার চিত্তে চাঞ্চল্যের পরিমাণ বেশি, তা বোঝা যায় রিমোট কন্ট্রোলের অতি ব্যবহারে। কোন অনুষ্ঠানই সে বেশিক্ষণ দেখে না। দেখার মত ভালো কিছু পায় না হয়তো। সময় কাটানোর জন্যে রিমোটের বাটনগুলোকে শাফলিং করতে থাকে। ইদানিং সে আগের চেয়ে বেশি রাত জাগছে। যেন চেষ্টা করছে আমার ঘুমের সময়টাকে তাড়া করে ফিরতে! এখনও অবশ্য তা পেরে ওঠেনি। তবে এ ধারা অব্যাহত গতিতে চলতে থাকলে আর কিছুদিন পরে হয়তো আমি তার দরজায় নক করে বলব,
"ভাই, টিভিটার সাউন্ড কমায় দেন। আমি ঘুমাবো"
কারো সাথে প্রথম সাক্ষাতে বলার জন্যে খুব একটু উপযুক্ত বাক্য নয় অবশ্য, পরিচিয়পর্বটা সেরে নেয়া যেতে পারে,
"শুভরাত্রি। আমি আপনার পাশের রুমে থাকি। আমার নাম..."
নাহ, বেশি কথা বললে সে বিরক্ত হতে পারে। লোকটা সম্ভবত কথাবার্তা বলতে তেমন পছন্দ করে না। বাসায় ওঠার পর মালপত্র তদারককারীদের কিছু নির্দেশনা দেয়া ছাড়া আর কিছু বলতে দেখিনি কখনও। আজ রাতে সে সম্ভবত তার পছন্দের অনুষ্ঠান খুঁজে পেয়েছে। প্রায় দু ঘন্টা যাবৎ একটি মারদাঙ্গা সিনেমা দেখছে। আমার কাছে ব্যাপারটা একটু অদ্ভুত লাগলো। সিনেমার হাস্যকর সংলাপ, নিম্নমানের শব্দ, কিছুক্ষণ পরপর উদ্ভট কথা সম্বলিত গান, এসব তো তার পছন্দ হবার কথা না! দীর্ঘ দু মাসের অভিজ্ঞতা থেকে জানি, কোন চ্যানেলে এসব সিনেমা শুরু হলে সে সাথে সাথেই পাল্টে দেয়। হঠাৎ তার রূচি পরিবর্তনের হেতু কী? নাকি সে টেলিভিশনটা অন রেখেই ঘুমিয়ে গেছে? তাহলে তো গিয়ে দরজায় কড়া নাড়তেই হয়! হঠাৎ করে তার সাথে কথাবার্তার সুযোগ তৈরি হলে আমার মধ্যে কেমন যেন একটা প্রফুল্ল ভাব কাজ করে। দীর্ঘদিন কারো সাথে গল্প করা হয়না এটাই কি কারণ? প্রথম পরিচয়ের ক্ষেত্রে কিছুটা আনুষ্ঠানিকতা করাই যায়! আমি চুল আঁচড়ে, ময়লা ট্রাউজারটা পাল্টে তার সাথে দেখা করার জন্যে প্রস্তুতি নেই।
"এই যে ভাই, দেখুন তো কী অবস্থা! টিভিটা অন করেই ঘুমিয়ে গিয়েছিলেন। খুব ক্লান্ত নাকি?"
হৃদ্যতার সুরে বলতে পারি আমি। অথবা রসিকতাও করতে পারি এক প্রস্থ,
"ছবিটার মধ্যে পরিচালক মনে হয় ঘুমের ওষুধ পুরে দিয়েছে। হাহাহা!"
নাহ, ঠিক যুৎমত হচ্ছে না রসিকতাটা। কেউ হাসবে না। অনেকদিনের অনভ্যাস! দরজার কাছে পৌঁছে কড়া নাড়তে যাব, ঠিক সেইসময় টেলিভিশনটা বন্ধ করে দেয় লোকটা। ঘুমিয়েই পড়েছিলো মারদাঙ্গাপূর্ণ চলচ্চিত্র চালু রেখে। ফিরে আসার সময় আমার কেন যেন মন খারাপ হয়।
একদিন আমাদের পাড়ায় বিশাল একটা বৈদ্যুতিক গোলযোগ ঘটে গেল। বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হল ট্রান্সফর্মার। কমপ্লিট ব্ল্যাকআউট। পাশের ঘরের টেলিভিশনটার নীরবতায় এক অস্বস্তিকর অবস্থার তৈরি হল। লোকটা এখন ঘুমুবে কী করে? আর না ঘুমিয়ে করবেই বা কী! আমি না হয় শুয়ে শুয়ে হাবিজাবি ভাবতে ভাবতে দিব্যি সময় কাটিয়ে দিতে পারি। আর আজকের রাতটায় ভাবার মত ভালো একটা টপিক তো পাওয়া গেছেই! পাশের ঘরের বাসিন্দার বিনোদনসামগ্রীর বিকল হয়ে যাওয়াতে কী কী বিপত্তি ঘটতে পারে, বা সে কীভাবে এই দূরাবস্থার মোকাবেলা করতে পারে তার একটা লিস্ট করা যায়। সে হয়তো বা ঘরের মধ্যে পায়চারি করেই কাটিয়ে দেবে ঘুমানোর আগ পর্যন্ত, অথবা বারান্দায় এসে রাতের প্রকৃতি দেখবে। দ্বিতীয়টা হবার সম্ভাবনা খুব কম। তাকে ঘরের বাইরে বের হতে দেখিনি খুব একটা, বারান্দায় তো কখনই না! হয়তোবা সে আড্ডা দেবার জন্যে আমার ঘরে চলে আসতে পারে। ভালোই হয় তাহলে। আমি বেশ উষ্ণ অভ্যর্থনাই বরাদ্দ রাখবো তার জন্যে।
"আরে... আপনি! কী সৌভাগ্য আমার!"
বিনয়ে বিগলিত হয়ে বলতে পারি, অথবা গাম্ভীর্য বজায় রেখেই রাত্রিকালীন আড্ডার যাবতীয় বন্দোবস্ত প্রস্তুত থাকবে, জানিয়ে দিতে পারি। সে যদি অমন কিছু ভেবে থাকে আমার সত্যিই কোন আপত্তি থাকবে না। তার পদশব্দ শুনতে পাচ্ছি। সে কি এদিকে আসছে? নাকি মাঝখানের করিডরটাতে পায়চারি করছে? উত্তেজনায় আমি শোয়া থেকে বসে পড়ি। পরমুহূর্তেই নিজের ভেতর রাশভারি একটা ব্যক্তিত্ব আনয়নের চতুর প্রচেষ্টা চালাই।
"আরে কী খবর আপনার? ভালো আছেন তো? বসুন।" বলে আমি চা-বিস্কিটের আয়োজন করতে লেগে যাব। তার মধ্যে স্পষ্ট দ্বিধা কাজ করছে। আমার দরজার কাছাকাছি এসে ফিরে যাচ্ছে বারবার। বেশিক্ষণ অবশ্য এ দোলাচলে আমাদের কাউকেই দুলতে হল না। বিদ্যুৎকর্মীদের কর্মতৎপরতা আমার ভেতর একটা মৃদু ক্রোধের সঞ্চার করে। তবে সান্ত্বনা পাই এই ভেবে, গরমে বড্ড কষ্ট পাচ্ছিলাম! ফ্যানটা যেন আমার মনের কথা বুঝতে পেরেই অনুগত ভৃত্যের মত প্রবল বেগে ঘুরতে থাকে।
মাস ছয়েকের মধ্যে লোকটার কোন একটা ব্যবসায়িক বা চাকুরীগত বিপর্যয় ঘটে যায় সম্ভবত (আমি ঠিক জানিনা সে কী করে)। সে বাইরে বেরোয় না। আমার মতই ঘরের মধ্যে বসে থাকে আর টেলিভিশন দেখে। সঞ্চিত টাকা ভালোই আছে বোধ হয়। যে হোটেলটা থেকে তাকে প্রতিবেলা খাবার দিয়ে যায় সেটা যথেষ্টই দামী। আমি শুয়ে শুয়ে ভাবি, তাকে আমার জীবনের গল্প বলব নাকি? তবে আমার গল্পগুলো এত ব্যক্তিগত এবং স্পর্শকাতর; তা সবার সাথে শেয়ার করা যায়না। আর এসব কথা তার সাথে শেয়ার করতে গিয়ে ধরে নিই একটা বেশ ভালো বন্ধুত্বের সম্পর্ক সৃষ্টি হয়ে গেল, তাহলেই বিপদ! আমি জেনেছি আমার বন্ধু থাকতে নেই, বন্ধু রাখতে নেই। বন্ধুর চেয়ে বিপদজনক শত্রু আর হয় না। বন্ধুদের মত সহাস্যে, নির্বিকারভাবে আঘাত করতে অতি বড় শত্রুরও হাত কাঁপবে। আর বন্ধুদের কাছ থেকে অতি সামান্য আঘাতেই পর্যুদস্ত হওয়া যায়। এখন আমি যদি তাকে বলি সেই ঘটনাটা, যার কারণে আমার প্রেমিকার সাথে বিচ্ছেদ হয়েছিল, কিছুটা অদ্ভুত বটে...
"আমি সকল বন্ধনের ঊর্ধে তাকে স্থান দিয়েছিলাম। জীবনের সমস্ত স্বাদ সে নিয়েছিলাম তার কাছ থেকে। মমতা, যৌনতা, ভালোবাসা, চুম্বন... অনুভূতির ক্যালাইডোস্কোপে প্রতিনিয়ত যুক্ত হত নতুন রঙ, নতুন আয়নায় আমরা প্রতিদিন আমাদের সুন্দরতর প্রতিবিম্ব দেখতাম। জীবনের সব স্বাদ এত দ্রুত, এত তীব্রভাবে চেখে নেবার ফলে আমাতে কিছুটা অবসাদ পেয়ে বসে। আর কিছু পাবার বাকি নেই ভেবে আমি বিষণ্ণ হয়ে পড়ি। তার বিশ্বস্ত হাতে আমার হাত নির্ভরতা খোঁজে না, ভবিষ্যতের স্বপ্নশপথ নেয় না নীরবে, আমি শপথের পরিবর্তে ঝাঁকে ঝাঁকে শ্বাপদ দেখি। কৌতুকের দৃষ্টিতে চেয়ে আছে আমাদের 'পরিপূর্ণ' সম্পর্কের দিকে। পরিপূর্ণ। এক টিন ভর্তি পানি যেন, শক্তিশালী টিন। কোথাও কোন ছিদ্র নেই। লিকেজের কোন সম্ভাবনাই নেই। কিন্তু শ্বাপদেরা যদি তাদের ধারালো নখ দিয়ে আঁচড়ে দিতে চায়? সে আমাকে বারবার তিরস্কার করত এমন অবাস্তব সম্ভাবনার কথা ভাবার জন্যে। তার বক্ষবন্ধনী খুলে সযতনে রাখা টিনের কৌটাটা চুপিচুপি দেখাত আমাকে, আর অভয় যোগাত "কেউ দেখতে পারবে না" বলে, আঁচড় কাটার তো প্রশ্নই নেই! আমি আশ্বস্ত হতাম, তারপরে আরো বিমর্ষ হয়ে যেতাম। কেন, জানি না। কীসের অভাব? কী নেই আমাদের মধ্যে? আমাকে তুমি কী দাওনি? কিছু একটা বাকি থেকে যাচ্ছে, কিছু একটার অভাব! হঠাৎ একদিন আমি বুঝতে পারি, কোন সে অনাস্বাদিত অনুভব আমাকে তাড়িয়ে ফিরছে। মৃত্যু! জীবনকে তাগড়া ঘোড়ার মত খোলা মাঠে টগবগিয়ে ছুটে চলতে দেখেছি আমরা, তাতে সওয়ারও হয়েছি। আশেপাশে দেখেছি অসংখ্য মৃত ঘোড়া, মৃত আরোহী, জীবন্মৃত ঘোড়া এবং আরোহী। ভ্রূক্ষেপ করি নি। শুধু ছুটেই গেছি। প্রিয় তারা, আমাকে সেই স্বাদ দাও। আমি জানি তোমার কাছ থেকেই কেবলমাত্র এই স্বাদ আমি পেতে পারি। আমি ভীরু, তাই নিজের পরখ করতে ভয় হয়। তুমি বিশ্বস্ত, তুমি প্রেমময়ী, তুমিই পারো আমাকে পূর্ণ করতে, কার্পন্য করো না, দাও দাও দাও...
-কী বলতে চাও?
-তোমার গলা টিপে ধরব, মৃত্যুর কাছাকাছি নিয়ে যাব। তারপর ছেড়ে দেব। তুমি আমাকে বলবে মৃত্যুর সম্মুখীন হওয়াটা কেমন।
অতঃপর সে আমাকে অন্য এক জীবনের সম্মুখীন করে চলে গেল, স্মৃতিস্মারক হিসেবে সেই টিনের কৌটাটা দিয়ে গেল। এর মধ্যে গচ্ছিত রয়েছে 'পূর্ণতা' নামক হাস্যকর নামের ভয়ংকর এক গরল।"
... তো এই কাহিনী শুনে পাশের রুমের বাসিন্দা যদি ফিক করে হেসে ফেলে, অথবা আমাকে পাগল ঠাউরে বসে, কিংবা কোন আগ্রহই না দেখায়, ব্যাপারটা অসম্মানের চুড়ান্ত হবে। এর চেয়ে সে তার মত করে টিভি দেখতে থাকুক, আমি ফাঁকা টিনের কৌটাটায় পিন দিয়ে খুঁচিয়ে ছিদ্রের সংখ্যা বাড়াতে থাকি।
তারপর সেদিন, যেদিন টিভিটা বিকল হয়ে গেল, সে সস্তার হোটেল থেকে খাবার আনা শুরু করল, বুঝতে পারলাম তার সঞ্চয় ফুরিয়ে আসছে, টিভিটা মেরামত করার বিলাসিতা হয়তোবা দেখাবে না। ততদিনে টিনের কৌটাটায় আমি অনেকগুলো ছিদ্র করে ফেলেছি। শক্ত কৌটো, বেশ কসরৎ করতে হয় ছিদ্র করতে। আমার না হয় একটা অবলম্বন আছে সময় কাটাবার, কিন্তু বেচারা লোকটা কী করবে? টিভিটা ছাড়া আর তো কিছু তার ছিলো না। তাকে বলব নাকি টিনের কৌটাটা ছিদ্র করতে সহায়তা করার কথা? এতে অবশ্য সে রেগে যেতে পারে। হয়তোবা আমার নেতিবাচক এবং ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম তাকে ক্ষিপ্ত করতে পারে। সে হয়তোবা বলতে পারে, "কৌটোটায় ছিদ্র না করে তা বন্ধ করার চেষ্টা করুন না!"। এরকম কিছু অনেকদিন শোনা হয়না। বলবে কি সে?
নাহ, তার সময় হয়না। আর্থিক দুরবস্থা দ্রুতই কাটিয়ে ওঠে। টেলিভিশনটাও মেরামত করে ফেলে আবার আগের রুটিনে ফিরে যাবার প্রস্তুতি নেয় সে। তবে ফিরে যাবার আগে সে আকস্মিক হৃদ্যতা করে বসে! আমাকে তার সাথে টেলিভিশন দেখার আমন্ত্রণ জানায়। এরপরে একসাথে টিভি দেখাটা আমাদের রুটিনকর্মে পরিণত হয়। আমরা কেউ একে অপরের সাথে কথা বলি না যদিও, তাতে কোন সমস্যা হয় না। সে রাত করে বাড়ি ফেরে। আমি সারাদিন শুয়েবসে টিনের কৌটোটা খোঁচাই। রাতের আহার সম্পন্ন করে আমরা একে অপরের ঘরের দরজা খুলে দিই। তারপর টেলিভিশন দেখতে বসি।
বছরখানেক এভাবে টেলিভিশন দেখার পর আমি বুঝতে পারি আমার জীবনে দ্বিতীয়বারের মত বিশ্বস্ত কেউ একজন এসেছে। তার কাছে যা ইচ্ছে তাই আবদার করা যায়। টেলিভিশনটাকে আমি আজকালের মধ্যেই প্রস্তাব দেব আমার দ্বারা মৃতপ্রায় হবার। একটা লোহার রড দিয়ে ভেঙে কাঁচ গুড়িয়ে দিলে তার কেমন লাগবে, মৃত্যু অনুভূতি হবে কী না, আর হলে সেটা কেমন এসব জিজ্ঞাসা করব। আমার মনে হয়, পাশে বসে থাকা লোকটির কাছে এমন আচরণ এখন আর অদ্ভুত বলে মনে হবে না। বরং সেও আমাকে সাহায্য করতে পারে। আপনতম, বিশ্বস্ততম জনের কাছে অদ্ভুত এবং বিপদজনক আবদার করব না তো কার কাছে করব?
এক মহেন্দ্রক্ষণে অনুধাবনের অনুপ্রাননে উদ্বুদ্ধ হয়ে আমরা প্রথমবারের মত একে অপরের সাথে পূর্ণবাক্যে ভাবপ্রকাশ করি,
-রেডি আছেন তো? রডটা নিয়ে আসি পাশের রুম থেকে?
-না, আপনি কষ্ট করবেন কেন? আমার কাছেই তো আছে!
তারপরেও আমি পাশের ঘরে চলে যাই। টিনের কৌটোটাকে নিয়ে আসতে। প্রিয়তম জড়পদার্থদ্বয়কে একসাথে দেখতে পারার অনুভূতিটা চমৎকার!