তারা দুইজন বসে ছিলো এই ভীড়বাট্টা, কংক্রিট অরণ্য, আর তেলজলঘামের শহরের একটি হ্রদের ধারে। জলের কাছে এলে তাদের বিক্ষিপ্ত মন কিছুটা স্বস্তি পাবে বলেই সপ্তাহের শেষ কর্মদিবসে এখানে তাদের আগমন। যুবকদ্বয়ের মনের বিক্ষিপ্ততা এবং হতাশার কেন্দ্রে রয়েছে লিখতে না পারার কষ্ট। অনেকদিন ধরেই তারা কিছু লিখতে পারছে না। তারা গল্প খুঁজেছিলো ঝাউবনের সামুদ্রিক হাওয়ায়, তারা গল্প খুঁজেছিলো প্রান্তিক মানুষের ব্রাত্য নিত্যনৈমিত্তিকে, তারা নতজানু হয়ে প্রার্থনা করেছিলো নক্ষত্রনিবাসে, তাদের এই আকুল আকুতির জবাবে তারাগুলো শুধু মিটমিট করে হেসেছিলো। এভাবে নানারকম অবজ্ঞা, টিটকিরি আর ভর্ৎসনায় পিছু হটে তারা ফিরলো জলের কাছে। পুড়ছে নিকোটিন, ক্যাফিনের প্রভাবে তারা আলতো করে ঝেড়ে ফেলে দিতে চায় কর্মদিবস থেকে অর্জিত ক্লান্তি। তারা দুইজন লেখক, রাশেদ আর রিফাত, রাইটার্স ব্লকে আক্রান্ত হয়ে হ্রদের ধারে বসে হতাশা বিনিময় করছিলো।
-পেইন ,বড় পেইন রাশেদ ভাই। এখন আফসোস হচ্ছে কেন যে লেখালেখি শুরু করেছিলাম!
-তোমাকে কী আর বলবো, আমার নিজেরও তো একই অবস্থা। খারাপ সময় আসতেই পারে কিন্তু এত দির্ঘস্থায়ী হবে তা ভাবি নি।
-আমি সেদিন লেখার চেষ্টা করেছিলাম। দশ লাইন লেখার পর দেখি তিন বার 'তারপর' লিখেছি। ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলাম কাগজটা।
-চলো উয়ারি বটেশ্বরের দিকে যেয়ে কয়েকদিন কাটিয়ে আসি। ওখানে বেশ ভালো জঙ্গল আছে। বিভূতির 'আরণ্যক' ফ্লেভার পাওয়া যাবে বেশ।
-আর তারপর গড়গড়িয়ে গল্প বেরুতে থাকবে আমাদের কলম থেকে? মনে হয় না। সেই তো ফিরে আসতে হবে ধূলি-ধোঁয়াময় এই বিষাক্ত শহরে!
-না এসে উপায় কী! এখানে আমাদের চাকুরি, ব্যাংক এ্যাকাউন্ট, সিনেপ্লেক্সে থ্রিডি, প্লাজমা টেলিভিশন, সন্তান, স্ত্রী...সব। পালাবে কোথায় তুমি?
-সুখ! একেই মনে হয় বলে সুখ। তাই না রাশেদ ভাই?
-হ্যাঁ! শাস্ত্রে তো এমনই বলে। আমরা সুখী।
-সুখ একটা আশ্চর্য অভিশাপ।
-ভালো বলেছো। এই কথাটার জন্যে তোমাকে একটা সিগারেট খাওয়ানো যায়।
রিফাত এবং রাশেদ। দুজনই স্বনামধন্য গল্পকার। ছোটগল্প লেখেন তারা। বেশ কয়েকটি বইও প্রকাশিত হয়েছে। পাঠক এবং সমালোচকদের প্রশংসায় ধন্য হয়েছে তাদের রচনা। লেখালেখির সুবাদে বিভিন্ন সেমিনার বা ওয়ার্কশপে গিয়ে দুজনের মধ্যে বেশ ভাল বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। সেই বন্ধুত্বের সূত্র ধরে একে অপরের বইয়ের সমালোচনা, গল্পের পেছনের গল্প, সামনে যা লেখা হবে এসব নিয়ে তারা ঘন্টার পর ঘন্টা আলাপ করতো। তারা ছিলো সৃষ্টির আনন্দে উদ্বেল, ঝলমলে এবং প্রাণবন্ত। তবে আজ এই হ্রদের ধারে বসে আছে তারা মলিন মুখে, হারিয়ে ফেলেছে সেই রোশনাই।
-তোমার বয়স কত রিফাত?
-২৭
-২৭ সংখ্যাটা কিন্তু বেশ শিল্পমণ্ডিত। সঞ্জীবদা গেয়েছিলেন "আমার বয়স হলো সাতাশ/ আমার সঙ্গে মিতা পাতাস। ওদিকে শাহাদুজ্জামানের একটা গল্প আছে সাড়ে সাতাশ। সাতাশটি গল্প লেখার পর তিনি আর কিছু লিখতে পারছিলেন না। তখন পুরোনো গল্পগুলোর চরিত্রগুলোকে একসাথে বেঁধে তিনি লিখেছিলেন ঐ গল্পটি।
-অনেকটা ফেদেরিকো ফেলেনির এইট এ্যান্ড হাফের মতো, তাই না?
-হ্যাঁ। গল্পেও তার উল্লেখ ছিলো।
হ্রদের জলে পার্শ্ববর্তী এলাকায় কনসার্টের জন্যে সজ্জিত আলোর প্রতিফলনে বেশ মায়াময় একটা দৃশ্য সৃষ্টি হয়েছে। সবাই বেশ সুখী এখানে। তরুণ-তরুণীদের মধ্যে জুটিবদ্ধ হয়ে খুনসুটি করছে, মওকা পেয়ে চুমু দিতেও কোন বিলম্ব নেই তাদের! এখানে আরো আছে নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত হওয়া দম্পতিদের জোড়া। চারিদিকে সবাই বন্ধু। হাসির হুল্লোর, তামাশার ফোয়ারা, স্বাস্থ্যে টগবগ করা ছেলেমেয়েদের জগিং। শুধু দুইজন রাইটার্স ব্লকে আক্রান্ত লেখক যেন বড্ড বেমানান এখানে। বিষণ্ণ।
-রাশেদ ভাই, পেইন দরকার বুঝলেন, পেইন! যন্ত্রণা, বিষণ্ণতা, মানসিক বিকারগ্রস্ততা এসব ছাড়া লেখা আসবে না। আপনার কথাই ধরেন। প্রথমদিকে কি লেখাই না লিখতেন! জাদুবাস্তবতা, মেটাফর, সিম্বল, ক্রেইজি ক্রোনোলোজি, কত নিরীক্ষাই না করেছেন! কোথায় হারালেন সেই আপনি? আপনি বিয়ে করেছেন, মেয়ের বাপ হয়েছেন, এখন আপনার সুখী জীবন। আর আমি? আমিও একজন সফল মানুষ। সফল একামেডিশিয়ান। বিয়ে করলাম সম্প্রতি। আপনি তো এসেছিলেন, তাই না? রান্নাটা ভালো হয়েছিলো বেশ। আসুন আমরা এখন সুখী মুদি দোকানদারের মতো হিসেব নিকেশ করতে বসি। কয় মণ ঘি লেগেছিলো, টিকিয়ায় মাংস ঠিকমত দেয়া হয়েছে কী না, রোস্টের লবণ ঠিকঠাক হয়েছিলো কী না। বাদ দেন এইসব লেখালেখি
-এ এক অদ্ভুৎ দ্বান্দ্বিক পরিবেশ। এখান থেকে বের হওয়া অত সহজ না। আমার মেয়েটা ভিকারুন্নিসাতে চান্স পেয়েছে। আমি তাকে নিয়ে ফ্যান্টাসি কিংডমে গিয়েছিলাম। তার আনন্দ দেখে মনটা ভরে গিয়েছিলো। এই সুখের কোন তুলনা হয় না। অপরদিকে আমার গায়ে সুখের চাদর এসে ঢেকে দিচ্ছে যাবতীয় এভিল থটস, ডার্ক এ্যারেনা, মানুষের মনের অন্ধকার অলিগলির শুলুক সন্ধান। আমি এখন আর নিজেকে জোর গলায় নরকের রাজপুত্র বলতে পারবো না। সুখের মেদ গলে টসটস করে পড়বে আমার মৃতপায় এ্যানার্কিস্ট ডিসটোপিয়ান জগৎ। ওরা মরে যাবে, খুব কষ্ট পেয়ে মরে যাবে। গল্প আমি এখনও লিখি। ফরমায়েশী। ওসবের কথা তোমাকে বলি নি আগে। ওহ! চুরমার হয়ে যাচ্ছে আমার ভেতরটা! আমি কোথায় ছিলাম, আর এখন কোথায় এলাম! আমি আমার কন্যার হাত ধরে সবুজের আলে হাঁটতে চাই, আবার মানুষের মনের অন্ধকার প্রকোষ্ঠেও পৌঁছাতে চাই। আমি কোথায় যাবো জানি না!
-আপনাকে একটা কঠিন সত্যি কথা বলি। ইউ আর ডান। আর আমি তো সেভাবে শুরুই করতে পারলাম না। আমরা দুজনেই হারিয়ে যাবো একসময়। কেউ আমাদের মনে রাখবে না।
-চলো এখান থেকে উঠি।
-উঠে কোথায় যাবেন?
-নগর পরিভ্রমণে বের হবো। হাঁটাহাঁটি করি কিছুক্ষণ চলো।
-আপনি কি ভাবছেন এখান থেকে কোন গল্পের প্লট পেয়ে যাবেন?
-না, ঠিক সেরকম উদ্দেশ্য নিয়ে বেরুই নি, তবে যদি কিছু পেয়ে যাই তাহলে তো ভালোই। চলো উঠি।
-চলেন।
সোডিয়াম লাইটের আলোয় প্লাবিত শহরে বিষণ্ণ দুই যুবক হাঁটতে থাকে। উদ্যানের পাশ দিয়ে যাবার সময় পতিতাদের মাদক আহবানের পেছনে যে কষ্টের ইতিবৃত্ত সেটা নিয়ে গল্প হতে পারতো। অথবা বাসে ওঠার প্রতিযোগিতায় ব্যর্থ হয়ে যে বৃদ্ধ হুমড়ি খেয়ে পড়লেন, তার জীবন নিয়েও কিছু লেখা যেতো। অথবা কিছুই না, স্রেফ একটা বেলুন যা পথশিশুর হাত থেকে পড়ে গিয়ে দফারফা হয়েছে তার মধ্যে কি প্রবেশ করতে পারতো না কিছু বায়বীয় শব্দ? তারপর সেই বেলুন উড়তো আকাশে, পেটে শব্দের শোকেস নিয়ে। উড়তে কার না ভালো লাগে? সে বেলুন হোক, বা পতিতা বা বাসের হেল্পার, কিংবা বিষাদী গল্পকার! আকাশে উড়ছে অসংখ্য ফানুস। কারা যেন কোন একটা বিজয় উদযাপনের জন্যে ফানুস ছুড়েছে। সবাই উল্লসিত হয়ে দেখছে। শুধু হতাশ দুই গল্পকার একবার দেখেই দৃষ্টি অন্যখানে নিবিষ্ট করলো। ওরা শোক উদযাপন করবে। উড়বে না।
-ফানুস উড়ছে আকাশে। কী তার রঙ আর জেল্লা! কী প্রাণময়তা ওদের ভেতরে! আর আমরা!
-এই ফানুস নিয়ে একটা গল্প লিখলে কেমন হয় রাশেদ ভাই?
-ফানুস নিয়ে? উমম...লেখা যায়। সবকিছু নিয়েই তো গল্প লেখা যায়। আগে আমি এক সেকেন্ডের ভগ্নাংশের অনুভূতি নিয়ে দশ পাতা গল্প লিখেছি। আর এখন!
-ধরেন একটা মেয়ে, তার কষ্টগুলো লিখে রাখে ডায়েরির পাতায়। লিখতে লিখতে তার সাথে কষ্টগুলোর সখ্যতা হয়ে যায়। তারপর মেয়েটির জন্মদিনে মোমবাতি, ডায়েরির পাতা, আগুন আর গ্যাস মিলে ফানুস হয়ে তাকে সারপ্রাইজ দেবার জন্যে আকাশে ওড়ে, আর স্কাই রাইটিং করে "হ্যাপিবার্থডে টু ইউ!"
-থিমটা তো বেশ ভালো! লিখে ফেলো তুমি।
-আচ্ছা লিখবো। কিন্তু আপনি কী লিখবেন?
-আমার আর হয়েছে লেখা!
-এক কাজ করি আসেন, দুইজনই এক থিম নিয়ে লিখে ফেলি।
-লিখবো বলছো?
-থিমটা হয়তো বা এত ডিপ না, তবে অনেকদিনের বন্ধ্যাত্ব ঘুচিয়ে দেবার জন্যে এমন হালকা একটা থিম স্টার্টার হিসেবে মন্দ হয় না!
-আচ্ছা দেখা যাক।
-দেখা যাক আবার কী! চলেন, এক্ষণি চলেন আমার বাসায়। কড়া দুই কাপ কফি খাবো দুজনে, তারপর তুমুল লেখালেখি। কাম অন ম্যান! চিয়ার আপ! হোয়াই দ্যা লং ফেস? কাম অন!
রিফাতের কথার ভেতর একটা প্রাণবন্ত বৈদগ্ধ ছিলো। অনেকদিন পর এটার দেখা পেয়ে রাশেদের ভেতরেও উত্তেজনা সৃষ্টি হলো। তার মনে হচ্ছিলো সে এবার পারবে। অনেকদিন পর লেখার তাড়ণা জাগ্রত হয় তার ভেতর।
-চলো তবে রওনা দেয়া যাক!
তারা একটা ট্যাক্সিক্যাব ভাড়া করে রিফাতের বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হয়।
*
ক্রিং ক্রিং
কলিংবেলের আওয়াজ। দরোজা খুলে দিলেন একজন কাঁচা-পাকা চুলের প্রৌঢ় ব্যক্তি।
-আমি জানতাম তোমরা আসবে। পথ ভুল করে আমার এখানে আসাই তোমাদের ভবিতব্য ছিলো। এসো রাশেদ, এসো রিফাত। আমার গল্পের দুই চরিত্র। আমি বড় একাকী বুঝলে! তোমরা আসলে ভালো লাগে। ইদানিং লেখালেখিও তেমন আসে না। পুরোনো চরিত্রগুলো চলে গেছে অনেক দূরে। এখন তোমরাই আমার ভরসা।
-ওসব ছাড়েন জনাব সৃষ্টিকর্তা! লেখার ক্ষমতা আপনার নেই আর। ইউ আর কার্সড ফরএভার।
রিফাত বেশ অহমিকার সুরে বলে।
-আমরা আপনার মগজে ঘোরাঘুরি করবো, আপনি যন্ত্রণা পাবেন যন্ত্রণা! আপনি লিখতে চাইলেও পারবেন না। আপনার আর নতুন করে দেয়ার কিছু নেই। কিন্তু আমরা তো আর আপনার গল্পের স্থবিরতায় চিরবন্দী হয়ে থাকতে পারি না! আমরা এখন লিখবো। ফানুস নিয়ে লিখবো, মানুষ নিয়ে লিখবো, তরুণী নিয়ে লিখবো, ব্যালকনি নিয়ে লিখবো। আপনি বরং কাশির ঔষধ আর ইনসুলিন নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন।
লেখক তার চরিত্রদের এমন বিশৃঙ্খলা এবং বিদ্রোহে আহত হলেও হাল ছেড়ে দেন নি। তিনিও পুরোনো লেখার খাতাটা নিয়ে বসে পড়েন লিখতে। কত লেখা আছে সেখানে! নতুন করে কিছু একটা লিখতেই হবে তাকে। তিনি পাতা ওল্টাতে থাকেন। কী আশ্চর্য! পাতাগুলোয় কোনো লেখা নেই। সব পৃষ্ঠা সাদা! আর ওদিকে তার গল্পের চরিত্র দুজন লিখে চলেছে দ্রুতগতিতে। লেখকের খাতা থেকে অজস্র চরিত্র, অনুভূতি, টুইস্ট, নিরীক্ষা সব চলে যেতে থাকে ওদের কাছে। এ এক অদ্ভুৎ অভ্যুত্থান! গল্পের চরিত্রগুলো বুঝে গেছে এই একাকী বুড়ো আর তাদেরকে সামলে রাখতে পারবে না। তুমুল গতিতে স্প্রিন্ট চলছে। রাত বাড়ে। ছায়ারা দীর্ঘ হয়। দীর্ঘতর হয়। অতি দীর্ঘ হয়। ছায়ার নিবাসে গুটিশুটি মেরে লেখক বুঝতে পারেন, দিনে দিনে তার ছায়াই বেড়েছে শুধু। তিনি একজন ছায়াবন্দী।, অথর্ব শব্দভিক্ষুক। সাদা হয়ে যাওয়া ডায়েরির পাতাগুলো খুলে ভিখিরীর মতো বসে থাকেন তিনি। কোথা থেকে যদি একটা শব্দ পাওয়া যায়! চরিত্র গড়া যায়! কাহিনী বানানো যায়!
বিশেষ কৃতজ্ঞতা- মাশরুর ইমতিয়াজ
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে নভেম্বর, ২০১৪ সকাল ১০:০৬