somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ফ্লাজলামি

১৬ ই অক্টোবর, ২০১৬ রাত ১১:১৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


আমার একজন প্রেমিকা আছে। তার অধরে টিয়া পাখির ঠোঁটের মত লাল টুকটুকে আনন্দের সমাহার। তার চোখের অতলে বরিশালের সুপুষ্ট নদীগুলোর মত গভীর জলপ্রাসাদ। তাকে আমি একটা নাকফুল কিনে দিয়েছি। গ্রিক দেবীদের মত খাড়া নাকটি আঁকড়ে ধরে রাখা নাকফুকটিকে আমার হিংসে হয় মাঝে মধ্যে। অতটা কাছে কেন আমি যেতে পারি না?

নাম তার শায়লা। আমার “হতে যাচ্ছে” অর্ধাঙ্গিনী। বিয়ে নামক সামাজিক সনদটা পাবার আগে প্রি-রিকুয়েস্টেড কোর্স হিসেবে আমরা প্রেমের ইশকুলের মনোযোগী শিক্ষার্থীদের মত ক্লাশ করে যাচ্ছি। আপাতত আমরা লাস্ট সেমিস্টারের মাঝামাঝি পর্যায়ে আছি। এই পরিস্থিতিতে আমরা শিখছি ‘শেয়ারিং’। আমরা দুজনেই এক অন্যকে সব বলি। মন খারাপ হলে, মন ভালো হলে, দুঃখের সিনেমা দেখে মন কাঁদলে, হাসির বই পড়ে আমোদ পেলে, কলিগের কূটনামীতে বিরক্ত হলে, বাসের কন্ডাক্টরের সাথে ঝগড়া হলে, সব বলি। তার সাথে দেখা করতে এলে লম্বা ডাঁটা অলা শ্বেত শুভ্র রজনীগন্ধা, অথবা শিউলি ফুলের মালা উপহার দেই। আরো দেই চকলেট, আইসক্রিম, টিপ অথবা দুল। শহর থেকে দূরে নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক পরিবেশে চমৎকার সময় কাটাই আমরা। ভবিষ্যতের স্বপ্নে বিভোর হই, হালকা খুনসুটি করি, ছদ্মরাগের কপটতায় দূরে সরে যাই, আবার কাছে চলে আসি চুম্বনের চুম্বক আকর্ষণে।

সবকিছুই ঠিকঠাক ভাবে চলছিলো, কিন্তু হঠাৎ একদিন আমার পেট খারাপ করলো। সমস্যা হলো, মন খারাপ হলে যতটা সাচ্ছন্দ্যে বলা যায় পেট খারাপ হলে তা বলা একটু মুশকিলই বটে। কাছের বন্ধুকে বলা যায় “পাতলা পাইখানা হইছে রে দোস্ত”, কলিগকে বলা যায় “ডায়রিয়া হইছে”। প্রেমিকাকে কি তা বলা যায়? একান্তই দরকার পড়লে বলা যেতে পারে স্টোমাক আপসেট, বা ফুড পয়জনিং হয়েছে। আমার বিবাহিত বন্ধুদের কাছে শুনেছি, তারাও প্রেমিকার কাছে এমন স্থূলভাবে এ কথাটি বলতো না। তবে বিয়ে হয়ে গেলে এসব সুগার কোটেড কথাবার্তার কোন মূল্য থাকে না। এমন কি একে অপরের সামনে সশব্দে বাতকর্ম করাটাও খুব মামুলি ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায় না কি! ছি ছি! শায়লা যেমন সূক্ষ্ণ রূচির আদুরে বিড়াল একটা, ওর সামনে এসব বললে বা করলে কী প্রতিক্রিয়া হবে ভাবতেই পারি না! তাই সুমনের ভাতিজার মোসলমানির অনুষ্ঠানে গলা পর্যন্ত খেয়ে যখন আমার চুয়া ঢেকুর উঠতে লাগলো এবং ঘনঘন প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেবার দরকার পড়লো, শায়লাকে তা বলে সহানুভূতি অর্জনের চেষ্টা রহিতই রাখতে হলো। অফিসে যাবার আগে ফার্মেসি থেকে এক পাতা ফ্লাজিল কিনে নিলাম। এই ঔষধটা ভালো। এসব ক্ষেত্রে দারুণ কাজ দেয়। দ্রুত রিকভারি খুব দরকার আমার। অফিসে যেতেই হবে। পরদিন আবার শায়লার সাথে ডেটিং। টাইট শিডিউল।

সৌভাগ্যের বিষয়, তিনটি ট্যাবলেট বাকি থাকা অবস্থাতেই আমি সুস্থ হয়ে উঠি, এবং যত্ন নিয়ে দাড়ি কেটে, মাঞ্জা মেরে শায়লার সাথে দেখা করার উপযুক্ত হিসেবে নিজেকে প্রস্তুত করি ফুরফুরে মেজাজে। মানিব্যাগে বাকি ট্যাবলেটগুলো রেখে দেই অবশ্য। কখন কাজে লাগে বলা যায় না। উত্তেজিত বৃহদান্ত্রকে বিশ্বস্ত প্রেমিকার মত অনুগত ভাবার কোন কারণ নেই।

শায়লা দেরী পছন্দ করে না। তাই আমি আগেভাগেই রওনা দিলাম। ঝুম জ্যামে ঝিম মেরে বসে থাকতে থাকতে ভাবতে লাগলাম বিচিত্র সব বিষয়। ভাবনাক্রমে উদ্বৃত্ত থাকা ট্যাবলেটগুলির কথাও মাথায় এলো। তারা উপকারী এবং একা। অপেক্ষায় আছে কারো পেটে ঢুকে পড়ে জীবাণুদের ঠ্যাঙানোর জন্যে। এটাই তাদের জীবনের উদ্দেশ্য। ভাবতে ভাবতে এক মহৎ জীবনদর্শন আমাকে গভীর ভাবে ছুঁয়ে গেলো। আমার বিশেষ প্রয়োজনে তাকে একান্ত ভাবে কাছে পেয়েছি। এখন তার কোন প্রয়োজন আমার কাছে নেই। হয়তো বা ফেলে দেবো দুদিন পর। ধূলিধূসরিত রাস্তায় কাদা লেগে থাকা স্যান্ডেলের তলে পিষ্ট হবে, অথবা ডাস্টবিনের নোংরার সাথে এক অসম্মানজনক সহাবস্থানে বিনষ্ট হবে। এ বড় অন্যায়, বড় অন্যায়! যদি ফেলে না দেই তাতেই বা কী! নিশ্চিতভাবেই ভুলে যাবো। অপার সম্ভাবনাময় বস্তুটির এক্সপায়ার্ড ডেট শেষ হয়ে যাবে। কী মর্মান্তিক! ওহ! আমার মধ্যে বিপ্লব এবং মানবতার এক যৌথ অনুভূতি অভ্যুত্থান করে নৃশংস ভাবে হত্যা করলো মনের অলস এবং অকেজো অনুভূতিগুলোকে। তিনটি ফ্লাজিল ট্যাবলেট নষ্ট হওয়া মানে পেটের বেদনাদায়ক মোচড়ে কাবু হওয়া রোগীর ক্রমবর্ধমান যন্ত্রণা, ন্যাশনাল রিজার্ভ থেকে ছটি টাকা গচ্চা যাওয়া। একজন সচেতন এবং দেশপ্রেমিক মানুষ হিসেবে আমি এটা হতে দিতে পারি না। কোনভাবেই না। প্রচণ্ড প্রতিজ্ঞায় দৃঢ় হয়ে উঠলো আমার চোয়াল, মুষ্টিবদ্ধ হলো হাত, কেঁপে উঠলো চোখের পাতা। আর তখনই কন্ডাকটর বাজখাঁই কণ্ঠে তাগাদা দিতে লাগলো- এ্যাই ধানমন্ডি ৩২, শুক্রাবাদ নামেন! যাহ, এসে গেছি! আরেকটু হলেই তো স্টপেজ মিস করতাম!

-এ্যাই, কী ভাবছো বলো তো? আজ তোমাকে কেমন যেন আনমনা লাগছে।

শায়লার অনুযোগে সম্বিৎ ফিরে পাই আমি। ফ্লাজিল বিষয়ক রোমান্টিক বিদ্রোহী ভাবালুতা আমাকে বারবার অন্যমনস্ক করে দিচ্ছিলো। শায়লার জন্যে কিনে রাখা রক্তগোলাপটা ভুল করে বাসেই ফেলে এসেছি। এ নিয়ে আর বেশি মাথা ঘামালাম না। সবসময় এমন লুতুপুতু উপহার দেবার কোন মানে নেই। আমরা বাকিটা জীবন এক সাথে কাটাতে যাচ্ছি। আমাদের মধ্যে শুধু জানু-মানু-চুমু থাকবে না, আমরা হব বিপ্লবী, র্র‍্যাডিকাল, এনার্কিস্ট, বিদ্রোহী! আমরা কাজ করে যাবো ফ্লাজিলের অধিকার রক্ষার্থে। আমার শ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুত হতে লাগলো, কেঁপে উঠলো কণ্ঠ।

-আজ তোমাকে এক অমূল্য উপহার দেবো শায়লা।

শুনে সুখে গদগদ হয়ে মিষ্টকণ্ঠী শায়লা প্রবল আগ্রহে জিজ্ঞেস করলো,

-কী এনেছো বেইবি?

-এমন একটা জিনিস, যা তোমার পেট ফাঁপলে, আমাশয় হলে, অথবা পাতলা…

তার দু চোখ বিস্ফোরিত হয়ে পাবনার লক্ষী মিষ্টান্ন ভান্ডারের বড় বড় রাজভোগের আকার ধারন করলো। বিকৃত বিস্ময়ের নীরব আস্ফালনে আমার মনের ভেতরের যাবতীয় বিপদ সংকেত এবং লাল আলো জাগিয়ে তুললো। আমার কথা শেষ না করতে দিয়েই ঝানু পুলিশ অফিসারের মত রিমান্ডে নেয়া আসামীকে জেরা করার ভঙ্গিতে ভয়াবহ শীতল কণ্ঠে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করলো।

-এসব অরুচিকর কথা কোথা থেকে শিখেছো? আমার সামনে এসব বলতে তোমার লজ্জা করলো না? তোমার জন্যে আমি গাউসিয়া থেকে কত খুঁজে ম্যাচিং করা ওড়না, দুল আর থ্রি পিস পরে এসেছি, আর তুমি এসব গ্রাহ্য না করে অশালীন কথা বলতে শুরু করে দিয়েছো!

এমন পরিস্থিতি সৃষ্ট হলে আদর্শ তটস্থ প্রেমিকের মত নিজের ভুল স্বীকার করে তার মান ভাঙাতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ি। কিন্তু গভীর সন্তোষের সাথে অনুধাবন করলাম যে আমার বিপ্লবী স্বত্ত্বাটি এখনও জিহাদী জজবা বজায় রেখেছে। ভর্ৎসনার দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে প্রতিবাদ করে বসলাম ভুলোমনা শালিক পাখিটির মত, যে কি না একটি কুমীরের নাকের কাছে ওড়াওড়ি করছে।

-দেখ শায়লা, হতে পারো তুমি সুন্দরী, প্রসাধন ছাড়াই তোমাকে ভালো লাগে, প্রসাধন নিলে আরো বেশি ভালো লাগে। হতে পারে তোমার চামড়া মসৃন, চুল ঢেউ খেলানো। তার মানে এই না যে পেট পুরে বেগুনী অথবা হালিম খেলে তোমার বুক জ্বালা করে না। গরুর মাংসে মশলা বেশি হলে ঠিকই তোমার পেট ফাঁপে, ভুটভাট শব্দ করে। আনারসের সাথে দুধ খেলে তোমারও হতে পারে আমাশয়। তবে ফ্লাজিল থাকতে তোমার কোন চিন্তা নেই। একমাত্র ফ্লাজিলই দিতে পারে তোমাকে কুইক সলুশন। নিকটস্থ ফার্মেসিতেই পাচ্ছো। প্রতিটি ট্যাবলেট মাত্র দুই টাকা।

-কী! আমার পেট ফাঁপা হয়! আমাশয় হয়! এমন কথা তুমি বলতে পারলে? কতটা জঘন্য তোমার মন! কী অশ্লীল তোমার চিন্তা ভাবনা! আজ তোমার আসল রূপ দেখলাম। ভেবেছিলাম তুমি আমাকে বিশ্বাস করো। কিন্তু তোমার মনে শুধু সন্দেহ আর কূটিলতা। তুমি কীভাবে ভাবতে পারলে যে আমার মত বছর তেইশের (পিএস- আসলে ২৬), আবেগপ্রবন, সুন্দরী একটা মেয়ের পেট খারাপ হবে, ভুটভাট করবে! সবাইকে তোমার মত ভাবো না কি? অভদ্র, আনকালচার্ড, ভালগার লোক তুমি একটা। আমার ইমোশনের সুযোগ নিয়ে তুমি যাচ্ছে তাই করতে পারো না। আমি চললাম। ফর এভার!

প্রচন্ড দুঃখবোধ আমাকে শোকাতূর করে তুললেও মহৎ জীবনের হাতছানি এবং বিপ্লবের বিচ্ছিরি রকম অস্থির তাড়নায় আমি আবার পারলাম সোজা হয়ে দাঁড়াতে। এই অসহায় ট্যাবলেটগুলোর একটা ব্যবস্থা না করা পর্যন্ত আমি স্বস্তি পাবো না।

অনতিদূরে তখন শায়লা কাঁদতে কাঁদতে গটগট করে হেঁটে যাচ্ছে। অশ্রূর স্পর্শে গলে গলে পড়ছে তার মেকআপ। ত্বক হয়ে যাচ্ছে নীলচে-বাদামী রঙের। তাতে গোলাপী রঙের ফুঁসকুরি। তার কানের দু-পাশ দিয়ে শুঁরের মত বের হলো কী যেন একটা। প্রবল বাতাসের ঝাপটায় তার চুলগুলো উড়ে গিয়ে সেখানে কাঁটা কাঁটা কী সব যেন প্রতিস্থাপিত হতে লাগলো। তারপর সে কিছুদূর দৌড়ে আকাশের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে উড়তে শুরু করলো। ওহ আচ্ছা, এই তাহলে ব্যাপার! যেহেতু সে দাবী করেছে ওসব তথাকথিত নোংরা রোগ এবং বস্তু তাকে আক্রান্ত করতে পারে না, তাহলে সে নিশ্চয়ই মানবী না! এলিয়েন নাকি পরী কে বলতে পারে! কী দরকার ছিলো তার মানবীর মুখোশ পরে আমার সাথে অন্তরঙ্গ হবার! না কি সে তার গহীনের মহাজাগতিক প্রাণীটার কথা জানতোই না! অবিচার এবং প্রতারণার শিকার হয়ে ভেঙে পড়ার বদলে আমি আরও দৃঢ় হলাম।

ধানমন্ডি ছেড়ে কাওরানবাজার আন্ডারপাসের ভেতরে ঢুকে একটি মোটামুটি পরিষ্কার জায়গা বেছে নিয়ে বসে পড়লাম। পাশেই ওজন মাপার মেশিন নিয়ে বসা ব্যক্তিটি আমার দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আঁচ করার চেষ্টা করলো তার কোন রাইভাল এসে গেছে কি না। আমি আন্তরিক হাসি দিয়ে তাকে সহজ করার চেষ্টা করলাম।

-ভাই আপনার কি পেটের গোলযোগ অথবা আমাশয় আছে?

কোন জবাব না দিয়ে রুঢ় লোকটা একঘেয়ে স্বরে আন্ডারপাসের যাত্রীদের ওজন মাপার আহবান জানাতে লাগলো। আমিও হতোদ্যম না হয়ে প্রচারনা চালাতে শুরু করলাম। পাশের লোকটির মত একঘেয়ে, নন ক্রিয়েটিভ স্বরে নয়। মানুষের ইমোশনকে আঘাত করার জন্যে মর্মবিদারী কণ্ঠে সুন্দর এবং শক্ত শব্দ নির্বাচন করে রচনা করলাম এক অনন্য কাব্যিক বক্তৃতা। কিন্তু কেউ এগিয়ে এলো না, আগ্রহ দেখালো না। কিছু বখাটে টোকাই ফিচকে হেসে আমার চারদিক ঘিরে বসে মজা নেবার প্রস্তুতি নিলো। বুঝলাম, বিপ্লবের ফল পেতে আরো অনেক বেশি ধৈর্য ধরতে হবে, আত্মত্যাগ করতে হবে। ইতিমধ্যেই প্রেমিকাকে হারিয়েছি। দরকার হলে আরো অনেক কিছু বিসর্জন দেবো। ট্যাবলেটটার ডেট এক্সপায়ার্ড হতে আরো মাস তিনেক বাকি। এর মধ্যেই তার কোনো একটা গতি করে ফেলবো।

বিপ্লবের চেতনা মানুষকে কেবল সাহসী এবং বেপরোয়া করে না, আন্তরিক এবং সহৃদয় করে তোলে। যে কারো সাথে কথা বলতে গেলেই কৌশলে তাদের পৈটিক গোলযোগের খবর নেয়া শুরু করলাম। প্রথম দিকে কাজটা খুবই এ্যামেচারিশ এবং হাস্যস্পদ ছিলো। কথা শুরুই করতাম পেট এবং ঔষধ নিয়ে। পরে ঠেকে শিখে কৌশল পরিবর্তন করে সবার মধ্যে একটা গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করতে সক্ষম হলাম। শিখলাম কীভাবে কথার জাল তৈরি করে তাতে আঁটকে থাকা পোকার মত ট্যাবলেট যোগ করতে হয়। কিন্তু এত কিছু করেও কোন লাভ হচ্ছিলো না। সবাই বেশ হ্যা হু করলেও আসল সময়ে লবডঙ্কা। তাই বন্দি সেনাপতির মত ট্যাবলেট গুলি তার সমস্ত রণশক্তি গুটিয়ে রেখে মানিব্যাগের এক প্রান্তে অসহায় জীবন যাপন করতে লাগলো।

হতাশ আমি বাধ্য হয়ে নতুন পন্থা বেছে নিলাম। প্রচুর খেতে লাগলাম। বিয়ে বাড়িতে, জন্মদিনে, অথবা রেস্টুরেন্টে গলা পর্যন্ত খেয়ে এক মাসেই ওজন বাড়িয়ে ফেললাম দশ কেজি। কিন্তু কোনভাবেই আমার পাকস্থলীতে এর প্রভাব পড়লো না।

বাহিরে অতি মাত্রায় মশলা যুক্ত দামী খাবার খেতে খেতে দিনে দিনে আমার অর্থনৈতিক অবস্থার অবনতি ঘটতে লাগলো। খরচে কুলিয়ে উঠতে পারছিলাম না। এদিকে স্বাস্থ্যেরও অবনতি ঘটা শুরু হলো। বেশিক্ষণ হাঁটলেই হাঁফ ধরে যায়। নড়াচড়া করতেও কষ্ট হতে লাগলো। তাতে কী! এ বিপ্লব সত্যিকারের কর্মীদের অধিকার আদায়ের বিপ্লব। রাষ্ট্রের ভাঁড়ার ঘর থেকে ছয় টাকা হারিয়ে যেতে না দেয়ার বিপ্লব।

নীতি এবং আদর্শে অবিচল থাকলে একদিন কাঙ্খিত ফল পাওয়া যাবেই। বেচারা বস্তুটির ডেট এক্সপায়ার্ড হতে আর মাত্র ৭ দিন বাকি। এ অবস্থায় মহা আরাধ্য পেটের গোলযোগ দেখা দিলো আমার। পেটের ভেতরের প্রত্যঙ্গগুলোতে পতঙ্গেরা আবাস গড়ে কুটকুট করে কামড়াতে লাগলো। আমি পেট চেপে ধরে কোঁ কোঁ করতে লাগলাম। তবে মনে আমার খুশি। অচিরেই বিপ্লব সম্পাদিত হবে। প্রলেতারিয়েত, অসহায় ফ্লাজিল ট্যাবলেট গুলো খুঁজে পাবে আপন ঠিকানা। তাদের বংশধরেরা মহান নেতা হিসেবে আমাকে স্মরণ করবে দিনে-রাতে, আঁধার-প্রভাতে। প্রশান্তির হাসি ছড়িয়ে পড়লো মুখে। আমি একজন নেতা। আমি একজন দিকদিশারী। আমার হাতে রয়েছে আলোকবর্তিকা। আমার চলাচলে এখন থেকে শোভা পাবে অভিজাত রুচিশীলতার ছাপ। ভাবতে ভাবতে আমার মন প্রসন্ন হয়ে উঠলো।

কিন্তু হঠাৎ এক সুতীব্র মোচড়ে তালজ্ঞান, রুচি, আভিজাত্য হারিয়ে দৌড়ে টয়লেটের দিকে যেতে নিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়লাম। টেবিলের কোণার সাথে সংঘর্ষে আমার ঠোঁট কেটে গেলো।

অবশেষে রক্তপাত! এটাই বাকি ছিলো। রক্তপাতহীন বিপ্লব কখনই ফলপ্রসূ হয় না। আমি সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছি। ট্যাবলেট এবং টয়লেট দুটোই আমার থেকে মাত্র কয়েক মিটার দূরে। তারপরেই আমি পৌঁছে যাবো লক্ষ্যে। হয়ে উঠবো মহান এক কিংবদন্তী। চিৎকার করে অগ্রীম সাফল্য উদযাপন করতে থাকি আমি। শ্লোগান দিতে থাকি নীপিড়িত গোষ্ঠীর পক্ষে, মহান চেতনার হয়ে।

আমার চিৎকার মুহূর্তেই ছড়িয়ে গেলো বিশ্বব্রহ্মান্ডে, বিশাল গ্যালাক্সির এ প্রান্তে ও প্রান্তে। সচকিত হলো গ্রহ-নক্ষত্রেরা, জেগে উঠলো মহাজাগতিক প্রাণীরা। কেমন একটা উইয়ার্ড ফিলিংস হতে লাগলো আমার। যেন খুব কাছ থেকে কেউ আমাকে দেখছে। তার চোখে একটা ব্যঙ্গ মেশান দৃষ্টি। গভীর ভাবে আমাকে দেখছে। কোন কিছু না ভেবেই প্রাচীন পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে বহন করে চলা ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের অনুমানের জোরে ঝট করে তাকালাম জানালার দিকে। ও পাশে সেই নীলচে অবয়বের অদ্ভুত প্রাণীটা কে? খুব চেনা চেনা লাগছে!

নীলচে অবয়বের কিম্ভুত প্রাণীটা ধীরে ধীরে মানুষের বেশ নিচ্ছে।

শায়লা! সেই সে দিন মহাজাগতিক প্রাণী হয়ে উড়ে যাওয়া শায়লা আবার ফিরে এসেছে মানবী রূপে! কত কাছে! নৈকট্যের অবারিত নৈপুন্যে সময়টাকে কোন এক গুণী শিল্পী রাঙিয়ে দিতে লাগলেন রঙধনু রঙে। এত কাছে কি কোনদিন এসেছিলো সে? এত স্নিগ্ধ, এত মায়াময় সে! তার এ রূপ তো কখনো দেখি নি আগে! কিন্তু সে কিছু বলছে না কেন! কতক্ষণ আর এভাবে তাকিয়ে থাকবে! বিচ্ছিরি জানালাটা প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে গ্যাঁট হয়ে। তার শীতল এবং কৌতুহলী দৃষ্টির সামনে আমি খুব অস্বস্তিতে পড়ে গেলাম। শায়লা বিদ্রুপ মাখা স্বরে মেকি আগ্রহ দেখালো,

-কই! বিপ্লব সম্পন্ন করো! ওটা দেখার জন্যেই এত দূরের পথ থেকে ফিরে এসেছি।

এ কথা শুনে আবেগে বিহবল হয়ে বাংলা ছবির শক্তিমান নায়কের মত জানলার গ্রিল ভেঙে তাকে ঘরে নিয়ে এসে সিক্ত আলিঙ্গনের পর আনন্দ নৃত্যে মেতে ওঠাই স্বাভাবিক ছিলো। কিন্তু সভ্যতার অপরিনামদর্শী সুশিক্ষায় শিক্ষিত একজন ভদ্র নাগরিক হিসেবে পেট চেপে ধরে টয়লেটে দৌড় দেয়া ছাড়া আর কোন উপায় আমার ছিলো না।

কোন এক চতুর চোরাপথ দিয়ে ঘরে প্রবেশ করে শায়লা টয়লেটের দরোজা ধরে ধাক্কাতে লাগলো প্রবল ভাবে। দরোজায় করাঘাতের শব্দ ছাপিয়ে স্পষ্ট শুনতে পেলাম তার পেটের ভুটভাট শব্দ। আহ! অবশেষে!

মহাজাগতিক প্রাণী থেকে সে মানবীতে রূপান্তরিত হলো শেষমেষ! তারও টয়লেট চাপে, পেটের মধ্যে বায়বীয় পদার্থের বিক্রিয়া চলে!

টয়লেট থেকে বের হয়ে হ্যাঙ্গার থেকে প্যান্ট নামিয়ে দেখলাম, ট্যাবলেট গুলো ঠিকঠাক মতই আছে মানিব্যাগে। বিপ্লবের রাত্রিতে আপ্লুত হয়ে তার হাতে একটি ফ্লাজিল ট্যাবলেট ও এক গ্লাস পানি ধরিয়ে দিয়ে নিজেও একটা নিয়ে আমরা বিজয়োল্লাসে সেলিব্রেশন করলাম-

‘চিয়ার্স!’।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই অক্টোবর, ২০১৬ রাত ১১:১৮
২২টি মন্তব্য ২২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বরিষ ধরা-মাঝে শান্তির বারি

লিখেছেন বিষাদ সময়, ০৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:১৬





মাসের আধিক কাল ধরে দাবদাহে মানব প্রাণ ওষ্ঠাগত। সেই যে অগ্নি স্নানে ধরা শুচি হওয়া শুরু হলো, তো হলোই। ধরা ম্লান হয়ে, শুষ্ক হয়, মুমূর্ষ হয়ে গেল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=নীল আকাশের প্রান্ত ছুঁয়ে-৭ (আকাশ ভালোবেসে)=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:১৯

০১।



=আকাশের মন খারাপ আজ, অথচ ফুলেরা হাসে=
আকাশের মন খারাপ, মেঘ কাজল চোখ তার,
কেঁদে দিলেই লেপ্টে যাবে চোখের কাজল,
আকাশের বুকে বিষাদের ছাউনি,
ধ্বস নামলেই ডুবে যাবে মাটি!
================================================
অনেক দিন পর আকাশের ছবি নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

পানি জলে ধর্ম দ্বন্দ

লিখেছেন প্রামানিক, ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৫২


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

জল পানিতে দ্বন্দ লেগে
ভাগ হলোরে বঙ্গ দেশ
এপার ওপার দুই পারেতে
বাঙালিদের জীবন শেষ।

পানি বললে জাত থাকে না
ঈমান থাকে না জলে
এইটা নিয়েই দুই বাংলাতে
রেষারেষি চলে।

জল বললে কয় নাউযুবিল্লাহ
পানি বললে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সমস্যা মিয়ার সমস্যা

লিখেছেন রিয়াদ( শেষ রাতের আঁধার ), ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৭

সমস্যা মিয়ার সিঙ্গারা সমুচার দোকানে প্রতিদিন আমরা এসে জমায়েত হই, যখন বিকালের বিষণ্ন রোদ গড়িয়ে গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে, সন্ধ্যা পেরিয়ে আকাশের রঙিন আলোর আভা মিলিয়ে যেতে শুরু করে। সন্ধ্যা সাড়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

এই মুহূর্তে তারেক জিয়ার দরকার নিজেকে আরও উন্মুক্ত করে দেওয়া।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৬ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:২৬


তারেক জিয়া ও বিএনপির নেতৃত্ব নিয়ে আমি ব্লগে অনেকবারই পোস্ট দিয়েছি এবং বিএনপি'র নেতৃত্ব সংকটের কথা খুব স্পষ্টভাবে দেখিয়েছি ও বলেছি। এটার জন্য বিএনপিকে সমর্থন করে কিংবা বিএনপি'র প্রতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×