পরম করুণাময় ও দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু করছি
আল্লহর শাস্তি থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য প্রত্যেক মুসলিমের তার দৃষ্টিকে সংযত রাখা একটি অত্যন্ত জরুরী বিষয়। প্রতিটি বিশ্বাসী মুসলমানের উচিত নিজের দৃষ্টির সংরক্ষণের জন্য ও এই দুর্বলতা কাটিয়ে উঠার জন্য বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নেওয়া ও এ বিষয়ে কোন রকম ত্রুটি না করা।
দৃষ্টি অবনত রাখার উপায়ের ব্যাপারে প্রখ্যাত আলেম শেইখ সালিহ আল মুনাজ্জিদ বলেনঃ
ইসলামী শরিয়ত এমন সমস্ত পথকে নিষিদ্ধ করে যা মানুষকে অনৈতিকতার দিকে নিয়ে যেতে পারে; তার মধ্যে একট হল গায়ের মাহরাম বা বেগানা নারীর দিকে তাকানো। মাহরাম হল বিয়ের জন্য নিষিদ্ধ এমন আত্মীয়, যেমন পুরুষদের জন্য মা, বোন, মেয়ে, আপন খালা, ফুফু, শাশুড়ি ইত্যাদি। নারীদের জন্য বাবা, ভাই, ছেলে, আপন চাচা, মামা, শ্বশুর ইত্যাদি। সুতরাং গায়ের মাহরাম হল এমন সমস্ত মানুষ যারা মাহরাম নন(অর্থাৎ, যাদের সাথে বিবাহ বন্ধন বৈধ)। মহান আল্লাহ বলেন,
“মুমিনদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টি নত রাখে(নিষিদ্ধ জিনিস দেখা হতে) এবং তাদের যৌনাঙ্গর হেফাযত করে। এতে তাদের জন্য খুব পবিত্রতা আছে। নিশ্চয় তারা যা করে আল্লাহ তা অবহিত আছেন।”[সুরা নুরঃ৩০]
এই আয়াত সম্পর্কে ইমাম ইবনে কাসীর বলেছেনঃ আল্লাহ তা’আলার নির্দেশ হল যেগুলোর প্রতি দৃষ্টিপাত করা হারাম করা হয়েছে বান্দা যেন সেগুলোর প্রতি দৃষ্টিপাত না করে। হারাম জিনিস হতে চক্ষু নিছু করে নেয়। যদি আকস্মিকভাবে দৃষ্টি পড়েই যায় তবে দ্বিতীয়বার যেন দৃষ্টি না ফেলে।
জারীর ইবনে আব্দুল্লাহ(রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ(সাঃ)কে হঠাৎ দৃষ্টি পড়ে যাওয়ার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেনঃ ‘সাথে সাথেই দৃষ্টি সরিয়ে নেবে।’(মুসলিম ৫৩৭২)।
দৃষ্টি নিম্নমুখী করা, এদিক ওদিক দেখতে শুরু না করা, আল্লাহর হারামকৃত জিনিসগুলোকে না দেখা এই আয়াতের উদ্দেশ্য।
হযরত বুরাইদা(রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসুল(সাঃ) হযরত আলী(রাঃ) কে বলেন-‘হে আলী! দৃষ্টির উপর দৃষ্টি ফেলো না। হঠাৎ যে দৃষ্টি পড়ে ওটা তোমার জন্য ক্ষমার্হ, কিন্তু পরবর্তী দৃষ্টি তোমার জন্য ক্ষ্মার যোগ্য নয়।’(আবু দাউদঃ২১৪৪)
ইমাম নববী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘হঠাৎ দৃষ্টি’ বলতে বোঝায় যখন কোন ব্যাক্তির চোখ অনিচ্ছাকৃতভাবে কোন বেগানা নারীর উপর পড়ে যায়। এভাবে হঠাৎ করে চোখ পড়ে যাওয়াতে কোন গুনাহ নেই, তবে সাথে সাথে তার দৃষ্টি অন্য দিকে সরিয়ে নিতে হবে। কিন্তু যদি সে এর পরও দেখা বন্ধ না করে, তাহলে সে এই হাদিস মোতাবেক গুনাহগার হয়ে যাবে।
পুরুষরা তাদের দৃষ্টি অবনত রাখবে, সব অবস্থায় নিষিদ্ধ জিনিস দেখা থেকে নিজেকে বিরত রাখবে, যদি না একান্তই কোন বৈধ কারণ থাকে, যেমন- কোন সাক্ষ্য দেওয়া, চিকিৎসা, বিয়ের প্রস্তাব, আর্থিক লেনদেন এর সাথে সম্পর্কিত কোন বিষয় ইত্যাদি। এই সমস্ত ক্ষেত্রেও ঠিক ততটুকুই দেখা বৈধ ঠিক যতটুকু দরকার, এর বেশী নয়।
দৃষ্টি সংযত রাখার অনেক উপায় আছে। আর আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করিযেন আল্লাহ আমাদেরসাহায্য করেন।
১| সবসময় ম্নে রাখা যে আল্লাহ আপনাকে দেখছেন, আপনি যেখানেই যান আল্লাহ আপনার সঙ্গেই আছেন(তাঁর সর্বময় জ্ঞানের মাধ্যমে)। হতে পারে আপনি লুকিয়ে আপনার পাশের জনকে দেখছেন যা সে জানে না, কিন্তু আল্লাহ তা জানছেন।
“চোখের চুরি এবং অন্তরের গোপন বিষয় তিনি জানেন।”(সুরা গাফিরঃ১৯)
২| আল্লাহর কাছে সাহায্য চাওয়া, মিনতি সহকারে তাঁকে ডাকা। আল্লাহ বলেন-
“তোমাদের পালনকর্তা বলেন, তোমরা আমাকে ডাক, আমি সাড়া দেব।” (সুরা গাফিরঃ৬০)
৩| সবসময় মনে রাখবেন, আপনি যা যা নেয়ামত উপভোগ করছেন তার সবই আল্লাহর তরফ থেকে পেয়েছেন, আর এ জন্যে আপনার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা উচিত। আল্লাহর দেওয়া দৃষ্টির নেয়ামতের কৃতজ্ঞতা জানাতে হলে আপনাকে আপনার চোখ দুটিকে সে সব জিনিস দেখা থেকে বিরত রাখতে হবে যা যা আল্লাহ নিষেধ করেছেন। ভাল কাজের প্রতিফল কি ভাল ছাড়া কিছু হতে পারে?
“তোমাদের কাছে যে সমস্ত নেয়ামত আছে, তা আল্লাহরই পক্ষ থেকে।”(সুরা নামলঃ৫৩)
৪| নিজের সাথে সংগ্রাম করা, দৃষ্টি নত রাখার জন্য নিজে নিজে অভ্যাস করার চেষ্টা করা এবং এ কাজে ধৈর্যশীল হওয়া ও হাল ছেড়ে না দেওয়া। আল্লাহ বলেন-
“যারা আমার পথে সাধনায় আত্মনিয়োগ করে, আমি অবশ্যই তাদেরকে আমার পথে পরিচালিত করব। নিশ্চয় আল্লাহ সৎকর্মপরায়নদের সাথে আছেন।”(সুরা আনকাবুত” ৬৯)
৫| এমন সব স্থান এড়িয়ে চলার চেষ্টা করা যেখানে নিষিদ্ধ দৃষ্টির প্রলোভনে পড়ার আশঙ্কা আছে বলে মনে হয়। যেমন, মার্কেট, বিপনী বিতান, পর্দাহীন দাওয়াতের আসর, রাস্তা ঘাটে অলস আড্ডা, ইন্টারনেটে অহেতুক ঘাটাঘাটি ইত্যাদি।রাসুল(সাঃ) বলেছেন-
“তোমরা রাস্তার উপর বসা ছেড়ে দাও। লোকজন বলল, এ ছাড়া আমাদের কোন উপায় নেই। কেননা, এটাই আমাদের উঠাবসার জায়গা আর এখানেই আমরা কথাবার্তা বলে থাকি। তিনি বললেন, “যদি তোমাদের সেখানে বসতেই হয়, তবে রাস্তার হক আদায় করবে।” তারা বলল, রাস্তার হক কি? তিনি(সঃ) বললেন, ‘দৃষ্টি অবনমিত রাখ, কষ্ট দেওয়া হতে বিরত থাক, সালামের জবাব দেওয়া, সৎকাজে আদেশ দেওয়া এবং অসৎকাজে নিষেধ করা’।”(বুখারীঃ ২৩০৩; ইসলামী ফাউন্ডেশন)
ইন্টারনেট ব্যাবহারের ক্ষেত্রেও এই হাদিসটি প্রযোজ্য। এখানেও নিজের দৃষ্টিকে (নিষিদ্ধ সাইট, অন্যের প্রোফাইল অকারণে দেখার মাধ্যমে) যত্রতত্র নিক্ষেপ করা, কাউকে কটাক্ষ করে মন্তব্য করা, অর্থহীন আলোচনায় লিপ্ত হওয়া অনুমোদনযোগ্য নয়।
৬| সবসময় এটা মনে রাখা যে, পরিস্থিত যেমনই হোক, নিষিদ্ধের প্রতি আকর্ষণ বা প্রলোভন যতই বড় হোক, আপনার মনের ভেতরে যতই আবেগের তাড়না আসুক, এই ব্যাপারে আপনার আর কোন পথ খোলা নেই। আপনাকে সব জায়গায়, সব সময় নিষিদ্ধ জিনিস হতে দৃষ্টি সংযত করতেই হবে। আশেপাশের কলুষিত পরিবেশের অজুহাত দিয়ে বা আপনি প্রলোভনের শিকার হয়েছেন এসব কথা বলে নিজের দোষের স্বপক্ষে যক্তি দেখানোর কোন অবকাশ নেই।
৭| বেশী বেশী করে নফল ইবাদত করা, কারন নিয়মিত ফরজ ইবাদতের সাথে সাথে নফল ইবাদত করেনিজের শারীরিক কার্যাবলিকে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হয়। হাদিসে কুদসিতে আল্লাহ বলেছেন,
“…আমার বান্দা সর্বদা নফল ইবাদত দ্বারা আমার নৈকট্য অর্জন করতে থাকবে। এমন কি অবশেষে আমি তাকে আমার এমন প্রিয়পাত্র বানিয়ে নেই যে, আমিই তার কান হয়ে যাই যা দিয়ে সে শোনে(অর্থাৎ আল্লাহর ইচ্ছা অনুযায়ী শোনে)। আমিই তার চোখ হয়ে যাই যা দিয়ে সে সবকিছু দেখে(অর্থাৎ আল্লাহর ইচ্ছা অনুযায়ী দেখে)। আমিই তার হাত হয়ে যাই যা দিয়ে সে ধরে(অর্থাৎ আল্লাহর ইচ্ছা অনুযায়ী হাত দিয়ে কাজ করে)। আমি তার পা হয়ে যাই যা দিয়ে সে চলে(অর্থাৎ আল্লাহর ইচ্ছা অনুযায়ী চলে)। সে যদি আমার কাছে কোন কিছু চায়, তবে আমি নিশ্চয়ই তাকে তা দান করি। আর যদি সে আমার কাছে আশ্রয় চায়, তবে অবশ্যই আমি তাকে আশ্রয় দেই।…”[সহীহ বুখারী ৬০৫৮]
৮| এটা মনে রাখা যে আমরা যে জমীনের উপর গুনাহ করি, সেই জমীন আমদের বিরুদ্ধে আমাদের গুনাহের সাক্ষী দেবে। আল্লাহ বলেনঃ
“সেদিন সে(পৃথিবী) তার বৃত্তান্ত বর্ণনা করবে।”(সুরা জিলজালঃ ৪)
৯| যে আয়াতে দৃষ্টিকে এদিক সেদিক অযথা নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি নিক্ষেপ করতে নিষেধ করে তা মনে করা। যেমনঃ
“মুমিনদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টি নত রাখে(নিষিদ্ধ জিনিস দেখা হতে) এবং তাদের যৌনাঙ্গর হেফাযত করে। এতে তাদের জন্য খুব পবিত্রতা আছে। নিশ্চয় তারা যা করে আল্লাহ তা অবহিত আছেন।”[সুরা নুরঃ৩০]
১০| অপ্রয়োজনীয় এদিক সেদিক দৃষ্টিপাত করা থেকে বিরত থাকা, শুধুমাত্র যা দেখা প্রয়োজন সেদিকে তাকানো; বিশেষ করে এমন জায়গায় অযথা দৃষ্টি না ফেরানো যেখানে এমন প্রলোভনের আশঙ্কা থাকে যা থেকে সহজে মুক্ত হওয়া কঠিন। হতে পারে সেটা আপনার আশেপাশের দৃশ্যে, বা কোন ম্যাগাজিনে, টিভিতে, অথবা ইন্টারনেটে।
১১| বিয়ে হল একটি কার্যকরী প্রতিকার। নবী মুহাম্মাদ(সাঃ) বলেছেন-
“হে যুব সম্প্রপদায়! তোমাদের মধ্যে যারা বিয়ে করার সামর্থ রাখে তারা যেন বিয়ে করে। কেননা, বিবাহ তার দৃষ্টিকেসংযত রাখে এবং যৌনতাকে সংযমী করে; এবং যাদের বিয়ে করার সামর্থ নেই, সে যেন রোজা পালন করে। কেননা, রোজা তার যৌনতাকে দমন করবে।”(সহীহ বুখারী ৪৬৯৬, ইফা)
১২| বেহেশতের হুরদের কথা মনে করা; আল্লাহ আপনাকে যা নিষেধ করেছেন তা দেখা হতে নিজেকে বিরত রাখতে উৎসাহিত করবে, যাতে আল্লাহর এই নেয়ামত পাওয়ার আশা করতে পারেন। রাসুল(সাঃ) বলেছেন-
‘জান্নাতের কোন নারী যদি দুনিয়ার প্রতি দৃষ্টিপাত করে তবে সমস্ত দুনিয়া আলোকিত ও মোহিত হয়ে যাবে। জানাতী নারীর নাসীফ(ওড়না) দুনিয়ার সবকিছুর চেয়ে উত্তম।’(সহীহ বুখারী ৬১২১; ইফা)
১৩| যার প্রতি আকৃষ্ট বোধ করছেন তার ত্রুটি সম্পর্কে চিন্তা করা…
১৪| যত্রতত্র দৃষ্টি নিক্ষেপের কুফল, এর শাস্তি ও তার যন্ত্রণার কথা চিন্তা করা।
১৫| দৃষ্টি অবনত রাখার সুফল সম্পর্কে চিন্তা করা।
১৬| মানুষের সঙ্গে আলোচনার আসরে, জনসমাবেশে এই প্রসঙ্গ উত্থাপন করা, এর কুফল সম্পর্কে ব্যাখ্যা করা।
১৭| যেসব পোশাকে, চালচলনে, কথাবার্তায় সৌন্দর্য প্রদর্শিত হয় ও অন্যকে আকৃষ্ট করে এমন সব কিছু পরিহার করতে নিজের পরিবার ও আত্মীয়দেরকে উপদেশ দেওয়া।
১৮| যেসব কুচিন্তা ও শয়তানের ওয়াসওয়াসা মনে জাগে তা আপনাকে কাবু করে সেই অনুযায়ী কাজে পরিণত করার আগেই সাথে সাথে তা ঝেরে ফেলা। যে প্রথম দৃষ্টিতেই নিজেকে সংযত করে নেয় সে অনেক সমস্যা থেকে নিজেক বাঁচাতে পারে; কিন্তু যে নিজেকে এ কাজেই লিপ্ত রাখে সে কখনও দৃড়তার সাথে মন থেকে এর কুপ্রভাব দূর করতে পারে না।
১৯| মৃত্যুর সময় নিজের কর্ম নিয়ে গভীর অনুশোচনার কথা জীবন থাকতেই চিন্তা করা ও এই করুণ পরিণতির কথা চিন্তা করে ভীত হওয়া।
২০| সৎসঙ্গে থাকা। কারণ মানুষ যাদের সাথে চলাফেরা করে তাদের বৈশিষ্ট্য দিয়েই প্রভাবিত হয়। আর তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সহচরের অনুসরণ করে; এবং সবচেয়ে কাছের বন্ধুই মানুষকে তার নিজের পথে টেনে নেয়। আপনি যদি এমন বন্ধুদের সঙ্গে থাকেন যাদের দৈনন্দিন অভ্যাসই হল অন্য নারীদের নিয়ে আলোচনা করা, হারাম দৃষ্টি নিক্ষেপ করা, তাহলে নিশ্চিত ভাবেই আপনার জন্য দৃষ্টি সংযত রাখা দুরুহ। অন্যদিকে আপনি যদি এমন মানুষের সঙ্গে থাকেন যিনি এই বিষয়ে সদা সতর্ক, স্বাভাবিকভাবেই তখন আপনি ইচ্ছা থাকলেও এই হারাম কাজ প্রকাশ্যে করতে সংকোচ বোধ করবেন। অতএব সঙ্গ নির্বাচনে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন ক্রুন, নিজের স্বার্থেই।
সৌজন্যেঃ http://www.islamqa.com