রোদেলার প্রকাশক যখন থেকে প্রকাশক হওয়ার চেষ্টা করছে, তখন থেকে তাকে চিনি। তার প্রকাশনীর নাম কী হবে সেই আলোচনা যখন হতো, তখন থেকে। এই বইটা সে কেন বের করেছে, তাও খুব ভালভাবে জানি। এমনকি আমি এটাও জানি, ধর্ম নিয়ে বিতর্কিত একটা বই প্রকাশ করার সুবিধা কী- এই বিষয়টা সে কতদিন আগে জেনেছে এবং কোন্ মারফত জেনেছে। সহজ কথা যায় না বলা সহজে।
রিয়াজ কোন নাস্তিক নয়। ও শুধু ব্যবসায়ী। একবার খেতে বসেছি, কোন্ হোটেলের ইজারা কম, ওটা যেন দখল করা যায়, সে নিয়েও কথা বলছিল। এরা মুক্তজ্ঞানের ধারক বাহক নয়। মুক্তমন শব্দটা প্রকাশনী দেয়ার আগে কোনদিন রিয়াজের মত মানুষেরা শুনেছে কিনা সন্দেহ।
এরা যে কোন্ গ্রেডের মানুষ, কল্পনা করাও কষ্টকর। প্রমিত ভাষায় কথাও বলতে জানে না, ভদ্রভাবে আলাপও করতে জানে না, কখনো নিজের প্রকাশনীর বই পড়েছে কিনা তাও সন্দেহ। এ মুক্তমনের ধারক বাহক কোন্ ক্লাসের পাবলিক, সেটা বোঝা সহজ খোদ লেখকদের সাথে তার আদান প্রদানের কথা শুনলে।
লেখকদের কাছ থেকে সে পারলে দুই হাজার টাকা নেয়, 'ট্রেসিং' মারফত।
অনুবাদকদের যে কী জঘন্য পরিমাণ অর্থ দেয়া হয় বইয়ের জন্য, তা শুনলে আতকে উঠতে হয়। সেই জঘন্য পরিমাণ অর্থ, যা চুক্তি করা হয়েছে, সেই চুক্তির অর্থ'র তিনভাগের একভাগ দেয়ার পর এরা অনুবাদকদের নাম্বার ব্লক করে রাখে। যদি বাকী আট হাজার টাকা দিতে হয়! যদি পনেরো হাজার দিতে হয়!
কেটে দেয় কাগজওয়ালার কাছ থেকে বাকীতে কাগজ নেয়ার কারণে ফোন দিলে তাদের নাম্বারও।
দেখা যাবে আলী দস্তির এই বইয়ের অনুবাদকও 'পুরো' টাকা পায়নি।
আমরা গাল ফুলিয়ে বলি, বাংলাদেশে বইয়ের কালচার নেই। ছ্যাচোড়ের হাতে বইয়ের কালচারের দায় দিয়ে রেখেছি- সেই খবর নেই।
দেখলাম, বুকে হাত ভাঁজ করে অনেক 'লেখক' 'বুদ্ধিজীবি' ব্যানার নিয়ে দাঁড়িয়েছে। রোদেলা খুলে দাও। হায়রে, তোরা যদি শুধু তোর অধিকার নষ্ট করার কারণেও দাঁড়াতি! তোর পেটে এই লোকগুলো চোখ বুজে লাথি মারে যদি সে কারণেও দাঁড়াতি! কিন্তু না, দাঁড়াবে ধর্ম ইসুতে। ধর্মকে কী করে হেয় করা যায়, যারা হেয় করে তারা চোর হোক, বাটপার হোক, ছ্যাচোড় হোক, প্রতারক হোক, এমনকি খোদ তার সাথেও সব ধরনের বাজে কাজ করে থাকুক- তার পক্ষ নিয়ে দাঁড়াতে হবে।
কেননা, যে দাঁড়াচ্ছে, কমবেশি তার ইসুটাও ওই একই রকম।
নজরুলের মৃততুক্ষুধা আজো যায়নি। এখনো আছে। এখনো পুওরের হার্টের সবচে কাছের স্থান হল মাউথ।
ওর মত মানুষ লক্ষ লক্ষ আছে বাংলাদেশে। কোন একটা বিতর্ক তুলতে পারলে দশ হাজার কপি বিক্রি হবে বই। হাতে দশ লাখ টাকা আসবে। ব্যস। ওই দশ লাখ টাকাই। এইটুকুই। শুধু এইটুকুর জন্য এতকিছু।
বিষয়টা মোটেও অবিশ্বাস্য নয়। খুবই সিম্পল। আমরা দালাল দালাল বলে চিৎকার করি, দালাল কী করে হয় সেটা রিয়াজের মত বস্তু দেখলে বোঝা সম্ভব। কেউ দালাল হয় স্রেফ এবং স্রেফ টাকার জন্য। তাও হাজার হাজার কোটি টাকা না, মাত্র দশ লাখের আশায়। মাত্র এক লাখের আশায়। মাত্র দশ হাজারের আশায়। কেউ ক্ষমতার জন্য। দেশের প্রেসিডেন্ট প্রধানমন্ত্রী নয়, গলির প্রভাব রক্ষার জন্যই দালাল বনে যায়। ব্লগে নাম করার জন্য বনে যায়। কেউ স্রেফ নামের জন্য, কেউ স্রেফ লাইকের জন্য, কেউ নিজেকে ভিন্ন হিসাবে উপস্থাপনের জন্য দালাল হয়।
রিয়াজ এবং ওর মত কিছু ব্যবসায়ী ধর্মকে তোয়াক্কা করে না, গণমানুষের কষ্টকে তোয়াক্কা করে না, মানুষের ক্ষোভকে তোয়াক্কা করে না। ওরা শুধু ব্যবসাকে তোয়াক্কা করে। ওর মত কিছু কীটের মাথায় যদি এই আইডিয়া দেয়া যায়, নিজের মায়ের ন্যাংটা ছবি দিয়ে চাররঙা বই বের কর, প্রকাশক নিজেই এটা করেছে- এটা মানুষ জানলে বই কিনবে, ও সেই কাজই করবে।
রিয়াজ যে মোটেও নাস্তিক নয়, সে যে মোটেও ধর্মবিরোধী নয়, সে যে মোটেও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিদ্বেষী নয়, এটা আমাদের মত গুটি কয়েক মানুষ ছাড়া অন্যরা জানে না।
লাখ দশেক টাকা পাবার লোভে মানুষ যখন এই কাজ করতে পারে, তখন গণমানুষের ধর্ম নিয়ে যারা বিকৃতি করে বেড়ায়, তাদের বিকৃতির উৎস বোঝা মোটেও দুষ্কর নয়। বরং এটা প্রমাণিত সত্য।
ওদেরকে ধর্মের বাণী শুনিয়ে কোন লাভ নাই, সমাজে কোটি মানুষ কষ্ট পাবে তা বলেও কোন লাভ নাই, হানাহানি হবে তা বলেও কোন লাভ নাই।
ওর মত কীট পত্রিকা'র মালিক আছে। প্রকাশনীর মালিক আছে। ফেসবুক প্রোফাইলেরও 'মালিক' আছে। ব্লগ অ্যাকাউন্টের 'মালিক' আছে। ওরা যেহেতু শুধু ব্যবসা, শুধু পয়সার জন্য কাজটা করে, ওদের জবাব দেয়ার একমাত্র পথ হল, পয়সার আনাগোনা বন্ধ করে দেয়া। পয়সার পথে জুতা মারা। কারণ ওদের হৃদয় পয়সা, ভাবনা পয়সা, শোয়া-ওঠা-বসাও পয়সার সাথে।
পরম সাধুবাদ জানাই বাংলা একাডেমি ও পুস্তক প্রকাশক বিক্রেতা সংগঠনের প্রতি। প্রথম প্রতিষ্ঠান ওর স্টল বাতিল করেছে, দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠান ওর সদস্যপদ বাতিল করেছে।
ও তো থেমে গেল। ওর পর যে শুধু এক বা দশ লাখ টাকার জন্য ধর্ম বেচতে আসতো, সে এই শিক্ষা পেয়ে গেল যে, পয়সা পাওয়া যাবে না। আর পয়সা পাবার পথ যদি বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে মক্কার ওই ব্যবসায়ী প্রভাবশালীদের মত এরাও ধর্ম অবমাননা বন্ধ করে দিবে। কোলে উঠে নাচার জন্য যারা ধর্ম অবমাননা করে, তাদের শুধু কোল থেকে ফেলে দিলেই হবে। বিদেশে যাবার জন্য যারা ধর্ম অবমাননা করে, তাদের বিদেশের পথ রুদ্ধ করে দিলেই হবে।
এদের পশুত্ব এমনি দিকবিদিকশূণ্য যে, মানুষের কষ্ট অথবা ন্যায় অন্যায় কোনকিছুই এদের কাছে বিষয় নয়, বিষয় মাত্র একটা, পয়সা। লাইক। নাম। ক্ষমতা। জীবনেও ন্যায়বোধ এদের আক্রান্ত করবে না, আর ন্যায়বোধ যাকে কখনোই আক্রান্ত করে না, শাস্তি তো তারই জন্য।
গ্রেপ্তার এবং জেলের সাজা চাওয়াটা খুব বড় কিছু নয়। কিন্তু তা হোক না হোক, এটুকু হয়েছে, কৃতজ্ঞতা অপরিসীম।