somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শিক্ষকের নির্যাতনে কলেজ ছাত্রের আত্মহত্যা

২৩ শে অক্টোবর, ২০১৪ রাত ৮:০৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


ভোরের কাগজ > বৃহস্পতিবার, ২৩ অক্টোবর ২০১৪
শিক্ষকের নির্যাতনে কলেজ ছাত্রের আত্মহত্যা
মো. রহমত উল্লাহ
“রাজধানীর ভাটারা এলাকায় হোস্টেল সুপারের নির্যাতন সইতে না পেরে জাহিদুল ইসলাম (১৭) নামে ক্যামব্রিয়ান কলেজের এক ছাত্র আত্মহত্যা করেছে। শুক্রবার ভোরে ওই ছাত্রের ঝুলন্ত লাশ উদ্ধারের পর ময়নাতদন্তের জন্য তা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়। এ ঘটনায় অভিযুক্ত দুই আবাসিক শিক্ষক ওমর ফারুক ও আশরাফ আলীকে আটক করেছে পুলিশ।” [যাযাদি রিপোর্ট, ১৮.১০.২০১৪]
‘শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রীদের শারীরিক ও মানসিক শাস্তি রহিত করা সংক্রান্ত নীতিমালা-২০১১’ শিরোনামে জারিকৃত আদেশের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে শারীরিক শাস্তি বলতে বোঝাবে যে কোনো ধরনের দৈহিক আঘাত করা। যেমন- শিক্ষার্থীকে হাত-পা বা কোনো কিছু দিয়ে আঘাত বা বেত্রাঘাত, চক বা ডাস্টার জাতীয় বস্তু ছুড়ে মারা, আছাড় দেয়া ও চিমটি কাটা, কামড় দেয়া, চুল টানা বা চুল কেটে দেয়া, হাতের আঙুলের ফাঁকে পেন্সিল চাপা দিয়ে মোচড় দেয়া, ঘাড় ধাক্কা দেয়া, কান টানা বা ওঠা-বসা করানো, চেয়ার-টেবিল বা কোনো কিছুর নিচে মাথা দিয়ে দাঁড় করানো বা হাঁটু গেড়ে দাঁড় করে রাখা, রোদে দাঁড় করিয়ে বা শুইয়ে রাখা কিংবা সূর্যের দিকে মুখ করে দাঁড় করানো এবং ছাত্রছাত্রীদের দিয়ে এমন কোনো কাজ করানো। আর মানসিক শাস্তি বলতে বোঝাবে- শ্রেণীকক্ষে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে এমন কোনো মন্তব্য করা যেমন- মা-বাবা, বংশ পরিচয়, গোত্র, বর্ণ ও ধর্ম সম্পর্কে অশালীন মন্তব্য করা, অশোভন অঙ্গভঙ্গি করা যা শিক্ষার্থীদের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। এই নীতিমালা সরকারি ও বেসরকারি প্রাথমিক, নিম্নমাধ্যমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কলেজ, উচ্চমাধ্যমিক কলেজ, কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মাদ্রাসাসহ (আলিম পর্যন্ত) অন্য সব ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রযোজ্য হবে। নীতিমালায় বলা হয়, কোনো শিক্ষক-শিক্ষিকা কিংবা শিক্ষা পেশায় নিয়োজিত কোনো ব্যক্তি অথবা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারী পাঠদানকালে কিংবা অন্য কোনো সময় ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে উল্লিখিত শাস্তিযোগ্য আচরণ না করার নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। এসব অপরাধের সঙ্গে প্রতক্ষ্য বা পরোক্ষভাবে সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলে, তা ১৯৭৯ সালের সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধিমালার পরিপন্থী হবে এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হবে। এসব অভিযোগের জন্য অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা ১৯৮৫-এর আওতায় অসদাচরণের অভিযোগে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে।
এতো কিছুর পরও বাস্তবে কিন্তু থেমে নেই শিক্ষার্থী নির্যাতন। তদুপরি যৌন হয়রানি/নির্যাতনের খবরও অনেক বেশি প্রকাশিত হচ্ছে ইদানীং। আমাদের দেশে শিক্ষার্থী নির্যাতিত হওয়ার কয়েকটি লক্ষণীয় কারণ হচ্ছে-
১. শিক্ষা গ্রহণে বা উপদেশ পালনে বাধ্য করার জন্য শাসন করার নামে শারীরিক ও মানসিক শাস্তি প্রদান থেকে শিক্ষার্থীদের সুরার উপযোগী সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা অতীতে ছিল না এবং বর্তমানে থাকলেও তার বাস্তবায়ন নেই অনেক ক্ষেত্রেই।
২. বিভিন্ন সময় শিক্ষার্থীদের অমানবিক শাস্তি প্রদানের কারণে মারাত্মক আহত/নিহত হওয়ার খবর পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু নিষ্পাপ শিশু শিক্ষার্থীদের এরূপ কঠিন শাস্তি প্রদানকারী শিক্ষকের কোনো দৃষ্টান্তমূলক সাজা প্রদান করা হয়নি বা সাজা প্রদানের খবর সেভাবে পত্রপত্রিকা-টেলিভিশনে প্রচার করা হয়নি।
৩. যেসব প্রতিষ্ঠান বা বিভাগ এসব শাস্তি রোধ করার দায়িত্বে নিয়োজিত, তারা সক্রিয়ভাবে দায়িত্ব পালন করছে না বা করতে পারছে না। কারণ বিচারের দাবিতে বাদীরা আদালতে আসে না বা আসতে পারে না। তদুপরি বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো স্বেচ্ছায় এগিয়ে আসার মতো পর্যাপ্ত নিরপেক্ষতা নেই আমাদের আইন প্রয়োগকারী সংস্থার। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা বিধিতেও এ বিষয়ে সুস্পষ্ট কোনো নির্দেশনা আগে ছিল না এবং বর্তমানে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে থেকে থাকলেও বাস্তবে তা কার্যকর নেই।
৪. শিক্ষার্থীদের প্রতি অমানবিক আচরণকে সংবিধানে বর্ণিত মৌলিক অধিকারহরণ ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে প্রকাশ্যে কোনো সরকারি ঘোষণা আগে ছিল না এবং বর্তমানে থাকলেও তার বাস্তবায়ন লক্ষণীয় নয়। এবং এই অপরাধ দমনে গণসচেতনতা সৃষ্টির জন্যও সরকারিভাবে জোরালো তৎপরতা নেই।
এসবের পাশাপাশি আরো একটি বড় কারণ হচ্ছে ‘শিশু মনোবিজ্ঞান’ সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের, বিশেষ করে শিক্ষক, প্রশিক্ষক ও অভিভাবকদের তেমন কোনো শিক্ষা। তাই তারা মনে করেন শাস্তি প্রদানই শিক্ষার্থীদের মনোযোগ আকর্ষণের ও নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার। তারা এটিও মনে করেন, শিক্ষা প্রদানের দায়িত্ব পাওয়া মানেই শাস্তি প্রদানের অধিকার পাওয়া। এই ভ্রান্ত ধারণার কারণেই শিক্ষার্থীদের ওপর নেমে আসে অধিকাংশ অমানবিক ও নিষ্ঠুর নির্যাতন। যার মাত্র দুচারটি ছাড়া সবাই থেকে যায় আমাদের জানার বাইরে।
প্রতিদিন হাজারো শিশু শিক্ষার্থী নিজ গৃহেও নির্যাতিত হয় তাদের পিতা, মাতা ও গৃহ শিক্ষকদের দ্বারা। প্রি-ক্যাডেট স্কুল, ক্যাডেট কলেজ ও কওমি মাদ্রাসাসহ যেসব আবাসিক/অনাবাসিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ধর্মীয় ও সামরিক ভাবধারায় পরিচালিত সেখানে নির্যাতনের মাত্রা তুলনামূলকভাবে বেশি এবং ধরন বিচিত্র। শিক্ষার্থীরা শ্রেণীকক্ষে, শিক্ষক কক্ষে, প্রশিক্ষণ মাঠে, প্রশিক্ষক কক্ষে, আবাস কক্ষে; এক কথায় সর্বত্রই প্রতিনিয়ত নির্যাতিত হয় শিক্ষক দ্বারা। শুধু লেখাপড়ার জন্যই নয়; চলতে-ফিরতে, উঠতে-বসতে, নাইতে-খাইতে, জাগতে-ঘুমাতে এমনকি হাসতে-কাঁদতেও নিয়মের সামান্য ব্যত্যয় ঘটলে ভাগ্যে জুটতে পারে কঠোর শাস্তি। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আদেশে যা কিছু নিষেধ করা হয়েছে তা তো করা হয়ই; তারচেয়েও বেশি কিছু করা হয় কখনো কখনো কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে এমন কথাও শোনা যায়। এসব নির্যাতনের প্রতিবাদ তো দূরের কথা; জানাজানি হওয়ার মতো জোরে কান্নাকাটি করলেও বেড়ে যায় নির্যাতনের মাত্রা! তাই সামান্য সুযোগ পেলেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নামক এসব জেলখানা থেকে পালিয়ে যেতে চায় বা পালিয়ে যায় অনেক শিক্ষার্থী। বাড়িতে গিয়েও উল্টো ধমক খেতে হয় মা-বাবাসহ সবার। পড়া না পারলে, দুষ্টুমি করলে, কথা না শুনলে তো মারবেই। ফিরে যেতে বাধ্য হয় আবার সেই ভয়ার্ত আস্তানায়। যারা এতিম, তাদের তো আর পালানোর জায়গাও নেই, কষ্ট শোনার মানুষও নেই!
এমন অবস্থায় শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক শাস্তি থেকে সুরাহার জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন সুনির্দিষ্ট সরকারি নির্দেশনার যথাযথ বাস্তবায়ন। আর এই নির্দেশনা প্রণয়ন, পরিমার্জন ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে লক্ষ্য রাখতে হবে যেন; ঘরে, বাইরে, ক্লাসে, ক্যাম্পাসে, মাঠে, ছাত্রাবাসে সর্বত্রই নিরাপদ ও ভয়মুক্ত থাকে সব ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সব শিক্ষার্থী। বিশেষায়িতের দোহাই দিয়ে কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই থাকতে পারে না দেশের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আইনের বাইরে। মনে রাখতে হবে, এসব বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নকারীরাও ছাত্র। আমরা অনেকেই জানতে পারি না আমাদের শিশুদের কতো কঠিন আদর-যতœ করা হয় সেসব বিশেষায়িত আবাসিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে! মানবিক কারণেই তাদেরও আনতে হবে আইনের আওতায়। যেন নিষ্ঠুরতম শারীরিক ও মানসিক শাস্তিতে মারাত্মক আহত হয়ে (মা-বাবাকেও জানানো যায় না) পড়ে থাকার ভয়ে ঘুমে-জাগরণে তটস্থ থাকতে না হয় শিক্ষার্থীদের।
মো. রহমত উল্লাহ : অধ্যক্ষ ও লেখক।

২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। গানডুদের গল্প

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮




তীব্র দাবদাহের কারণে দুবছর আগে আকাশে ড্রোন পাঠিয়ে চীন কৃত্রিম বৃষ্টি নামিয়েছিলো। চীনের খরা কবলিত শিচুয়ান প্রদেশে এই বৃষ্টিপাত চলেছিলো টানা ৪ ঘন্টাব্যাপী। চীনে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর প্রক্রিয়া সেবারই প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×