পারিবারিকভাবে ছোটকাল থেকেই বাইসাইকেলের সাথে আমার পরিচয়। সুস্পষ্ট মনে আছে সাইকেল চালানো শেখার জন্য ১ টাকা মানত করেছিলাম। আমাকে প্রশিক্ষণে সহযোগিতা করেছিল সমবয়সী দুই ভাতিজা তবিবর ও নূরুল্লাহ। আমি তাদের কাছে ঋণী। পরবর্তীতে দাখিল পাশের পর টিউশনির ১৫০০/- টাকা দিয়ে একটি হিরো (HERO) সাইকেল কিনি। সালটা ১৯৮৯, কেশবপুর থাকতাম। সাইকেলটা দৌঁড়াত ভালো কিন্তু এর বাইরের চেহারাটা আমার পছন্দসই না হওয়াতে বিক্রেতাকে বলে দুদিন পর এটি বদলিয়ে আরো ২০০/- অতিরিক্ত দিয়ে হাতে পেলাম BSA সাইকেল (ইন্ডিয়ান এ ব্রান্ডের সঠিক পূর্ণরূপ কী তা কারো কাছ থেকে জানতে না পারলেও আমি আদর করে বলতাম Bicycle of South Asia -BSA)।
সাইকেলটি আমার কাছ থেকে অনেক আদর-যত্ন পেতে থাকল। প্রতিদিন ধুয়ে-মুছে মবিল দিয়ে তাকে লালন পালন করতে থাকি। আদর-যত্নের মানদণ্ডে মনে করতাম ব্যবহৃত অন্যান্য জিনিসপত্রের ন্যায় সাইকেলটিও আমার আদরের সন্তান। ওকে ফুল দিয়ে সাজিয়ে রাখতাম। ওর শরীরের ময়লা-ধূলা নিজ হাতে পরিষ্কার করতাম, গোসল করিয়ে দিতাম। ওর প্রাণ থাকলে আমার যত্নে সে আপ্লূত হয়ে চোখের পানি না ফেলে পারত না। এভাবেই চলতে থাকে। ৯৩ সালে যখন কেশবপুর থেকে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে আসি তখন সেটিকে বাসের ছাদে বহন করে এনেছিলাম ঝিনাইদহে। শহরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে সাইকেলে করে ছুটে বেড়িয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করে ৯৯ সালে যখন ঢাকা চলে আসি তখন অবশ্য তাকে আর সাথে আনা সম্ভব হয়নি। এক দরিদ্র ছেলেকে সেটি গিফ্ট করে এসেছিলাম।
১৭ বছর পর আমার ঘরে নাতি সাইকেল এসেছে। পুত্র রাতিব রিদওয়ান স্কুলে ভালো রেজাল্ট করার পুরস্কার স্বরূপ গত ৫ জানুয়ারি ২০১৬ তাকে একটি সাইকেল কিনে দেয়া হয়। বাস্তবে দাদা অনেক আগে হলেও (আমার বড় আরো দুই ভাই দাদা হওয়ার সুবাদে) যন্ত্রের দাদা হলাম সেদিন। দীর্ঘদিন পর ঘরে সাইকেল আসাতে ছেলের চাইতে আমিই বেশি খুশি হয়েছি। প্রথম ওর ৪ চাকা ছিল সপ্তাহ দুয়েক পর দুটি চাকা খুলে ফেলা হয়। এখন রাতিব দুই চাকাতেই চালাতে পারে। আমার চাইতে ওর কম সময় লেগেছে চালানো শিখতে। লক্ষ্য করছি সে এটাকে অনেক যত্নে রাখতে চাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর পর সে সাইকেলের কাছে গিয়ে সেটাতে বসে। সাইকেলের ওপর কিছু রাখলেই আপত্তি করে ইত্যাদি। তার সাইকেল তার কাছে পুত্রের মতো, আর আমার কাছে সেটি নাতি। এখন প্রতিদিন নাতি সাইকেলের পরিচর্যায় আমি সময় ব্যয় করি। অফিস শেষে রাতে ঘরে ফিরলে ছেলের পড়া শেষ হলেই সাইকেল নিয়ে দুজনে বের হই। ও চালায় আর আমি সাথে সাথে দৌঁড়াই। আর চালানো শেষে ঘরে ফিরে আমার ডিউটী, ব্রাশ দিয়ে চাকা ও বডি ক্লীন করি, ধূলাবলি জেড়ে বিয়ারিং-এ মবিল দিই আরো কত কি!
দাদা/নানা হওয়ার অভিজ্ঞতা একেবারে মন্দ না। অন্তত মানব সন্তানের আসল দাদা হওয়ার আগে যন্ত্রপিতামহ হওয়ার আনন্দ আমাকে বেশ মজা দিচ্ছে।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ সকাল ১০:৪৫